তোমায় পাবো বলে পর্ব-০৩

0
1295

#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

“স্যরি মা। টয়াকে নিয়ে আমার একটু বের হতে হবে!”

আন্টি আর কথা বাড়ালেন না৷ বিষয়টাকে সহজ, স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিলেন। মনে হলো যেনো পরশ ভাইয়ার এইরূপ অস্বাভাবিক আচরনের সাথে আন্টি পূর্ব থেকেই পরিচিত! হাসিমুখে আন্টি অনুষ্ঠানে মনোনিবেশ করলেন। বর পক্ষের সাথে জরুরী কথা-বার্তায় লিপ্ত হয়ে পড়লেন। বাড়ি ভর্তি সমস্ত অতিথিদের আকর্ষণ এখন পিয়ালী আপু এবং উনার উডবি হাজবেন্ডের দিকে! এই মুহূর্তেই হয়তো আংটি বদল হবে৷ সবাই যেনো এই শুভ মুহূর্তটার অপেক্ষাতেই অধীর আগ্রহ নিয়ে আছেন। এর মধ্যেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটি মাথা নিচু করে আমাদের সম্মুখ থেকে প্রস্থান নিলেন। দ্রুত গতিতে হেঁটে যুবকটি পিয়ালী আপুর উডবি হাজবেন্ডের পাশ ঘেঁষে বসলেন। বুঝতে আর দেরি হলো না, যুবকটি পিয়ালী আপুর দেবর জাতীয় কিছু হবেন! যুবকটির আড়চোখে তাকানোর ভাবভঙ্গিমা দেখে আমার গাঁ জ্বালা করছে। পুরুষ মানুষের এই বেহায়া রূপটা আমার মোটে ও পছন্দ না!

যুবকটির থেকে দৃষ্টি ঘুড়িয়ে আমি উৎসুক দৃষ্টিতে পরশ ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। অতঃপর পরশ ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“কোথায় যাবো আমরা?”

প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে পরশ ভাই আমায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“এখানেই বলব?”

“কেনো? কোনো সমস্যা?”

“রুমে ডেকেছি শুনো নি?”

“শুনেছি৷ তবে প্রোগ্রাম ছেড়ে এখনই যেতে হবে?”

“তোমার ভাব-ভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে এনগেজমেন্ট পিয়ালীর না তোমার হচ্ছে! বেশ ইন্টারেস্টেড দেখছি, তুমি এই এনগেজমেন্ট নিয়ে। সো টেল মি? এর পেছনে কি বিশেষ রিজন আছে?”

“আশ্চর্য! পিয়ালী আপুর এনগেজমেন্টে আমার কেনো ইন্টারেস্ট থাকবে? আর ইন্টারেস্ট যদি থাকে ও এর পিছনে রিজন কি থাকতে পারে? বাড়িতে কোনো প্রোগ্রাম থ্রো করলে স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির সব সদস্যরা সেই প্রোগ্রামে এটেন্ড থাকবেই। এর পেছনে বিশেষ রিজন কি থাকতে পারে?”

“এই যে, আশে পাশে সুদর্শন ছেলেরা। ঘুড়ঘুড় করছে তো! একজন তো প্রথম দেখাতেই ফ্রেন্ডশিপ করে নিলো! এই রিজনটাই বেশি চোখে পড়ছে আমার!”

পরশ ভাইয়ার আপত্তিকর কথার বিপরীতে আমার রাগ হওয়াটা নিতান্তই স্বাভাবিক ছিলো। স্বাভাবিক ভাবেই আমি রাগান্বিত দৃষ্টিতে পরশ ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। পরশ ভাইয়া ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে তিরিক্ষিপূর্ণ কন্ঠে বললেন,,

“ফর দ্যা গড সেইক, আমার সাথে রাগ দেখাতে এসো না। দয়া করে আমার রুমে এসো। তোমার জন্য একটা গুড নিউজ ওয়েট করছে।”

উদ্বেলিত কন্ঠে আমি উনাকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“হিমেশের খোঁজ পেয়েছেন?”

পরশ ভাই নিরুত্তর, নিস্তব্ধ থেকে পিছু ঘুড়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। অপার সম্ভাবনা নিয়ে আমি ও পরশ ভাইয়াকে অনুসরন করলাম। পিছু পিছু উনার রুমে প্রবেশ করতেই উনি গাঁয়ে একটা হোয়াইট শার্ট জড়িয়ে ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার দিকে ঘুড়ে তাকিয়ে বললেন,,

“চট্টগ্রাম যেতে হবে আমাদের। এক্ষনি, এই মুহূর্তে!”

উদগ্রীব হয়ে আমি পরশ ভাইয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম,,

“বলুন না? চট্টগ্রাম কি হিমেশের সন্ধান পাওয়া গেছে?”

শার্টের বাটন গুলো এক এক করে লাগিয়ে পরশ ভাই আমার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“হয়তো পেয়েছি। বাকিটা চট্টগ্রাম গেলে বুঝা যাবে!”

ক্ষনিকের মধ্যে পরশ ভাই আমার হাত ধরে রুম থেকে প্রস্থান নিয়ে ড্রইং রুম ভর্তি গেস্টদের উপেক্ষা করে বাড়ির বাইরে চলে এলেন। পার্ক করে রাখা গাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে পরশ ভাই হঠাৎ থেমে গেলেন। কিছু একটা ভেবে পরশ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,

“ট্রেন জার্নি করতে পারবে?”

“গাড়ি থাকতে ট্রেন কেনো?”

“কারণ, গাড়িতে পেট্রোল নেই। তাছাড়া কাল পায়েলের কলেজ আছে, পিয়ালীর ও ভার্সিটি আছে। আমরা এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম রওনা দিলে ফিরতে ফিরতে আই থিংক কাল দুপুর তো হবেই। হিমেশকে খুঁজতে অনেকটা টাইম লেগে যাবে। গাড়ির পার্কিং নিয়ে ও অনেক প্যারা আছে। তাছাড়া গাড়ির সেইফটির ও একটা ব্যাপার আছে।”

“ওকে। আপনার যা ঠিক মনে হবে!”

বাড়ির মেইন গেইট ক্রস করে পরশ ভাই আমায় নিয়ে মেইন রাস্তায় দাঁড়ালেন। রিকশা খুঁজতে উনি ব্যস্ত। প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে আমি পরশ ভাইকে বললাম,,

“আন্টিকে কিছু না বলেই চলে এলেন যে?”

“দেখছিলে না? মা ব্যস্ত? তাই ডিস্টার্ব করতে চাই নি। কিছুক্ষন পর কল করে জানিয়ে দিবো।”

এর মধ্যেই একটা খালি রিকশা এসে আমাদের সামনে থামল। রিকশা ওয়ালাকে ইশারা করার পূর্বেই রিকশা ওয়ালা আমাদের ইশারা বুঝে নিলেন? রিকশা ওয়ালাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পরশ ভাই ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললেন,,

“কমলাপুর রেলস্টেশান যাবেন?”

রিকশা ওয়ালা দাঁতের পাঁটি বের করে বললেন,,

“যামু না মানে? যাওয়ার লেইগ্গাই তো রিকশাটা থামাইলাম।”

পরশ ভাই আর বিলম্ব করলেন না। রিকশায় উঠে বসলেন। সংকোচ বোধ নিয়ে আমি পরশ ভাইয়ার পাশ ঘেঁষে বসতেই পরশ ভাইয়া হঠাৎ রিকশা থেকে নেমে পড়লেন। অতি আশ্চর্যিত চোখে আমি পরশ ভাইয়ার দিকে তাকাতেই পরশ ভাইয়া উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,,

“নো নো নো। এই এক রিকশায় দুজন একসাথে যাওয়া যাবে না। আমি পরের রিকশায় আসছি।”

ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ সংকুচিত করে আমি পরশ ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“মানে কি? এই রিকশায় আমি একা যাবো নাকি?”

“ভয়ের কিছু নেই। আমি পরের রিকশায় আসছি!”

উদ্বিগ্ন কন্ঠে আমি মাথা নিচু করে বললাম,,

“এই অপরিচিত শহরে, রাতের আঁধারে আপনি আমাকে একা ছেড়ে দিবেন?”

পরশ ভাই অধৈর্য্য কন্ঠে বললেন,,

“একা কোথায়? আমি তো পেছনের রিকশাটায় আছিই!”

“তবু ও। আমার ভয় করছে!”

কিছু সময় মৌন থেকে পরশ ভাই তিরিক্ষি পূর্ণ কন্ঠে বললেন,,

“ওকে ফাইন। ভুলবশত যদি কোনো ভাবে তোমার শরীরের কোনো অঙ্গে আমার টাচ লেগে যায় তখন কিন্তু আমাকে দোষারোপ করতে পারবে না ওয়ার্ন করলাম!”

আমি মাথা উঁচিয়ে আধো কন্ঠে বললাম,,

“ঠিক আছে!”

পরশ ভাই পুনরায় আমার পাশ ঘেঁষে বসলেন। দুজন দুজনের গাঁয়ের সাথে লেগে আছি। আমার বাঁ হাতের বাহু পরশ ভাইয়ার বাঁ হাতের বাহুতে বিনা বাঁধায় ছুঁয়ে আছে। যদি ও পরশ ভাই খুব উশখুশ করছেন। ডান সাইডে যতোটা সম্ভব চিপকে বসে আছেন। আমার গাঁয়ের সাথে ঘেঁষবেন না বলে হয়তো পণ করে রেখেছেন! কেমন উজবুক ভঙ্গিতে একটুখানি জায়গা দখল করে বসে আছেন উনি। মুখের আদলে বিরক্তির ছাপ স্পষ্টত উনার। যেকোনো মুহূর্তে অগ্নিশর্মা হয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়ার ও সম্ভাবনা আছে! আচমকাই খেয়াল করলাম রিকশার হুট উঠানো। তাই হয়তো আমাদের বসতে একটুখানি সমস্যা হচ্ছে। হুট টা নামিয়ে দিলে বসতে অনেকটাই সুবিধে হবে। জায়গাটা একটুখানি প্রশ্বস্ত হবে। পাশ ফিরে আমি পরশ ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার পূর্বেই পরশ ভাইয়া আমার মুখের কথা টেনে নিয়ে বললেন,,

“আই থিংক, রিকশার হুড টা খুলে দিলে ভালো হবে।”

“আশ্চর্য! আপনি বুঝলেন কিভাবে? আমি ও ঠিক সেইম কথাটাই বলতে চাইছিলাম?”

“মাঝে মাঝে মনের ভাব মিলতেই পারে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে?”

পরশ ভাই রিকশার হুড টা খুলে দিলেন। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে উনি নিশ্চিন্তে নড়েচড়ে বসলেন। মুখের বিরক্তির ভাবটা এখন লুপ্তপ্রায়। দেখে ভীষন চনমনে লাগছে। রাস্তায় দৃষ্টি ঘুড়িয়ে নিলাম আমি। কমলাপুর রেল স্টেশান পৌঁছার অপেক্ষায় আছি! ওখান থেকেই আমাদের চট্টগ্রাম যাএা শুরু হবে। হিমেশের মুখোমুখি হওয়ার দীর্ঘ একটা পথ ওখান থেকেই শুরু হবে! অজানা সব প্রশ্নের উত্তর পাবো আমি আজ। যার জন্য দীর্ঘ ১ টা মাস ওয়েট করছিলাম।

_______________________________________

ঘড়িতে রাত ১০ টা বেজে ৩০ মিনিট। চট্টগ্রাম শহরের চকবাজার এলাকায় স্থানীয় একটা আবাসিক হোটেলের রিসেপশানে দাঁড়িয়ে আছি আমি এবং পরশ ভাই। পরশ ভাইয়ার এইমাএ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী হিমেশ এই আবাসিক হোটেলেই কোনো একটা রুমে নিজের বাসস্থান গেড়ে নিয়েছেন। বিগত এক মাস যাবত উনি এই হোটেলেই গাঁ ঢাকা দিয়ে আছেন। রিসিপশনিস্টকে অনেক কনভেন্স করে পরশ ভাই অবশেষে সফল হয়েছিলেন হিমেশের রুম নাম্বার কালেক্ট করতে। দু তলার ২০৫ নম্বর রুমটার দিকে আমি এবং পরশ ভাই দ্রুত পায়ে হেঁটে অগ্রসর হচ্ছি। কাঙ্ক্ষিত রুমটা খুঁজে পেতেই পরশ ভাই স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে রুমের দরজাটার সামনে দাঁড়ালেন। অতঃপর আমার দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“কোনো কথা বলবে না তুমি। জাস্ট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে আমি কি করছি৷ ওকে?”

আমি হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানিয়ে পরশ ভাইয়ার ঠিক পিছনের দিকটায় দাঁড়ালাম। আশেপাশে গুটি কয়েক লোকজন রুম থেকে বের হচ্ছেন তো কয়েকজন ব্যস্ত ভঙ্গিতে রুমে প্রবেশ করছেন৷ কোলাহল চোখে পড়ার মতো না। গলা খাঁকারি দিয়ে পরশ ভাই রুমের দরজায় টোকা মারতেই ভেতর থেকে পুরুষারী কন্ঠে হয়তো হিমেশ বলে উঠলেন,,

“কে?”

পরশ ভাই জোরপূর্বক হাসি টেনে বললেন,,

“আমি পরশ। দরজাটা খোল হিমেশ!”

সঙ্গে সঙ্গেই রুমের দরজাটা খুলে হিমেশ হাসোজ্জল মুখে পরশ ভাইয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। অশ্রুসিক্ত চোখে আমি পরশ ভাইয়ার পিছন থেকে হিমেশের দিকে উঁকি দিতেই হিমেশ চোখে, মুখে আতঙ্ক নিয়ে রুমের দরজাটা বন্ধ করে দেওয়ার পূর্বেই পরশ ভাইয়া দরজা ঠেলে হিমেশকে নিয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ পড়লেন। আমি ও তাড়াহুড়ো করে রুমে প্রবেশ করে প্রথমে রুমের দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিলাম। হিমেশের শার্টের কলার ধরে পরশ ভাইয়া জোরে এক ধাক্কা মেরে হিমেশকে বিছানার উপর ছুড়ে মারলেন৷ হিমেশ চোয়াল শক্ত করে বিছানা ছেড়ে উঠে পরশ ভাইয়ার শার্টের কলার চেঁপে ধরে বললেন,,

“কাজটা তুই ঠিক করিস নি পরশ। বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আজ এই মুহূর্তে আমাদের নষ্ট হয়ে গেলো!”

পরশ ভাই নাক, মুখ শক্ত করে কঠোর ভঙ্গিতে হিমশকে বললেন,,

“বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আমাদের ঐদিনই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো হিমেশ। যেদিন তুই বিয়ে ভেঙ্গে টয়ার সাথে সাথে তার গোটা পরিবারের সাথে অন্যায় করেছিলি। টয়াকে কষ্ট দিয়েছিলি। আমি তোকে বলেছিলাম অতীতের সব ভুলে যেতে। ভালোবেসে টয়াকে আপন করে নিতে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তুই তাই করলি, যা তুই আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলি!”

“খুব কষ্ট হচ্ছে টয়ার জন্য না? খুব কষ্ট হচ্ছে? অথচ আমার কষ্টটা তোর চোখে পড়ল না? কি অন্যায় করেছিলাম আমি? যার জন্য টয়ার বড় বোন আমার সাথে চিট করেছিলো? কোথায় ছিলো ঐদিন তোর নীতিকথা? হাজার চেষ্টা করে ও কি ফেরাতে পেরেছিলি ফারিনকে?”

#চলবে….?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে