তোমার ছায়া পর্ব-১২

0
1310

#তোমার ছায়া (পর্ব ১২)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

ফারহা সকালে ঘুম থেকে উঠে রুমের কোথাও খুজে পেলো না আবরারকে। রুমের বাইরে এসে খুজে দেখেও পাচ্ছে না। ওই বাড়ির দুই একজন কে জিজ্ঞেস করলেও, কেউ কথা বলছেনা ফারহার সাথে।
পুনরায় রুমে ফিরে আসলে ঐ বাড়ির একটা ছোট মেয়ে চা আর বিস্কিট রেখে গেলো। মেয়েটাকে পেছন থেকে ডেকে আবরারের কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলে, দেখেনি।

ফ্লোরে বসে দুই হাতে নিজের চুল খা’মচে ধরে কেঁদে উঠে ফারহা।
‘এই অচেনা একটা শহরে আবরার আমায় একা ফেলে চলে গেছে। কোথায় চলে গেলেন আবরার? প্লিজ আমার এখান থেকে নিয়ে যান।

কাঁদতে কাঁদতে বার বার আবরারের নাম জ্বপছে ফারহা। তখনই পেছন থেকে পুরুষ কন্ঠ ভেষে আসলো।
– কাঁদছো কেন?
আবরারের গলার স্বর শুনে পেছন ফিরে উঠে দাড়ায় ফারহা। কাঁদু গলায় বললো,
– কোথায় চলে গিয়েছিলেন আপনি আমাকে রেখে?
আবরার তার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
– আর ইউ ম্যাড? আমি তোমাকে ফেলে চলে গিয়েছি তাও আবার অচেনা একটা জায়গায়?
– আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কোথায় ছিলেন এতোক্ষন?
আবরার তার পাশে বিছানায় বসে বললো,
– রাতে তো কিছুই খেয়াল করিনি। তাই রাস্তা খুজতে গিয়েছিলাম। চলো বের হবে।
ফারহা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
– এখন? মানে এতো সকালে?
আবরার একটু রেগে বললো,
– এখানে বেড়াতে আসিনি আমরা। যে আস্তে ধিরে সবাইকে বলে এখান থেকে বিদায় নিবো। আর এখন এই শহরটা কেই আমার সবচেয়ে বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। কতোটা নিচু এদের মন মানসিকতা।
ফারহা বলার মতো কিছু খুজে না পেয়ে চুপচাপ নিচের দিকে চেয়ে আছে। আবরার উঠে দাড়িয়ে বললো,
– চলো, এখানে আর থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। নিজেদের পথ নিজেরাই খুজে নিতে হবে।

ফারহা কিছু না বলে চুপচাপ বের হয়ে গেলো আবরারের সাথে। ভুল ঠিক কিছুই যেন বুঝতে পারছে না তারা।

সকালের সূর্য উঠতেই, ঐ বাড়িতে আশে পাশের বাড়ির মহিলাদের আগমন ধটলো। কেউ খুব আগ্রহ নিয়ে বলতে লাগলো,
– গত কাল যে ধরা খেয়ে বিয়ে করেছে ঐ ছেলে মেয়ে দুটু রাতে নাকি এখানে ছিলো? কই তারা? এই শিউলি ওদেরকে গিয়ে বলবি যে, আপনাদের কে অনেক মানুষ অভি’নন্দন জানাতে এসেছে। বাইরে আসতে।
মুহুর্তেই উপস্থিত সবাই হেসে উঠলো।

বাড়ির শিউলি নামের ঐ মেয়েটা রুমে এসে তাদের না দেখে দৌড়ে গিয়ে বললো,
– ওরা চলে গেলো, চা ও খায় নি। টেবিলে পরে আছে।
কেউ বলে উঠলো,
– কি অসভ্য রে তারা, যারা মায়া করে আশ্রয় দিয়েছে তাদের থেকেও বিদায় নিয়ে যায় নি। আর বলেই কি লাভ, ভদ্র ঘরের ছেলে মেয়ে হলে কি আর এভাবে ধরা খেয়ে বিয়ে করে?

এর পর একে একে বাড়ির উঠান খালি হয়ে গেলো। দেখে যেন মনে হচ্ছিলো, আজব কোনো প্রা’নি কে দেখার জন্য লোকজন ভিড় জমিয়েছিলো।
(বিঃদ্রঃ আমি চিটাগং এর ভাষা জানিনা। তাই কথা গুলো নরমাল ভাষায় বললাম)

সকাল সকাল সোনালি আলোয় দুজন পা ফেলে হাটছে রাস্তার পাশ ধরে। দুজনের পকেট’ই খালি। আর কিছুটা দুরে গেলে হয়তো বাজারের দেখা মিলবে। যদিও এখনো সামনে কিছু চখে পরছে না।
পাশ থেকে ফারহা আড় চোখে আবরারের দিকে চেয়ে দেখে মুখে দুই তিন টা জায়গায় কালো হয়ে আছে। আর গালের এক পাশে ছোট্ট একটা কা’টার চিহ্ন। গত কাল রাতে লোকজনের মা’রের কারণে এমনটা হয়েছে।
ফারহা’র খারাপ লাগলেও কিছু না বলে নিজের মতো করে হাটতে থাকলো। কারণ এই মুহুর্তে আবরারকে এসব বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা মানে কা’টা গায়ে নু’নের ছি’টা দেওয়া।

বেশ কিছুক্ষন হাটার পর সামনে একটা বাজার চোখে পরলো তাদের। দোকান খোলায় সাটারের শব্দ কানে আসছে। কেউ কেউ এখন এসে দোকান খুলছে মাত্র। আর বাকি গুলো এখনো বন্ধ।
বাজারে ঢুকে একটা দোকানের সামনে এসে দাড়ালো দুজন। ফারহা’দিকে চেয়ে আবরার বললো,
– কিছু খাবে?
ফারহা চুপচাপ দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বুঝালো। যদিও আবরার বুঝতে পারছে ফারহা’র ঠিকই ক্ষুদা লেগেছে। কারন গত কাল রাতেও কিছু খায়নি। হয়তো এখন টাকা নেই দেখে কিছু বলছে না।
আবরার একটু সামনে গিয়ে একটা মুদি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো,
– ভাই, সামনে এই বিকাশ দোকান টা কখন খুলবে বলতে পারেন?
লোকটা বললো,
– লাগবে হয়তো কিছু সময়। সে একটু দেড়ি করে আসে।
– আচ্ছা ধন্যবাদ।

প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করার পর ওই দোকান টা খুললো। আবরার ফারহাকে নিয়ে ওই দোকানের সামনে এগিয়ে গেলো।
– ভাই একটা কল করা যাবে? খুব জরুরি।
লোকটা একটু উপর নিচ চেয়ে বললো,
– প্রতি মিনিট পাঁচ টাকা।
– আচ্ছা দশ টাকা করে দিবো, দেন।

বাসায় ফোন করে কোনো বিপদের কথা বলে ঝামেলা বাড়াতে চায় না আবরার। তাই ফারহাকে বললো,
– ফারদিনের নাম্বার টা জানো?
ফারহা মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যা’ সূচক জবাব দিয়ে বললো,
– প্লিজ বাসায় কিছু বলবেন না। আমাকে বাড়িতেই ঢুকতে দেবে না তাহলে।
আবরার একটু বিরক্তি নিয়ে বললো,
– ঝামেলা বাড়ানোর ইচ্ছা আমারও নেই। অন্য দরকারে নাম্বার চেয়েছি।

এর পর নাম্বার টা নিয়ে কয়েকবার কল দিলে অবশেষে রিসিভ করলো ফারদিন। ওপাশ থেকে বিরক্তিকর গলা ভেসে উঠলো,
– আরে ভাই, দেখছেন যে ফোন রিসিভ করছি না। তাও কেন বার বার ফোন দিয়ে বিরক্ত করছেন। দুই বারের উপরে কেউ ফোন রিসিভ না করলে জানেন না যে, সে হতো বিজি আছে, নয়তো ফোন তার কাছে নেই।
আবরার বললো,
– আরে শুন, আমি আবরার। বিপদে পরেছি খুব।
ফারদিন হুট করে শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে বললো,
– আবরার, কি বিপদ? কিছু হয়েছে তোর?
– ভাই এখানে একা একটু বের হয়েছিলাম, তখনই ছিন’তাই কারির কবলে পরে সব হারালাম। দুটু হাত আর পা ছারা এখন কিছুই নেই। দ্রুত এই নাম্বারে কিছু টাকা পাঠা তো। আমি ঢাকায় এসেই ব্যাক করে দিবো।
– হায় হায় বলিস কি? তোর কোনো ক্ষতি হয় নি তো? ফারহা আয়রিন এরা ঠিক আছে তো? গত কাল রাত থেকে ফারহা আর তোর ফোন বন্ধ।
– ফারহারও ফোন টাকা সব নিয়ে গেছে। এখন আমার পাশেই আছে সে।
– কিভাবে হলো এসব? আর বাকিরা কোথায় ছিলো?
– ভাই তোকে পরে সব বলবো।
– আচ্ছা ঠিক আছে। আমি এক্ষুনি পাঠাচ্ছি টাকা। তোরা সেভ আছিস তো?
– হুম,,,

আবরার এর পর আয়রিন কে ফোন দিয়ে এখন কোথায় আছে জেনে নিলো। আয়রিন অনেক উত্তেজিত হলেও আবরার ঠান্ডা মাথায় বললো,
– স্যারকে গিয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে বলবি। আর বলবি যে ভাইয়া একটা ছোট্ট ঝামেলায় পরেছে।

কিছুক্ষন বসে থাকার পর আবরার দোকানদারটাকে বললো,
– ভাই টাকা এসেছে?
– হ্যা, এই নিন।
– ধন্যবাদ।
বলেই ফারহাকে নিয়ে হাটা ধরলো আবরার। দেখে ভালো কোনো রেস্টুরেন্টও নেই। যেই কয়টা আছে, সেগুলো এখনো বন্ধ৷ রাস্তার পাশে কিছু চায়ের দোকান চোখে পরলো। ফারহাকে সাথে নিয়ে ওখানে গিয়ে বললো,
– ভাই কি পাওয়া যাবে এখানে?
লোকটা বললো,
– পরোটা, ডিম, আর চা।
– আর ভালো কিছু নেই?
– না ভাই। এখনো এগুলো ছারা কিছু তৈরি হয় নি এখনো।
– আচ্ছা তাহলে এগুলোই দিন। একটু তারাতারি করুন। আমাদের তাড়া আছে।

সব শেষে একটা সি’এন’জি নিয়ে বাকিদের কাছে পৌছাতে প্রায় ঘন্টা খানেক লেগে গেলো। তখন প্রায় ৯ টা।
ভোর ছয়টায় সকলের রওনা দেওয়ার কথা ছিলো। সবার কাছে যেতেই সবাই তাদের ঘিরে ধরলো। মুখে আঘাতের দাগ গুলো দেখে বাকি স্যার রা ব্যাস্ত হয়ে বিষয়টা জানতে।আবরার ছিনতাই কারির বিষয়টা বুঝিয়ে বললে সবাই অবাক হয়ে মুখে হাত দেয়। প্রন্সিপাল স্যার বললো,
– সকালে তোমাদের ফোন না পেলে তো এতোক্ষনে পুলিশে ইনফর্ম করতাম। যাই হোক তোমরা ভালো আছো, এটাই অনেক।

বিষয়টা নিয়ে এই মুহুর্তে আর কথা বারালো না কেউ।
রওয়া দিতে দেড়ি করায়, কক্সবাজার পৌছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। সবাই রেডি হয়ে চলে গেলো সমুদ্রের তীরে। এক পাশে চুপচাপ বসে আছে ফারহা। আয়রিন এসে বললো,
– এখনো মন খারাপ করে আছিস? দেখ যা গেলো মালের উপর দিয়ে গেছে। জা’নের উপর দিয়ে যায় নি এর জন্য ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বল।আর এখন এসব চিন্তা বাদ দে। চল বাকিদের সাথে ইনজয় করি।
– ভালো লাগছে না, তুই যা আমি একটু পর আসবো।
যদিও ফারহার ইচ্ছে শক্তি সব ফুরিয়ে গেছে। তবুও আয়রিনকে পাঠাতে কথাটা বললো সে। এর পর আবারও বিষণ্ন মনে বসে আছে চুপচাপ। ভাবতে লাগলো, সব কি করে সামলাবে সে? আর হুট করে হয়ে যাওয়া এই সম্পর্ক টার শেষ টা কোথায় গিয়ে দাড়াবে?

একটু পর দুইটা ডাব হাতে ফারহার পাশে এসে দাড়ালো আবরার। ফারহার প্রতি তার একটু রাগ আছে এটাই স্বাভাবিক। তবুও মেয়েটাও ডিপ্রেশনে আছে প্রচুর। নিজেদের মাঝে আগে বিষয় টা সমাধান না হলে, ঝামেলা টা আরো বড় হয়ে যাবে।
হুট করে ফারহা কেঁদে দিয়ে বললো,
– কেন হলো এমন টা? আমি তো এভাবে কিছু চাইনি। আমার ফ্যামিলি আমায় নিয়ে কতটা গর্বিত ছিলো। কতো বিশ্বাস করতো আমাকে আর শেষে আমি কিনা,,,,
পাশ থেকে আবরার বললো,
– এটা মাত্রই একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। আর প্রত্যেক সমস্যারই একটা সমাধান আছে। আর আমাদের দুজনেরই কোনো ঝামেলা হোক, অথবা আমাদের ফ্যামিলির কোনো দুর্ণাম হোক। আর বিশেষ করে ফারদিনের সাথে আমার সম্পর্ক টা নষ্ট হোক তা আমি চাইনা। বিষয় টা আমাদের মাঝেই সমাধান করাটা ঠিক হবে।
ফারহা আবরারের দিকে চেয়ে বললো,
– কিভাবে?
আবরার একটা দির্ঘশ্বাস ছেরে বললো,
– বিষয় টা জানাজানি না করে, আমরা নিজেরাই আলাদা হয়ে গেলে তো আর কোনো ঝামেলা তৈরি হবে না তাই না?
এই কথাটায় যেন আবরারের গলাটা খুব ভারি শোনালো। ফারহা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। বার বার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। যে, আমরা আলাদা হবো না। আমি তো আপনাকেই চাইতাম। হয়তো ভাগ্য তা অন্যভাবে করে দিয়েছে। প্রয়োজনে ফ্রেন্ডলি আমার পাশে থাকবেন। তবুও আলাদা হবেন না প্লিজ। ভালোবাসা হারানোর কষ্টের ঢেউ টা অনেক আগে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো। আমি চাইনা আবার সেই কষ্ট আমাকে এসে ছুয়ে দিয়ে যাক। আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো এবার। প্রয়োজনে ‘ছায়া’ হয়ে পাশে থাকবেন আমার। তবুও ছেরে যাবেন না প্লিজ।

কিন্তু চাইলেও কথা গুলো বলতে পারছে না ফারহা। বার বার গলার মাঝে দলা পাকিয়ে কি যেন আটকে যাচ্ছে। ফ্যামিলির কথা ভেবে হলেও আবরারের কথার ছোট্ট করে একটা জবাব দিলো,
– আচ্ছা।

To be continue…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে