তোকে চাই❤(সিজন-২)part:57+58

0
3808

তোকে চাই❤(সিজন-২)part:57+58
#writer: নৌশিন আহমেদ রোদেলা❤

?

— উঁহু! কিসের উঁহু? সরুন, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার….

— আসুক দম বন্ধ হয়ে। ছাড়বো না।

— এখন কিন্তু কান্না করবো আমি। ছাড়ুন বলছি। উফফ..মরে গেলাম। সররররুন….(চিৎকার করে)

— সরা তো যাবেই না তার চেয়ে বরং মেরেই ফেলি।

কথাটা বলেই ঠোঁট ঠোঁট ছোঁয়ালেন উনি। এতোক্ষণ যতটুকু শ্বাস নিতে পারছিলাম এখন সেটুকুতেও বাঁধ সাধলেন উনি। একেই বলে সুখে থাকতে ভূতে কিলাই। আগেই তো ভালো ছিলাম। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য হাত-পা নাড়ারও সুযোগ নেই আমার। সবই এখন উনার শরীরের নিচে পিষ্ট। উনি প্রায় দশমিনিট পর ছেঁড়ে দিয়ে মুখ দিয়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন,

— আবার যদি ছাড়ুন ছাড়ুন করো তো পরেরবার এর থেকেও ভয়াবাহ হবে। আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমোতে দাও ডিস্টার্ব করবে না।

কথাটা বলে আরো একটু জোড়ে চেপে ধরে গলায় মুখ গুঁজলেন উনি। আমি কয়েকবার জোড়ে জোড়ে শ্বাস টেনে নিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে শুঁয়ে রইলাম। উনার এভাবে জাপটে ধরায় সারা শরীর যেন কাঁপছে আমার। হৃৎস্পন্দনটাও বেড়ে গেছে হাজার গতিতে। মনে হচ্ছে এটাই সেই প্রথম স্পর্শ। প্রথম অনুভূতি!কিছুক্ষণ পরই গলায় ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম আমি। সাথে সাথেই গলা শুকিয়ে গেলো আমার। চোখ-মুখ কুঁচকে বন্ধ হয়ে এলো মুহূর্তেই। এবার চোখদুটোতে ঘুমের খুব প্রয়োজন আমার…খুব খুব প্রয়োজন। চোখে ঘুম এলেই যেনো রেহাই আমার। এই স্বর্গীয় যন্ত্রণা থেকে মিলবে মুক্তি!

?

সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয়ে গেলো লাফালাফি। আজ চিত্রার গায়ে হলুদ কথাটা ভাবতেই নাগিন ডান্স দিতে ইচ্ছে করছে আমার৷ উফফ…সেই স্কুল লাইফ থেকে স্বপ্ন দেখে আসছি চিত্রার বিয়ে হবে আর তার দেবরের সাথে আমি চুটিয়ে প্রেম করবো। জুতো চুরি করে মাধুরী আর সালমানের মতো নাচানাচি করবো। আহা! কিন্তু তা আর হলো কই? শিশির স্যারের ছোট ভাই ঠিকই আছে কিন্তু বেচারা ট্রেনটা মিস করে ফেলছে। এখন সে ট্রেন ধরতে গেলে শুভ্র তাকে ফ্লাইটের টিকেট ধরিয়ে দিবে কনফার্ম। সকাল দশটা বাজতেই চিত্রা ফোনের পর ফোন দিতে লাগলো। আমিও রেডি ফটাফট রেডি হয়ে শুভ্রর গলায় ঝুলাঝুলি করে অবশেষে তাকে নিয়ে হাজির হলাম চিত্রানিবাশ। আর সেখান থেকে গেলাম ওয়েডিং হাউজ। তিন দিনের জন্য বুক করা হয়েছে এই হাউজ। হলুদ, মেহেদী, বিয়ে আর রিসেেশনের অনুষ্ঠান হবে এখানে। কনে পক্ষ আর বর পক্ষ এই কটা দিন একসাথেই থাকবে। শুভ্র ভাইয়ার সব ফ্রেন্ডস্ এবং রাতুল ও সাকিব ভাইকেও দাওয়াত করেছে চিত্রা। সবাই এখানে উপস্থিত। আমাকে আর শুভ্রকে উপরের তলার একটা রুম দেওয়া হলো। রোহুন- সাব্বির ভাইয়াদের দেওয়া হলো আমাদের পাশের রুম। রাহি আপু আর নীলি আপুও এসেছেন। সবাই যার যার মতো রুমে চলে গেলো রেস্ট নিতে। বিকেল তিনটায় হলুদের ফাংশন শুরু হবে। হলুদের পর পরই হবে মেহেদী নাচ- গান সব।। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখি শুভ্র হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। গায়ে লাল টি-শার্ট আর পরনে ব্ল্যাক থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট। পায়ের লোমগুলো পায়ের সাথে ল্যাপ্টে আছে….চুলগুলোতেও ভেজা ভাব। মুখটা মুছে তোয়ালেটা বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়ে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভ্রু কুঁচকে খানিকক্ষণ উনাকে দেখে নিয়েই বলে উঠলাম,

— গোসল করেছেন নাকি?

উনি চোখ বন্ধ করেই বলে উঠলেন,

— হুম।

— কোথায় করলেন? ওয়াশরুমে তো আমি ছিলাম,তাহলে?

— সাব্বিরদের ওয়াশরুমে করে নিয়েছি। ছাড়ো ওসব, মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও তো। প্রচন্ড মাথা ধরেছে আমার।

আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ উনার মাথার কাছে গিয়ে বসে পড়লাম। আমি পাশে বসতেই কোলে মাথা রেখে দু’ হাতে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরলেন উনি। সাথে সাথেই চমকে উঠলাম আমি৷ তাড়াহুড়ো করে উনার কপালে হাত রেখেই কেঁপে উঠলাম,

— এতো জ্বর! আবারও এতো জ্বর কি করে?

আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না উনি। কোমরটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলেন। উনার গায়ে হাত দিতেই কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার। এখানে তো আম্মুও নেই ডাক্তার কোথায় পাবো আমি? আপাতত সব চিন্তা বাদ দিয়ে জ্বর কমানোর আয়োজন করতে উনাকে ছাড়াতে গেলেই আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলেন,

— খবরদার কোথাও যাবে না। কোত্থাও যাবে না। আচ্ছা রোদ? আমাকে একটা হেল্প করবে প্লিজ?

আমি অবাক চোখে তাকালাম। আমার কাছে কি হেল্প চায় উনার? আমি কৌতূহলী গলায় বলে উঠলাম,

— কি হেল্প?

— আমায় মেরে ফেলতে পারবে রোদ? প্লিজ?

উনার কথায় হৃদস্পন্দন যেনো থমকে গেলো আমার। কি সব বলছেন উনি? হঠাৎ এসব অদ্ভুত কথা কেন?আমি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলাম,

— এসব কি বলছেন আপনি? পাগল হয়ে গেলেন?

— পাগল হয়ে যাচ্ছি রোদ। পাগল হয়ে যাচ্ছি। মেরে ফেলো না আমায়। আচ্ছা? আমি মরে গেলে কি সাহেলকে বিয়ে করবে তুমি?

— কি বলছেন এসব? এসব বাজে কথা বন্ধ করুন প্লিজ। না আপনার কিছু হবে আর না আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো। বুঝতে পারছেন আপনি?

শুভ্র হাসলো। খুবই মৃদুভাবে হাসলো। শীতল কন্ঠে থেমে থেমে বলে উঠলো সে,

— কে তোমায় বেশি ভালোবাসে রোদ? আমি? নাকি সাহেল? সাহেল কি তোমাকে ভিক্ষা দিলো আমায়? তুমি কি সাহেলকে ভালোবাসো রোদ?

এবার ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। কিসব অদ্ভুত কথা বলছেন উনি। আমি সাহেল ভাইয়াকে ভালোবাসতে যাবো কেন? এতোদিন পর শুভ্র এই কথাটা কেন বলছে? কেন? আমার কান্নার শব্দ শুনে মাথা তুলে তাকালেন শুভ্র।কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন উনি,

— কাঁদছো কেন রোদপাখি? কার জন্য কাঁদছো? আমার জন্য? নাকি সাহেলের জন্য? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রোদ… খুব। বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার মধ্যে আটকে গেছি আমি। সাহেলের মুখ দেখলে কষ্ট হয় আবার তোমার মুখ দেখলেও কষ্ট হয়। এই বোঝাটা বয়ে বেড়ানো খুব কষ্টের রোদপাখি, খুব কষ্টের। ছোট থেকে কখনো কিছু সেক্রিফাইজ করতে হলে সেক্রিফাইজটা সবসময় আমিই করতাম সাহেলকে কখনো সুযোগই দিই নি। সাহেল সবসময় বলতো ” তোর এই জিতটা বেশিদিন থাকবে না শুভ্র। কোনো একদিন আমি এমন কিছু করবো যে তুই জাস্ট তাকিয়ে থাকবি।” সত্যিই আমি এবার তাকিয়েই আছি,, সাহেলের কাছে প্রথমবারের মতো হেরে গেছি।। কি করবো বলো? তোমাকে যে ছাড়তে পারি নি আমি। কেনো এলে বলো তো আমার জীবনে? কেনো এলে তুমি? আমি না পারছি বাঁচতে আর না পারছি মরতে। আমি মরে গেলেই সব ঝামেলা চুকে যেতো রোদপাখি। আমি জিতে যেতাম। আচ্ছা, আমার খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারবে না তুমি? আমার কোনো অভিযোগ থাকবে না রোদ শুধু অনুরোধ থাকবে তখনও আমার মাথাটা এভাবেই কোলে রেখো। ব্যস! আর কি চাই?

এবার আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। জ্বর হয়েছে বলে কি যা ইচ্ছে বলবেন নাকি উনি? মুহূর্তেই এগ্রেসিভ হয়ে উঠলাম আমি। দু’হাতে কোমর থেকে উনার হাতদুটো সরিয়ে দিলাম। মাথাটা কোল থেকে সরাতেই অবাক হয়ে তাকালেন উনি। উনি আরো অবাক হলেন যখন উনার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালাম আমি। মনের সবটা ঝাঁঝই ঢেলে দিলাম উনার ঠোঁটে। উনি প্রথমে অবাক হলেন তারপর চোখবন্ধ করে সবটা সহ্য করলেন।। ।কিছুক্ষণ পর উনাকে ছেড়ে দিয়ে উনার বুকে মাথা রেখেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। কাঁদলাম…. ইচ্ছেমতো কেঁদে নিয়ে একসময় শান্ত হয়ে গেলাম। উনি কিছু বলছেন না শুধু দেখে যাচ্ছেন আমায়। আমি হেঁচকি তুলতে তুলতেই বলে উঠলাম,

— ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি আপনাকে। কেন বুঝেন না আপনি? সেই প্রথম দিন থেকে ভালোবাসি। সেই ভালোবাসাকে কি করে অপমান করলেন আপনি? সাহেল ভাইয়াকে নিয়ে কখনো এমন কিছু ভাবিই নি। আপনাকে ছাড়া অন্যকারো দিকে কখনো চোখ তুলে তাকাই নি। না বিয়ের আগে না পরে। তবুও এই অপবাদটা কি করে দিলেন আপনি? সাহেল ভাইয়া আমাকে ভালোবাসতে পারে কিন্তু আমি তো বাসি না। সেটা উনার সমস্যা আমার নয়। আমার বিয়ের পর হুট করে একদিন জানতে পারলাম সাহেল ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু তাতে কি আমার কোন দোষ ছিলো শুভ্র? অনেকেই অনেককে ভালোবাসে তাই বলে সবাই তো সবাইকে পায় না। ডক্টর আহানও ভালোবাসতো তাই বলে কি তাকেও ভালোবাসতে হবে আমায়? কলেজে সাব্বির নামে একটা ছেলে সুইসাইড এট্যাম্প করেছিলো তাহলে কি তাকেও ভালোবাসতে হবে আমায়? ভালোবাসাটা দু’দিকেই থাকতে হয়। ওয়ান সাইডেড লাভ আর কতোদূর এগোই? ভিক্ষাটা তখন হতো যখন আমি সাহেল ভাইয়াকে ভালোবাসতাম কিন্তু তা তো নয়। ভালো তো আমি আপনাকেই বাসি। উনার কাছে কি সরে যাওয়া ছাড়া অন্যকোনো অপশন ছিলো? আমি আপনাকে পেয়ে নিজেকে সুভাগ্যবতী মনে করি। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মনে হয় যখন ভাবি আপনি আমায় ভালোবাসেন। শুধু এবং শুধুই আমায় ভালোবাসলেন। কিন্তু আজ যখন জানলাম আমার জন্য আপনার মরে যেতে ইচ্ছে করে। আমি আপনার জীবনে একটা ঝামেলা মাত্র। তখন মনে হলো আমার তো বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই। আপনি ভুল বলেছেন শুভ্র। আপনি নয় আমি মরে গেলেই সব শেষ হয়ে যাবে। খাবারে বিষের কথা বললেন না? ঠিক আছে, মরবো আমি।

কথাটা বলতেই চট করে উঠে বসলেন শুভ্র। আমাকে টেনে উঠিয়ে চড় বসালেন গালে। গাল দুটো চেপে ধরে বলে উঠলেন উনি,

— এই কথা বলার সাহস কোথায় পেলে তুমি? এতোটা সাহস বেড়ে গেছে তোমার?

আমি মুচকি হাসলাম। গাল থেকে হাতটা সরিয়ে দিয়ে উনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,

— ভয় লেগেছে? বুক কেঁপে উঠেছে? আমারও এমনটায় লেগেছিলো শুভ্র। কিন্তু আমার ভাবনা বা ভালোবাসা কোনোটায় আপনার নজরে পড়ে নি। আপনারা সবাই তো একে অন্যের জন্য সেক্রিফাইজ করতে ব্যস্ত….আমি কি চাই সেটা আপনাদের কাছে বড় বিষয় নয়। সাহেল ভাইয়া এজন্য সরে যায় নি যে আপনি আমায় ভালোবাসেন। সাহেল ভাইয়া এজন্য সরে গিয়েছে কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি। উনি আমার ভালোবাসাটা বুঝলেন অথচ আপনি বুঝলেন না? এবার আমাকে হারিয়ে বুঝবেন কতোটা ভালোবাসতাম আমি। ভালোবাসতে আপনারাই জানেন না আমিও জানি। আমার ভালোবাসাকে অপমান করার শাস্তি আপনাকে পেতে হবে। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলার জন্য শাস্তি আপনাকে পেতে হবে। খাবারে বিষ মিশবে কিন্তু খাবারটা আপনার হবে না আমার!

আমার কথায় উনি যেনো কেঁপে উঠলেন। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন,

— কোনো পাগলামো করো না প্লিজ। আমি সরি…আর কখনও এমন কথা বলবো না। তুমিও বলো না…

— বলবো না করবো। ছাড়ুন আমায়। আপনার জ্বরটা ভালো হওয়ার পরেই করবো। এখনই চলে গেলে আপনার সেবা করবে কে? আপনি যা কেয়ারলেস। তাই আগে জ্বর ভালো হবে তারপর বিষ থেরাপি শুরু হবে। এবার ছাড়ুন, সেবা করতে দিন আমায়।

— চুপ! একদম চুপ! আবার এসব বললে মাইর দিবো বলে দিলাম। ভালোবাসি পিচ্চি। আমার পিচ্চিটাও যে আমায় এতো ভালোবাসে বুঝি নি আমি। সরি তো।

— ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি আমি। এখন সরি টরি তে চলবে না। ছাড়ুন আমায়….আমি কোনো হার্টলেস মানুষের বুকে থাকবো না।

— আচ্ছা ছেড়ে দিবো তার আগে গালটা দেখি। ইশশ খুব জোড়ে লেগেছে না? আমার গালেও দুটো চড় বসিয়ে দাও তো। নয়তো হাতটাই কেটে দাও। এই হাতটার এতো সাহস আবরার শুভ্রর বউকে মারে!

কথাটা বলেই বাম গাল টা অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলেন উনি। আমি গম্ভীর মুখে বসে আছি। বুঝতে পারছি জ্বর অনেকটায় কমে গিয়েছে উনার। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো বিষ কোথায় পাবো আমি? অনলাইনে অর্ডার করা যায় নাকি?

#চলবে….

#তোকে চাই❤
……. (সিজন-২)
#writer: নৌশিন আহমেদ রোদেলা❤
#part: 58

?

দুপুর দুটো। মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে রুমের দিকে ফিরছিলাম। ঠিক তখনই দেখি আন্টি আই মিন চিত্রার মা মেজাজের ফালুদা বানিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন। মেয়ের বিয়ে নিয়ে যার এতো লাফালাফি সে কিনা মুখ ফুলিয়ে এভাবে চুপচাপ বসে আছে? আশ্চর্য! আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আন্টির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলাম,

— কিছু হয়েছে আন্টি? আপনার শরীর খারাপ নয় তো?

আমাকে পেয়ে আন্টি যেন আস্ত একটা চাঁদ হাতে পেয়ে গেলেন। রাগে ফুসফুস করতে করতে বলে উঠলেন,

— রোদ! এই তুমিই একমাত্র সমস্যাটা বুঝবে। নয়তো এখানে আর সবাই তো এক একটা বলদ। এতো টাকা দিয়ে ওয়েডিং হাউজ ভাড়া করেছে অথচ রান্না ঘরে পিঁপড়ার ঝাঁক? কি সাংঘাতিক ব্যাপার বুঝতে পারছো? আমি কি এখন মেহমানদের পিঁপড়ার হালুয়া বানিয়ে খাওয়াবো?

আন্টির কথা শুনে বুঝলাম, উনি পিঁপড়া বিড়ম্বনায় ক্লিষ্ট। উনার এই বিড়ম্বনার সমাধান না করলে যে উনি এই বিয়ে বাড়িকেই পিষ্ট করে দিবেন তাও বুঝতে পারছি আমি। এই ক্লিষ্ট- পিষ্ট এর বেড়াজাল থেকে বের হতে হলে কিছু তো একটা করতেই হবে। কনে পক্ষ বলে কথা…মেহমানকে তো আর পিঁপড়ার হালুয়া খাওয়ানো যেতে পারে না। কথাগুলো ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আন্টিকে এই বলে আশ্বস্ত করলাম যে ” বিষয়টা আমি দেখছি। ” আন্টিকে শান্ত করে স্টাফ রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো একজন ওয়েটার। উনার দিকে এগিয়ে গিয়েই বলে উঠলাম,

— এক্সকিউজ মি?

— ইয়েস ম্যাম? কিছু লাগবে?

— আপনাদের মতো ওয়েলনোন একটা ওয়েডিং হাউজের সার্ভিস এতো খারাপ , ভাবতেই অবাক হচ্ছি আমি।

— সরি ম্যাম?এনি প্রবলেম?

— অবশ্যই প্রবলেম। রান্নাঘরে পিঁপড়া পাওয়া গিয়েছে। ১০ মিনিটের মধ্যে এই পিঁপড়া দূর করার ব্যবস্থা করুন প্লিজ।

— উই আর এক্সট্রেমলি সরি ম্যাম। এক্চুয়েলি আমাদের ম্যানেজমেন্টে একটু সমস্যা হয়েছে তাই এমনটা হচ্ছে। আমাদেরকে দু’ ঘন্টা সময় দিতে হবে ম্যাম!

দু’ঘন্টা!! এই ছেলে বলে কি? এই দু’ ঘন্টায় তো চিত্রার মা দুশোবারেরও বেশি হার্ট অ্যাটাক করবে। শুধু নিজে আট্যাক করে ক্ষান্ত হবেন না। নিজের সাথে সাথে আমাদের সবাইকে নিয়ে হার্ট অ্যাটাক করবেন। আচ্ছা? এই হার্ট অ্যাটাকের নাম কি দেওয়া যেতে পারে? গ্রুপ হার্ট অ্যাটাক? কথাটা ভেবে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। সামনে দাঁড়ানো ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম,

— আপাতত পিঁপড়া তাড়ানোর জন্য আপনাদের কাছে কোন বিষ হবে? পিঁপড়া মারা বিষ? বাজারে তো এমন অনেক ধরনের বিষ পাওয়া যায়। আপনি কি ম্যানেজ করে দিতে পারবেন?

এটুকু বলতেই কোথা থেকে ছুটে এলেন শুভ্র। আমার হাত টেনে ধরেই হাঁটা দিলেন উনি। আমি অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলাম,

— আরে, আরে, টানছেন কেন? আমি একটা ইম্পোর্টেন্ট ডিসকাশন করছিলাম।

— চুপ! একদম চুপ। এসব স্টাফদের সাথে তোমার কিসের ডিসকাশন?ওদের সাথে কথা বলা বন্ধ। এখানে কি কথার বলার জন্য কম মানুষ আছে? ওদের সাথে কথা বলো….তা না স্টাফদের সাথে বিষ নিয়ে ডিসকাশনে নেমে গেছো। বাচ্চা মানুষ এতো বিষ টিষ নিয়ে ডিসকাশন কেন করবা? ডিসকাশন যদি করতেই হয় তাহলে ফুল, পাতা, চকলেট, আইসক্রিম এসব নিয়ে ডিসকাশন করবা।

উনার কথায় ভ্রু কুঁচকে এলো আমার। কি আশ্চর্য! আমি স্টাফদের সাথে ফুল, পাতা নিয়ে ডিসকাশন করতে যাবো কেন?

— আজব তো? আমি ওদের সাথে ফুল, পাতা নিয়ে গল্প করতে যাবো কেন? ছাড়ুন তো। ছাড়ুন!

— আচ্ছা ছাড়বো। আগে বলো স্টাফদের সাথে কোনোরকম কথা বলবে না।

— আচ্ছা বলবো না। ছাড়ুন!

— আর তোমা..

এটুকু বলতেই শিশির স্যার এসে হাজির। ড্রেস আপ নিয়ে কি একটা হেল্প লাগবে বলে শুভ্রকে ফোর্স করতে লাগলেন উনি। শুভ্রও বাধ্য ছেলের মতো উনার পিছু নিলেন। যাওয়ার সময় পেছনে ফিরে করুণ চোখে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝালেন আমায়। আমি সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে পিঁপড়া তাড়ানোর পেছনে লেগে গেলাম৷ কি করা যেতে পারে? কি করা যেতে পারে? ভাবতে ভাবতেই রাতুল ভাইয়াকে চোখে পড়লো। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে গেইম খেলছিলেন। আমি উনার সামনে দাঁড়াতেই উনি অসচেতন চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়েই আবারও ফোনে মুখ গুঁজলেন। তারপর কি ভেবে সটান দাঁড়িয়ে পড়ে বলে উঠলেন,

— আসসালামু আলাইকুম ভাবি।

— ওয়ালাইকুমুস সালাম ভাইয়া।

— ককোনো দরকার ভাবি? মানে কিছু বলবেন?

— হুম বলবো। একটা হেল্প চাই। করবেন প্লিজ?

— কি হেল্প ভাবি?

— আশেপাশে কোনো শপ আছে? যেখানে বিষ পাওয়া যাবে। থাকলে একটু এনে দিবেন প্লিজ?

কথাটা বলা শেষ হতেই আবারও শুভ্র এসে হাজির। উনি এসেই আমার হাত টেনে ধরে রাগী চোখে তাকালেন। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। উনার সমস্যাটা কি বুঝতে পারছি না আমি। উনি গাল ফুলিয়ে একটা জোড়ে শ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,

— আবারও শুরু করছো তুমি? আর তুই?(রাতুলের দিকে তাকিয়ে) যাহ্ ভাগ এখান থেকে। আগামী তিনদিন তোর ভাবির আশেপাশে আসবি না কথা তো দূরের কথা।

শুভ্রর কথায় করুণ চোখে তাকালেন রাতুল ভাইয়া। মাথা নিচু করে মিনমিন করে বলে উঠলেন,

— আমি আবার কি করলাম ভাই? ভাবি তো শুধু বিষের কথাটায় জিজ্ঞেস করছিলো।৷ আমি তো কিছু করি নি।

— তুই কিছু করিস নি ভাই। তবু তোর ভাবি থেকে দশহাত দূরে থাক। ভাবির প্রতি তোর অতি ভক্তিতে বিপদের আশঙ্কা আছে বুঝলি? তুই কি চাস তোর ভাইটা বউ হারিয়ে এতিম হয়ে যাক?

— না ভাই।

— তাহলে ওর থেকে দূরে থাক। আগামী তিনদিনের মধ্যে যদি দেখি ওর সাথে তুই কথা বলছিস তো খবর আছে। একদম হাড়গুঁড় ভেঙে ছাদের সাথে ঝুলিয়ে রাখবো। এখনো এক বছর হলো না বিয়ে করছি আর তোরা আমাকে বিধবা… ওহ সরি! এই রাতুল? বিধবার মেইল ফ্রম কি রে?

— জানি না ভাই। ( মাথা চুলকে)

— তা জানবি কেন?এটা জানলে তো ভালো কিছু একটা জেনে যাবি। তুই তো শুধু বিষ কোন দোকানে পাওয়া যায় সেটা জানবি। বলদ একটা! যাহ ভাগ।

রাতুল ভাইয়া দিলেন এক দৌঁড়। ভাইয়ের মেজাজ তার কাছে মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না । আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি।উনি আমাকে হাত ধরে টেনেটুনে রুমে এনে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বিছানায় দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। আমি ঘাড়টা হালকা কাত করে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি। উনি হঠাৎই সটান দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে নিজের কাছে টেনে নিলে বললেন,

— কি শুরু করছো বলো তো? সবার কাছে গিয়ে বিষ চাইছো। আমি সরি বলেছি তো। তোমার কিছু হলে কি আমি বাঁচবো বলো? তখন তো ডিপ্রেশনে কি না কি বলে দিয়েছি সেটা ধরে বসে আছো তুমি? এটা কি ঠিক বলো?

আমি এতোক্ষণে বুঝলাম উনার মাথায় এক্চুয়েলি কি ঘুরছিলো। বিষ খাওয়ার ব্যাপারটা তো আমি এমনি বলে দিয়েছিলাম। উনি সেটাকে যে সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছেন বুঝতে পারি নি। এতো কিউট একটা হাজবেন্ড থাকতে সুইসাইড করতে যাবো কেন দুঃখে? উনার ছোঁয়ায় ঘোর কাটলো আমার। উনার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালাম। উনি করুণ কন্ঠে বলে উঠলেন,

— এমন বিষ বিষ করো না। তোমার মুখে “বিষ” ওয়ার্ডটা শুনলেই হার্ট অ্যাটাক হওয়ার অবস্থা হয় আমার। প্লিজ রোদপাখি।

এবার আমি ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। রাগী গলায় বললাম,

— দূরে থাকুন। আগলা পিরিত দেখাবেন না বলে দিচ্ছি।

— আগলা পিরিত? কি সব ওয়ার্ড ইউজ করো তুমি রোদ?

— ওহ! এখন আমার বলা ওয়ার্ডেও প্রবলেম আপনার? হুহ! হবেই তো হবে না? এখন তো পুরাতন হয়ে গেছি। চারপাশে এতো সুন্দরী সুন্দরী রমনীর মিষ্টি বুলির ভীরে কি আর আমার কথা আপনার ভালো লাগবে? লাগবে না তো। বুঝি তো আমি। ( মুখ ফুলিয়ে)

— হোয়াট? পাগলের মতো কি সব বলছো তুমি রোদ?

— পাগল? এখন আমি পাগল? কিছুক্ষণ পর নিশ্চয় বলবেন আমি এক্সপায়ার্ড হয়ে গেছি তাই না?

— হোয়াট? এক্সপায়ার্ড? মানুষ কখনো এক্সপায়ার্ড হয় নাকি? (ভ্রু কুঁচকে) কেমন উদ্ভট বিহেভ করছো তুমি রোদ।

— বিয়ের ৬ মাসের মাথায় আমি উদ্ভট? বাবা দেখে যাও কেমন ছেলের কাছে বিয়ে দিয়েছো আমায়!

কথাটা বলেই এগিয়ে গেলাম আমি। শুভ্র যেন বোকা বনে গেছেন। আমার এমন বিহেভিয়ার তার কাছে নতুন। আমি উনার কাছে গিয়ে পাঞ্জাবীর কলার চেপে ধরে কিছু একটা বলতে যাবো তার আগেই সাব্বির ভাইয়ার কন্ঠ কানে এলো,

— এই শুভ্র? তোর কাছে ক্যা….ওপস্ সরি বস! রং টাইমিং!

আমরা দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। শুভ্র হতভম্ব ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি উনার কলার ছেড়ে দিয়ে সাব্বির ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনার হাত থেকে কোল্ডড্রিংকস্ এর বোতলটা নিয়ে বললাম,

— নতুন নাকি?

— জি ভাবি।

— ওহ্। আই ওয়ান্ট টু টেস্ট ইট। আমার বরের থেকে আরেকটা কিনে নিয়েন। বাই ভাইয়া।

কথাটা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি। কোল্ডড্রিংকস্ খেতে খেতে ভাবতে লাগলাম এই পিঁপড়া সমস্যার সমাধানটা কি করে করা যায়? চিত্রার থেকে হেল্প নিবো? আর আধাঘন্টা পর ওর গায়ে হলুদ সেজেগুজে বসে আছে আধাঘন্টা যাবৎ নিশ্চয় মাথায় জ্যাম বেঁধে গেছে? পিঁপড়া সমস্যা নিয়ে চিন্তা করলে এই জ্যাম খুললেও খুলতে পারে। কথাটা ভেবে হুট করে ঢুকে গেলাম চিত্রার রুমে। কিন্তু রুমে গিয়ে যা দেখলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই দিলাম এক চিৎকার। তাড়াতাড়ি মুখ চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করে চোখ- মুখ কুঁচকে বলে উঠলাম,

— সরি! রোমান্স চলছিলো বুঝতে পারি নি।

আমার কথায় চিত্রা লালে লাল। শিশির স্যার পারেন তো দৌড়ে পালান। আমি নিজেও বেশ লজ্জা পেয়েছি তবু সেই লজ্জাটুকুকে পাত্তা না দিয়ে, ওদেরকে আরেকটু লজ্জা দেওয়ার ইচ্ছেই বলে উঠলাম,

— আপনারা চাইলে আবার কন্টিনিউ করতে পারেন। আমি এবার আর হুট করে রুমে ঢুকবো না৷ নক করে ঢুকবো। নো টেনশন, চালিয়ে যান। বাই।

কথাটা বলে একমুহূর্ত দাঁড়ালাম না আমি। কি একটা লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। তবে শিশির স্যার আর চিত্রার মুখটার কথা মনে করে নিজের লজ্জার কথা ভুলে গিয়ে হাসিতে ভেঙে পড়তে ইচ্ছে করছে আমার। তবু নিজেকে সংযত করে আশেপাশে তাকালাম। চারপাশে মেহমানে ভর্তি। এতোসব মেহমানদের মধ্যে সবুজ পাঞ্জাবী পড়া রাতুল ভাইকে দেখতে পেলাম। হাতে একগাঁদা কোল্ডড্রিংক্সের বোতল। আমি উনার সামনে যেতেই উনি ঘুরে হাঁটা দিলেন। আমিও কম কিসে? আবারও উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি আবারও কাটিয়ে যেতে গেলেন তো আবারও উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। রাতুল ভাইয়া অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি ভ্রু নাঁচিয়ে বললাম,

— কি জনাব? পালান কেন?

— ভাই আপনার সাথে কথা বলতে মানা করছে। কথা বলবো না।

উনার কথায় হেসে উঠলাম আমি। হাসতে হাসতেই বললাম,

— আপনি তো কথা বলছেনই। এনিওয়ে একটা কোল্ডড্রিংক্স দিয়ে যান। নয়তো যেতে দিবো না।

রাতুল ভাইয়া একটা কোল্ডড্রিংক্সের জায়গায় দুটো দিয়ে গেলেন। আমি কোল্ডড্রিংক্স খাচ্ছি আর হাঁটছি। হঠাৎই কোথা থেকে এক ছেলে এসে সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে উঠলো,

— হাই! আমি মিসির আহমেদ। শিশিরের ছোট ভাই। আর আপনি?

উনার কথায় ভ্রু কুঁচকালাম আমি। ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম,

— মিসির? এটা আবার কেমন নাম? আপনার নামটা একটু অন্যরকম। এনিওয়ে আপনি শিশির স্যারের ছোট ভাই?

— জি।

— ওহ। তাহলে তো আপনার নাম কুয়াশা হওয়া উচিত ছিলো। শিশির আর কুয়াশা… জিনিস দুটো কিন্তু কাছাকাছি।

— আমার জানা মতে কুয়াশা মেয়েদের নাম।

— তাই নাকি? জানা ছিলো না তো। তাহলে একটা কাজ করবেন আপনার একটা বোন হলে তার নাম রাখবেন কুয়াশা।

কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় দিলাম। বুঝলাম ভুল কথা বলে ফেলেছি আমি। যে মহিলা ক’দিন পর নাতি নাতনীর পেছনে দৌঁড়াবে তার আবার মেয়ে কি করে হতে পারে? অদ্ভুত! নিজের ভুল বুঝতে পেরে মুখে হাসি টেনে নিয়ে বললাম,

— আই মিন টু ছে, শিশির স্যারের মেয়ের নাম কুয়াশা রাখলে বেশ হবে। বাপ শিশির, মেয়ে কুয়াশা! দারুন না?

— হুম দারুন। আচ্ছা আপনার নামটা তো বললেন না। কনেপক্ষ?

— জি কনেপক্ষ। আমার নাম নৌশিন আবরার রোদেলা।

— বাহ সুইট নেইম। আপনি দেখতে যেমন মিষ্টি আপনার নামটাও তেমন মিষ্টি।

— আই নো। আমার বরও তাই বলে।

আমার কথায় ছেলেটা অবাক হলো বলেই মনে হলো। কয়েকসেকেন্ড চুপ করে থেকে বলে উঠলেন,

— আপনি ম্যারেড? দেখে বুঝার উপায় নেই একদম। তবে ব্যাপার না। আপনার মতো রসগোল্লা টাইপ মেয়েদের দু তিনটা হাজবেন্ড থাকলেও ব্যাপার না। আপনারা অলওয়েজ প্রাণোবন্ত। এটা ২০২০ এখন ম্যারিড – আনম্যারিড ডাজেন্ট ম্যাটার রাইট?

— ইয়াহ্ অফকোরস্। আপনি তো দেখি খুব অত্যাধুনিক মন-মানুষিকতা পোষন করেন। আমার হাজবেন্ডের মন-মানুষিকতাও কিন্তু খুব আধুনিক। এক মিনিট দাঁড়ান…এখনি আসছি।

আমাদের থেকে কিছুটা দূরেই শুভ্র কয়েকজন লোকের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। আমি দৌঁড়ে উনার কাছে গিয়ে আঙ্গুল দিয়ে পিঠে গুঁতো দিলাম। উনি পেছন ফিরে আমাকে দেখেই অবাক হলেন। উনাদেরকে বিদায় দিয়ে আমাকে একটু দূরে সরিয়ে এনে বললেন,

— কি হয়েছে? এমন বাচ্চাদের মতো বিহেভ কেনো করছো?

— ওদিকে চলুন। একটা জিনিস দেখাবো।

— কি দেখাবে?( ভ্রু কুঁচকে)

— আহা! চলুন না।

কথাটা বলেই উনাকে টেনে মিসিরের সামনে এনে দাঁড় করালাম। মিসিরকে ইশারা করে বললাম,

— ইনি হলেন কুয়াশা। মিষ্টার কুয়াশা।(জিহ্বায় কামড় দিয়ে) ওপস্ উনার নাম কুয়াশা নয়…মিসির আলি। শিশির স্যারের ভাই। আর ইনি হচ্ছেন আমার বর। কিউট না?( মিসিরের দিকে তাকিয়ে)

শুভ্র মুচকি হাসলেন। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

— হ্যালো মিষ্টার মিসির। আমি আবরার আহমেদ শুভ্র।

মিসির কিছুক্ষণ শুভ্রর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে হাত মেলালেন। আমি শুভ্রর হাত ঝাঁকিয়ে বলে উঠলাম,

— জানেন? উনি না খুব আধুনিক মন-মানুষিকতা সম্পন্ন মানুষ।

— তাই নাকি? বাহ্ ভালো তো।( মিষ্টি হেসে)

— হুম। উনি বলছিলেন, আমার মতো রসগোল্লা আর মিষ্টি মেয়েদের দু তিনটা বর থাকতেই পারে এতে দোষের কিছু নেই। আজকালকার যুগে এসব কেই বা মানে?

এবার শুভ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ভ্রু কুঁচকে মিসিরের দিকে তাকালেন । মিসির রীতিমতো ঘামছেন। কোনরকম ঢোকগিলে বলে উঠলেন,

— আমি আসছি।

মিসির চলে যেতেই ফিক করে হেসে উঠলাম আমি। শুভ্রকে দু’হাতে জড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলাম,

— ভয় পেয়েছে।

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলেন আমায়। ফিসফিস করে বলে উঠলেন,

— কি করছো? সবাই দেখছে তো।

— তাতে কি? দেখলে আমার কি?

— এই? তুমি এমন বিহেভ করছো কেন বলো তো? কিছু খেয়েছো নাকি?

শুভ্রর প্রশ্নে তুমুল উৎসাহ নিয়ে বলে উঠলাম আমি,

— হ্যা খেয়েছি তো।

— কি খেয়েছো?

— বিষ।

— কিহহহহ!

— নাহ নাহ্ বিষ খাইনি। মধু খেয়েছি।

— হোয়াটট?

— নাহ্ আমি মধুও খাই নি। (কাঁদো কাঁদো মুখে) কি খেয়েছি বলুন তো? বাহ্ আপনার গালগুলো তো খুব কিউট। আমি চুমু খাবো।

কথাটা বলতেই বিদ্যুৎ বেগে সরে দাঁড়ালেন শুভ্র।
আমার এসব অসংলগ্ন কথার কিছুই মাথায় ঢুকছে না উনার। একটা জোড়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করে নিয়েই আমার হাত ধরে হাঁটা দিলেন উনি। ইতোমধ্যে চিত্রা আর শিশির স্যারকে স্টেজে নেওয়া হয়েছে। ওদেরকে দেখেই লাফিয়ে উঠলাম আমি। শুভ্রর ডানহাতটা জড়িয়ে ধরে বললাম,

— ওই দেখুন চিত্রার বর।

— শিশিরকে আজ নতুন দেখছি না রোদ। চলো রুমে চলো।

— ইশশ দাঁড়ান না। চিত্রাকে অনেক কিউট লাগছে তাই না?

— হুম লাগছে।

— আপনি দেখে বলছেন নাকি না দেখে?

— না দেখে।

— ধেৎ। দেখুন বরটাও কি কিউট। কিন্তু আমার বরটা বেশি কিউট। তাই না?

শুভ্র এবার অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি উনার হাতে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলে উঠলাম,

— বলুন না। ওই বরটার চেয়ে আমার বরটা অনেক অনেক অনেক বেশি কিউট তাই না?

— হুম তোমার বর অনেক বেশি কিউট। এবার রুমে চলো।

উনি আমাকে একরকম টানতে টানতেই রুমের দিকে নিয়ে গেলেন৷ হঠাৎ সাব্বির ভাইয়াদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন শুভ্র। ইশারায় ওদের সবাইকে কাছে ডাকলেন উনি। উনারা কাছে আসতেই দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,

— শালা! আমার বউকে কি খাইয়েছিস বল। কি সব বিহেভ করছে।

সাব্বির ভাইয়া অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলে উঠলেন,

— আমরা ভাবিকে কি খাওয়াবো আজব।

— সত্য বলবি? নাকি দিবো কানের নিচে লাগাইয়া?

সাব্বির ভাইয়া এবার মুখ কাঁচুমাচু করে বলে উঠলেন,

— আসলে,, শুভ্র? হয়েছে কি? ভাবি তখন যে কোলড্রিংক্সের বোতলটা নিলো ওটা বিয়ার ছিলো। একটা বিয়ারে নেশা টেশা হয় না বলে আমিও আর কিছু বলি নি। তারপর শুনলাম রাতুলের থেকেও দুটো নিছে। আমি জানতাম না রে দোস্ত সরি।

কথাটা শুনেই রাতুল ভাইয়ের দিকে রাগি চোখে তাকালেন শুভ্র। রাতুল ভাইয়া মুখ কাঁচুমাচু করে বলে উঠলেন,

— আসলে ভাই, আমিও জানতাম না ওইটা বিয়ার। নয়তো দিতাম না। সরি ভাই। ভাবি চাইলো তাই আর না করতে পারি নাই।( মাথা নিচু করে)

— তোরা আসলে কোনোদিন মানুষ হবি না।

— আরে দোস্ত। আমরা দশ বার ক্যান খেয়ে ফলি কিছুই তো হয় না। কোল্ডড্রিংক্স আর বিয়ারের মধ্যে কি এমন পার্থক্য বল? এখন এটা কমন….

— বিয়ার একজাতীয় মদ সাব্বির। ওটা হারাম। যে জিনিসটা আমিই টাচ করি না সেটা তোরা রোদকে ধরতে দিলি? আধুনিকতারও একটা লিমিট আছে। ধর্মের বাইরে গিয়ে আধুনিক হওয়ার মাঝে কোনো বীরত্ব নেই। যা হারাম তা হারাম এখানে কমন আনকমনের কোনো দোহাই আসতে পারে না।

কথাটা বলে একরাঁশ রাগ নিয়ে আমাকে নিয়ে রুমে এলেন শুভ্র। উনি দেয়ালে ঠেস দিয়ে একপা দেয়ালে রেখে একহাতে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বিছানায় বসে গোলগোল চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলে উঠলেন,

— এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?

— আপনি তো অনেক হ্যান্ডস্যাম!উফফ…একদম রসগোল্লা টাইপ।

উনি একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে করুণ চোখে তাকালেন। আমি আগের মতোই গালে হাত দিয়ে গোল গোল চোখে উনার দিকে তাকালাম।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে