তৈমাত্রিক পর্ব-৩৫+৩৬

0
1004

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ৩৫

মানুষের জীবন তো বয়ে চলে সমুদ্রের স্রোতের মতো। আর এই জীবনে কতো বাধা-বিপত্তি ই না আসে। কখনো কাদায় আবার কখনো হাসায়। জীবন থেকে সব হারিয়ে গেলেও কোথাও না কোথাও কিছু একটা থেকেই যায় যা মানুষকে তার জীবনে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। বা হয়ে থাকে তার জীবনের শেষ অবলম্বন হিসেবে। মেহরামেরও আচ্ছে আর তা তার অনাগত বাচ্চা। কিন্তু এখানে এখন অবলম্বন দুইজন। আয়ুশ আর তার বাচ্চা। মেহরাম কখনোই ভাবে নি যে আয়ুশ একটা সময়ে এসে তার জীবনের সাথে এভাবে জুড়ে যাবে। যাই হোক যেমন হোক ভালোই আছে। এগুলোই সোফার ওপর বসে বসে ভাবছিলো মেহরাম। তখনই কণা এসে ধপ করে মেহরামের পাশে বসে পরে। মেহরাম প্রথমে অবাক হলেও পরে হেসে ওঠে….

মেহরাম;; আরে কখন এলে?

কণা;; এইতো মাত্রই।

মেহরাম;; কিন্তু বাইরে তো অনেক বৃষ্টি, আর এই বৃষ্টিতে তো…

কণা;; আরে রিকশা দিয়ে এসেছি আর ছাতা ছিলো।

মেহরাম;; একা এসেছো, খালামনি কোথায় আসে নি?

কণা;; না মানে বাবা বাসায় তো বাবা কে রেখে আর মা কিভাবে আসতে পারে তাই আমি এসে পরেছি।

মেহরাম;; অনেক ভালো করেছো।

কণা;; আর তোমার জন্য একটা জিনিসও এনেছি, দাড়াও

মেহরাম;; কি?

কণা;; দাড়াও দাড়াও

কণা তার ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে। সে বক্সটার মুখ খুলে মেহরামের দিকে ধরে। মেহরামের তো দেখেই খুশিতে মুখ ঝলমল করে ওঠে। কারণ বক্সে বিরিয়ানি।

মেহরাম;; বিরিয়ানিইইইইইইইইই!!

কণা;; হ্যাঁ, আমি এখানে আসার প্লেন আগে থেকেই করছিলাম। আর মা তখন আমার হাতে এই বক্স টা ধরিয়ে দিলো। তুমি নাকি খেতে ভালোবাসো তাই আর কি।

মেহরাম;; খালামনি তো এখানে নেই তা না হলে একটা পাপ্পি আর একটা ঝাপ্পি দিতাম।

কণা;; তার বদলে আমাকে দিয়ে দাও।

মেহরাম;; হিহিহিহিহি।।

মেহরাম আর কনা বসে কথা বলছিলো। তখন মেহরামের মা আর চাচি এলো। সবাই বসে বসে অনেক কথা বলছে। এদিকে বাইরে তুমুল বেগে বৃষ্টিও হচ্ছে। মেহরাম আরামছে বৃষ্টি দেখছে আর বসে বসে খাচ্ছে। মেহরাম কে এখন আর খাওয়ার জন্য জোর করতে হয় না সে একা একাই অনেক খাবার খায়। পেট যেন আগের থেকে আরো অনেক ফুলেছে। নড়তে চড়তেও ভারি কষ্ট হয়। বসতে গেলে কিছু একটা ধরে তারপর বসতে হয় দাড়াতে গেলেও একই দশা। আগে তো রুম ওপরে ছিলো মেহরামের কিন্তু এখন রুম নিচে। কারণ এই সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা আবার সিড়ি বেয়ে নিচে নামার কর্ম মেহরামের না। দশমাশ তিন দিন চলছে। ডাক্টর দশমাশ বারো দিনের মাথায় ডেলিভারির ডেট দিয়েছেন। একদম নজরে নজরে রাখে সবাই তাকে, কারণ কখন কি হয়ে যায়। মেহরাম কে কেউ দেখলে ভাববে হয়তো টুইন বেবি কিন্তু না ডক্টর বলে দিয়েছেন একজনই। আর বেবি একটু স্বাস্থ্যবান তাই এমন মোটা দেখায় পেট টা। আয়ুশ আসে মেহরাম আর বাকি সবার সাথেই কথা হয়। মানে সবকিছুই অনেক ভালো চলছে। মাঝে মাঝে তনুকে প্রচন্ড ভাবে মিসও করে মেহরাম। আবার মাঝে মাঝেই আয়ুশকে নিয়ে তনুকে দেখতে চলে যায়। সবার কত্তো প্লেন বেবি হলে এই করবে সেই করবে। তবে যখন মেহরাম ঘরে একা থাকে। বা যখনই নিজের দিকে নজর পরে তার কেন জানি সোহেলের কথা মনে পরে যায়। স্পেশালি যখন চোখ জোড়া পেটের দিকে যায়। মেহরাম মাঝে মাঝে পেটের ওপর হাত দিয়ে আয়নাতে নিজেকে দেখে। কেমন এক আলাদা অদ্ভুত অনুভুতি হয়। শুনেছে মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্ত যখন সে মা হয়। কখনো ভাবেনি নিজের ক্ষেত্রেও এমন হবে। সেও মা হবে। এইসব ভাবতে ভাবতেই হেসে ওঠে। মেহরাম কখনো কাউকে দেখি নি যে কেউ বাচার জন্য এতো আকুতি করছে। চোখে মুখে বাচার প্রবণতা এত্তো বেশি। মেহরাম সোহেল কে দেখেছে। নিজের বাচ্চার মুখ দেখার জন্য কতোই না আগ্রহ ছিলো, বাচতে চেয়েছিলো সে কিন্তু ভাগ্য তা মেনে নেয় নি। এক লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে মেহরাম। দিন খুব দ্রুত গতিতে চলেছে। কখন দিন কখন রাত বুঝায় যায় না।

একদিন মেহরাম হলরুমে বসে ছিলো সবার সাথেই। এটা বিকেল বেলা। তখন কণাও আসে বাসায়। ইদানীং প্রায়ই কণা মেহরাম দের বাড়িতে আসে। যখনই সময় পায় তখনই। মেহরাম হেলান দিয়ে বসে ছিলো। পাশেই তার দাদি, চাচি, মা সবাই বসে আছে। কণাও গিয়ে গল্প শুরু করে দেয়। মেহরাম সবার কথা শুনছে আর হাসছে। তবে হুট করেই মেহরাম তার কপাল কুচকে ফেলে। হাতটা আপনা আপনিই পেটের নিচে চলে যায়। কেমন যেন একটু ব্যাথা অনুভব করে। কিন্তু এখন এই ব্যাথা যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে৷ অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। এবার মেহরাম এক হাত কোমরে আরেক হাত পেটের নিচে ধরে। আর থাকতে না পেরে চিৎকার দিয়ে ওঠে…..

মেহরাম;; আহহহহহহ, মায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া..

আতিয়া;; মেহরু কি হয়েছে তোর। ব্যাথা শুরু করেছে। ভাবী

কনিকা;; ল্যাবার পেইন

কণা;; কিন্তু আপুর ডেলিভারির তো আরো পাঁচ দিন বাকি।

কনিকা;; কণা মাঝে মাঝে এমন হয় যে ডেটের আগেই ডেলিভারি হয়ে গেছে। এবার বেশি দেরি না করে দ্রুত বাইরে গিয়ে ড্রাইভার কে গাড়ি বের করতে বলো।

কণা;; হ্যাঁ যাচ্ছি।

কণা দৌড়ে বাইরে চলে যায় আর আতিয়া মেহরামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কনিকাও একই ভাবে মেহরামের হাত ধরে রেখেছে। কিন্তু এদিকে যেন কারো কোন কথা মেহরামের কান দিয়ে যাচ্ছেই না। তীব্র ব্যাথায় সে ছটফট করছে। অবশেষে গাড়ি বের করে আতিয়া আর কনিকা মেহরাম কে ধরে ধরে নিয়ে হস্পিটালে চলে গেলো। বড়িতে আকাশ আর দাদি কে কোন রকমে বুঝিয়ে রেখে গেলো। আর হস্পিটালে মেহরামের সাথে কণা আতিয়া আর কনিকা গেলো। যেই ডাক্তারের আন্ডারে মেহরামের চেকাপ হচ্ছিলো উনিই মেহরামের ডেলিভারি করবেন। তাকে ফোন করে বলেও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাড়াহুড়োর কাজই খারাপ। সময় আর রাস্তা যেন যেতেই চাচ্ছে না। যদিও গাড়ি জোরে চালানো হচ্ছে। প্রায় পচিশ মিনিট পর হস্পিটালের সামনে আনা হয়। হাটার শক্তি টুকুও মেহরাম পাচ্ছে না। ব্যাথায় যেন ছিড়ে যাচ্ছে। হস্পিটালের সামনে নামলে দুইজন নার্স ছুটে আসে। ধরাধরি করে মেহরাম কে কোন রকমে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এবার আর মেহরাম হাটতে পারে না। বেড নিয়ে আসা হয়, বেডের ওপর মেহরাম কে শুইয়ে দেওয়া হয়। এদিকে মেহরামের চাচি আর মার চিন্তায় যায় যায় অবস্থা। কনিকা তো আরো ঘাবড়ে যাচ্ছে কারণ মেহরাম ব্যাথায় চিল্লাচ্ছে অনেক। আতিয়া কোন রকমে কনিকা কে একটা জায়গায় বসিয়ে দেয়। তারপর শান্তনা দেয়। কণা হস্পিটালে আসার সময়ই লায়লা কে খাতুন কে ফোন করে বলে দিয়েছিলো। তিনি হয়তো আসছেন। তবে কণার মাথায় হুট করেই এবার আয়ুশের চিন্তা আসে। কণা তো ভুলেই গিয়েছিলো, এতো তাড়াহুড়ো তে মাথা থেকে তার ভাইয়ের খেয়াল একদম বের হয়ে গিয়েছিলো। সে আর দেরি না করে দ্রুত আয়ুশকে ফোন দেয়। প্রথম বার ফোন বেজে কেটে যায় একা একাই। এতে কণার রাগ মাথায় উঠে পরে। একশ একটা গালি দিয়ে আয়ুশকে আবার ফোন দেয়। আয়ুশের ফোন তার কেবিনে ছিলো আর সে বাইরে ছিলো। হাতে ফাইল দেখতে দেখতে কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করে আয়ুশ। এসেই দেখে কণা ফোনের ওপর ফোন করে চলেছে। আয়ুশ গিয়ে জলদি রিসিভ করে। হ্যালো বলতে না বলতেই ওপর পাশ থেকে কণা চিল্লিয়ে বলে ওঠে…..

আয়ুশ;; হ্যল….

কণা;; এই কোথায় রে তুই, ফোন রেখে কই গিয়েছিলি। কখন থেকে ফোন দিচ্ছি। কাজের সময় তো পাওয়াই যাবে না।

আয়ুশ;; আরে ভাই থাম হয়েছে কি?

কণা;; আরে মেহরাম আপুর পেইন শুরু হয়েছে।

আয়ুশ;; কিহহ কিন্তু এখনই কেন। আরো কয়েক দিন দেরি

কণা;; হ্যাঁ ছিলো কিন্তু এখন পেইন শুরু হয়ে গেছে। আর আমরা সবাই হস্পিটালেই আছি আপু কে নিয়ে। মা কে ফোন করে আমি বলে দিয়েছে মা হয়তো আসছে। আর প্লিজ সব ছেড়ে জলদি আয় এখানে।

আয়ুশ;; আচ্ছা মেহরাম কোথায়?

কণা;; আপু কে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেক চিল্লাচ্ছে ব্যাথা করছে অনেক। তুই আয় জলদি ভাই।

আয়ুশ;; জাস্ট গিভ মি ফাইভ মিনিটস্।

আয়ুশ ফোন রেখে দ্রুত অফিস থেকে বের হয়ে পরে। ওদিকে খুব কষ্টে মেহরামের ড্রেস চেঞ্জ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার ভেতরে। অবস্থা বেশি ভালো না খুব ক্রিটিকাল তাই জলদি জলদি ডেলিভারির কাজ শুরু করে দিয়েছে। নরমাল ভাবেই ডেলিভারি হওয়া সম্ভব। আর আয়ুশ যেন ঝড়ের গতিতে চলছে। আধাঘন্টার রাস্তা পনেরো মিনিটে শেষ করে এসেছে। হস্পিটালের সামনে গাড়ি থামিয়ে গাড়ির দরজা টা কোন রকমে লাগিয়ে চাবি নিয়ে এসে পরে। দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে। গিয়েই দেখে কণা পায়চারি করছে। তার মাও এসে পরেছে তার আগেই। কনিকার পাশে আতিয়া আর লায়লা খাতুন বসে আছে। আয়ুশ দেখছিলো তখন তার কানে মেহরামের চিৎকার ভেসে আসে। আয়ুশ সেদিকে তাকায়। গিয়ে কেবিনের বাইরের গ্লাস দিয়ে উকি দেয়। তেমন কিছুই দেখে যাচ্ছে না তবে শুধু রক্ত আর রক্ত দেখা যাচ্ছে। এগুলো দেখে তো আয়ুশের মাথা ঘুড়ে পরে যাওয়ার মতো অবস্থা। কণা ব্যাপার টা বুঝতে পেরে আয়ুশকে সেখান থেকে এনে পরে। আয়ুশকে বুঝাতে থাকে যে কিছুই হবে না সব ঠিকই হবে। এভাবেই থাকতে থাকতে প্রায় ৪৫ মিনিট পর ডাক্তার বের হন। ডাক্তার কে দেখেই সবাই দ্রুত তার কাছে যান। তবে এবার ডাক্তার যা বলেন তাতে সবাই ঘাবড়ে যায়…

ডাক্তার;; দেখুন আসলে আমরা আগে ভেবেছিলাম যে প্রেগন্যান্সিতে তেমন কোন অসুবিধা হবে না কিন্তু উনার ওয়াটার ব্রেক করেছে। আর অনেক বেশি ব্লিডিং হচ্ছে। কেন যে হচ্ছে এতো তাও বুঝতে পারছি না। আর বেবির ব্যাপারে একদম চিন্তা করবেন না। বেবি সুস্থ আছে শুধু মায়ের একটু সমস্যা হচ্ছে। অনেক বেশি ব্লিডিং যাচ্ছে। আর এখন রক্তের প্রয়োজন। তো…

আয়ুশ;; আপনি, আপনি আমার ব্লাড নিন। আমার আর মেহরামের ব্লাড গ্রুপ সেম। আপনি যতো ইচ্ছে রক্ত নিন কিন্তু মেহরাম বা বাচ্চার কোন রকম যেন কোন সমস্যা না হয়। আপনি আমার ব্লাড নিন।

ডাক্তার;; জ্বি আসুন আমার সাথে।

আয়ুশ ডাক্তারের সাথে চলে যায়। এদিকে এবার মেহরামের মা অঝোরে কেদে দেন। কারণ মেয়ের সাথে আজ পর্যন্ত কিছু না কিছু হয়েই এসেছে এখন যদি তার মেয়ের বা বাচ্চার কিছু হয় তাহলে এই জীবন রাখার চেয়ে না রাখাই ভালো। কনিকা কাদছে আর বাকি সবাই তাকে কোন রকমে বুঝিয়ে যাচ্ছে। প্রায় বিশ মিনিট পর আয়ুশ আসে। দুই ব্যাগের মতো রক্ত নেওয়া হয়েছে তার বডি থেকে। যার ফলে আয়ুশের শরীর এখন অনেক খারাপ লাগছে৷ ডাক্তার কেবিনে গিয়ে আবার তাদের কাজ শুরু করে। মেহরাম যেন এই চোখ বন্ধ করে করে এমন কিন্তু তাকে চোখ খোলা রাখার জন্য অনেক বলা হচ্ছে। এদিকে যেহেতু বেবি নরমালে হচ্ছে তাই মায়ের পুশ করতে হবে। তবে শক্তি যেন আর বাকি নেই। কিন্তু এবার শেষ চেষ্টা করে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মেহরাম পুশ করে আর ডাক্তার একটা বেবি কে আনেন। বের করার সাথে সাথে কেবিন একদম ফাটিয়ে বাচ্চা কান্না করে দেয়। বাচ্চার কান্নার শব্দ কেবিনের বাইরে পর্যন্ত আসছে। ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ পেয়ে বাইরে সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আয়ুশ ফট করে মাথা তুলে কেবিনের দিকে তাকায়। বুকের ভেতরে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছে তার। মেহরাম নিভু নিভু চোখেই তাকিয়ে থাকে। জোরে জোরে দম ছাড়ছে আর মুখে ঝুলছে হাসি। অনেক ক্লান্ত হয়েছে গিয়েছে সে। ডাক্তার খুব সাবধানে সিজার দিয়ে বেবির নাভির সাথে নাড় টা কেটে দেয়। নার্স কে বলে একটা সাদা ধবধবে টাওয়াল নিয়ে আসে। তাতে বাচ্চাকে শুইয়ে দেয়। ডাক্তারের নিজেরই যেন মুখ থেকে হাসি সরছে না। ডাক্তার হেসে মেহরামকে বলে ওঠে….

ডাক্তার;; Congratulations!! মেয়ে বাচ্চা হয়েছে।

এটা শোনার পর মেহরামের মুখের হাসি টা যেন আরো চওড়া হয়ে গেছে। সোহেলের কথা গুলো এখন মেহরামের কানে বাজছে। যেন বারবার একই কথা ঘুরেফিরে মেহরামের কানে এসে ঠেকছে।

“” মেহরাম, দেখো আমাদের মেয়েই হবে। তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিও। আমার মেয়ে বাচ্চাই চাই। যে একদম তোমার মতো হবে দেখতে। মেহরাম, আমাদের মেয়েই হবে “”।

মেহরামের এখন বলতে ইচ্ছে করছে যে ” হ্যাঁ সোহেল, ইট’স্ এ বেবি গার্ল। মেয়েই হয়েছে। আপনি ঠিক ছিলেন। মেয়ে হয়েছে”।

ডাক্তার বেবিকে একদম সুন্দর করে পরিষ্কার করে একটা সাদা টাওয়ালে মুড়িয়ে নিলো। মেয়ে অনেক মোটা সোটা হয়েছে। মাথা ভর্তি চুল। গাল গুলো একদম লাল হয়ে আছে। আর ফর্সার কথা তো বাদই দিলাম। পুরাই পুতুল। শরীরে যে ব্যাথাই ছিলো যাই ছিলো নিজের বাচ্চা কে দেখার পর থেকে সব যেন দূর হয়ে গেছে মেহরামের । বাচ্চাকে ডাক্তার নার্সের কাছে দেবার পর মেহরামকে আবার দেখে। কেননা মেহরামের অনেক ব্লাড গিয়েছে। আর এইসব ঠিক ঠাক করতে হবে। পুরো দুই ঘন্টার কাছাকাছি লেগেছে এই সব করতে। মেহরাম কে কেউ দেখে এখন বলবেই না যে তার শরীরে রক্তের স্বল্পতা ছিলো। সবকিছু পরিষ্কার করে এখন বেডে শুয়ে আছে। তবে হাতে সুই পুশ করা। যখন থেকে বাচ্চা হয়েছে মেহরামের নজর যেন তার থেকে সরছেই না। মেহরামের যদিও তেমন শক্তি নেই তবুও সে উঠে বসতে চায়৷ ডাক্তার তাকে হাল্কা উঠিয়ে হেলান দিয়ে বসায়। তারপর মুচকি হেসে বাচ্চাকে মেহরামের কোলে দেয়। মেহরামের মনে হচ্ছে যে সে এখন তার হাতে আকাশের চাঁদটা পেয়ে গেছে। তার জীবনে কোন কমতিই নেই। কে বলেছে মেহরাম জীবনে কিছুই পায় নি। পৃথিবীর সব থেকে বড়ো সুখ এখন তার হাতে, তার কোলে আছে। মেহরাম বাচ্চার ছোট ছোট হাত গুলো ছুইয়ে দিলো। বুক টা ফেটে কান্না বের হচ্ছে তার। মেহরামও বলতে পারবে যে এটা আমার মেয়ে। খুশি, কান্না, হাসি সব যেন একসাথে কাজ করছে। ইতোমধ্যে কান্নাও করে দিয়েছে মেহরাম। মেহরাম তার হাত দিয়ে বাচ্চার গাল গুলোতে হাল্কা ভাবে ছুইয়ে দেয়। বাচ্চা হেসে ওঠে মুচকি। তা দেখে মেহরামও কান্নার মাঝেই হেসে ওঠে। ডাক্তার বাইরে বের হয়ে পরে। তারপর সবাইকে বলে যে এখন সবাই দেখা করতে পারে মেহরামের সাথে। আর মেয়ে বাবু হয়েছে। সবার খুশি আর কে দেখে। ছুটে চলে যায় কেবিনে। মেহরামের মা গিয়েই আগে মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বাচ্চা কে কোলে নেয়। এইতো হলো কাজ কেউ যেন আর কারো মাঝে নেই। বাচ্চা কে পেয়ে সবাই খুশিতে দিশেহারা। মেহরাম উকি দিয়ে একটু বাইরে দেখে। তাকিয়ে দেখে যে আয়ুশ সবার পেছনে দুই হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। মেহরাম আয়ুশ বলে ডাক দেয়। আয়ুশ এসে মেহরামের পাশে দাঁড়ায়।

আয়ুশ;; কেমন আছো?

মেহরাম;; আমার মনে হয় না যে এখন আমার থেকে ভালো বা খুশি অন্য কেউ আছে।

আয়ুশ;; এখনো ব্যাথা করছে?

মেহরাম;; একদমই না। তুমি কেমন আছো?

আয়ুশ;; আমি, আরে আমি আবার কেমন থাকবো অনেক ভালো।

মেহরাম;; দুই ব্যাগ রক্ত দিলে অবশ্যই কেউ এতো ভালো থাকে না। শরীর দূর্বল লাগছে না!!

আয়ুশ;; তুমি..

মেহরাম;; আমি জানি।

আয়ুশ আর কিছুই বলে না, মেহরামের হাত ধরে মুচকি হাসে। সবার দিকে তাকিয়ে দেখে তারা এখনো বাচ্চাকেই নিয়ে পরে আছে। তা দেখে মেহরাম আর আয়ুশ হেসে দেয়। তবে এবার আতিয়া গিয়ে তার কোল থেকে আয়ুশের কোলে বাচ্চা কে দিয়ে দেয়। আয়ুশ একবার মেহরামের দিকে তাকায়। মেহরাম মুচকি হাসি দেয়। এবার আয়ুশ বাচ্চা কে কোলে নেয়। তারপর চোখে মুখে যেই হাসি ফুটে ওঠে তার। আয়ুশের মনে হয় না যে এমন খুশি সে তার পুরো জীবনে আর কখনো হয়েছিলো। সবাই সিচুয়েশন টা বুঝতে পেরে মেহরাম আর আয়ুশকে কেবিনে রেখে বাইরে বের হয়ে পরে। আয়ুশ বাচ্চার ছোট ছোট হাত গুলো দেখছে। আয়ুশ গলা টা হাল্কা খাকাড়ি দেয়। মেহরামের কেমন যেন একটু খটকা লাগে মেহরাম আয়ুশের নাম ধরে ডাক দেয়।

মেহরাম;; আয়ুশ..!

আয়ুশ মেহরামের ডাকে মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। মেহরাম অবাক হয়ে যায় আয়ুশকে দেখে। আয়ুশের চোখে পানি এসে পরেছে।

মেহরাম;; আয়ুশ তুমি..

আয়ুশ;; জানো কখনো ভাবি নি যে বাচ্চাকে কোলে নেবো। আমারই বাচ্চা এটা।

মেহরাম কি বলবে খুঁজে পায় না। হঠাৎ করেই মেহরামের মনে হয় যে আজ ঠিক কয় তারিখ। মেহরাম কপাল কুচকে আয়ুশকে বলে ওঠে…

মেহরাম;; আয়ুশ..!

আয়ুশ;; হুমম।

মেহরাম;; আজ কয় তারিখ?

আয়ুশ;; ৮ এপ্রিল

আয়ুশের কথা শুনে মেহরাম হাসে। আয়ুশ বেবি কে নিয়ে খেলছে। একসময় আয়ুশ বেবি কে মেহরামের কোলে দিয়ে দেয়। মেহরাম বাচ্চার মুখের দিকে এক নয়নে তাকিয়ে থাকে। আর আয়ুশ তাদের দুজনের দিকেই। আয়ুশ বলে ওঠে….

আয়ুশ;; মেহরু..!

মেহরাম;; হুমম

আয়ুশ;; ওর নাম কি দিবে?

মেহরাম;; ওর নাম…!!

মেহরাম অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাচ্চার দিকে। সোহেল যখন বেচে ছিলো তখন সোহেল মেহরামকে কিছু কথা বলেছিলো। কথা গুলো মেহরামের কানে এসে বাজছে।

“” মেহরাম আমাদের না খুব সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে বাচ্চা হবে দেখো, ঠিক হুবাহু তোমার মতোন। আর জানো আমি না মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছি। তোমার নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছি। ওর নাম হবে ”মেহের”। আমি জানি নাম টা অনেক সুন্দর””।

মেহরাম সোহেলের বলা এই কথা গুলো ভাবছিলো ঠিক তখনই আবার আয়ুশের ডাকে মেহরামের হুস ফিরে।

আয়ুশ;; মেহরু..

মেহরাম;; হুমমম

আয়ুশ;; ওর নাম কি হবে??

মেহরাম আবার তার মেয়ের দিকে তাকায়। আর মেহরাম এখন আয়ুশকে আজকের তারিখের কথা জিজ্ঞেস করেছে। কারণ আজ ৮ এপ্রিল৷ আজ তনুর জন্মদিন। কি মিল তাই না। আজ তনুর জন্মদিন আর আজই মেহরামের মেয়ে জন্ম নিলো। মনে হচ্ছে তনু হয়তো আবার মেহরামের মেয়ের মাঝেই জন্ম নিয়ে নিয়েছে। আজ তনুর জন্মদিন।
মেহরাম তার মেয়েকে আরো কিছুটা আগলে নিয়ে বলে ওঠে..

মেহরাম;; ওর নাম হবে “” তনু আফরোজা মেহের “”।

এই বলেই মেহরাম তার মেয়ের কপালে অর্থাৎ মেহেরের কপালে চুমু একে দেয়। এবার মেহরাম আয়ুশের দিকে আর আয়ুশ মেহরামের দিকে তাকায়। হেসে দেয়। আর সাথে মুচকি হেসে ওঠে ছোট্ট প্রাণ মেহেরও ❤️।





🍂চলবে~~

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ৩৬

🌹~~

মেহরাম কে তার ডেলিভারির একদিন পরে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। অর্থাৎ ডেলিভারির দিন এবং তার পরের দিন হস্পিটালে থাকতে হয়েছে তাকে। তবে বাচ্চা অনবরত কেদেই চলেছে ক্ষিদায়। এখন এই নবজাতক শিশুকে ডাক্তার তো মায়ের বুকের দুধ ছাড়া আর কিছু খাওয়ানোর জন্য সাজেস্ট করবেন না। এই নিয়ে হলো আরেক বিপদ। মায়ের বুকে দুধ নেই এখন বাচ্চা খাবে কি। ক্ষুদায় জ্বালায় যে পরিমাণে কান্না করছিলো এতে হস্পিটালের জানালার কাচ গুলো যেন ফেটে পরার উপক্রম হয়ে গিয়েছিলো। কেউই নিয়ে শান্ত করাতে পারছিলো না। অবশেষে আর কোন উপায় না পেয়ে বাইরের লিকুইড দুধ খাওয়াতে হয়েছে। মুখে দেবার সাথে সাথে খাবার উধাও, যেন কত্তো ক্ষিদে তার পেটে লুকিয়ে ছিলো। মেহরামের চাচি বাচ্চা কে খাইয়ে দেয়। আজ সকাল বেলাই হস্পিটাল থেকে রিলিজ করে দিয়েছে মেহরাম কে। হাতের ওপরে এখনো একটু ব্যান্ডেজ করা। পেটের দিকে হাল্কা ব্যাথা হয় কিন্তু এটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। আয়ুশ, মেহরামের মা কনিকা আর লায়লা খাতুন গিয়েছিলো মেহরাম কে হস্পিটাল থেকে আনতে। হস্পিটাল থেকে সবকিছু গাড়িতে করে নিয়ে এসে পরেছে। লায়লা খাতুনের কোলে মেহের, সে ঘুম আর ঘুমের মাঝেই সে ছোট্ট আঙুল গুলো চুষছে। মেহরামের মা মেহরামের সব কিছু নিয়ে বাড়ির ভেতরে আস্তে আস্তে যাচ্ছে। মেহরাম গাড়ি থেকে নামলে তার এক হাত আয়ুশ ধরে, নিজের আরেক হাত মেহরাম তার পেটে ধরে রেখেছে। কণা মেহরাম দের বাড়িতেই রয়েছে। গাড়ির শব্দ পেয়ে তাদের বুঝতে আর বাকি রইলো না যে মেহরাম এসে পরেছে। দ্রুত বাড়ির ভেতর থেকে কণা আর আতিয়া বাইরে আসে। কণা তো এসেই মেহের কে কোলে তুলে নেয়। খুশিতে গদগদ যাকে বলে আর কি। আতিয়া গিয়ে এক গাল হেসে মেহরাম কে আরেক দিক দিয়ে ধরে। আস্তে আস্তে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। মেহরাম বাড়ির সোফার ওপর বসে পরে। সবার মাঝে যেন খুশি ঢলে পরলে। তবে আয়ুশ খেয়াল করলো যে এতো কিছুর মাঝেও মেহরামের মন টা কেমন যেন খারাপ খারাপ ভাব। আয়ুশ মেহরাম কে জিজ্ঞেস করে….

আয়ুশ;; মেহরাম, কি হয়েছে। ভালো লাগছে না শরীর??

মেহরাম;; আমি ভাবছি।

আয়ুশ;; কি?

মেহরাম;; মাঝ খানে অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছে। তো এতে তো এমনিতেই বোঝা যায় যে ডেলিভারি হয়ে গেছে। আমার মেয়ে টা হলো। কিন্তু তবুও সোহেলের মা একটা বার দেখতে পর্যন্ত আসলো না। দেখতে আসা তো দূর একটা বার ফোন করে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন অব্দি মনে করলো না।

মেহরামের এমন কথা শুনে সচারাচর সবারই একটু খারাপ লাগলো। আর তখন মেহরামের মন ভালো করার জন্য লায়লা খাতুন বলে উঠলেন…

লায়লা;; কেন, সোহেলের মায়ের জানতে হবে কেন। উনি তো নিজেই সব কিছুর মায়া ছিন্ন করে দিয়েছেন। আর আমি কি একা যথেষ্ট নই নাকি। আমাকে পছন্দ হয় না।

মেহরাম কিছুটা শব্দ করেই হেসে দিলো সাথে বাকিরাও।

মেহরাম;; আবার জিগায়, পছন্দ নাকি হবে না। খালামনি কি যে বলো না।

লায়লা;; এই যে দিলে তো মুড টা নষ্ট করে। আরেকবার খালামনি ডাকলে খবর আছে।

মেহরাম;; মানুষের একটা মা থাকে আমার তিন তিনটা।

সবাই হাসছিলো তবে এর মধ্যে মেহের কেদে ওঠে। মানে মনে হয় সবার এই হাসি হাসি মুখ টা তার আর ভালো লাগলো না তাই দিলো কেদে। হয়তো ক্ষিদে পেয়েছে। মেহরামের মা কনিকা গিয়ে কোলে নেয় তারপর খাইয়ে দেয়। এখনো তাকে বাইরের লিকুইড দুধই খাওয়ানো হয়। কারণ মায়ের বুকে দুধ এসে সারে নি। আর এছাড়াও মেহরামের বডিতে ব্লাড দেওয়া হয়েছে। সেটারও তো বডির সাথে খাপ খেতে কিছুদিন দরকার। তাই ডক্টরের পরামর্শেই এমন টা করা হয়েছে। মেহের কে কনিকা খাইয়ে দিচ্ছে আর অনেক গল্প করছে। মেহরাম তার দিকে তাকিয়ে আছে। মা কে দেখতে পেয়েই হেসে দেয়। মেহরাম মেহেরের দিকে তাকিয়েই ক্ষীণ দম ছেড়ে হেসে দেয়। মেহরাম পাশে তাকিয়ে দেখে আয়ুশও মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ুশ মেহরামের বাম হাতের ভাজে আলতো করে নিজের হাত রেখে দেয়। মেহরাম মুচকি হাসে। আয়ুশ তার মুখের কাছে নিয়ে হাতের উলটো পাশে চুমু আকে।
এভাবেই দিন যেতে থাকে। মেহরাম এখন অনেক টাই সুস্থ। হাটাচলা করতে পারে আগের মতোই। সারাদিন মেয়েকে নিয়েই কেটে যায় বেলা গুলো। বাড়ির সবার চোখের মনি মেহের। সারাক্ষণ সবার কোলে কোলেই থাকে। বাড়ি যেন আলো করে এসেছে। সারাক্ষণ মেতেই থাকে। কণা তো এখন পারে না এই বাসাতেই থেকে যেতে। হুট হাট এসে পরে শুধু এই মেহেরের জন্যই। এখন সবাই বোঝে যে বাড়িতে একটা ছোট্ট বাচ্চা থাকলে সেই বাড়ির রুপ আপনা আপনিই পালটে যায়। ইদানীং মেহরামের মাঝেও অনেক টা চেঞ্জ এসেছে। আর এটা সবার নজরেই বাধে। কেমন একটা মা মা ফিলিংস। এখন আর মেহের কে বাইরের লিকুইড দুধ খাওয়ানো হয় না। মেহরামই দুধ ফিডিং করায়। আকাশ তো ছোট। কিন্তু মেহের কে নেবার জন্য তার কি জেদ। মেহরামের সাথে এক প্রকার ঝগড়া লাগিয়ে দেয় মেহের কে নেবার জন্য। বাকি সবাই না করলেও কে শোনে কার কথা। যখন আতিয়া আকাশ কে বকতে শুরু করে দিলো তখন আর না পেয়ে মেহরাম নিজেই থামিয়ে দিলো। আকাশ কে নিজের পাশে বসিয়ে আস্তে করে মেহের কে তার কোলে দেয়। আকাশের সে কি খুশি। মেহেরও নিজের মামার কোলে গিয়ে হাসছে। তবে এভাবেই কিছুক্ষণ থাকতে থাকতে আকাশ নিজেই কান্না করে দেয়, মেহের আর কি কানবে। মেহরাম তো অবাক হয়ে যায়। কি হয়েছে জানতে চাইলেই আকাশ বলে মেহের হিশু করে দিয়েছে তার কোলে। আকাশের এমন কথায় সবাই যেন হাসিতে ফেটে পরলো। আতিয়া শুধু আকাশ কে চেতাচ্ছে যে সে তো আগেই মানা করেছিলো কিন্তু ত্যাড়ামি করে কোলে নিয়েছে এখন বুঝুক ঠ্যালা। মেহরাম মেহের কে কোলে নিয়ে নেয় আর আকাশ কানতে কানতে ওয়াসরুমে চলে যায়।

দিন যেতে যেতে পার হয় যায় এক সপ্তাহ। মেহের আস্তে আস্তে বড়ো হচ্ছে। তবে বাড়িতে এতো গুলো মানুষের মাঝে একটা মাত্র বাচ্চা থাকলে যা হয় আরকি। আদরবে কমতি নেই। এই টুকু বয়সেই তার কাপড়ের যেন অভাব নেই। মেহেরের আসার পর থেকে মেহরামের জীবনের পুরো নকশাই উলোট পালোট হয়ে গেছে। কাবার্ডে মেহরামের নিজের থেকে মেয়ের জামা কাপড় বেশি। কাপড় এক প্রকার এদিক সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। মেহরাম মাঝে মাঝে ভাবে যে তার মেয়ে যে এতো গোলুমোলু হবে সে ভাবেও নি। মেহেরের ওজন ৫ কেজি। হয়েছে এক সপ্তাহ হলো এখনোই ৫ কেজি। মুখ দেখলে কেউ ভাববে যে অনেক রেগে আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে হুট করেই এমন এক হাসি দেয়। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় মেয়ে কে নিয়ে মেহরামের। এখনই এই দশা যখন আরেকটু বড়ো হবে বা হাটতে শিখবে তখন পাগল বানিয়ে দিবে। এখন মেয়েকে বিছানার ওপর শুইয়ে দিয়ে মেহরাম তার সামনে দু হাত ভাজ করে চিন্তা মাখা মুখ বানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ মেহের কে ডায়পার পরাতে হবে। আরেক যুদ্ধ। পা নড়াচড়া করে অনেক। এক পা ভেতরে দিলে আরেক পা বাইরে বের করে ফেলে সেই ফাকে। এখনো তার ব্যাতিক্রম না, মেহরাম ডায়পার পরানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। হাপিয়ে গিয়েছে। আর উপায় না পেয়ে মেহরাম ডায়পার না পরিয়েই তা হাতে করে নিয়ে নেয়। তারপর মেহের কে নিয়ে নিচে নেমে পরে। নিচে যে যার কাজ করছিলো তখনই মেহরাম নেমে আসে আর মেহরাম কে এমন পাগল পাগল অবস্থায় দেখে আতিয়া বলে ওঠে…

আতিয়া;; কিরে কি হয়েছে। এই অবস্থা কেন?

মেহরাম;; আমি আর পারবো না। এই যে ডায়পার আর এই যে ডায়পারের মালিক। পরাও তুমি। আল্লাহ জীবন শেষ আমার।

আতিয়া;; হেহ কি ভাবছো ময়না একটা বাচ্চা মানুষ করা মুখের কথা। জীবন তামা তামা করে দিবো। আর মেহের তো বড়োই হয়নি এখনই এই অবস্থা আর বাকি দিন গুলো তো পরেই আছে তখন কি করবি তুই।

মেহরাম;; তোমরা সবাই আছো না আমার আর চিন্তা কিসের।

কনিকা;; হ্যাঁ হ্যাঁ ওই আমরা থেকেই রক্ষা বুঝলা নইলে তুমি মেহরাম এতোদিনে পাবনা থাকতা।

মেহরাম;; আচ্ছা হইছে বুঝলাম এখন ওকে দেখো।

কনিকা হাতের কাজ ছেড়ে মেহের কে কোলে নিয়ে নেয়। নানু আপুর কাছে গেতেই তার কি খুশি। কনিকা সুন্দর করে ডায়পা পরিয়ে দিলো মেহের কে।

তবে আগে তো মেহরাম রাতে ঘুমাতে পারতো না, পারতো না বলতে ঘুম আসতো না কিন্তু এখন তো আর পেটে বেবি নেই। এখন রাতে ঘুমে একদম পরে যায় কিন্তু তবুও ঘুমাতে পারে কারণ মেহের। এই হুট করে ক্ষিদে লাগছে, আবার ঘুম আসছে না, আবার কান্না শুরু। আহহহ, মায়েদের জীবন। মেয়েকে ঘুম পারাতে গিয়ে মাঝে মাঝে নিজেই ঘুমিয়ে পরে কিন্তু মেয়ের চিৎকার শুনে বেজে যায় ঘুমের বারো টা। মেহরামের মন চায় মাঝে মাঝে মেহেরের সাথে নিজেরও কেদে দিতে। কিন্তু তা তো আর পারে না। এখনও তাই মেয়ে কে নিয়ে করিডরে ঘুরছে আর মেয়ে আরামে ঘুমিয়ে পরেছে। হঠাৎ মেহরামের ফোন বেজে যায়। এইতো কাজ হলো। কি কষ্টে মেয়েকে ঘুম পারিয়েছিলো এই ফোনের শব্দে মেহের আবার কেদে দেয়। তার ঘুম অনেক বেশি পাতলা। মেহরাম দ্রুত গিয়ে ফোন তুলে। দেখে আয়ুশের ফোন, মেহরাম হাবলা হয়ে যায়। রাগ করবে নাকি নিজে কেদে দিবে খুঁজে পায় না। ফোন টা কানে ধরে আবার মেয়েকে ঘুম পাতানোর চেষ্টা করে। এদিকে আস্তে আস্তে কথাও বলছে।

মেহরাম;; হুম

আয়ুশ;; কি করো?

মেহরাম;; হুম

আয়ুশ;; খেয়েছো রাতে আর মেহের কোথায়?

মেহরাম;; হুম

আয়ুশ;; কি সেই কখন থেকে হুম হুম করছো কি হয়েছে?

মেহরাম;; হুম

আয়ুশ;; মেহরাম

মেহরাম;; আরে মেহের ঘুমাচ্ছে আমার কাধেই আছে এখন জোরে কথা বললে ঘুম ভেংে যাবে এমনিতেই তুমি প্রায় ওর ঘুম ভাংিয়ে দিয়েছিলে।

আয়ুশ;; ওহহ আচ্ছা। এখন ঘুমিয়েছে?

মেহরাম;; হ্যাঁ ঘুমিয়েছে দাড়াও একটু।

মেহরাম ফোন টা হোল্ডে রেখে মেহের কে শুইয়ে দেয় ঠিকঠাক ভাবে। তারপর আবার কানে ফোন নিয়ে কথা বলতে থাকে।

মেহরাম;; হ্যাঁ হ্যালো

আয়ুশ;; হুম আছি

মেহরাম;; ওকে শুইয়ে দিলাম।

আয়ুশ;; কি করো?

মেহরাম;; নিজেও জানি না কি করি। এতোক্ষণ ঘুমে ঢলে পরছিলাম কিন্তু এখন ঘুম এমনিতেই চলে গেলো। আর তুমি এখনো জেগে আছো যে?

আয়ুশ;; না এমনি। আচ্ছা শুনো তোমার আর মেহেরের কিছু পিক দাও তো আর একসাথেই দিবে।

মেহরাম;; আচ্ছা ওয়েট।

মেহরাম গিয়ে মেহেরের পাশে কিছুটে ঝুকে পরে। তারপর ফটাফট মা & মেয়ের কয়েকটা সেলফি তুলে ফেলে সেগুলো আয়ুশকে পাঠিয়ে দেয়। আয়ুশ আবার ফোন দেয়।

মেহরাম;; পেয়েছো?

আয়ুশ;; হ্যাঁ পেয়েছি। আমার মেয়ে বেশি সুন্দর তোমাকে পেত্নী পেত্নী লাগে কেমন জানি।

মেহরাম;; এহহহহহ আইছে রে নিজের দিকে দেখছো একবার ছাগল কোথাকার একটা।

আয়ুশ;; ওইই ভার্সিটির মেয়েরা মরতো আমার ওপর ওকে।

মেহরাম;; এখন আমি তোমাকে মাইরা ফালাই 🙂।

আয়ুশ;; মজা করছি তো বাবা ক্ষেপো কেনো?

মেহরাম;; হেহ ভার্সিটির মেয়েরা মরতো আমার ওপর (বেংগ করে) হেই লিসেন ওটা ভার্সিটি লাইফ ছিলো ওকে। অনেক বছর আগের কাহিনী এখন টেনে এনো না অযথা।

আয়ুশ;; তো তুমি এখন কি বলতে চাচ্ছো। আমি এখনো বের হলে মেয়েরা তাকিয়ে থাকবে। আমি তেমনই। আর অফিসের সব মেয়ে স্টাফরা তো ড্যাবড্যাব করে তাকায় আমার দিকে।

মেহরাম;; তো যাও না ওইসব মেয়েদের কাছেই যাও এখানে কি করো। আমি রাখলাম আমার মেয়ে আছে বায়।

আয়ুশ;; এই না না না না না। আরে মজা করছি তো। আচ্ছা সরি সরি।

মেহরাম;; মা কোথায় আর কণা?

আয়ুশ;; মা ঘুম আর কণাও হয়তো ঘুম। ওহ হ্যাঁ বলতেই ভুলে গেছি। কাল মা আসছে তোমার কাছে।

মেহরাম;; তুমি আসবে না?

আয়ুশ;; না মানে আসলে আমার তো একটু কাজ আছে।

মেহরাম;; হ্যাঁ কাজ নিয়েই থাকো। আমাকে দিয়ে আর কি করবে।

আয়ুশ;; হ্যাঁ যেখানে নিজের জীবন আটকে আছে সেই কিনা বলছে যে আমাকে দিয়ে কি করবে। এইতো আর কিছুদিন তখন বললেও বাইরে যাবো না।

মেহরাম;; হ্যাঁ হয়েছে।

আয়ুশ;; এইযে শুনেন আমার চাপাবাজ আপনার চাপার জোরে তো আর কিছু পারবো না। তো এখন কথা হচ্ছে রাত অনেক হয়েছে। মেয়ে ঘুমিয়ে পরেছে আর আপনিও ঘুমান। আমিও ঘুমাবো।

মেহরাম;; আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।

আয়ুশ;; আল্লাহ হাফেজ।

মেহরাম ফোন কেটে দিয়ে মেহেরের পাশে শুয়ে পরে। আয়ুশও মেহরামের দেওয়া ছবি গুলো জুম করে করে দেখছে আর হাসছে। মেয়ের কপালে-গালে চুমু দিয়ে ঘুমিয়ে পরে মেহরাম।





💞চলবে~~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে