তৃণকান্তা পর্ব-০৭

0
1076

তৃণকান্তা
পর্ব : ৭
– নিশি রাত্রি

খাবার টেবিলে বসে বারবার আশেপাশে তাকাচ্ছে আমিন। সকাল থেকেই মাইশাকে একটা বারের জন্যও কোথাও দেখতে পাননি তিনি । ছেলেমেয়েদের ছাড়া ঘরটা কেমন যেনো শূণ্য শূণ্য লাগছে । সেদিন মায়ের সাথে রাগ করে সন্ধ্যায় বাসা থেকে চলে যায় মেঘা আর বৃষ্টি । এটাই ছিলো রাহেলার জন্য মূখ্যম জবাব । নিজের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শোধরানোর বদলে তিলে তিলে শেষ করতে চাইছিলো মেয়েটাকে। এমন চলতে থাকলে মা সমাজ থেকে একটা সময় মাইশার বিশ্বাস হারিয়ে যেতো। যে মা মানেই শান্তি। শুনেছি যা করে আল্লাহ ভালোর জন্যই করে। হয়তো সত্যটা জানার দরকার ছিলো বলেই সত্যের মুখোমুখি হয়েছে মাইশা। তবে তিনি তার দায়িত্বে বিন্দুমাত্রও কার্পূণ্যতা করবেন না।
খুব শীগ্রই ভালো একটা ছেলে দেখে তার হাতে মাইশাকে তুলে দিতে পারলেই তিনি নিশ্চিত হতে পারবেন। রাহেলা আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে। তাকে মাইশার কথা জিজ্ঞাসা করলেই একটা ট্যারা জবাব দিবে। যা শুনার কোনো ইচ্ছেই এই মূহুর্তে আমিন সাহেবের নেই। চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়াটাই তার কাছে শ্রেয় মনে হলো। তাকে আবার একটু দরকারী কাজে বের হতে হবে।

তূর্যের মুখ থেকে সব শুনে স্তব্ধ হয়ে আছে আশা। এতোটুকু একটা মেয়ে কতোবড় একটা সত্যের মুখোমুখি হয়েছে ভাবতেই বুকটা কেমন ধুকপুক করে উঠে। মাইশার চিন্তাধারা দেখেও কম অবাক হয়নি আশা। আমাদের সমাজে এতিম মানুষের স্থানটা কোথায় সেটা আমাদের কারোরই অজানা নয়। এতিম মানেই জঞ্জাল মনে করে সমাজ। আজকাল এতিমদের জায়গা এতিমখানা ছাড়া আর কারো ঘরে হয় না। বিভিন্ন স্টেশন, লঞ্চঘাট, ট্রেন স্টেশনে কতো ছোট ছোট এতিম মিসকিন কাজ করে বেরায়। নিজের শরীরের চেয়েও বেশি ভার বহন করে কতো কাজ করছে শুধুমাত্র পেটের টানে। সেখানে একজন এতিমকে পূত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে ক’জন শ্বাশুড়িই বা চায়! তাই সে আগে থেকেই নিজেকে আঁড়াল করে নিতে চেয়েছে। কিন্তু তূর্যের জন্য সম্ভব হয়ে উঠেনি। ঠিক ধরে এনেছে তাকে।
তূর্য! তূর্যের এমন সাজানো গুছানো জীবনটা একজন মা হয়ে কিভাবে সে নিজ হাতে নষ্ট করে দিবে? কতোদিন পর ছেলের কপাল থেকে চিন্তার রেখাটা মুছেছে। মুখে একটু হাসি ফুটেছে। মাইশাকে হারিয়ে প্রায় আধমরা হয়ে গিয়েছিলো তূর্য। কোনো কিছুতেই তার মন বসে না। মুখে কোনো হাসি নেই । সারাক্ষণ কেমন যেনো চুপচাপ । কিন্তু আজ বেশ স্বাভাবিক লাগছে। কোন মা ই তার সন্তানের মুখের হাসি কেড়ে নিতে চায়? কিন্তু সমাজ বলেও তো একটা কথা আছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে তূর্য মাইশা আর তুম্পাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। তুম্পাকে একটা রিক্সা ঠিক করে দিয়ে দুজন মিলে বাইকে উঠে পরলো। বাইক চলছে তার নিজস্ব গতিতে। তূর্য বারবার লুকিংগ্লাসে মাইশাকে দেখছে। তূর্যের কেনো জানি মনেহচ্ছে মাইশা আবার পালাবে। তার অবচেতন মন বারবার এটাই কেনো ভাবছে? সেটা কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছে না তূর্য। তবে কি সত্যিই এমন কিছু হতে চলেছে?

আজ তিহান আর তাহিয়ার আক্দ। সকাল থেকেই বেশ স্বাভাবিক ছিলেন রহিম মাষ্টার। কিন্তু বিপত্তি টা বাঁধালেন ঠিক বিয়ের আগের মূহুর্তে। তিনি খুব ভদ্র ভাষায় যৌতুকের দাবিটা প্রকাশ করলেন। পানের খিলিটা মুখে দিতে দিতে রহিম মাষ্টার বললো,
– আজকাল কি আর ছেলের বাবা কিছু চাওয়া লাগে নাকি। বিয়ের পরদিন দেখা যায় ট্রাক ভর্তি ফার্নিচার ছেলের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার বেয়াই মশাইয়েরও কম কিসে? সেও নিশ্চয়ই তার থেকে কম কিছু দিবেন না।
যৌতুকের ইঙ্গিতটা বুঝতে এতোটুকুও দেরি হলোনা ফারুক সাহেবের। তাহিয়ার বাবা ফারুক সাহেবও কম কিসে। তিনিও মেয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– তা তো অবশ্যই। মেয়ের সুখই তো চাই। বেয়াই সাহেব তার পূত্রবধূকে নিশ্চয়ই ঠকাবে না।
এতোক্ষণে টনক নড়লো রহিম মাষ্টারের। সম্মানের দিকে তাকিয়ে বাকি সময়টা তিনি চুপচাপ ছিলেন। বিয়ের আগের মূহুর্তে কাজী সাহেব যখন বললো,
– বিয়ের কাবিন কতো হবে?
ফারুক সাহেব হেসে বললেন,
– আরে কাজী সাহেব তা এতো কি জিজ্ঞাসা করছেন? বেয়াই সাহেব নিশ্চয় তার পূত্রবধূকে ঠকাবে না।
সম্মান বাঁচিয়ে রাখতে তিনিও বড় মুখ করে বললেন,
– হ্যাঁ। লিখেন পাঁচ লক্ষ।
ব্যাস! পাঁচ লক্ষ টাকার কাবিন করে দুটো মানব পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ট বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলো। বিয়ে হয়ে গেলো তিহান আর তাহিয়ার। বিয়ের পর কোনোরকম বিদায় নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো রহিম। বিয়ে হয়ে গেলেও বউকে আজকে উঠিয়ে দিবে না ফারুক সেটা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। একেবারে অনুষ্টান করেই তার মেয়েকে বিদায় দিবে। তাই বর সহ সবাই বাসায় ফিরে গেলো । তবে তিহান আজ খুব খুশি । অনেক সাধনার ফল তাহিয়াকে পেয়েছে সে । সেই পাঁচবছরের সম্পর্ককে আজ একটা নতুন পরিচয়ে পরিচিতো করে তুলেছে দুজন। বাসায় এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর তুমুল তুলকালাম করে বসলেন । রাগে তার শরীর কাঁপছে। পুরো বাড়ি চেঁচিয়ে মাথা তুলে রহিম। বাসায় ফিরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো তিহান। রাত জেগে প্রেম করে এখন দিনের বেলা ঘুমানোর একটা বদ অভ্যাস হয়ে গেছে তার। ড্রইংরুমে চেঁচামেচি শুনেই ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। বাবা মায়ের কণ্ঠ শুনে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো তিহান। তার বাবা মা দুজন কি নিয়ে যেনো ঝগড়া করছে।
– তোমার আশকাড়া পেয়ে পেয়ে আজ এই অবস্থা হয়েছে তোমার ছেলের।
– ও এখন আর দোষ?
– তোমার দোষ না তো কি আমার দোষ? এতো কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া করাইছি কি একটা ফকিরের মেয়েকে বউ করার জন্য?
– এখন ওরা ফকির? বিয়ের কাবিন পাঁচ লাখ করছে বলে ওরা ফকির? তুমি যে একজন মাষ্টার হয়ে যৌতুকের দাবি করলা ওইটা কি? ওদের মেয়েটাকে যে এতো লেখাপড়া করাইছে ওদের তো কোনো খরচ হয়নাই না? মেয়ের বাপ মা হইছে বলে কপাল পুড়ছে ওদের? বিয়ের আগ পর্যন্ত খাওয়াই দাওয়াই বড় করছে আবার বিয়ের সময় তোমাকে কাড়ি কাড়ি যৌতুক দিয়ে দিবে?
কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় রহিম। পাশে তাকাতেই দেখলো তিহান দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সব কথাই শুনেছে তিহান। তিহান এক পা দু’পা করে সামনে এসে বললো,
– বাবা তাহিয়া কোনো ফকিরের মেয়ে নয়। ও যথেষ্ট বড়লোক আর একটা ভদ্র ফ্যামিলির মেয়ে। তুমি যে একজন শিক্ষক তার বিন্দুমাত্র আলোও আমি তোমার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না। তুমিতো টাকার পাহাড় ছাড়া আর কিছুই বুঝো না। টাকার বিনিমনে ওদের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়ার মতো ছেলে নই। তুমি যেমন তোমার বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে যৌতুকের কথাটা বলেছো ওনিও তার বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েই কাবিনটা এতো টাকা করেছে। এতো চেঁচামেচি করার কিছুই হয় নি। তোমার কপাল ভালো যে বিয়েটা ওরা ভেঙ্গে দেয়নি। বলেই হনহনিয়ে রুমের ভিতর চলে গেলো তিহান।

ওয়াশরুমে ঝর্ণাধারার নিচে বসে মাইশা বারবার ভাবছে এটা কি হয়ে গেলো?
চলবে… !

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে