তৃণকান্তা পর্ব-০২

0
1729

তৃণকান্তা
পর্ব : ২
– নিশি রাত্রি

তূর্যকে এমন দিশেহারা দেখে তিহান বললো,
– গার্লফ্রেন্ড?
– না আপনার হবু বউ।
– এ্যা!
– হ্যাঁ।
তূর্যের কথা শুনে এবং তাকে দেখে তিহানের কাছে কেমন যেনো ভাবলেশহীন লাগছে তাকে।আবার লোকটাকে পাগল পাগলও মনে হচ্ছে।ডেকে এনে কিছুই বলছেনা। অথচ নিজ কাজে ব্যস্ত।এমন অদ্ভুত ও মানুষ হয়? জীবনে প্রেম করলোনা কিন্তু হবু বউ পর্যন্ত গড়িয়ে নিয়ে গেলো লোকটা? কে এই লোক? তাকেই বা চিনলো কি করে? কিছুতেই বুঝতে পারছেনা তূর্য।

তিহান বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।একমাত্র সন্তান হওয়ার যন্ত্রণা যে ঠিক কতোটা সেটা তারাই বুঝতে পারে যারা তার মতো অবস্থানে আছে। একমাত্র সন্তানের জন্য বাবা মায়ের ভয়টা যেনো চলার পথে প্রতিটা পদে পদে। টাইম টু টাইম কি করছে, কি খাচ্ছে সব কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে মাকে কখনো বাবাকেও। মাঝেমধ্যে খুব বিরক্তি লাগে তিহানের। এতোবড় ছেলে হয়েও এতো জবাবদিহিতা ভালোলাগে? কিন্তু মায়ের মুখটা দেখার পরই সব রাগ কেমন যেনো মেঘের ন্যায় হারিয়ে যায়। তিহানের দাদাভাইয়ের একমাত্র সন্তান তার বাবা রহিম মাষ্টার।আর রহিম মাষ্টারের একমাত্র ছেলে তিহান। শুনে অদ্ভুত লাগছে না? হ্যাঁ এটাই হয়েছে তার ফ্যামিলিতে।
না বাবার কোনো বোন ছিলো আর না তার আছে। আগে মমাষ্টারি করলেও এখন রিটায়ার করে একটা ফ্রিজের শোরুম দিয়েছিলেন। বিন্দু বিন্দু পরিশ্রমের কারনে সেই একটা থেকে আজ তিনটা শোরুমের মালিক তিনি। লেখাপড়ার পাশাপাশি একটা শোরুমে বসছে তিহান। দাদা দাদি মারা যাবার পর মা বড্ড একা হয়ে যায়। তিহান তখন সবেমাত্র অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বাবা আর ছেলে দিনের বেশিরভাগ সময়ই শোরুমে কাটাচ্ছে। বাড়িতে একা মা। কিন্তু ইদানিং অসুস্থ হয়ে পড়েছে তিনি। একদিন সুস্থ তো পরেরদিন অসুস্থ। আজ প্রেশারে সমস্যা, কাল বুকে ব্যাথা, তো পরদিন পিঠে ব্যাথা। এমনিই কাটছে দিন। দিন শেষে ঘরে ফিরতেই মায়ের কোঁকানো শব্দ শুনতে পায় তিহান। এইসবের মধ্যে দিয়েই সময় পার করছে তিহান। আজ শুক্রবার। শোরুমের নতুন মাল এসেছে। কর্মচারীরা সেগুলো ঠিক ভাবে গুছিয়ে রেখেছে কিনা তা দেখতেই একবার শোরুমে ঢু মারতে এসেছিলো। সব দেখে বেরিয়ে আসার ঠিক আগের মূহুর্তেই তিহানের মোবাইলটা বেজে উঠলো।স্ক্রিনে অপরিচিতো একটা নাম্বার।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শুনা গেলো,
– আপনি কি তিহান আহমেদ বলছেন?
– জি বলছি। আপনি কে বলছেন?
– আমি তূর্য বলছি। আমাকে আপনি চিনবেন না। আপনার সাথে একটু জরুরি কথা ছিলো। আমরা কি কোথাও দেখা করতে পারি? আপনাকে আসতে হবেনা। আপনি কোথায় আছেন বলুন আমি এক্ষুণি আসছি।
তিহানের কাছে তূর্যের ফোনটা যেনো উটকো ঝামেলা মনেহলো।আশেপাশে তাকিয়ে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বললো,
– আপনি কি রেডওয়ান রেস্টুরেন্ট চিনেন?
– জি চিনি।আমি কি ওখানটায় আসবো?
– হ্যাঁ আসুন।তবে খুব তাড়াতাড়ি। আমার কাজ আছে।
– ওকে আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাচ্ছি।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রেডওয়ান রেস্টুরেন্টের সামনে পৌঁছে গেলো তূর্য। রেস্টুরেন্টের সামনেই একজন যুবক দাঁড়িয়ে বারবার আশেপাশে তাকাচ্ছে। তূর্য লোকটির সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
– তিহান সাহেব?
– জি। তূর্য?
– হুম।
বলে হ্যান্ডশ্যাক করে নেয় দুজন। তূর্য হাসিমুখে বললো,
– আমরা একটু বসে কথা বলি? যাস্ট টেন মিনিটস?
– ইয়াহ শিয়র।

সেই যে বসেছে তিহান। কিন্তু তূর্য কিছুতো বলছেই না শুধু ফোন টিপছে। এবার কিছুটা বিরক্ত হলো তিহান।এভাবে ডেকে এনে বসিয়ে রাখার মানে কি? ফোনটা পাশে রেখে এবার মুখ তুলে তিহানের দিকে তাকালো তূর্য। তিহানের বিরক্তিকর ভাবটা চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। তা দেখে তূর্য বললো,
– আপনি মাইশার সম্পর্কে কতোটুকু জানেন?
– সরি? হো ইজ মাইশা?
তূর্য কিছুটা হেসে বললো,
– ভারী আশ্চর্য তো। যাকে দেখতে যাচ্ছেন তার নামই জানেন না?
– আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা। আপনি কে? হঠাৎ করে কেনো-ইবা ডেকে আনলেন? আর এই মাইশাটাই বা কে?
তূর্য মোবাইল থেকে মাইশার একটা ছবি বের করে তিহানের মুখোমুখি ধরলো।
– এই হলো মাইশা।যাকে আজ দুপুরের পর আপনি এবং আপনার ফ্যামিলি দেখতে যাচ্ছেন।
– ও। কিন্তু আমি এইসবের কিছুই জানিনা।
– চিনেন আপনি?
এবার ভালোভাবে ছবিটাকে লক্ষ্য করলো তিহান।ছবিটা ভালোভাবে দেখেই ওর গলা শুকিয়ে আসছে। সাথে সাথেই দুইমাস আগে রেস্টুরেন্টের কথাটা মনে পড়ে গেলো। আনমনে হাতটা চলে গেলো প্যান্টের পকেটের উপর।পাঁচটা হাজার টাকা। তিহানকে এমন বিব্রত দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় তূর্য। তূর্যের তাকানো দৃষ্টিতে বেশ কৌতুহল আর তিহানের দৃষ্টিতে ভয়।
তারমধ্যেই ওয়েটার এগিয়ে এলো।টেবিলে মেনুকার্ড রাখতেই তিহান বললো,
– আমি কিছু খাবোনা।
– একটা কফি।
ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলো। তিহানের মুখটা ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে আছে। তা দেখে
তূর্য বললো,
– এনি প্রবলেম?
একটা ঢোক গিলে তিহান বললো,
– আপনি কে বলেন তো?
– আমি তূর্য।মাইশার লাভার।
– এই মেয়েটা আপনার লাভার?
– হুম। কেনো?
– আপনি ঠিক আছেন তো ভাই?
বলে তূর্যের কপালে আর গলায় হাত রেখে,
টেম্পারেচারতো স্বাভাবিক লাগছে।
ভ্রু কুঁচকে সন্দেহ ভাবে তাকিয়ে রইলো তূর্য।রেস্টুরেন্টের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ তাকিয়ে আছে তাদের দুজনের দিকে।
– কি করছেন কি আপনি? সবাই তাকিয়ে আছে।
– আপনার গার্লফ্রেন্ড আপনারই থাক ভাই। একে আমার প্রয়োজন নাই। আমরা কেউ ওই মেয়ের বাসায় যাচ্ছিনা।
বলে তড়িঘড়ি করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো তিহান। তিহানের চলে যাওয়া দেখে অনেকটা বোবাবনে তূর্য।
আশ্চর্য তো! মাইশার ছবি দেখাতেই কি হয়ে গেলো ছেলেটার? তূর্য মনেমনে ভাবলো,
যাক ভালোই হয়েছে।কাজ তো হয়ে গেছে। মনেমনে একটা ধন্যবাদ দিলো আহসানকে।

মাইশাকে বাসার কাছে নামিয়ে দিয়ে বাইক নিয়ে তুম্পার বাসার উদ্দ্যেশে বেরিয়ে পড়ে তূর্য। তুম্পা হলো মাইশার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড। তুম্পার বাবা নেই বলে মাইশার বাবা তাকে খুব বেশিই আদর। তুম্পা যেনো তার আরেক মেয়ে। তাই ওকে দিয়েই ছেলের যাবতীয় তথ্য জানতে হবে। কিন্তু অর্ধেক পথ পাড়ি দেয়ার পরই তূর্যের মোবাইল বাজতে শুরু করলো।বাজছে তো বাজছে থামার নামগন্ধ নেই। এক সাইট করে বাইক থামিয়ে মোবাইল হাতে নিতেই দেখলো, এলাকার পলিটিশিয়াল সিনিয়র ভাই আহসানের মিসড কল। তারসাথে বেশ ভালো সম্পর্ক।এই ছোট বয়সে খুব বেশি পলিটিক্স করছে। এলাকায় লোকজন খুব বেশি ভয় পায় তাকে।
তূর্য কল ব্যাক করতেই বললো,
– কিরে দেবদাস কোথায় তুই?
তূর্যের বুঝতে বাকি নেই মাইশার বিয়ের কথা আহসান পর্যন্ত গড়িয়েছে। শান্তস্বরে বললো,
– আজকেই নাকি দেখতে আসবে বললো। ছেলের কিছুই তো জানিনা। কি করবো বুঝতে পারছিনা ভাই।
– শোন, ছেলের বাবা হলো আমার দুর সম্পর্কের ফুপা। একই এলাকায় থাকছি।
একটু আগেই কল করে মাইশা সম্পর্কে জানতে চাইলো। কিন্তু আমি যতোদুর জানি তোর আর মাইশার রিলেশন চলছে। তাই আমি ফুপাকে বলেছি,
‘ফুপা এলাকার পোলাপানগোরে তো ভালোই চিনি তবে মাইয়াগো তো তেমন চিনি না।আমি খবর নিয়া একটু পরে জানামু নে।’
– হ্যাঁ ভাই।তাতো ঠিকই বলছেন।মাইশা কেঁদে কেটে একাকার। কি করবো বুঝতে পারছিনা।
– শোন।তোকে আমার বেশ পছন্দ। তাই আমি ছেলের নাম্বার দিচ্ছি। ছেলে রাজি না থাকলে ফুপা কখনো জোড় করবেনা বিয়েতে।তাই দেখ ছেলেকে কনভিন্স করতে পারিস কিনা?
– ওকে ভাই। থ্যাংকস ভাই। থ্যাংকস।
ভেবেই মৃদু হাসলো তূর্য।
কিন্তু এই ছেলে তো মাইশার ছবি দেখেই পালিয়েছে। খুব হাসি পেলো তূর্যের। এই হাসিতে এককাপ কফি খেয়ে মনটাকে আরো রিফ্রেশ করে নিলো। তখন মাইশা চলে যেতেই তূর্যের মনেহলো মাইশা খুব কষ্ট পেয়েছে।জোড়ে কথা বলাটা খুব ভয় পায় মাইশা। যখনি দেখবে তূর্য রেগে যাচ্ছে। বলবে,
“তূর্য প্লিজ এভাবে জোড়ে চেঁচিয়ে কথা বলো না আমার ভয় লাগে।”
তারপর থেকেই মাইশাকে কল করছে কিন্তু রিসিভ করছেনা সে।

বাসার কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় মেঘা। মাইশাকে দেখেই মিষ্টি একটা হাসি দেয়।মেঘা জানে মাইশা এক্ষুণি বড়াপু বলেই এক চিল্লানি দিয়ে জড়িয়ে ধরবে মিনিট খানেকের আগে তো ছাড়বেই না। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো আজ মেঘাকে দেখে বড়াপু বলে চিল্লিয়ে গলা জড়িয়ে ধরেনি।শুধু একটু মৃদু হাসলো।তারপর বললো,
– কখন এলে বড়াপু?
মনেমনে খুব কষ্ট পেলো মেঘা। কোথাও যেনো একটু চাপা অভিমান কাজ করছিলো বোনের প্রতি।কি হতো একটাবার জড়িয়ে ধরলে? কতোদিন পর দেখা।একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– এইতো কিছুক্ষণ হলো।কোথায় গিয়েছিলি তুই?
– তুম্পাদের বাসায়।
মাইশার পেছন পেছন মেঘা মাইশার ঘরে এলো।মাইশা রুমে এসে ব্যাগ রাখতেই দেখলো বৃষ্টি ওর খাটে শুয়ে পায়ের উপর পা তুলে নাচাচ্ছে আর ফোনে টিপছে। তাকে দেখে মোবাইলে চোখ রেখেই বললো,
– মাইশু সুইটহার্ট! ছেলে নাকি তোর মহসিন ভাইয়ের থেকেও বেশি সুন্দর।তাইনা রে বড়াপু?
– হ্যাঁ। তাইতো বললো বাবা। কিরে ছবি দেখেছিস তুই? পছন্দ হলো?
কিন্তু সে কথা মোটেও কানে তুললোনা মাইশা। রাগ হচ্ছে তার খুব রাগ হচ্ছে। তূর্যের চুলগুলো ধরে ইচ্ছেমতো ঝাঁকাতে পারলে বোধহয় তার রাগটা কমতো। উচ্চস্বরে কেউ কথা বললেই খুব ভয় পায় মাইশা। তূর্য সেটা খুব ভালোভাবেই জানে। কিন্তু তারপরও?
এমনিতেই সে টেনশনে মরছে উল্টা তাকেই রাগ দেখাচ্ছে!
ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখলো তূর্য তখনো কল দিয়েই চলছে।প্রেম দেখানো হচ্ছে এখন। ভালোবাসা একদম উপচে পড়ছে। ফাজিল একটা। পরিস্থিতি শান্ত দুরের কথা উল্টা আরো আগুন লাগিয়ে দেয়। খুব কান্না পাচ্ছে তার।কার জন্য এতোসব করছে? চোখদুটো টলমল করছে। চোখের পানি ছাড়ার আগেই মনেহলো মেঘা আর বৃষ্টি তারই সামনে।নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– তুমি কখন এলে ছোটপু?
– এইতো ঘন্টাখানেক হলো।
মেঘা আর বৃষ্টি দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। মাইশার এমন রূপ তাদের বড্ড অচেনা।

মেঘা, বৃষ্টি আর মাইশা তিনজন বোন বটে তবে সবচেয়ে ভালো বন্ধু ওরা। দুইবোনের আদরের পুতুল মাইশা। মাইশার সকল আবদারের ঝুড়ি যেনো দুই বোনকে ঘিরে। মাইশা প্রচন্ড চঞ্চল স্বভাবের বলেই দুবোন মিলে ওকে আগলে রাখতো।মাইশা এতোটাই চটপটে যেখানে মায়ের সাথে প্রতিদিন কম করে হলেও তিন চারবার ঝগড়া হয় তার। মুখের উপর কথা বলার স্বভাবটা ছোটবেলা থেকেই ।কেউ কিছু দোষ করলে মহল মজলিশ বলে কোনো কথা নাই সবার সামনেই উত্তম মধ্যম করে দিয়ে আসবে। যেটা মায়ের ভাষায় বেয়াদবি। কতো যে বকবে। কিন্তু কে শুনে কার কথা।এককান দিয়ে ঢুকিয়েছে তো অন্যকান দিয়ে বের করে দেয়। মেঘা আর বৃষ্টির বিয়ের আগে বিছানায় দুইবোনের মাঝখানের জায়গাটা ছিলো মাইশার। বড় দুই বোনের বিয়ের পর যেনো অন্য এক পৃথিবী খুঁজে পেলো মাইশা। কাউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে পারছেনা, কেউ আদর করে ঘুম থেকে ডেকে তুলছে না, কেউ নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে না কেউ মাথা বেঁধে দিচ্ছেনা। বড্ড এলোমেলো একটা সময় অতিবাহিতো করছিলো তখন। বড় দুই বোনের বিয়েতে মরা কান্না জুড়ে দিয়েছিলো সে।কিছুতেই ছাড়তে চাইছিলোনা।কতোরাত যে একা একা কেঁদে কাটিয়ে দিয়েছে কেউ জানেনা। এ যেনো এক নতুন জীবন। একলা একা জীবন। মাঝেমধ্যে পড়তে বসে যখন কোনো পড়ায় আটকে যেতো ধুম করে মনে পড়ে যেতো মেঘা আর বৃষ্টি কে। পড়ার জন্য কতো চাপ দিতো। আর আজ কেউ নেই কেউ তাকে কোনোকিছুর জন্য চাপ দিচ্ছেনা।সেই সময়ের একটা সঙীর বড্ড অভাব ছিলো তার।রাতের সঙী হলো বাবা।মাঝেমধ্যে এসে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতো। মাইশা ঘুমিয়ে যাবার পর আবার চলে যেতো। এমন ভাবেই কাটতে লাগলো সময়। বেড়ে উঠতে লাগলো মাইশা। মাঝেমধ্যে যখন বোনরা বেড়াতে আসতো ঘুম জিনিসটাকে কিছুদিনের জন্য ছুটি দিয়ে আড্ডায় মেতে থাকতো তিনজন।ওদের হাসাহাসির শব্দ শুনে পাশের ফ্ল্যাটের ভাবিরাও চলে আসতো আড্ডা দিতে। রাত জেগে কতো শত আড্ডার গল্প।সেই মাইশা আজ চুপ? ভাবা যায়?
মেঘা বললো,
– কি হয়েছে বলতো?
– সেটা তো আমিও বুঝতে পারছিনা। নিশ্চয়ই মা আবার ওর চটপটে স্বভাবের জন্য বকেছে। যদি বকে থাকে না তো আজ মার একদিন আর আমার যতোদিন লাগে।মাকে কতো করে বলেছি না বকতে সবাই কি এক হয় নাকি?

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েই বাসার উদ্দ্যেশে রওনা হয় তিহান। নাক মুখ এখনো ঘামছে।
তূর্য নামের ছেলেটার উপর প্রথমে বিরক্ত হলেও এখন ছেলেটাকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ জানালো। জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়েছে তাকে।
বাপরে বাপ। কি ডেঞ্জারাস মেয়ে! মাত্র কয়েকবার তাকাতেই পাঁচ হাজার টাকা খরচ করালো। ভাবা যায়? চোখের সামনেই ভাসছে সেই সকালটা।

সেদিন।
ঘুম থেকে উঠতেই প্রায় দশটা বেজে গেলো তিহানের। গতকাল রাতে দুইজন কল করে বলেছিলো ফ্রিজ কিনবে।সকাল দশটার মধ্যেই ওনাদের আসতে বলেছিলো তিহান।
কিন্তু কি কপাল! নিজেই এখনো পৌঁছাতে পারেনি। বাসা থেকে শোরুম অনেকটা দুরে।রিক্সা দিয়ে যেতে প্রায় ত্রিশ মিনিটেরও বেশি সময় লাগে।তারওপর এখন সকালবেলা। জ্যামতো মনেহয় আঠার মতো লেগে আছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে মার থেকে বিদায় নিয়ে না খেয়েই ছুটলো তিহান। শোরুমে পৌঁছাতে বিশ মিনিট লেইট ও হয়ে গেছে।কাষ্টমার বসে আছে। তিহান কাষ্টমারদের বিদায় করে নাস্তা করতে পাশের রেস্টুরেন্টে গেলো। তিহান যে টেবিলটাতে বসেছে ঠিক তার সামনের টেবিলেই একদল মেয়ে। ওরা ছিলো পাঁচ জন।একএকটা কথা বলছে আর হেসে গড়াগড়ি।
চোখ তুলে তাকালেই চোখ পড়ছে ওই টেবিলে।
ছেলেটাকে এভাবে তাকাতে দেখে সুধা হিয়াকে নিচু কন্ঠে বললো,
– এই দেখ না ছেলেটা বারবার এদিকেই তাকাচ্ছে। মাইশাকে দেখছে দোস্ত।সেতো আজ ফিদা। মাইশাকে আজ যা লাগছে না।
ওদেরকে চুপিচুপি কথা বলতে দেখে মাইশা বললো,
– এই তোরা কি গুজুরগুজুর করছিস?
সুধা বললো,
– দোস্ত আমরা বোধহয় একটা ট্রিট পেতে চলেছি। ওইদিকে দেখ। কিভাবে তাকিয়ে আছে।
মাইশা ছেলেটার দিক তাকিয়ে দেখলো সত্যিই ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রথমবার ততোটা আমলে না নিলেও পরে কয়েকবার তাকাতেই দেখলো ছেলেটা তখনো দেখছে। কয়েকবার চোখাচোখিও হয়ে গেছে দুজনের।
সুধা টিটকারি স্বরে বললো,
– হ্যায় আমাদের তূর্য ভাইয়ের কি হবে এখন?
– এটাকে মুরগী বানালে কেমন হয়?
সবাই মিলে চেঁচিয়ে,
– দারুন হবে মাশু।
একটা ওয়েটারকে দেখে,
– এইযে শুনো।
– জি ম্যাম।
– আমাদের বিলটা একটু নিয়ে আসবেন।
– এক্ষুণি আনছি।
বিল প্যাপার নিয়ে আসতেই দেখলো দুইহাজার তেইশ টাকা। আরো কিছু টুকটাক নিয়ে বিলটা বরাবর তিনহাজার টাকার মিল করলো মাইশা। তারপর ওয়েটারের দিক বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– ওই যে পাশের টেবিলে ভাইয়াকে দেখছেন। ওনি যখন বিল চাইলে এটা প্লাস করে দিবেন। ওকে?
– কিন্তু ম্যাম…!
পাশ থেকে সুধা বললো,
– ওনার ফিয়ান্স হয় বুঝলে?
– ওকে ম্যাম।
তিহান নাস্তা শেষ করে ওয়েটারকে বিল নিয়ে আসতে বললে ওয়েটার বিল নিয়ে আসে। বিল দেখেই অবাক হওয়ার সপ্তম আকাশে তিহান। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– একটা বার্গার আর কফির দাম তিন হাজার দুইশো টাকা ?
– স্যার ম্যামদের বিলসহ এতোটাকাই এসেছে।
– ম্যাম?
ওয়েটার সামনের টেবিলে দেখাতেই ওই টেবিল থেকে চোখ মেরে দেয় একটা মেয়ে। অবাক হয় তিহান।কিছু বলার আগেই মেয়েগুলো গড়গড় করে বেরিয়ে গেলো। একটা মেয়ে ইশারায় বিলপ্যাপারটা উল্টাতে বললো।বিল প্যাপার উল্টিয়ে দেখলো,
” এই যে সাহেব, এভাবে মেয়েদের দিকে তাকিয়েছেন কেনো? জানেন না অপরিচিতো মেয়েদের দিকে তাকানো নিষেধ। কিন্তু আপনি তো তবুও তাকিয়েছেন।পানিশমেন্ট তো পেতেই হবে। তাই জরিমানা স্বরুপ আমাদের বিলটা আপনি পে করবেন। বাই। ”
লিখাটা পড়তে পড়তেই মেয়েগুলো বাইরে বেরিয়ে গেলো।
– আরে আমি বিল দিবো মানে? আমি কি ওদের চিনি নাকি? আপনি আমাকে আগে কেনো বলেন নি?
– ওনারাতো আপনার সামনে দিয়েই গেলো। আপনি বিল পে করুন। নয়তো আপনাকে পুলিশে দেয়া হবে।
মানসম্মানের দিকে তাকিয়ে পুরো বিলটা পে করে এসেছিলো সেদিন।কি করে ভুলবে এই মুখটা। বিরবির করে বললো,
– এইগুলো মানুষ না রাক্ষস? সকালের নাস্তায় পুরো তিন হাজার? আমাকেই মুরগী বানিয়ে দিলো?

সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বলেছিলো,
এ মেয়ে যার গলে ঝুলবে জীবন বরবাদ হয়ে যাবে তার। শেষে কি না তার গলায় ঝুলতে চলেছে? এটা অসম্ভব। হাত ঘড়িটার দিকে তাকাতেই দেখলো প্রায় বারোটা বেজে গেছে। রিক্সা থেকে নেমেই ভাড়া দিয়ে দৌড় বাসার দিকে। খুব বেশি তাড়াহুড়া করে কলিংবেল চাপতে লাগলো। ভেতর থেকে তার মায়ের কণ্ঠ ভেসে আসছে।
– আরে কে রে। বেলটাকে একদম নষ্ট করে দিলো।আসছি।
দরজা খুলে তিহানকে দেখেই তার মা শেফালি বেগম এগিয়ে এলেন।মুখে চওড়া হাসি। এই হাসি যে বিপদ সংকেত তা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে তিহান। হাসি দেখে মনেহচ্ছে এভারেস্ট জয় করে ফেলেছেন তিনি। তবে কি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে