তুমি রবে ১৯

0
1800
তুমি রবে ১৯ . . শেষ পনেরোটা দিনের মাঝে আজকের দিনটা ছিল মাহির জীবনের সব থেকে বড় ধাক্কা। আর সেই ধাক্কাটা যে আশফির থেকে এভাবে পাবে তা তো সে কল্পনাও করেনি। – “মাহি! এই মাহি! কিরে শুনতে পাচ্ছিস? দরজা আটকে রয়েছিস সেই অফিস থেকে এসে। কী হয়েছে রে? দরজা খোল তো।” মাহি চোখে মুখে পানির ঝাপটা মেরে এসে দরজা খুলল। মুমুর নজর মেয়ের ওপর পড়তেই তার বুকের মাঝটাতে কেমন বারি দিয়ে উঠল যেন। উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করল মেয়েকে, – “কী হয়েছে তোর? চোখ মুখের এমন অবস্থা কেন?” মাহি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, – “মা কালকের টিকিট বুকিং দিতে বলো বাবাকে। আমি কালই যাব।” বিস্ময়ের সুরে মুমু বলল, – “কোথায়?” মাহি এবার তিরিক্ষি মেজাজের সঙ্গে উত্তর দিলো, – “কোথায় আবার? চট্টগ্রাম। যেতে হবে না?” এই বলে মাহি রুমের ভেতর চলে এলো। মুমু কিছুক্ষণ দরজার মুখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর নিজের ঘরে চলে গেল। গম্ভীর রাজ্যের রাজার রাজত্ব আবার শুরু হয়েছে। তার প্রত্যাহিক রুটিন; অফিস থেকে বাসা, বাসায় এসে রুম। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া, ইচ্ছা হলে ভ্যাকেশনে লং ট্রিপে যাওয়া। তা হতে পারে দেশের মধ্যে অথবা বিদেশের মধ্যেও। যতদিন ইচ্ছা ততদিন দেশ বিদেশের বন্ধু সমাবেশের সঙ্গে দীর্ঘ সময় এনজয় করা। আর তার কাজ তো কাজের স্থানে। অফিস থেকে ফিরে আশফি ফ্রেশ হয়ে লম্বা একটা ঘুম দিলো। তারপর ঘুম থেকে উঠল রাত নয়টার সময়। আবার ফ্রেশ হয়ে সোজা খাবারের টেবিলে চলে এলো। দিশান, শায়খ, শাওন এক সঙ্গে বসেছে। তাদের বিপরীতে আবরার আর তার ছোট ছেলে আজাদ বসা। হীরা আর জেবা খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত। আশফি এসে শাওনের পাশে বসল। আবরার তখন ছোট ছেলের ব্যবসা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করছিল। আবরার সাহেবের বড় ছেলে মাহবুব মোস্তাফিজ যখন দেশে ছিল তখন সে বাবার থেকে একটু একটু করে ব্যবসা শিখে নিয়েছিল তার ছাত্র বয়স থেকেই। আর তারপর আব্বার থেকে বিগ অ্যামাউন্টের তরল সম্পদ নিয়ে একটা গার্মেন্টস সে খুলে বসে। কয়েক বছরের মাঝেই বহুদূরও চলে যায়। এরপর আবরার এর বুদ্ধিতে সে একটি টেক্সটাইল কোম্পানিও খুলে ফেলে। বড় ভাইয়ের দেখাদেখি আজাদও আবরার এর থেকে মোটামোটি একটা অ্যামাউন্ট নিয়ে সুতা কারখানা করলেও মাহবুবের মতো করে সে ব্যবসায়ে পটু হতে পারেনি। এখনো আবরার এর থেকে তাকে প্রচুর ব্যাকআপ নিতে হয়। আর মাহবুব যেদিন দেশ ছেড়ে অ্যামেরিকার মাটিতে স্থায়ী বসত গড়ল সেদিন থেকে তার ব্যবসায়ের সমস্ত দায়ভার আবরার নিলেও আশফি তার কোয়ালিফিকেশন অর্জন করতেই আবরার পুরো ব্যবসায়ের দায়িত্ব ধীরে ধীরে তাকে বুঝিয়ে দিলো। বলা বাহুল্য বাপের ছেলে বাপের মতো বুদ্ধিমান না হলেও তার চেয়ে অধিক পরিমাণ ট্যালেন্ট দ্বারা এই বিজনেস সে আরও বহুদূর নিয়ে এলো। এখন তার টেক্সটাইল, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির পাশাপাশি নিজের সদ্য প্রচেষ্টায় গোল্ডের বিজনেসেও সে পা ফেলেছে। বান্দরবন আর সিলেট আবরার এর সহায়তায় দুটো রিসোর্টও করেছে সে। আর এখন তার টার্গেট গাজীপুর। খাবার খেতে শুরু করার আগেই আশফি দাদাকে উদ্দেশ্য করে বলল, – “আমার একটা কথা ছিল দাদা।” আবরার রুটি ছিড়ে মুখে পুরে বলল, – “তার আগে বলো তোমার আর মিনহাজের মেয়ের ব্যাপারটা কতদূর এগোলো।” আশফি রীতিমতো অবাক চোখে তাকাল দাদার দিকে। ছোট থেকে আবরার তার বড় দুই নাতির সঙ্গে যথেষ্ট খোলামেলক। কিন্তু তাও কখনো সে নাতিদের প্রেম, সম্পর্ক ঘটিত কোনো ব্যাপারে কথাও বলেনি আর জানতেও চায়নি কিছু। আজ হঠাৎ সরাসরি দাদার এমন প্রশ্নে আশফি কিছুটা বিব্রত হলেও সে তার স্বভাবসুলভ আচরণ বজায় রেখে বলল, – “বুঝতে পারলাম না দাদা।” – “না বোঝার কী আছে? একটা মেয়েকে আমার নাতিবউ করব বলে আরও এক বছর আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তার বাবাকে। আর এখন সেই ব্যাপারটা পুরোটা ঘেঁটে বসে আছো তুমি। তাকে পছন্দ না হলে সেটা আগেই বলতে পারতে। এতদূর আসার পর তোমার এ কী ধরনের মতিগতি বলো?” – “এক মিনিট এক মিনিট। জবান আপনি দিয়েছিলেন। আমি কখনো এমন জবান ছাড়িনি যে আমাকে মিনহাজ সাহেবের মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে। পলিটিক্সে থাকাকালীন আপনাদের মাঝে সুসম্পর্ক গঠন হওয়ার সূত্রপাত ধরে কখন নিজেদের মাঝে এমন পক্সি টাইপ থিম কথা দেওয়া দেওয়ি করেছেন এখন তার দায়ভার আমাকে নিতে হবে?” আশফির কথার সুরে আবরার কিছুটা মিইয়ে গেল ঠিকই। কিন্তু তার কথার সুর আবরার এর একেবারেই পছন্দ হলো না। – “কী বললে তুমি? পক্সি? এটা তোমার কাছে পক্সি টাইপ থিম মনে হয়েছে? মানে আমি আনকুল করি তুমি এটাই বললে?” বেশ চেঁচিয়েই বলল আবরার। সবাই অনেকটা ঘাবড়ে গেল তাদের দুজনের আচরণে। সবাই আবরারকে ঠান্ডা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হীরা আশফিকে ধমকে বলল, – “খেতে বসে এটা কী আচরণ জোজো?” আশফি রগচটা স্বভাবে ভঙ্গিতে বলল, – “এ বাড়িতে এমন নিয়ম চালু হলো কবে থেকে? নিজের বিষয়ে নিজের কিছু বলা বারণ না কি?” দিশান এবার বলল, – “ভাইয়া থামো। বাদ দাও এসব কথা। দাদা যা বলছে তা শুধু শোনো। কিছু বলতে হবে না।” আশফি উচ্চস্বরে বলল, – “কেন বলব না? আমাকে একটা বাজে ব্লেম দেওয়া হচ্ছে আর আমি চুপ থাকব?” সবাই ভেবেছিল গরম আবরার হবে। আশফি যে এমন খিটখিটে স্বভাব ধারণ করবে তা সবার ভাবনার বাইরে ছিল। কিছুদিন যাবৎ আশফি তার রাগের লাগাম ধরে রাখতে পারছে না। অল্প কিছুতেও তার মেজাজের মিটার হাই হয়ে ওঠে। সে কপাল কুচকে একবার হীরার দিকে তাকিয়ে তারপর আবরারকে বলল, – “আমি তো বলেছি তাকে, যেন সে আমার জন্য অপেক্ষা না করে। এসব বিয়ে, ফ্যামিলি প্ল্যানিং ব্যাপার স্যাপার আমার দ্বারা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে আপনারা নিজেরা কতটুকু জানেন? আমি নিজেই তো জানি না।” আবরার চোখে ক্রুদ্ধতা রেখে নিস্তব্ধ বনে চেয়ে রইল নাতির দিকে। আশফি খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, – “আগামীকাল সন্ধ্যায় আমি দেশ ছাড়ছি। কবে ফিরব বলতে পারছি না।” দিশান বলল,
– “বাবার কাছে যাচ্ছো?” – “না। কোথায় কখন থাকব বলতে পারছি না। তাই যোগাযোগ না করতে পেরে অস্থির না হওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।” কথা শেষ করার পর কাউকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে সে তার লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেল। আবরার কিছু সময় চুপ থেকে উঠে চলে গেল ঘরে। দিশান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দাদীবুর দিকে তাকিয়ে আছে। শায়খ বলল, – “শুরু হলো তার আগের জীবন পদ্ধতি। কথা শুনে তো মনে হলো প্রাইভেট জেট নিয়ে বের হবে।” আজাদ জিজ্ঞেস করল, – “আব্বার সঙ্গে ঝগড়া করে আবার তাঁর জেট নিয়ে বের হবে। ভালোই!” হীরা তখন বলল, – “তোর আব্বার নয়, গত মাসে সে নিজে প্রাইভেট জেট কিনেছে।” আজাদ আর তা পরিবার খানিকটা চমকে উঠল। আজাদ বলল, – “কখন? কিছুই তো জানি না।” দিশান বা হীরা কেউ কোনো উত্তর দিলো না। জেবা আর শায়খের মুখ অনেকটা কালো হয়ে গেল। আজাদ অভিযোগের সুরে বলল, – “বেশ ভালোই সাপোর্ট দিলো আব্বা ওকে।” দিশান এবার বলল, – “সাপোর্ট কম বেশি সবাই-ই পেয়েছে মনিকাকু। আর এই জেটটা দাদা কিনে দেয়নি ওকে। ওর নিজের যোগ্যতা আছে।” আলহাজ হিসেবের খাতায় কলম চালাতে চালাতে মাহিকে বলল, – “বল কী বলবি? অন্তত এবার আর ব্যার্থ চেষ্টা করিস না। আমার মুখ থেকে যখন বেরিয়েছে তোকে চট্টগ্রাম যেতে হবে তোকে, তবে যেতেই হবে।” মাহি কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে একটা তাচ্ছিল্য ভরা হাসি হাসল। কিন্তু সেই হাসি অবশ্য আলহাজের নজরের আড়ালে ছিল। মাহি বলল, – “মামা আসতে তো বহু দেরি। আমি কালকে সকালের ট্রেনে যেতে চাই দাদু।” আলহাজ এবার কলম থামিয়ে তার গোল্ড সেনিওগ্লাস চশমার ফাঁক থেকে মাহির দিকে তাকাল। – “রিজাইন দিয়ে দিয়েছিস?” মাহি এবার এমন একটা কথা বলল যা শুনে আলহাজের নিজেরও অপমানবোধ হলো। আজ অনেক বড় একটা ব্লান্ডার করে ফেলেছে মাহি। প্রজেক্টের মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট থিম সামার কালেকশনের ব্যাকসাইডের জন্য নিম্নমানের ম্যাটেরিয়াল সিলেক্ট করেছিল নতুন একজন ডিজাইনার। যার ফাইনাল টাচ মাহির দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে বেখেয়ালে ম্যাটেরিয়াল চেক না করেই ওকে করে দেয়। যার ফলস্বরূপ প্রজেক্টে হাত দেওয়ার আগের দিনই হলো সব ভুলে ভরপুর। প্রতিটা কালেকশন হলো নিম্নমানের কাপড়ের। কাজের স্থানে আশফি নিজেকেও কখনো ছাড় দেয়নি। এত বড় ভুল সে মেনে নিতে পারল না। অনেক ছোট করে কথা শোনাল সে মাহিকে। মাহি কাজটা বেখেয়ালে নাকি ইচ্ছা করেই করেছে তা আশফি জাজ করল না। মাহিকে ফায়ার করে দিলো সে। এই কাজের মাধ্যমে মাহির কাজের স্থানে রেপুটেশন নষ্ট হয়ে গেছে। এরপর মাহি যদি অন্য কোনো কোম্পানিতে চাকরির অ্যাপ্লাই করে তবে ভেরিফিকেশনের সময় মাহির কাজের অভিজ্ঞতা বিচার করে তাকে কখনোই সেই কোম্পানি হায়ার করবে না। আলহাজকে মাহি শেষ কথা বলে চলে এলো নিজের ঘরে। প্রচন্ড কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু সে এত কাঁদতে চায় না। আজ তার আশেপাশের প্রতিটা মানুষ তাকে বাছবিচার না করে তাদের সিদ্ধান্ত ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে পানিশমেন্ট বাবদ। সবখান থেকে শুধু তাকেই শাস্তি পেতে হয়। এই যে ভুলগুলো সে করেছে, এই ভুলের পিছে যে অন্য কিছু ব্যাপার বা অন্য কেউও দায়ী থাকতে পারে, যার প্রভাবে সেই এই ভুলগুলো করেছে তা আর কেউ বিচার করে দেখল না। আলমারি থেকে লাগেজটা বের করে মাহি কাপড় গোছাতে শুরু করল। মমিন গেছে ট্রেনের টিকিট বুক করতে। কাল সকালে না হলেও রাতের টিকিট পেয়ে যাবে হয়তো। মিমি বোনের ঘরে ঢুকে তাকে কাপড় গোছাতে দেখে কেঁদে ফেলে বলল, – “এই আপু তুই কি সত্যি চলে যাবি?” মাহি নীরব থাকল। মিমি তার হাত থেকে কামিজটা টেনে নিয়ে বিছানার ওপর ফেলে দিলো। এরপর ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বসলো বেলকনিতে। – “রাগ করে যে তুই নিজের ক্ষতি নিজে করছিস। তা কি বুঝতে পারছিস?” – “কোনো ক্ষতি করছি না আমি। শেষবারের মতো ওদের খুশি করছি তো। কারণ এরপর থেকে যা হবে তা শুধু একজনের মর্জি মতো হবে। এত মানুষের মর্জি আর আমার ঘাড়ে চড়াতে পারবে না।” – “তুই কী বলছিস কী? ওই সোমের হাতে নিজেকে এভাবে তুলে দিবি? আরে ও তো সবসময় তোর মর্জিকে মূল্যহীন করে তোর মালিক হওয়ার চেষ্টায় আছে।” – “তোর তাই মনে হলো? মর্জি আমার হলে তার মালিকও আমি। আজ আমার সাথে যা ঘটল এর থেকেও যদি আমি শিক্ষা না পাই তবে আমাকে মানুষ ভাবাই উচিত না। আমি চট্টগ্রাম যাব তাদের বাধ্য সন্তান, বাধ্য নাতি হয়ে। কিন্তু ফিরে আসব নিজের মর্জির মালিক হয়ে। সেদিন কেউ চাইলেও আর এই মাহিকে আজকের মাহির মতো পাবে না। তারা নিজেরাও জানে না, কতটা দূরে সরিয়ে দিলো তারা আমাকে।” চোখের কোণ উপচে এবার নোনাপানির ধারা গাল বেয়ে পড়ল মাহির। মিমির কাঁধে মাথা রেখে মাহি সেই তখন থেকে কাঁদতে আছে নীরবে। – “আপু, আমাকে বলবি?” – “কী?” – “কী হয়েছে তোর বল? আমি জানি তুই শুধু আমাদের পরিবার নিয়ে আপসেট না। এর থেকেও বড় কিছু নিয়ে তুই কষ্ট পেয়েছিস। বল না আমাকে।” মাহি কাঁদতে কাঁদতে এবার চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল। এত বেশি ব্যথা সে কেন অনুভব করছে? সেদিন ছুটির পর আশফি লিফ্টে ঢুকতেই মুখোমুখি হলো মাহি আর সোমের। একদম না চেনার ভঙ্গিতে আশফি মাহির পাশে দাঁড়াল। মাহির বাহুর সঙ্গে তার বাহুর সংঘর্ষন হতে আশফি দূরে গিয়ে দাঁড়ায় কিছুটা। আর তখন সোম মাহির বাহুর ধরে নিজের কাছে চেপে নিয়ে আসে। ব্যাপারটাতে মাহি বিস্মিত হলেও সোম সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেনি। মাহি খুব ধীর কণ্ঠে সোমকে বলল, – “আমি ঠিক আছি সোম ভাই। আমাকে ছাড়ো।” কিন্তু সোম মাহির কোনো কথাই কানে তুলেনি। মাহি অপ্রতিভ হয়ে আশফির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখল আশফি ভাবলেশশূন্য। কিন্তু তখন যদি মাহি আশফির হাতের মুঠো পানে তাকাত তবে হয়তো সেদিনই বুঝে যেত ওর জন্য আশফির প্রতিক্রিয়া কেমন। লিফ্ট থেকে বেরিয়ে আশফি ওদের দিকে না তাকিয়ে সোজা গাড়িতে উঠে বসে। আর মাত্র মিনিট দুই ওদের সামনে থাকলে সোমের গায়ে হাত উঠে যেত তার। পরদিন সকালে আশফি দেখল সোম মাহিকে এগিয়ে দিতে অফিসের মধ্যেই চলে এসেছে। সোমের প্রতি আশফির সীমাহীন ক্রোধ থাকলেও তা সে চেপে গেল বারবার। কারণ সে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে, কোনোদিনও সে মাহি বা মাহি সংক্রান্ত কিছুই আর ভাববে না। নতুন প্রজেক্টটার দায়িত্ব মাহির ওপর থাকায় মাহিকে এখন বেশিরভাগ সময় ঐন্দ্রী আর আশফির সাথে সময় কাটাতে হয়। কারণ ঐন্দ্রীর ডিজাইনের প্রতিটা স্যাম্পল মাহিকে রি-চেক দিতে হয়। এরপর আবার আশফির কেবিনে দৌঁড়াতে হয় অন্য কোনো দরকারে। মাহির ফাইনাল টাচ শেষে যেদিন আশফি ডিজাইনের স্যাম্পলগুলো বসে দেখছিল তখন সে ঐন্দ্রীর প্রতি খুবই সন্তুষ্ট হয়েছিল। কারণ প্রতিটা ডিজাইনই ছিল রুচিসম্মত যা ছোট বড়, বয়স্ক সবারই নজরে লাগবে। আশফি খুশি হয়ে সেদিন ঐন্দ্রীর অনুরোধে সন্ধ্যার পর একটি রেস্টুরেন্টে যেতে রাজি হয় তার সঙ্গে ডিনার করতে। কিন্তু আশফি সেদিন একা যেতে পারেনি। ঐন্দ্রীর কাছে ট্রিট চেয়ে অন্য সব ইন্টার্ন আর কলিগেরাও তাকে চেপে ধরে। বাধ্য হয়ে ঐন্দ্রী দিশান মিলি, রাতুল, মাহি সঙ্গে আরও দুজন কলিগকে রেস্টুরেন্ট যেতে বলে। যেহেতু সন্ধ্যার পর তাই মাহি যেতে পারবে না বলে জানায়। দিশান মাহির ব্যাপারটা চিন্তা করে বলল তখন, – “ঐন্দ্রী, সবাইকে নিয়ে এনজয় করতে চাইলে সন্ধ্যার পর না হয়ে বিকাল বেশি ভালো হতো।” – “হ্যাঁ না হলে তো মাহি থাকতে পারবে না।” মাহি বলল, – “কোনো সমস্যা নেই। আর তাছাড়া আমাকে দ্রুত যেতে হবে বাসায়।” দিশান খুব অনুরোধের সুরে বলল, – “চলেই তো যাবে আমাদের ছেড়ে। একটু এনজয় করো না আমাদের সঙ্গে?” কথাটা শুনতেই মাহির ভেতরটা কেঁপে উঠল। কিছুটা আড়চোখে তখন আশফির দিকে তাকাল সে। কাজে ব্যস্ত তখন আশফি। সেই দিনের সকালের পর থেকে মানুষটা একটাবার তার দিকে কখনো তাকিয়েও দেখে না। কিছুদিন পর থেকে আর কোনোদিনই হয়তো এই মানুষটাকে দেখতে পাবে না। চোখটা ঝাপসা হয়ে উঠল মাহির। কেউ দেখার আগেই চোখটা মুছে নিলো মাহি। রেস্টুরেন্ট যাওয়ার পর তিনটা টেবিল বুক করল দিশান। দুটোতে তিনজন তিনজন করে বসল। আর অন্য টেবিলটাতে ঐন্দ্রী আশফিকে নিয়ে বসতে চাইল। আশফি তখন বলল, – “এক সঙ্গে বসলে বেশি ভালো লাগত তো।” কথাটা শুনতেই মাহি আশফির দিকে তাকাল। ওই দিনের পর সেদিন প্রথম দুজনের চোখাচোখি হলো তাদের। আশফি তখন ঐন্দ্রীকে বলল, – “না থাক, সবার সঙ্গেই বসতে আমি ইজি ফিল করি না। চলো।” বিকালের ট্রিটটা ঐন্দ্রীর দেওয়ার কথা থাকলেও আশফি তাকে দিতে দিলো না। সবাই যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো তখন শুধু ভেতরে মাহি বসে রইল। আশফিকে স্যরি বলাটা খুব দরকার। আশফি বিল পে করে ফিরে আসতেই মাহি উঠে দাঁড়াল আশফির সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু আশফি তাকে অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। মাহি অবশ্য জানতো এমন কিছুই পাবে সে আশফির থেকে। কিন্তু রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো মাহি। বাইকের সিটে বসে ক্রুদ্ধ চোখে চেয়ে আছে সোম মাহির দিকে। আর তার পাশেই আশফির গাড়ি। আশফি গাড়িতে উঠতে গিয়ে থেমে গেল সোমের ভাবমূর্তি দেখে। কিছুক্ষণ পর যা ঘটল তাতে আশফি সহ বাইরের প্রতিটা মানুষ স্তব্ধ। আশফি এবার আর এড়িয়ে যেতে পারল না সোমকে। ……………………………….. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে