তুমি রবে ১৮

0
1799
তুমি রবে ১৮ . . – “কী করে হলো আমার দ্বারা এই ভুলগুলো? আমি নিজেই ভেবে স্তব্ধ।” – “ভাইয়া ওর নিশ্চয় কোনো সমস্যা হয়েছে হয়তো। তার জন্যই ও…” – “দিশান! আমি তার নামটাও আর শুনতে চাচ্ছি না। বাদ দাও তার ব্যাপার। ভুল মানুষেরই হয়। আর আমারও তা হয়েছে। আমি সেটাকে শুধরে নিয়েছি। আমার লাইফে এসব জিনিসের কোনো গুরুত্ব কোনোদিনও ছিল না আর আজও নেই।” – “কাল রাতটার সবকিছুই ভুল ছিল ভাইয়া? ক্ষণিকের দূর্বলতা মাত্র?” – “হ্যাঁ অবশ্যই। যা কখনো কখনো মানুষের জীবনে আসে আবার তা চলেও যায়।” দিশান ভাইয়ের চোখে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে বলল, – “তুমি ওকে ভালোবাসো ভাইয়া। তা শুধু ক্ষণিকের দূর্বলতা ছিল না। যা ছিল এবং যা আছে তোমার মাঝে, তা একদিনে তৈরি হয়নি। ধীরে ধীরে হয়েছে। যা এখন খুব গভীর।” – “দিশান যাও, অফিসের জন্য তৈরি হও। আমি আসছি।” আশফি সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে চোখ দুটো বন্ধ করে। দিশান উঠে দাঁড়িয়ে ওর চোখের ওপর থেকে হাত নামিয়ে দিলো। আশফি তাকালে সে বলল, – “তুমি নিজেকে শান্ত করো ভাইয়া।” – “আমি শান্ত আছি দিশান। ইনফ্যাক্ট এতদিন যে অদৃশ্য ঘোরের মাঝে ছিলাম তা থেকে বেরিযে আসতে পেরে কতটা হালকা লাগছে নিজেকে, তা তুমি বুঝতে পারছো না।” দিশান শুধু চেয়ে রইল তার ভাইয়ের দিকে। ভেবেছিল সে, এবার হয়তো তার ভাইটা বাস্তবিক জীবনের সম্পর্কগুলোতে বিশ্বাসী হয়ে উঠবে। প্রতিটা মানুষের জীবনে একজন আজীবন স্থায়ী সঙ্গী কতটা জরুরি তা হয়তো তার ভাইটা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে। কিন্তু সব যে আগের চেয়ে আরও বেশি ঝাপসা হয়ে গেল। যতটুকু অনুভূতির জন্ম তার মাঝে হয়েছিল তা আজ একেবারে নিঃশেষ হওয়ার পথে। দিশান তা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। তার মাঝে হঠাৎ করে যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্ত সেই অনুভূতি যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই মরে যাবে তা কে জানতো? আর কোনোদিনও কি এই অনুভূতির জন্ম নেবে তার মাঝে? যা শুরু হওযার পূর্বেই শেষ হয়ে গেল! যখনই সে এই ভালোবাসা নামক অনুভূতি অনুভব করতে শুরু করল ঠিক তখনই তার মৃত্যু ঘটল। অনুভূতির মৃত্যু। তার ভাইটা এমনিতেই কষ্ট দুঃখ আপন মনের মাঝে পিষ্টে রাখা মানুষ। যত বড় কষ্ট বা দুঃখ অথবা বিপদই হোক না কেন, তা সে কোনোদিনও কারো কাছে প্রকাশ করবে না। আজ মাহির জন্য যা সে উপলব্ধি করেছে, তা সে কখনো আর কারো জন্য করেনি। এই প্রথম সে আশাবাদী হয়েছিল সম্পর্কের টানে। যাকে ঘিরে এই আশা তৈরি হয়েছিল, সে আশায় আজ সেই ব্যক্তিটি নিজেই জল ঢেলে দিয়েছে। এবং পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, তাকে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো অপরাধ যেন সে না করে। হ্যাঁ অপরাধই ভাবে তা আশফি। কারণ সে মানুষটার প্রতি অধিকার তো অন্য কারো।
অন্যায়ের পরিমাণ হয়তো দ্বিগুণ হয়েছে আজ মাহির। যা সে নিজেও বুঝতে পারছে। বিকাল পাঁচটার সময় তার পুরো পরিবার এসে উপস্থিত হয়েছে বাড়িতে। আলহাজ তার পরিবার নিয়ে আসা মাত্রই সোমও এসে উপস্থিত হয়। সন্ধ্যা সাতটাতে বসার ঘরে প্রতিটা মানুষ জড় হয়েছে। ছোট থেকে শুরু করে বড় অবধি। পুরো একটা রাত এ বাড়ির বড় মেয়ে কোনো এক অনাত্মীয় পুরুষের ঘরে কাটিয়েছে। যা ছিল পরিবারের প্রতিটা মানুষের চিন্তার বাহিরে। আলহাজ মাহিকে তেমন কিছুই বলল না। সে তার বন্ধু আবরারকে কল করল। প্রথমবার রিসিভ না হলেও দ্বিতীয়বার আবরার রিসিভ করতে দুই বন্ধুর কুশল বিনিময় পর্ব শেষ হলে আলহাজ তাকে বলল, – “আমার নাতনির ব্যাপারে একটা কথা ছিল আবু।” – “কে মমিনের মেয়ের কথা?” – “হ্যাঁ।” – “হ্যাঁ হ্যাঁ বল। তোর নাতিটা খুব লক্ষ্মী রে ভাই। আমার ছোট নাতি বলছিল একদিন ওকে নিয়ে। খুব অ্যাক্টিভ কাজের প্রতি। একদিন ওর খুব উন্নতি হবে রে।” – “আমিও তা জানি। ওকে নিয়ে আমি প্রচন্ড আশাবাদী। আসলে আমি যেটা বলতে চাইছিলাম তা হলো, আমি ওকে আপাতত জবটা করতে দিতে চাইছি না।” আবরার বেশ বিস্ময়ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল, – “সেকি কেন?” – “আসলে ওর এমবিএটা কমপ্লিট হয়নি তো। তাই ভাবছি এমবিএটা কমপ্লিট করুক। তারপর যোগ্যতা দ্বারা জব নেবে।” – “আরে স্টাডি তো করবেই। পাশাপাশি জবটা করলে ওর জন্যই ভালো হবে। খুব দ্রুত ভালো পজিশন পেয়ে যাবে।” – “সমস্যাটা হচ্ছে ও ঢাকার মধ্যে কোথাও এমবিএ করতে পারছে না।” আলহাজের কথাতে সোমও অনেকটা চমকে গেল মাহির সঙ্গে। আবরার জিজ্ঞেস করল, – “কোথায় করবে এমবিএ ও?” – “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।” কথা শেষে আলহাজ অপ্রসন্ন হয়ে মুমুকে বলল, – “তোমাদের ইচ্ছা ছিল ওখানে মেয়েকে পড়াশোনা করানোর। আমিও আজ মত দিচ্ছি। তাকে ওখানেই পাঠাও। যদি সেখানেও সে সুযোগ না পায় তবে ওখানেই কোনো ন্যাশনালে ভর্তি করে দিও তাকে। স্বাধীনতা দিয়েছিলাম মুক্ত আকাশ দেখার জন্য। আকাশে কালো মেঘের ছায়া নেমে এসেছে। বৃষ্টি ঝরার পূর্বেই তাকে নীড়ে ফিরিয়ে আনাতে চাই।” চট্টগ্রামে মাহির মামা মোর্শেদ কামালের বাড়ি। যেখানে তার ওই একটি মামাই বসত করে শুধু পরিবার নিয়ে। চারটা মেয়ে আছে তার। প্রথম দুই কন্যার বিয়ে ছিল সম্পর্কের বিয়ে। আজ তারা দুজনই ডিভোর্সি। কিন্তু তাদের কাউকেই মোর্শেদ ঘরে তোলেনি। কারণ তাদের কাউকেই সে মেনে নেয়নি। প্রচন্ড কড়া শাসনের মাঝে সে মেয়েগুলোকে বড় করে তুললেও আটকে রাখতে পারেনি প্রথম দুই কন্যাকে। পরের দুই কন্যাকে সে বিয়ে করিয়ে ঘরে বসিয়ে পড়াশোনা করাচ্ছে। সেজো মেয়ে বিবিএ তৃতীয় বর্ষে আর ছোট মেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পড়ছে সবে। পড়াশোনা শেষ হলে তাদের বড় আয়োজন করে তুলে দেবে তাদের বরের হাতে। বোনকে সে বলেছিল মাহির বিয়েটাও যেন সোমের সঙ্গে করিয়ে দেওয়ার পর তাকে পড়াশোনা করায়। কিন্তু আলহাজ তাতে রাজি হয়নি। মুমুর আর মমিনের দুজনেরই ইচ্ছা ছিল মাহিকে এসএসসির পর মামার কাছে পাঠিয়ে দেবে। এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবশ্য অনেক বড় একটা কারণ ছিল। কিন্তু তখন বাঁধা দিয়েছিল আলহাজ। একজনের ভুলের জন্য সেই ভুলের মাশুল সে মাহিকে দিয়ে গোণাতে চায়নি। কিন্তু আজকের পর সে তার সিদ্ধান্তকে ভুল মেনে পরিবর্তন করে ফেলল। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মাহির দিকে শীতল চাউনিতে চেয়ে তাকে বলল, – “কাল সকালে লিমন বা সোম কাউকে সাথে নিয়ে গিয়ে রিজাইন দিয়ে এসো।” ঘরে ফিরে এসে মাহি বালিশে মুখ চেপে বসে কাঁদতে শুরু করল। ছোট থেকে আজও অবধি সে পরিবার ছাড়া কখনো কোথাও থাকেনি। যখন প্রথমবার মাহিকে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দেওয়ার কথা উঠেছিল তখন তার কান্না ছিল হৃদয় কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো কান্না। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে ছাটাছাটি করে কেঁদেছিল। আর দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, – “আমি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারব না দাদু। মরে যাব আমি।” মুমু আর মমিনের ধারণা তাদের প্রচুর আদরের কারণে তারা মাহিকে কখনো শাসন করতে পারবে না। মোর্শেদ মাহিকে নিজের মেয়ের চোখেই দেখে। সেই পারবে তার মেয়েদের মতো মাহিকে শাসনে রাখতে। যাতে সে কখনোই কোনো ভুল না করে। আর যদি কখনো ভুল করেও বসে তবে তার অবস্থা হবে তাদের মতোই যাদের আজ পরিবারের বাহিরে চিরতরের জন্য ফেলে দেওয়া হয়েছে। অফিস থেকে ফেরার পর আশফির সেই পূর্বের অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকল আজ থেকে। উত্তরার বাড়িতেই ফিরল আজ সে। বাড়ির সকলে বেশ অবাক হলো আশফিকে দেখে। তবে আবরার আর হীরা যেন খুব খুশিই হলো। রাত আটটা বাজে। ল্যাপটপ আর কিছু কাগজপত্র নিয়ে বেলকনিতে এসে বসলো আশফি। কাজ করার মাঝে মনোনিবেশ বারবার ভাঙতে থাকল তার। শত চেষ্টার পরও সে কাজে মনে দিতে পারল না। ভেবেছিল মাহি আজ অফিসে এলে হয়তো মাহি নিজে থেকেই এসে তাকে স্যরি জানাবে। কিন্তু সে আজ অফিসে আসেইনি। মাহির কথা আবার মনে আসতেই এবার আশফি নিজের প্রতি নিজে বিরক্ত হলো। এভাবে সে ফালতু ভাবনায় নিজেকে হারালে তো বেশিদিন আর তাকে বিজনেসের পথে থাকতে হবে না। নিচে গিয়ে লিভিংরুমে শাওনকে দেখে ওকে বলল, – “এক কাপ কফি দিয়ে আয় তো শাওন। আর তোর তোজো ব্রো কি ফিরেছে বাসায়?” – “না তো ভাইয়া। তোমাকে খুব মরা মরা লাগছে। তুমি কি অসুস্থ?” আশফি চোখ মুখ কুচকে বলল, – “মরা মরা আবার কী শব্দ? কোথা থেকে শিখিস এগুলো? কফিটা নিয়ে আমার রুমে আয়। তারপর তোর ল্যাঙ্গুয়েজ শুনছি।” শাওন সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে ভাইকে বলল, – “এগুলো আপডেট বুঝেছো? শুধু ল্যাপটপের বারান্দায় চাপাচাপি করলে এসব জানবে কী করে?” কথাগুলো বলে শাওন চলে গেল কিচেনে। আশফি একটু হাসল তার ইন্টার প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত বোনের কথাগুলো শুনে। লিমন ব্যস্ত থাকায় শেষমেশ সোমের সঙ্গে মাহিকে অফিস যেতে হলো। অফিস সে আজ খুব লেটেই গেল। সোম মাহির সঙ্গে অফিসের ভেতর চলে এলো। গেস্টরুমে বসে মাহির জন্য অপেক্ষা করতে থাকল সে। আশফির মুখোমুখি মাথা নত করে বসে আছে মাহি। আশফি নতুন এক্সিকিউটিভ মালিহার সঙ্গে কথা শেষ করে মাহির দিকে স্বাভাবিক নজরে তাকিয়ে বলল, – “হ্যাঁ আপনি কী যেন বলছিলেন বলুন।” – “স্যার আমার রিজাইনের ব্যাপারটা….মানে আনোয়ার স্যার বললেন আমাকে রেজিগলেশন দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কেন?” – “কিছুদিন আগেই একটা নতুন প্রজেক্ট আমি হাতে নিয়েছি আপনি জানেন নিশ্চয়?” – “জি।” – “আপনি জানেন আপনার সিনিয়র খুশি ম্যামের বদলে তার দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হয়েছিল?” – “জি।” – “তাহলে এখন আপনার বদলে আমি আবার নতুন কোনো ইন্টার্নকে কাজটা বোঝাব কিছুদিন ধরে। তারপর কাজে হাত দেবো? আপনি তাই বলতে চাইছেন? আর এখন মাসের অর্ধেক। আপনি এক মাস হওয়ার পূর্বে এমন একটা কাজ হাতে পাওয়ার পর জব ছাড়তে এসেছেন। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি কী করে? আপনি যে প্রজেক্টটার ইনফরমেশন অন্য কোথাও লিকড করবেন না তার গ্যারান্টি কী? তাই আমি দুঃখিত। কাজটাতে হাত না দেওয়া অবধি আপনাকে রিজাইন করতে দিতে পারছি না।” মাহি বিমর্ষ মুখ করে কিছু বলতে গেলে আশফি শীতল চাহনি মেলে মাহিকে বলল, – “আবরার মোস্তাফিজ বললেও নয়।” এই বলে আশফি মালিহাকে বলল, – “আমি এখন বাহিরে যাব। দিশান আসলে ওকে ওটা দেখাবেন।” মাহিকে একদম অগ্রাহ্য করে আশফি রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ……………………………….. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে