তুই হবি শুধু আমার পর্ব-২২

0
1221

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_বাইশ

💙ফালাক💙
আমি ভাবতাম পৃথিবিতে তিনজন আমাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে।তারা হচ্ছে, বাবা মামনি আর তুমি। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। জানো তুমি প্রথমে দাদাই আর আমাকে নিয়ে যেটা করেছিল সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। কারন তোমাকে ভালোবাসি আমি। তুমি আমায় ততটাই ভালোবাসো ভেবেছিলাম। কিন্তু আমাকে ভালোবাসলে মুগ্ধতার কাছে কেন গিয়েছিলে?আমি জানি তুমি ওকে ছুঁতে চাওনি, ওর কাছে যেতে চাওনি। ও নিজেই ধরা দিয়েছিল। রাগের বশে হয়তো তাঁর সঙ্গে চুঁম্বনে লিপ্ত হয়েছো। কিন্তু তখন একবারও কি ভেবেছো আমার কথা? তোমার কাছে নিজের জেদ, রাগ অভিমানটাই বড় ছিল। কেন?

আমি কখনও চাইনি তুমি অভিনয় করো। কারন, ওখানে বিভিন্ন নারী থাকবে যাদের তুমি অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও ছোঁবে। আমি চাইনি আমার প্রিয় মানুষটা আমাকে ছাড়া অন্যকারোর সঙ্গে থাকুক। তবুও সবটা সহ্য করেছি। এই আড়াই বছর তোমাকে সুযোগ দিয়েছি আমায় সত্যগুলো বলার। তুমি বলোনি। বলতে চাওনি। মুগ্ধতা তোমার চাচার মেয়ে, তোমার কাজের সঙ্গী! তোমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা বিয়ে অবধি গড়াবে? বিয়ের দিন একটা মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করা কতটা ভয়ঙ্কর জানো? মেয়েটা বধুর সাঁজে অপেক্ষা করছিল তোমার জন্য আর তুমি ওকে ছেড়ে দিলে? ভুল ওর বাবা করেছে ও করেনি। ভুল তুমি করেছো, মুগ্ধতা করেনি। আমি সর্বদা সত্যের পথে থেকেছি। আজও থাকবো। তোমার কাজ আমি সমর্থন করিনা, এটা বলতে আমার গলা কিংবা লিখতে হাত কোনোটাই কাঁপবে না।

আমি তোমার জেদের কারণ? রাগের কারণ? সেদিন বিকেলে তুমি বলেছিলে আমার জন্য তুমি খারাপ হবে। প্রচন্ড খারাপ হবে। এটা তার নমুনা ছিল? পাতালের সদর দরজা খুলে তাতে প্রবেশ করার সময় আমার কথা মনে পড়েনি? এখন কেন মনে পড়ছে? ভালোবাসা কিন্তু সময়, দিন কাল ক্ষণ মেনে চলে না। রাগের বশে নিয়ন্ত্রণ হারায় না। আমার বাবাদের কথা তুমি জানতে অথচ আমাকে জানালে না। যদি আমাকে নিয়ে তোমার একটুও চিন্তা থাকতো, আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা থাকতো তাহলে আমার থেকে কথা লুকাতে না। তোমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা কি? আমার পেছনে লোক লাগিয়েছো,আমাকে নজরবন্দি করেছো। কেন? বিশ্বাস করোনি আমাকে তাইনা? পালিয়ে গিয়েছিলাম, এবং আমি বলেছিলাম আমাকে চাওয়ার মানুষের অভাব নেই তাই?

ভালোবাসা এটাকে বলে না,ভালোবাসায় পাওয়ার ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা থাকে না। শুধু ভালোবাসার মানুষটির সুখ, শান্তিটাই স্পৃহা হয়, অভিলাষ হয়। অঁধরচুঁম্বন তো সবাই করতে চায় কিন্তু সেই অঁধরে হাসি ফুটিয়ে রাখতে ও ধরে রাখতে চায় ক’জন? তুমি বলেছিলে বিছানায় তো অনেকে আসতে পারে, মনে ক’জন আসতে পারে? ইয়্যু নো হোয়াট! মনে কেউ থাকলে বিছানায় অন্যকারোর আসার কোনো সম্ভবনাই নেই। সেখানে মুগ্ধতা তোমার বিছানায় শুয়েছে, তোমাকে ছুঁয়েছে! মানছি তোমাকে সে বেহুশ করে ফায়দা লুটতে চেয়েছে, তোমার এখানে কোনো দোষ নেই, তুমি জানতে না এসব, কিন্তু নিজের ওপর কি তোমার একটুও ভরসা নেই? তোমাকে আমি তোমার চাইতেও বেশি বিশ্বাস করি, এর প্রমাণ কি চাও তুমি? তাহলে শুনে রাখো, পৃথিবির সবাই, যখন তোমার বাবাও তোমাকে অবিশ্বাস করেছিল। ভেবেছিল তুমি সত্যিই মুগ্ধতার সঙ্গে থেকেছো, তখন আমি এটা বিশ্বাস করিনি। কারন আমি জানি আমার ফালাক ভাইয়া এটা করতেই পারেনা। কিন্তু তুমি নিজে যখন অনিশ্চিত হয়ে বিয়েতে সায় দিলে তখন আমার কেমন লেগেছিল? ভাবতে পারবে? পারবে না!

অভিনয় তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো আমার থেকেও বেশি! কারন অভিনয় তোমার জীবনে আগে এসেছে। আমি তো আরও দশ-বারো বছর পর এসেছি। তাই আমি চাইনি আমার আগে যা, যে তোমার জীবনে এসেছে তাকে ভুলে তুমি আমাকে নিয়ে থাকো।কারন যদি এমন হত তাহলে এটা হওয়ার সম্ভাবনাও কম নয় যে আমার পরে তোমার জীবনে আরও কিছু আসতে পারে। তখন তুমি আমাকে ভুলে সেটা গ্রহণ করবে। মানুষ পরিবর্তনশীল। তাই আমি সর্বদা ভেবেছি, চেয়েছি তুমি পরিবর্তন হবে। সবকিছু ছেড়ে আমাকে নিয়ে থাকবে। কিন্তু আরও একটা চলিত কথা আছে, সেটা হচ্ছে ‘মানুষ অভ্যাসের দাস’ তোমার অভ্যাস এত সহজে পাল্টাবে না। আমি অপেক্ষা করেছি, সহ্য করেছি, ধৈর্য ধরেছি। তোমার মুখ থেকে তোমার জীবনের ইতিহাস শুনতে চেয়েছি। অনেক বেশি চেয়েছি তাইনা?

যে আ’ঘা’ত করে সে ঘা’ত’ক হলে যে বিশ্বাসে আ’ঘা’ত করে সে নিশ্চই বিশ্বাসঘা’ত’ক। তুমি আমার বিশ্বাসে চরমভাবে আ’ঘা’ত করেছ। তুমি বলেছিলে তুমি শুধু অভিনয় নিয়ে আছো, আমি বিশ্বাস করেছিলাম এটা। কিন্তু আমি ভুল। তুমি কালো জগতের মোহতে পড়ে গেছো। তুমি বলেছিলে ওসব তুমি ছেড়ে দিয়েছ। আমি বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু ফলাফল আবারও শূণ্য। তুমি বলেছিলে আমি ছাড়া তুমি কারোর মোহতে পড়বে না। কেউ তোমার জীবনে আসবে না । বিশ্বাস করেছিলাম আমি, কিন্তু আবারও ঠ’কে গেলাম। সারাটাজীবন কি এভাবেই কা’টবে আমার? তাহলে এই জীবন চাই না আমার।

দাদাই আমাকে কষ্ট দিয়েছে, তোমার বাবা কষ্ট দিয়েছে,আমীর আঙ্কেলও সবসময় নিজের কষ্ট লুকিয়ে মিথ্যে বলে কষ্ট দিয়েছে। সবার দেওয়া কষ্ট আমি ভুলে যেতে পারি। কিন্তু তোমার দেওয়া কষ্ট? সেটা কিভাবে ভুলবো ফালাক ভাইয়া? খুব কষ্ট হয় যে, যখন তোমার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে তোমার বিশ্বাসঘা’ত’কতার কথা। মনে পড়ে তোমার ওয়াদা ভা’ঙার কথা। বুকের ভেতরটা পুড়ে যায়। যন্ত্রণায় ছটফট করি। দম বন্ধ হয়ে আসে। দুচোখের পানি শুকিয়ে যায় পড়তে পড়তে। কি ভুল করেছিলাম আমি? কি পাপ করেছিলাম যে বিধাতা আমার ভাগ্যে এমনটা লিখে রেখেছিল। আমি বাঁচবো না এটা জানি। তাই আমার বাবা-মামনিকে যে মে’রেছে তাকেও বাঁচতে দেবো না আমি।

আমার একটা কথা রাখবে? আমি যদি ম’রে যাই তুমি মুগ্ধতাকে বিয়ে করবে। অনাথের জীবন কেমন আমার থেকে ভালো কেউ বুঝবে না। মেয়েটা তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। ওকে ভালো রাখবে। ভাববে ওর মাঝেই তোমার চাঁদ নতুন করে এসেছে। তোমার এসব কাজকে আমি মন থেকে মানতে পারবো না। তোমার কাছে ফিরে আসতেও মন চায় না। যদি বেঁচেও থাকি তোমার এসব কাজ দেখলে তোমার কাছে আমি ফিরে আসবো না। মুগ্ধতা তোমার পেশার সঙ্গে যুক্ত। ওকে জীবনে নিয়ে আসলে তোমার ভালোবাসা ও অভিনয় দুটোই থাকবে। তবে গ্যাংস্টার হওয়ার নেশা কেন? কি হবে ওসব করে? ওসব বাদ দিতেও বলবো না। কারন আমি চাইনা আমার চাওয়া মানতে গিয়ে তুমি নিজের চাওয়া পাওয়া ভুলে যাও। তোমাকে বেশি কিছু বলতে চাইনা কারন ইচ্ছে করেনা। তোমাকে লিখতে গিয়ে দু দফা চোখ ভিজলো। এত হালকা কথাগুলো লিখতেও কষ্ট হচ্ছে। অদ্ভুত না?

জানো! মাঝে মাঝে ভাবি, আমি চাইলেই তো তোমার কাছে ফিরে যেতে পারি। কিন্তু আমার আত্মসম্মান বলে ওঠে, তোকে যে ঠকালো তাঁর কাছে যাবি রোজ? তখন আমার উত্তর থাকে না। মিথ্যেবাদী রাখালের গল্প মনে আছে নিশ্চই। তোমাকে আমার তেমন মনে হয়। এখন তুমি সত্য বললেও আমার বিশ্বাস হয়না। কারন পেছনে পেছনে কি করছ তা তো জানি না আমি।তোমার একটা লোককে পিটিয়ে সত্য বের করেছি তাই দুঃখিত। ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। হসপিটালে আছে, আজকালের মধ্যেই ফিরে যাবে তোমার কাছে। তোমার,আমার ওপর নজর রাখার সকল উপায় বন্ধ করে দিয়েছি। চাইলেও আমাকে খুজে পাবে না। তবে যদি নিজেকে বদলাও, আমি ফিরে আসতে চাইবো। (যদি বেঁচে থাকি) নতুবা আমার একাকিত্বই আমার সর্বকালের সঙ্গী হবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি! আজীবন ভালোবেসে যাবো। তবে ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছেটা আর নেই। একটা সময় যাকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছে জাগতো তাকে আজ দূরে ঠেলে দেওয়া ছাড়া গতি নেই আমার। ইশ! কতটা বেদনায় ভরা এই মুহূর্ত তা কেউ বুঝবে না।

তোমাকে ভালোবাসি ফালাক! নাম ধরে ডাকছি বলে অবাক হয়ো না। অনেকদিনের ইচ্ছে আমার। আমি তোমাকে নাম ধরে ডাকবো। ভাইয়া ডাকটা এখন প্রচন্ড বিরক্তিকর লাগে। তাই বলছি অনেক বেশি ভালোবাসি তোমায় ফালাক, কিন্তু ভালোবাসলেও তোমার কাছে ফিরতে চাইনা। চলে যেতে চাই এই অতিতে ঘেরা জীবন থেকে। বেঁচে থাকলে নতুন করে বাঁচতে চাই, আর ম’রে গেলে যতটুকু ছিল আমার জীবনে ততটুকুর তৃপ্তি নিয়েই যেতে চাই।

আমি ছোট থেকে একটা কথা তোমার মুখে সবসময় শুনতাম,’ ভালোবাসা ভালোবাসে, শুধুই তাকে।ভালোবেসে ভালোবাসা বেঁধে যে রাখে। ‘ আমাকে তুমি বেঁধে রাখতে পারলে না। আমি স্বেচ্ছায় বন্ধন গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার মিথ্যেগুলো আমাকে সেটা করতে দেয়নি। আজ চলে যাচ্ছি সব বন্ধন ছেড়ে। মুক্ত পাখির মত ডানা মেলে। ভালো থেকো, ভালোবেসো। কখনও এমন মিথ্যে বলো না যা কারোর মন ভা’ঙে, যা কারোর স্বপ্ন ভা’ঙে, যা কারোর জীবনটাই ত’ছ’ন’ছ করে দেয়। সত্য বলার পর মন ভা’ঙলে তা দোষের নয়। কারন সত্য, সত্যই হয়। আর সত্যের থেকে মূল্যবান কিছু নয়।

আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। সবার কাছ থেকে এভাবে আলাদা আলাদা করে বিদায় নিতে ভালো লাগছে না।
ইতি
তোমার চাঁদ!!!

ডায়েরিটা বন্ধ করে পাশের টেবিলের ওপর তাকালো ফারহান। রোজের সাদা-কালো একটা ছবি ফ্রেম করে রাখা আছে সেখানে। ফারহান ফ্রেমটা হাতে নিয়ে তাতে হাত বুলিয়ে বলে,

-আ’ম স্যরি চাঁদ!আমি বুঝিনি তুই এতটা কষ্ট পেয়েছিস। আমি সত্যিই বুঝিনি। তুই ঠিক বলেছিস তোর গল্পের সবগুলো হিরোই স্বার্থপর। শুধু নিজেদের কথা ভাবে। কিন্তু আর ভাববে না চাঁদ। তোকে ফিরতে হবে। তোর এই গল্পের সমাপ্তি তোকে ছাড়া কিভাবে সম্ভব? দাদাই আর কুসুম সমাপ্তি টানলেও শেষ পর্যন্ত তোকে থাকতে হবে। আজ বুঝতে পারছি আমার স্বপ্ন দেখাটা আসলে ভুল ছিল। তোর নেশার কাছে অন্যসব নেশা অতি তুচ্ছ। মুগ্ধতাকে আমি ছুঁয়েছি কিনা জানি না, কিন্তু যদি না ছুঁয়ে থাকি। তাহলে ফিরবি তো? অভিনয় করেছি, নানা রকম ইন্টিমেট সীন করেছি! অন্যায় করেছি! আমি সব ছেড়ে দেবো চাঁদ! একদম সিম্পিল হয়ে যাবো। ট্রাস্ট মি এবার ওগুলো ছাড়লেও আমার কষ্ট হবে না। কারন সব কষ্ট তোকে ঘিরে রয়েছে। এসবের থেকে উর্ধ্বে তুই। সব স্বপ্ন ভালোলাগার উর্ধ্বে!আমার তোকে বুঝতে সময় লেগে গেল চাঁদ। আমাকে শাস্তি দে, যা ইচ্ছে তাই কর। তবুও ফিরে আয় চাঁদ! প্লিজ ফিরে আয়।

ফারহান সিয়ামকে ফোন দিল। কয়েকবার ফোন বেজে বেজে থেমে যায়। অবশেষে সিয়াম যখন ফোন রিসিভ করে তখন শুনতে পায়, ফারহানের ভগ্নস্বর!
-মুগ্ধতাকে নিয়ে আমীর আঙ্কেলদের বাড়িতে এসো।

_________

-তোমার সঙ্গে সেদিন রাতে আমার কি হয়েছিল মুগ্ধতা? সত্যটা বলবে। কি করেছিলাম আমি? আর তুমিই বা কি করেছিলে?

মুগ্ধতা থতমত খেয়ে তাকালো।ফারহান এখনও কাঁদছে আর ওর হাতে একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি।মুগ্ধতা বুঝলো এটা রোজের ছবি। কিন্তু এভাবে কান্নাকাটি করছে কেন ফারহান? মুগ্ধতার উত্তর না পেয়ে ফারহান আবার প্রশ্ন করে,

-বলো।

-নতুন করে কি বলবো? সেদিন তো সব বললাম। তুমি তো সবটাই শুনেছো।

-তুমি আবার বলো। আমার চাঁদকে আমি শোনাতে চাই সবটা। তোমার মুখ থেকে শুনলে ও বিশ্বাস করবে। তুমি যদি সব সত্য বলো, আমি তোমাকে আবার বন্ধু বানাবো মুগ্ধতা। প্লিজ!

-চাঁদকে এত ভালোবাসো? আমার ভালোবাসায় কিসের কমতি ফারহান?

-আত্মমর্যাদার!আত্মসম্মান নেই তোমার।থাকলে সেদিন নিজেকে আমার সামনে বিলিয়ে দিতে চাইতে না। চাঁদ আর বাকি মেয়েরা আলাদা মুগ্ধতা!বোঝার চেষ্টা করো। তোমার জন্য, তোমার সুখের জন্য ও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে।

-তাহলে ওর ত্যাগকে সম্মান দাও। আমাকে আপন করে নাও। আমিও তো তোমাকে ভালোবাসি। তোমার চাঁদের মত ছেড়ে চলে যাওয়া ভালোবাসা নয়। আমি তোমাকে কখনও ছেড়ে যাবো না।

-ঠান্ডা মাথায় তোমাকে অনুরোধ করছি মুগ্ধতা। আমার সঙ্গে কোঅপারেট করো। নাহলে তোমাকে শেষ করতে আমার দুসেকেন্ডও সময় লাগবে না। তোমাদের বাপ মেয়ের খেলা আমার চাঁদকে ঘিরে। চাঁদের নিরাপত্তার জন্য চুপ ছিলাম। চাঁদই যখন চলে যাচ্ছে তখন আমার চুপ থাকার কোনো প্রয়োজন দেখছি না।

-মানে? কি করবে তুমি? আমাকে মা’রবে? পারবে না।

ফারহান বাঁকা হেসে বলে, ‘দেখতে চাও, পারি কিনা? ‘

-ওকে, বলছি। সেদিন তোমার খাবারে ড্রাগ দিয়েছিলাম আমি। তুমি নেশায় বুদ হয়ে গিয়ে রোজের ওপর রাগ দেখিয়ে আমাকে কিস করেছিলে। আমি ভেবেছি তুমি আমাকে চাও, তাই তোমার সঙ্গে ইন্টিমেট হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে তোমার জ্ঞান পুরোপুরি হারিয়ে যায়। তোমাকে অজ্ঞান দেখে আমি নিজের দেহে নিজেই কলঙ্ক লেপ্টে নেই। ব্যাস এটুকু।

-এটুকু?

-আর কি?

-চাঁদের কানে সেদিন রাতের কথাগুলো পৌঁছালো কি করে?

-জানি না। হয়তো সাইমুন বলেছে। সাইমুনকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না তাই শিওর না ও বলেছে কিনা।

ফারহান চেঁচালো, ‘সিয়াম! ‘ সিয়াম ছুটে আসে। ফারহান স্পষ্ট গলায় বলে,
-মেহমেদ এসেছে?

-জি স্যার।

-ম্যাডামকে নিয়ে মেহমেদের হাতে হস্তান্তর করো। মেহমেদকে বলে দেবে, সে যেন মুগ্ধতাকে একটি যন্ত্রণাদায়ক মৃ’ত্যু উপহার দেয়।

-রোজ ম্যামের খোঁজ?

-ও নিজেই আমাকে খুজে নেবে।চাঁদকে খোজার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি এই স্লাটটাকে নিয়ে যাও।

-ওকে স্যার।

মুগ্ধতা ফারহানের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাতেই ফারহান অত্যন্ত দুঃখি মুখে বলল,

-তোমাদের জন্য আমার জীবনের অনেকগুলো বছর নষ্ট হয়েছে। তোমরা বেঁচে থাকলে আরও নষ্ট হবে। শুধু আমার না, অনেকের। তাই নিজেদের জীবনটা ত্যাগ করে সবাইকে সুখ শান্তিতি দাও, মুগ্ধতা। জানো তো? একটা প্রবাদ, চলিত বাক্য আছে। “ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ”
তোমার জীবনের সমাপ্তি সুখকর হোক। সিয়াম নিয়ে যাও এটাকে।

মুগ্ধতাকে নিয়ে সিয়াম চলে যেতেই ফারহান অস্ফুট কন্ঠে আওড়ালো,

-কালো জগৎটাও ছেড়ে দিলাম চাঁদ। এটাই হবে তোর ফালাকের জীবনের শেষ হত্যাকান্ড! অভিনয়ের জগৎ থেকে কাল অফিসিয়ালি বেরিয়ে আসবো। প্রডিউসারের টাকাটা ফেরত দিতে হবে। নাহলে আজই অতিত জীবনের পরিসমাপ্তি হত। সাবধানে থাকিস চাঁদ! তোকে আমার কাছে আসতেই হবে। তাই আশা করি নিজের খেয়াল রাখবি!

_________

ইরফানের সামনে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে রোজ। রোজের ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি। ইরফান সাহেব কিছুসময় পূর্বেই নিজের ছেলের মৃ’ত্যুর সংবাদ শুনেছেন। যার দরুন রোজকে এভাবে আটকে রেখেছেন। শীগ্রহই রোজকেও তিনি শেষ করবেন। শুধু টাকাগুলো হাতে পাওয়া অবধি তিনি সময় দিয়েছেন রোজকে।

বর্ডারের পাশেই নদীর তীরে তাবু টানানো হয়েছে। রোজ সেখানের একটা তাবুতেই আছে। আরিফিন স্যার সতর্ক দৃষ্টিতে পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছেন। এখনও অবধি কেউ জানে না রোজের সঙ্গে আরিফিন সাহেবও মিলিত আছেন। পূর্বের ন্যায় মাইন পোঁতা হয়েছে মাটির নিচে। বিস্ফোরণের স্থানও ঠিক করা হয়েছে।আরিফিন সাহেব সেটাই লক্ষ করছেন যেন নির্দোষ কেউ ওদিকটায় না যায়। বিকেলবেলা টাকা না পেয়ে যখন ইরফান রাগে অগ্নিশর্মা রূপ ধারণ করেছে তখনও ক্ষতবিক্ষত রোজ মৃদু মৃদু হাসছে। ইরফানের লোক এসে রোজকে নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। রোজের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। রোজের শরীরে এতটা ক্ষত তৈরি হয়েছে যে হাত পা নাড়ানও যাচ্ছে না। ধাঁরালো অস্ত্রে রোজের শরীর ফালা ফালা করা হয়েছে। তাতে আবার নুনও ছেটানো হয়েছে রোজের মত এক অপরাধির শাস্তি হিসেবে। আরিফিন সাহেবের চোখাচোখি হতেই তিনি রোজকে ইশারায় বোঝালেন সব ঠিক আছে। রোজ হেসে ইরফানকে উস্কে দেওয়া উদ্দেশ্যে বলে,

-আপনার ছেলেকে মা’রার সময় আমি তাকে শূকর, স্যরি শুয়ো** বাচ্চা বলেছিলাম। কিন্তু আপনি তাঁর থেকেও নিকৃষ্ট। কি ভেবেছেন আমাকে মা’রলে টাকাগুলো উড়ে উড়ে আসবে? আপনার গলা অবধি গেলানোর জন্য টাকা সরাইনি আমি। সরিয়েছি নিজের নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য। সেই টাকার হদিশ আপনারা ইহকালে পাবেন না।

ইরফান রেগে এগিয়ে যেতেই পায়ের নিচে কিছু্র আভাস পেল। শুধু ও নয়। আরও তিন-চারজন সেটা বুঝেছে। ইরফান নিচে তাকিয়ে পায়ের তলায় মাইন দেখে ভয়ে, রেগে রোজের দিকে তাকালো। রোজের পরিকল্পনা বুঝতে সময় লাগেনি ওর। আনসারীর সেই মৃ’ত্যুর খেলার পুনরাবৃত্তি করেছে আনসারীর মেয়ে। পা তোলামাত্র বিস্ফোরণ ঘটবে। আজ জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও হারতে চায়না ইরফান। তাই বন্দুক বের করে রোজের দিকে তাক করে বললেন,

-সত্যিই আনসারীর কন্যা তুমি। কিন্তু আমি তোমার বাবার মত ভালো নই। তাই শত্রু ও বিশ্বাসঘা’ত’ককে পৃথিবির বুকে রেখে যাবো না। আরিফিনকেও শেষ করে যাবো।

বন্দুক আরিফিনের দিকে ঘোরাতেই রোজের চোখের সামনে আরিফিনের আঠারো বছরের মেয়ে আর বাইশ বছরের ছেলেটার চেহারা ভেসে উঠলো। তাদের পরিণতি রোজের মত হবে? রোজ উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করে। একটা মাইন ব্লাস্ট হয়। লোকটার বন্দুক ছিটকে রোজের পাশে পড়তেই রোজ সেটা তুলে নিলো। ইরফান বন্দুকের ট্রিগার টান দিতেই রোজ হাটতে শুরু করে। আরিফিন সাহেবের নজর তখন তাবুর ভেতর। তিনি আর্মিদের উপর নজর রাখছিলেন। এত দ্রুত এসব ঘটতে পারে তা অনুমানও করেননি তিনি। রোজ হাটছে দেখে ইরফান কাউন্ট ডাউন শুরু করে। দশ, নয়, আট, সাত, ছয়… ইরফান শ্যুট করতেই রোজ লাফিয়ে পড়লো আরিফিন সাহেবের ওপর। গুলিটা গিয়ে ঠিক রোজের পেট বরাবর লাগে। ইরফান আবারও শ্যুট করে, রোজের পিঠে লাগলো এটা। রোজ ইরফানের পা বরাবর শ্যুট করলো, যেন পা সরে গেলে ব্লাস্ট হয়। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে গুলি করার পর পরই নদীতে পড়ে যায় রোজ। পানিতে পড়ার আগ মুহূর্তে সে দেখলো বিস্ফোরণের দৃশ্যটি। ইরফানের দেহ খন্ডবিখন্ড হয়ে ছড়িয়ে গেল। রোজের মাথা গিয়ে লাগে পানির নিচের পাথরে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে রোজের। রোজ অস্পষ্ট কন্ঠে বলে,

-তোমার কাজ সম্পন্ন করেছি আমি বাবা। টাকাগুলো ও বিশ্বাসঘা’ত’ককে তাদের উপযুক্ত স্থানে পৌঁছে দিয়েছি। আর আমিও আসছি তোমাদের কাছে। ফালাক, তোমাকে বলেছিলাম আমি সবসময় তোমাকে ভালোবাসবো। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমাকে ভালোবাসবো। আমার কথা আমি রেখেছি। ভালোবাসা নিয়েই চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো তোমরা।

আরিফিন সঙ্গে সঙ্গে ডুবুরি পাঠালো। কিন্তু নদীর স্রোত এত বেশি ছিল যে রোজের শরীর কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল তা ডুবুরিরাও বলতে পারলো না। আরিফিন জানে উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে মাত্র কয়েকটা মিনিট বাঁচবে রোজ। আর সে সময়টুকুও অতিবাহিত হয়ে গেছে। যার অর্থ রোজ আর নেই। লা’শটাও হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই খুজে পাওয়া যাবে। এভাবে এত কম সময় নিয়ে মেয়েটা এসেছিলো ভাবতেই আরিফিনের চোখ ভিজে আসে। কোথাও না কোথাও আরিফিনও দায়ী রোজের মৃ’ত্যুর জন্য।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে