তুই হবি শুধু আমার পর্ব-২১

0
1151

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_একুশ

সবার সামনে হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে রোজ। আজ সে অফিসিয়ালি মিশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। ফিরে আসতে পারবে কিনা জানে না ও, তাই সবার সঙ্গে দেখা করে যেতে চায়। আরশানদের বাড়িতেই এসেছে সবাই। আরশান, আরসালান, ফারহানসহ ফারদিন, আমীর ও ফারিয়া আন্টি সোফায় বসে আছেন। বাকিরা দাড়িয়ে আছে এদিক সেদিক। সবার একটাই কথা রোজ যেন থেকে যায়। রোজকে সুন্দর জীবন এরা উপহার দেবে। নষ্ট হয়ে যাওয়া বছর ও সবার সব ভুলের মাশুলও দেবে সবাই। রোজ সবার বক্তব্য শুনে ফিচেল হাসে। ফারহান এই হাসি আগেও দেখেছে। পরিচিত এই হাসিটা বিদ্রুপ করে হাসে রোজ। যখন মনে অনেক কষ্ট থাকে কিন্তু সে কষ্ট হেসে উড়িয়ে দিতে হয় তখন এভাবে হাসে রোজ। ফারহানের ভয় শুরু হয়ে গেলো। একজন চামচা যে সেবার নিখোঁজ হলো সে রোজের কাছে নয় তো? সব বলে দেয়নি তো? রোজ নিজেও সোফায় বসে বলতে শুরু করল,

-সবাই আমাকে কেন অনুরোধ করছো? এই কাজটা তো বাবা আমাকে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব তাঁর মেয়ের নয়?

ফারদিন সাহেব কোমল কন্ঠে বলল,
-সব বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি এভাবে যাবে না রোজ। দরকার হলে ফালাককে সঙ্গে নিয়ে যাও।

-কেন? ফালাক ভাইয়ার এ ব্যাপারে অনেক বেশি জ্ঞান আছে নাকি? গ্যাংস্টার, টেরোরিস্ট, ডিটেক্টিভ এগুলোর ওপর সে কি পি.এইচ.ডি করেছে?

-না করলেও নিয়ে যাও।তুমি একা গেলে আমাদের চিন্তা হবে।

-নিজের ছেলেকে কেন মৃ’ত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাচ্ছো আঙ্কেল? অপরাধবোধ, অনুশোচনা থেকে? তাহলে বাদ দাও সেসব। তোমাদের ওপর আমার কোনো অভিযোগ নেই।

ফারদিন সাহেব কেঁপে উঠলেন।রোজ ঠিক কি বোঝাতে চাইলো? ফারহানের চোখাচোখি হতেই বাবাছেলের দশা বেহাল হলো। দুজনেই ঘামছে। আরশান নিজেও কেমন নড়েচড়ে বসলো। অতিত বর্তমান জীবনের সকল কথা মনে পড়লো। অনুধাবন করতে পারলো সেই মেয়েটির কথা সে ছোট থেকেই ত্যাগ করা শিখেছে, অন্যকে কি ভাবে ভালো রাখতে হয়, ভালোবাসতে হয় শিখেছে। কি ভাবে সবাইকে এতগুলো বছর এক সুতোয় বেঁধে রেখে নিজেকে দূরে রেখেছে। আরশানের মনে পড়লো রোজ সবসময় ডায়েরি লিখতো আর বলতো,

”””’এই গল্পটা আমার দাদাই। কারন যে লেখে, যে সৃষ্টি করে সেটা তো তাঁরই হয়। তাইনা?কিন্তু গল্পটার হিরোইন বোধ হয় আমি নই। আমার গল্পে সর্বদা তুমি ও কুসুম লিড রোলে থাকবে। ফালাক ভাইয়া তো আমার সঙ্গে থাকার মানুষ। আমি হিরোইন না হলে সে এই গল্পের হিরো কিভাবে হবে? বাস্তবে সে অভিনেতা হলেও এই অসমাপ্ত গল্পের হিরো সে হবে না। কিছু না পাওয়া হিসেবের পাওনা পূর্ণতা পাবে তোমার জীবনে। আমার বা ওর জীবনে না। আমি না থাকলে তুমি আর কুসুম এই গল্পটা চলমান করে রাখবে। গড়িয়ে চলতে থাকবে গল্পটা যেমন গড়িয়ে যায় সময়। তোমার কুসুমকে আমি চিনি না। কিন্তু তোমাকে চিনি খাঁটি স্বর্ণ চিনতে ভুল হবে না তোমার। তাই আবারও বলছি আমাকে গুরুত্ব দিতে হবে না। এই গল্পের হিরোইন কুসুম, তাকে গুরুত্ব দাও। আমি নাহয় বিশেষ এক চরিত্রে থাকবো। বোন, বন্ধু, আনসারী ও রেণুর মেয়ে, ফালাকের চাঁদ, আঙ্কেলদের মেয়ে, অভীদের ফুপি হিসেবে। এতগুলো সম্পর্ক পেয়েছি আমি। এসবের সামনে সামান্য হিরোইন হতে চাইবে কে? আমি এটা ভেবেই শান্তি পাবো আমি না থাকলেও আমার রেখে যাওয়া গল্পটা থাকবে। তাঁর মূল চরিত্রগুলো থাকবে। তাদের স্মৃতি থাকবে, তাদের সকল কথা থাকবে। কিন্তু আমার এই গল্পে আমার, একান্তই আমার কাহিনিগুলো কি গ্রহণযোগ্যতা পাবে? যদি গল্পটা আমার হয় নিশ্চই পাবে। এই গল্পের শুরুটা যেমন তোমাকে, তোমাদের দিয়ে শুরু হবে তেমন শেষও তোমাদের দিয়ে হবে। আমি ডায়েরিতে লিখতে শুরু করেছি। শেষ হলে সবাইকে দেবো সেটা পড়তে। পড়বে তো তোমরা? নাকি ভুলে যাবে আমাকে? ‘হিরোইন ও হিরো পেলে কারোর তো এই রোজ বা ফালাককে মনে থাকবে না তাইনা? তাই ভাবছি আমি আমার ঘটনাও লিখবো। সবটা হিসেব করে লিখবো। পড়লে পড়বে না হলে রেখে দেবে স্মৃতি হিসেবে।”””

রোজের হাতে সেই ডায়েরিটা রয়েছে এখন। আরশান অয়ন্তির কানে ফিসফিসিয়ে ঘটনা’টা বলতেই অয়ন্তি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে। নীল রঙয়ের কভার এই ডায়েরিটির। তার ওপরে গোটা অক্ষরে লেখা “আনসারী”। সম্ভবত এটা রোজের বাবার ডায়েরি যেটা আনসারী সাহেবের পর রোজ লিখতো। রোজ মৃদু হেসে বলে,

-আমাকে কি এমন দুঃখি মুখে বিদায় জানাবে তোমরা? তোমাদের এমন কষ্টে জর্জারিত মুখ দেখে গেলে আমার ফেরার ইচ্ছেটাই যে থাকবে না। তোমরা কি এটাই চাও? যদি চাও, রোজের ফেরার দরকার নেই। রোজ ফিরবে না।

ফারহান উঠে দাঁড়ালো। রোজ ভ্রুকুটি করে তাকায়। এই পাগল মানুষটাকে সামলানো কঠিন। আরশানের মতো সে হিসেব করে চলতে পারে না, ভদ্রতা, নম্রতা জানে না। লজ্জাশরমও নেই। সবার সামনে জড়িয়ে টড়িয়ে ধরলে ওর থেকে নিজেকে কিভাবে ছাড়াবে রোজ? যে অভিমানগুলো সবার জন্য জমা হয়ে আছে তা সে সঙ্গে নিয়েই যেতে চায়। মনে কষ্ট থাকলে মনোবলটাও বাড়ে। ফারহান রোজের পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পড়লো শব্দ করে। আরশান আরসালান শব্দে উঠে পড়ে। এগিয়ে এসে ফারহানকে ধরারও ঝোঁক নেয়। কিন্তু তা ফারহান উপেক্ষা করে রোজের পা ধরতে যায়। রোজ দ্রুত পা টেনে নিলো। ফারহানের চোখ ভিজে আসে। সে কেঁদে উঠে বলে,

-তুই আমার ওপর অভিমান করে আছিস চাঁদ। আমি জানি, তুই আমি আমরা সবাই বদলে গেছি।কিন্তু এতটাও বদলে যাইনি যতটা বদল হলে তুই আমাকে তোর পা ধরতে দিবি না। তোর পা আমি এমনিও ধরতে পারি চাঁদ, এতে পাপ হবে না। তুই জেদ করে বলতিস তোর পা ধরে যেন মাফ চাই আমি। তখন আমি বলতাম, এতে পাপ হবে। আজ বলছি, পাপ হবে না। আমি নিজ থেকে তোর কাছে মাফ চাচ্ছি। তোর পা ধরছি, ছেড়ে যাস্ না আমাকে। আমি বাঁচবো না। তোর কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারবো না। তোর ওপর রাগ অভিমান করে ভুল করেছি আমি। সব ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবো। যা বলবি তাই করবো। অভিনয় ছেড়ে দেবো। সকল প্রকার বিলাসিতা ছেড়ে দেবো। আমি শুধু তোকে নিয়ে থাকবো, তোকে নিয়ে থাকতে চাই। দেখ আমি আগের মত রাগ করিনা, রাগ করার মানুষটা তো থাকেইনা রাগ করবো কার ওপর? বাবা তুমি ওকে বলো না, আমার কাছে থাকতে। ও তোমার কথা ঠিক শুনবে।

রোজের চোখে পানি চলে আসলো। মানুষটা এভাবে কথা বললে রোজের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। সব রাগ, অভিমান মিটে যায়। কিন্তু এবার তা হবে না। অভিমান জমা হতে হতে তা পাহাড় সমান হয়ে গেছে। এত সহজে তা মিটবে না। রোজ কানের ব্লুটুথ অন করে কাঠ কাঠ গলায় বলল,

-জি চাচ্চু। আসছি আমি, জিপ পাঠিয়ে দিয়েছেন তো? ওকে। না, আসেনি এখনও চলে আসবে, হয়তো রাস্তায় আছে। উহু, চিন্তা করবেন না, আমি টাইমেই চলে আসবো।

আমীর সাহেব নিজেও রোজের পাশে এসে বসলেন। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-আমাদের ওপর তোর এত অভিমান? কি করেছি সেটা তো বল। কোন কাজে কষ্ট পেয়েছিস? যে সবাইকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছিস।

-আমি কাউকে ছেড়ে যেতে চাইনি আঙ্কেল। এমনও সময় এসেছে যখন সব ভুলে তোমাদের কাছে থাকতে চেয়েছি। ভেবেছি আমার বাবা-মামনি নেই তাতে কি? তোমরা আছো। কিন্তু সেখানেও আমি ব্যর্থ! আমার জীবন ব্যর্থতায় পূর্ণ আঙ্কেল। সুখ আমার জন্য যতটুকু বরাদ্দ ছিল আমি তা পেয়ে গেছি।এবার অসুখের ডাকে সাড়া দিতে হবে। তোমরা জানো আমি ভিন্নস্বাদের অনুভূতি ভালোবাসি। এটুকু ভালোবাসা নিয়ে যেতে দাও।

-আমরা কি তোকে ভালোবাসি না?

-ভালোবাসলে বিশ্বাস করতে হয়। ভরসা করতে হয়। আফসোস! আমি সবাইকে বিশ্বাস, ভরসা করলেও কেউ আমাকে করেনি। পৃথিবিতে প্রতিটা মানুষ স্বার্থপর এটা মানো বা না মানো। আমিও স্বার্থপর তাই তো শুধু নিজের সুখের জন্য চলে যাচ্ছি।

জিপগাড়ির আওয়াজ আসতেই রোজ ফোন ও পি’স্ত’ল হাতে উঠে দাড়ালো। চোখের পানি মুছে ডায়েরিটা সে আমীর সাহেবের হাতে তুলে দেয়। ফারহানের দিকে সে একনজর তাকিয়ে বলে,

-আমাকে যদি ভালো রাখতে চাও, তাহলে তোমার ওই আঁধারে নিমজ্জিত দুনিয়া ছাড়তে হবে। আমার কসম ভাইয়া! তুমি কখনও হাতে অস্ত্র তুলে নেবে না। কখনও না। জানি কসম দিতে হয়না, কিন্তু এটাও জানি আমার কসম তুমি অগ্রাহ্য করবে না। আমি ফিরে আসবো কিনা জানি না, তবে তোমরা যদি আমাকে দেওয়া কথা রাখো তাহলে ফিরে আসার চেষ্টা অন্ততো করবো। বিধাতাকে বলবো সে যেন আমাকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। নতুবা মৃ’ত্যুই সই।

রোজ চলে যেতে থাকলে ফারহান বার কয়েক চেঁচাল। রোজ পেছনে ফিরলো না।কারন যদি পেছনে একবারও তাকায় তাহলে সে যেতে পারবে না। রোজ জিপে উঠে চলে গেল। ফারহান মূর্তির ন্যায় বসে রইলো । আমীর সাহেব ডায়েরি খুললেন। কিন্তু কৌতুহলী অয়ন্তি ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে নিজেই নিয়ে পড়তে শুরু করে।

”বাবার প্রিন্সেসের জন্য বাবার তরফ থেকে ছোট্ট একটা গিফট”

”’ব্যাংকের কোড, টাকার হদিশ, মিশনের বর্ণনা, কে কেমন তাঁর বর্ণণা।”’

”’কখনও মন খারাপ করবে না। সর্বদা জানবে তোমার তিনটে বাবা, তিনটে মামনি। আমি যাচ্ছি তাতে কি? ওরা তো থাকবে। ওরা তোমাকে নিজের মেয়ের চেয়েও ভালোবাসে। ওদের কষ্ট দেবে না।ছোট থাকতে তুমি কত ভুল করেছো, অন্যায় করেছো। ওরা তা আপন ভেবে নিয়েছে তাই কখনও ওদের কাছ থেকে কষ্ট পেলে তা মনে রাখবে না। ওরা যা বলবে তাই শুনবে। ওকে?”’
‘ঠিক আছে বাবা’—রোজ💙

”’কষ্ট পেলে প্রকাশ করবে না। কারন কেউ একবার তোমার দূর্বলতা জানলে তোমাকে নিঙড়ে ফেলতেও দু বার ভাববে না। এ জগৎ ভীষণ অদ্ভুত! তাই সর্বদা সচেতন থাকবে। কষ্ট পেলে রেণুকে অথবা ফালাককে বলবে। কষ্ট ভাগ করে নিলে তা কমে যায়। ”’
‘কেউ তো নেই বাবা। আমি তো বড্ড একা।’—-রোজ💙

”’বড় হয়েছো। সময় পাল্টাচ্ছে। চোখের সামনে যেসব ভাসমান আবেগ, রঙিন দুনিয়া দেখতে পাচ্ছো তার ঠিক ভুল বুঝতে শেখো। কারো দুটো মিষ্টি কথা শুনেই গলে যাবে না।রেণু অবশ্য এসব বলতো তোমাকে। কিন্তু আমি নিজেই বলে রাখছি, তুমি তো জেদি অনেক যদি মামনির কথা না শোনো? আমার কথা তুমি ফেলতে পারবে না আমি জানি। ”’
‘জেদ নেই বাবা। আমি এখন খুব করে মামনিকে চাই। তাঁর বকা খেতে চাই, দুষ্টুমি করতে চাই। কিন্তু দায়িত্ব ও একাকিত্বের বেড়াজালে আমার সেসব ইচ্ছে চাপা পড়ে গেছে। আমি খাঁচার বন্দি পাখি হয়ে গেছি যেটা আমি কখনও চাইতাম না। ‘—-রোজ💙

এমন আরও ছোট ছোট কথোপকথন আছে আনসারী সাহেব ও রোজের। কয়েকপৃষ্ঠা সামনে যেতেই ছেড়া পাতার আভাস পাওয়া গেলো। এই কাগজগুলো রোজ ছিড়ে ফেলেছে। শেষের দিকে আবারও লেখা।

💙আমীর আঙ্কেল💙
তোমার ব্যাপারে যত বলবো ততই কম। শুধু এটুকুই বলবো, ইউ আর দ্যা বেস্ট চাচ্চু! তোমাকে কখনও চাচ্চু বলে ডাকিনি । ভেবেছিলাম ফিরে এসে ডাকবো। কিন্তু আমার ভাগ্য মনে হয় ওতটাও ভালো নয়। যাই হোক লাভ ইয়্যু চাচ্চু!

💙দাদাভাই💙
তুমি বড্ড খারাপ দাদাভাই। ভাবিকে শুধু রাগিয়ে দাও। জানো না, ভাবি তোমার থেকে কষ্ট পেলে কাঁদে। আমার মিষ্টি ভাবিটাকে কাঁদিয়ে তুমি অন্যায় করো। তাকে আর রাগাবে না। আজই অতিতের সকল ভুলের জন্য মাফ চাইবে। ঠিক আছে? অভী অয়নকে একদম বকবে না। ওরা এখন দুষ্টুমি করবে না তো কখন করবে? আমি চাই না আমার মত কেউ ছেলেবেলার আনন্দ হারাক। ওদের পড়া ওরা ঠিক করবে। ওদের সঙ্গে তেমন ডিল হয়েছে আমার। তাই ওদের বকাবকি করবে না, আমি দেখেছি তুমি ওদের খুব বকা দাও, এভাবে বকলে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে অসুবিধা হয়। ওদের সঙ্গে ঠান্ডাভাবে কথা বলবে। অফিসের কাজ অফিসে ফেলে আসবে। সেটা টেনে বাড়িতে আনবে না। চাচ্চুর খেয়াল রাখবে, চাচ্চু রাতে অতিতের কথা মনে করে কাঁদে, আমি প্রায়ই রাতেই চাচ্চুর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেছি। তাকে কখনও একা রাখবে না, একাকিত্ব মানুষের সকল অনুভূতিকে গ্রাস করে ফেলে। অসহায় করে তোলে। রজনী ভাবির ফুল পছন্দ। রোজ রাতে ফেরার পথে তাকে রোজ দেবে উপহার স্বরূপ। তিন বাচ্চার বাপ হয়েছো বলে স্বামীর রোল থেকে বেড়িয়ে গেলে চলবে না। বুঝেছ? তোমাকে মিস করবো খুব দাদাভাই। লাভ ইয়্যু!

💙রজনী ভাবি💙
আমার বোনের থেকেও বেশি তুমি। মামনির পরে তুমি আমাকে যতটা স্নেহ দিয়েছো তেমনটা সবাই পারেনা। অনেকে ননদকে পছন্দ করে না। চোখের বালি ভাবে। সেখানে তুমি সর্বদা দাদাই, ফালাকের থেকে আমাকে বেশি ভালোবেসেছো। এমন অনেক সময়ও দেখেছি তুমি নিজের সন্তানদের থেকে আমাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছো। কিভাবে মায়ের ভূমিকা পালন করতে হয় তা তোমার থেকে শেখা উচিত। আমার গল্পে তুমি একটা দায়িত্বশীল, মমতায় ঘেরা চরিত্র! তোমার তেমন কথা লেখা নেই গল্পে তবে জ্বরের রাতের আবছা ঘটনাগুলো লিখেছি। অভীকে ধমকানোর মুহূর্তটুকুও লিখেছি।মূলত তোমাদের সবার কথাই কিছু কিছু লিখে রাখলাম।যখন পড়বে তখন আমার কথাও মনে পড়বে। পড়বে তো? তোমার স্নেহময় ভালোবাসার কথা মনে পড়বে আমার। সবাইকে নিয়ে ভালো থেকো, ভালোবাসি ভাবি।

💙ফারিয়া আন্টি💙
তোমাকে অনেক জ্বালিয়েছি তাইনা? তবুও মুখ বুজে আমার সব জ্বালাতন সহ্য করেছো। ভেবেছিলাম মামনি ডাকটা তোমার জন্যই বরাদ্দ। কিন্তু সময় সুযোগ হলো না। তোমার ছেলের বউ না হয়ে কি তোমাকে মামনি ডাকা যাবে না? আমি জানি তোমার উত্তর। তুমি মেয়ে হিসেবেই চাও আমাকে। ছেলের বউ হিসেবে না। তাই মেয়ে হয়েই বলছি। মামনি হিসেবে তোমাকে পেয়ে তৃপ্ত আমি। লাভ ইয়্যু মামনি।

💙দাদাইয়ের কুসুম💙
তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সময়কাল অতিস্বল্প। তবুও তোমার সঙ্গে আমার ভালো একটা সম্পর্ক হয়েছে সাধারনত সবার সঙ্গে আমি মিশতে পারিনা। ভালো লাগে না। তবে তোমার সঙ্গ আমার ভালো লাগতো। আমাকে তুমি তোমার অনাপির জায়গা দিয়েছো তার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। জানো আমি ছোটবেলায় বলতাম আমার শুধু ভাই (দাদাই, দাদাভাই) আর বন্ধু আছে। কোনো আপু নেই। আমার আপু থাকলে তাকে আমি হীরামন বলে ডাকতাম। রূপকথার হীরামনকে জানো? যে সুখের সংবাদ নিয়ে আসতো, বিপদ থেকে রক্ষা করতো। অবশ্য তুমি তেমনটাই, আমার দাদাইয়ের বিপদের ঢাল। তার সুখ, ভালোবাসা। আমার গল্পের প্রধান চরিত্রের একটা ডাকনাম থাকা উচিত। দাদাই তো তোমাকে কুসুম ডাকে। আমি না’হয় হীরামন দিলাম। মিস ইয়্যু হীরামন। অল্পদিনেই ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। সাবধানে থাকবে, নিজের যত্ন নেবে আর আমর দাদাইকে অনেক অনেক ভালোবাসবে।

💙দাদাই💙
তোমাকে কি লিখবো? বউ পেয়ে যে বোনকে ভুলে যায় তাঁর মত মানুষকে নিয়ে রোজ লিখতে পছন্দ করে না। তবে পুরো দোষটা তোমারও না। কুসুমকে এতো কষ্টে পেয়েছো তাই ওকে নিয়ে তোমার বেশি ভয় থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার গল্পের হিরোগুলো কেন এত স্বার্থপর? ফালাকের কথায় পরে আসছি। আগে তুমি বলো, সেদিন এক্সিডেন্টে যদি আমি টপকে যেতাম? তোমার বউয়ের জন্য, তোমার বউকে সুস্থ করার জন্য এত বড় একটা রিস্ক নিলাম আর তুমি? শেষে কিনা আমাকেই দোষারোপ করলে? খুব খারাপ এটা। আমি তোমার আর কুসুমের সব কথা শুনতে পাই কারন কি জানো?কুসুমের কানের দুল আর তোমার ঘড়ি যেগুলো আমি গিফট দিয়েছিলাম, যেগুলো তোমরা সারাক্ষণ পড়ে থাকো তাতে ছোট্ট ছোট্ট দুটো চিপ আছে যার শব্দতরঙ্গ আমার ফোনে প্রতিটা মুহূর্তে সাপ্লাই হতো। ওর মাধ্যমেই তোমাদের ভালো মন্দের খোঁজ রাখতাম আমি। দূরে গিয়ে একা থাকলেও তোমাদের চিন্তা বেশি বৈ কম হতো না। তাই স্যরি! গোপন অনেক কথা জেনে গেছি। সেগুলো আমার গল্পে আছে। ডায়েরি পড়লে জানবে। তোমাদের ক্যাফের দেখা, বাসর ঘরের ফার্স্ট সীন, গাড়িঘোড়ার সিন, বাথরুমের সিন! তোমরা যখন অনেক বছর পর এগুলো কিছু কিছু ভুলে যাবে তখন সবটা মনে করানোর জন্য লিখে রাখলাম। তোমাদের কথাগুলো ভোলা যাবে না, ভুলতে দেওয়া যাবে না। কারন তো জানোই, আমার গল্পের সবথেকে প্রিয় ও জাদুর জুটি তোমরা। প্রণয়ের পূর্ণতার দর্শন তোমরা। আমার অসমাপ্ত জীবনের পরিপূর্ণ কাহিনি তোমরা। তবে তোমার কিছু কিছু কথা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে, যেমন রেডিও সেন্টারের ঘটনা, হসপিটালের ঘটনা। তবে সেটা ধরার মধ্যে পড়ে না। সব প্রিয়দের ওপর অভিমান করতে নেই। লাভ ইয়্যু দাদাই, সবাইকে বিশেষ করে কুসুমকে ভালো রেখো। ভালোবেসো।

💙বাচ্চারা💙
আমি যে ফ্লাটটা কিনেছি সেটা আর আমার স্কুটার, বাইক অভী অয়নকে দেবে। অভীরা ট্রাভেল পছন্দ করে।
বাবা আমার জন্য প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা জমিয়ে রেখে দিয়েছিলেন ব্যাংকে। আমি না থাকলে টাকাগুলো শুধু ইন্টারেস্ট পেয়ে বৃদ্ধি পাবে। আমি চাই ট্রাভেলের খরচ ওখান থেকে হোক। আর বাকি টাকা দাদাইয়ের বেবি ও রোশনির জন্য।
আমার আমানতগুলো ওদের বুঝিয়ে দেবে।

💙ফারদিন আঙ্কেল💙
তোমার কথা মনে পড়লে কেন জানি না বুক চিরে এক বিশ্রি দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে আঙ্কেল। তুমি আমাকে কখনও মেয়ে মনে করোনি। আমাকে ঠকিয়েছো তুমি। তোমাকে আমি বাবা মনে করতাম। ইভেন বাবা বলেও ডেকেছি। সেই তুমি আমাকে বিশ্বাস করলে না, ভরসা করলে না।তোমার মনে হয়? আমি তোমাকে খু’নি ভাববো? যে যা বোঝাবে তাই বুঝবো? তুমি দিনের পর দিন ফালাকের মত অভিনয় করে গেছো। এসব করে কি পেয়েছো? যদি একবার আমাকে কাছে ডেকে সবটা বলতে আমি টু-শব্দ করতাম না। সেই তুমি আমার থেকে সত্য গোপন করে দিনের পর দিন নতুন নতুন মিথ্যে বলেছো। একটা মিথ্যে ঢাকতে কতগুলো মিথ্যে বলেছো, এটা ঠিক না। তুমি জানো আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু মিথ্যে? বাবা আমাকে মিথ্যে বলার বা প্রশ্রয় দেওয়ার শিক্ষা দেয়নি। তোমার ওপর আমি রাগও করতে পারিনা। তবে দূরে যেতে নিশ্চই পারবো। নিজেকে অপরাধি মনে করে চলাটা তোমার বোকামি। আমি জানি আমার বাবা আমার পরিবার কাউকে তুমি সামান্য কষ্টটুকুও দিতে পারবে না। এজন্যই মিথ্যে বলেছো। ইরফান তোমার ভাই সেজন্য কথা লুকিয়েছো। ইরফান বাবাকে মে’রেছে জানার পরও তুমি আমার সুরক্ষার জন্য আমার থেকে দূরে থেকেছো। এটা কতটুকু যুক্তিসংগত? আমার নিরাপত্তা তোমাদের কাছে ছিল, তোমাদের থেকে দূরে নয়। যাক বিষয়টা জটিল নয়, তাই আমি এটা পেঁচিয়ে জটিল করতে চাইনা। ইরফান আমার বাবাকে মে’রে ভুল করেছে সেই ভুল আমি সংশোধন করবো। তোমার ওপর আমার কোনো রাগ, অভিমান বা অভিযোগ নেই। তোমাকে আগে যেমনটা ভালোবাসতাম এখনও তেমন ভাবেই ভালোবাসি। শুধু একটু মন খারাপ ছিল কিন্তু তোমার পয়েন্ট অফ ভিউ বুঝতে পেরে সেটাও মিটে গেছে। তোমরা খুব ভালো বাবা! খুব ভালো! আমাকে মিস করবে না, ফালাক ভাইয়ার ওপর নজর রাখবে সে যেন কোনো খারাপ কাজ আর না করে। বুঝেছ? মনে রাখবে,রোজ কিন্তু বড্ড জেদি আর অভিমানি। রোজের কথা না শুনলে রোজ কষ্ট পাবে।

💙সবার উদ্দেশ্যে💙
আমি ছোট, অনেক জ্বালিয়েছি তোমাদের। অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমার ভুলগুলো, আমার দেওয়া কষ্টগুলো মনে রেখো না। আমি নিজের কথা ভেবেই চলে যাচ্ছি। স্বার্থপরের মত কাজ করছি। এছাড়া উপায় ছিল না। ইরফান আমাকে চায়,আমি ধরা না দিলে ওরাও সামনে আসবে না।আর ওরা সামনে না আসলে আমি নিজেকে তিল তিল করে যে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তৈরি করেছি তা পূর্ণতা পাবে না। সবাই যেমন আমাকে ভালোবাসো আমিও তোমাদের ভালোবাসি, বড্ড বেশি ভালোবাসি। নিজেদের খেয়াল রাখবে, শরীরের যত্ন নেবে। আমি যদি বাবার মত পরিণতি পাই তাহলে আমার লা’শটা বাবা আর মামনির মাঝে দেবে। আমি জায়গা ঠিক করে রেখেছি।

অয়ন্তি পড়া থামালো। আরশান রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
-এরপর?

অয়ন্তি ডায়েরি বন্ধ করে ফারহানের হাতে দিল। মুখে বলল,
-“এবার শুধু ফালাকের উদ্দেশ্যে লিখছি।এটা শুধু তাকে পড়তে দিও। এটা শুধুমাত্র তাঁর জন্য। অন্যকেউ এটা পড়ুক সেটা চাইনা আমি। নিজের একান্ত কথাগুলো শুধু তাকেই জানাতে চাই।”

💙ফালাক💙

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে