তি আমো পর্ব-৩৫

0
1396

#তি_আমো❤
#পর্ব_৩৫
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ঈশান শার্টের কলার ঠিক করতে করতে গলা খাকিয়ে সায়রাকে বললেন,

“কি ব্যাপার তুমি? আবার কেনো এসেছো?”

“ভাইয়া, ব্রেকফাস্ট করবেন না?আমি আপনার জন্য বিরিয়ানি বানিয়েছি। আন্টি একবার বলেছিল, আপনার নাকি খুব ফেভারিট। তাই।”

“আমি বিরিয়ানি খাবো না। তুমি যাও।”

“আরে ভাইয়া! দরজা বন্ধ করছেন কেনো? আমি সেই কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে আপনার জন্য এতো আয়োজন করে রান্না করলাম, আর আপনি কিনা বলছেন খাবেন না? আবার মুখের উপর দরজাও দিয়ে দিচ্ছেন? হাউ রুড!”

“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“তাহলে কি খেতে ইচ্ছে করছে বলুন? আমি না হয় সেটা….”

ঈশানের চোখ গরম দৃষ্টি দেখে চুপ মেরে গেল সায়রা। খানিক চুপ থেকে বলে উঠল মেয়েটি,

“আচ্ছা, তারিক ভাইয়া কোথায়? আপনি না খেলেও ভাইয়া নিশ্চয়ই খাবে। তারিক ভাইয়া..”

বলেই ভিতরে ঢুকতে নিচ্ছিল সায়রা। ঈশান সায়রাকে আটকে দিয়ে বললেন,

“তারিকও খাবে না। ও ঘুমাচ্ছে। ”

“ঘুমাচ্ছে? এখনো ঘুমাচ্ছে? সকাল এগারোটা বাজে। এখনো কেনো ঘুমাচ্ছে? শরীর খারাপ করেনি তো! সরুন দেখতে দিন আমাকে।”

“কোনো শরীর খারাপ করেনি। তোমাকে দেখতে হবে না। দেখার জন্য আমি আছি। ইউ ক্যান গো?”

“কি? আপনি আছেন দেখার জন্য? ”

সায়রা হেসে দিল৷ হাসতে হাসতেই বলল,

“যার নিজের উপরই কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকেনা,সময়-অসময় ফ্লোরে উল্টো হয়ে পড়ে থাকে, সে আবার আরেকজনকে কি দেখবে? বলি আপনাকে দেখার জন্যই তো আলাদা একজন লাগে।”

“কি বললে তুমি?”

“সরি ভাইয়া.. আমি আসছি। আর বিরিয়ানিটা খুব কষ্ট করে বানিয়েছি তো। আপনি না খেলেও তারিক ভাইকে দিয়ে দিয়েন। বা বায়!”

বিরিয়ানির প্লেট ঈশানের হাতে ধরিয়ে ছুট লাগাল সায়রা। ঈশান সমস্ত মেজাজ ঝাড়লেন দরজাটার উপর। ঠাস করে দরজায় একটা লাথি মেরে বজ্রপাতের আওয়াজে দরজাটা আটকালেন।

বারান্দাতে মৃদু আলোয় দাড়িয়ে আছি আমি আর সায়রা। আমার কথা বলার সুযোগ না থাকলেও মেয়েটা তখন থেকে বকবক করে যাচ্ছে। একটু বেশিই কথা বলে মেয়েটা। অপ্রয়োজনীয় কথা খুব বেশি বলে। যদিও তার এই অপ্রয়োজনীয় কথায় আমি তেমন কর্ণপাত করছি না। শান্ত দৃষ্টি আমার আকাশ দেখায় ব্যস্ত। খন্ড মেঘের এক গুচ্ছ সমাবেশ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে, কি নিরানন্দে! খুব ধীরগতিতে, অসার হয়ে, আচ্ছা মেঘের খন্ড গুলো কি শুধুই বাষ্প? যদি এগুলো কারো কাছে প্রেরিত চিঠিপত্র হতো? এমন যদি হতো, কোনো মৃত ব্যাক্তির কাছে বার্তা পাঠানোয় এক টুকরো মেঘ ব্যবহার করা যেতো! কি মজার ব্যাপার হতো, প্রতিটি মেঘের খন্ড পেয়ে যেতো এক নির্দিষ্ট গন্তব্য, এক নির্দিষ্ট অর্থ। তখনও কি মেঘগুলো এমন অসার বেগে চলতো? হয়তো ক্লান্তিহীন ভেসে বেড়াতো, কেউ ডানে, কেউ বামে, আপন গন্তব্যে পৌছানোর নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টায়। সায়রা আমার কাধ ঝাকাতেই আমি ভাবনার রেশ কাটিয়ে জবাব দিলাম,

“হু?”

বলেই থমকে গেলাম আমি। আমার তো কথা বলা নিষেধ। সায়রা আমার কথাটা শুনতে পেল না। সে বলল,

“কখন থেকে ডাকছি ভাইয়া, কথা শুনেন না? মানে কথা তো বলতে পারেন না, শুনতে পারেন তো?”

আমি মাথা দুলিয়ে হ্যা বললাম। সায়রা বলল,

“আচ্ছা আমরা তো লিখেও কথা বলতে পারি তাইনা? মানে আমি প্রশ্ন করলাম, আর আপনি লিখে উত্তর দিলেন। আবার আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলেও, আপনি লিখে জিজ্ঞেস করলেন। আর আমি মুখে উত্তর দিলাম। আইডিয়াটা কেমন?”

আমি মুচকি হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়লাম। বুঝালাম, আইডিয়া ভালো। কিন্তু এই মেয়ের কথা বলার এতো শখ কেনো আমি বুঝতে পারছি না। সায়রা খাতা কলম নিয়ে আসল। আমার হাতে খাতা-কলম ধরিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,

“আপনি মাথায় পাগড়ী কেনো পড়েন? আপনি কি পাগড়ীওয়ালা? উত্তরটা খাতায় লিখুন।”

প্রশ্ন শুনেই আমি অর্ধেক কাত। আবার উত্তর কি লিখব? কেনো পাগড়ি পড়ি সেইটা তো বলা যাচ্ছে না।ইমিডিয়েটলি কোনো একটা মিথ্যে কথা বানিয়ে ফেলতে হবে। সায়রা তাড়া দিয়ে বলল,

“কি হলো ভাইয়া লিখছেন না কেনো? জলদি লিখুন? আরো অনেক প্রশ্ন আছে তো! একটা লিখতেই এতো দেরি করলে বাকিগুলো কখন লিখবেন? ”

আমার গলা শুকিয়ে আসল। আবার কি উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করবে কে জানে? পেছন থেকে কেউ শব্দ করল,

“সায়রা! ”

আমরা দু’জনেই ঘুরে তাকালাম। ঈশান এসেছেন। উনার হাতে সবুজ মলাটের একটা ভারী বই। বইটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে ঈশান বললেন,

“টেবিলে এসো সায়রা। ”

সায়রার মুখটা মুহুর্তেই পূর্ণিমার চাদের মতো ঝলকানি দিয়ে উঠল। খুশি যেন আর ধরে না তার। আপাতত আমার ইন্টারভিউ নেওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ভদ্র মেয়ের মতো পড়ায় মনোযোগী হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে।আমি আবারও আকাশ দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। টুকরো টুকরো মেঘের নিরব গতিবিধি পরিমাপ করে চলেছি একনিষ্ঠ ভাবে। মাঝে মাঝে ঈশানের ভারী কণ্ঠের টুকটাক ধমক কানে আসছে। এই হারে ধমকানো হলে তো ছাত্রী পড়ার সাথে সাথে লেখাটাও ভুলে যাবে। যেমন এইমাত্র আমি ভুলে গেলাম, যে কি নিয়ে চিন্তা করছিলাম। আন্টি মানে সায়রার আম্মু হঠাৎ হাসিমাখা কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,

“শুভসন্ধ্যা! ”

সায়রা হাসোজ্জল মুখ করে বলল,

“শুভসন্ধ্যা আম্মু! ”

ঈশান গম্ভীর কণ্ঠে হালকা হেসে বললেন, “শুভসন্ধ্যা।”

আন্টিও সায়রার মতো অনেকটা খুশিতে গদগদ হয়ে নাস্তার প্লেট টেবিলে রাখলেন। অতঃপর বিছানায় আরাম করে বসতে বসতে বললেন,

“একটা জরুরী আলাপে এসেছিলাম। পড়াশুনায় ডিস্টার্ব না হলে বলি?”

ঈশান শান্তভঙ্গিতে জবাব দিলেন, “জি আন্টি, বলেন।”

এই দৃশ্য দেখে মুহুর্তেই আমার ভেতরটা গোমট হয়ে আসল। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বুড়ির কথাটা খুব করে মনে পড়ছে আজ। আন্টি এখন ইনিয়েবিনিয়ে সায়রার সাথে ঈশানের বিয়ের কথা বলবেন না তো? বলতেই পারেন, ঈশান এখন সম্পুর্ণ সুস্থ। এই দিনটির জন্যই তো অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন সবাই। আমার ধারণা সঠিক হল। আন্টি আমতা-আমতা করতে করতে বললেন,

“সামনেই তো মেয়েটার ইয়ার ফাইনাল। এই ঝামেলা শেষ হলেই আমি আর সায়রার বাবা মিলে ঠিক করেছি, আরেকটা ঝামেলা বাধিয়ে বসবো। ঘর থেকে আপদ বিদায় করবো।”

বলেই হেসে দিলেন আন্টি। সায়রা অভিমানী কন্ঠে উচ্চারণ করল, “আম্মু!”

ঈশান ভ্রু কুচকে বললেন, “মানে আন্টি? ঠিক বুঝলাম না।”

“আরে বোকা ছেলে। আমি সায়রার বিয়ের কথা বলছি।”

ঈশান অবাক হয়ে বললেন, “বিয়ে? ”

ঈশান অবাকচোখে একবার সায়রার দিকে তাকিয়ে আবার আন্টির দিকে তাকালেন। আর বললেন,

“আন্টি সায়রার এখনো বিয়ের বয়স হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। যদিও আপনাদের পারসোনাল ব্যাপার, তবুও আমার মনে হয় ওকে আরেকটু সময় দেওয়া উচিৎ। অন্তত ভারসিটি পর্যন্ত..”

আন্টি বললেন, “সেসব নিয়ে আমরা এখন একদম চিন্তা করছি না। তুমি তো আছোই। আর ফারায ভাই তো অনেক আগে থেকেই দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন সায়রাকে ভারসিটিতে ভর্তি করানোর। উনি কি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার মানুষ?আমাদের আর চিন্তা কোথায়? ”

ঈশানের মুখটা মুহুর্তেই অন্ধকার হয়ে আসল। সেইসাথে একরাশ দুশ্চিন্তা ভর করল উনার মুখে। বিয়ের ব্যাপারে উনি কিছু জানতেন ন মনে হচ্ছে। কিন্তু এবার কি হবে? উনি এখন কেমন রিয়েক্ট করবে ভাবতেই ভয় লাগছে আমার।

🍂
ঈশান তড়িৎ গতিতে সম্পুর্ণ ঘরের ডানে বামে ছুটোছুটি করছেন। অস্থিরতার সাথে তীব্র রাগেই নিয়ম করে পাল্লা দিয়ে কাপছে উনার শরীর। রাগটা নিজের বাবার উপর। আর অস্থিরতাটা এ বাড়ি ছেড়ে প্রস্থানের তাগাদা। হন্তদন্ত হয়ে নিজের সমস্ত নিজের জামা-কাপড় গুলো এলোমেলো ভাবেই ব্যাগে ভরছেন উনি। আবার ওয়্যারড্রোপ থেকে কাপড় তুলছেন। আমি ঈশানের সামনে গিয়ে হাত ভাজ করে তাকালাম। ঈশান দৃষ্টি লাল করে ধমকের সুরে বললেন,

“সামনে থেকে সরো তারিন।”

আমি ঈশানকে বুঝানোর চেষ্টা করে বললাম,” বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?”

“কিচ্ছু ঠিক হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আমি এ বাসায় আর কোনোভাবেই থাকবো না। আজকে এবং এখনি যাবো। আর তুমিও আমার সাথে যাবে।”

“তাই? কোথায় যাবো আমরা? আঙ্কেল আমাদের বাসায় ঢুকতে দেবেন?”

ঈশান কাপড়গুলো বিছানায় ছুড়ে দিয়ে বললেন, “কে বলেছে আমি ওই লোকটার বাড়িতে যাচ্ছি?”

“ওই লোক মানে? কাকে ওই লোক বলছেন আপনি? উনি আপনার বাবা।”

ঈশান তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলেন। আমি ঈশানের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে আদুরে গলায় বললাম,

প্লিজ আমার কথাটা শুনুন। এভাবে হুটহাট বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে কারো কিছুই যায় আসবে না। বরং আমরা নিজেরাই বিপদে পড়ব। কোথায় গিয়ে থাকবো আমরা বলতে পারেন?

ঈশান সরুচোখে বললেন,” কেনো? তোমাকে নিয়ে যদি রাস্তায় গিয়ে নামি, ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাখি, থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা না করতে পারি, তাহলে থাকবে না আমার সাথে? ধরবে না এই হাত? ছেড়ে চলে যাবে? ”

আমি ঈশানের মুখ থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালাম। মাথা নিচু করে নিলাম। মুহুর্তেই আমার চোখ দুটো টলমলে হয়ে আসল। ঈশানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কিছুটা অভিমানী সুরে বললাম,

“আপনি আমাকে এই চিনলেন? আপনার সাথে তো জাহান্নামে চলে যেতেও কোনো আপত্তি নেই আমার। ”

ঈশান আমার দুই বাহু ধরে টেনে তুললেন। তারপর বললেন,

“তাই যদি হয়, তাহলে এতো দ্বিধা কিসের? চলো আমার সাথে?”

“আপনার সাথে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু রাগের মাথায় এমন..”

ঈশান আমার ঠোটে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, “কোনো কিন্তু না। তুমি শুধু চলো।”

আমি সামনের দিকে ঘুরে নিজের জিন্সের পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। মিনমিন করে বললাম,

সাফিন ভাইয়াকে আগে ফোন করে সবটা জানাই। দেখি উনি কি বলে। তারপর না হয় একটা সিদ্ধান্তে..

আমাকে বিস্ময়ের চরম শীর্ষে তুলে ঈশান আমার হাত থেকে খপ করে ফোনটা কেড়ে নিলেন। শুধু তাই নয়, ঠাস করে মোবাইলটা জানালা বরাবর ছুড়ে মারলেন। বিকট শব্দ তরঙ্গ বেজে উঠল নিমেষেই। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বাকরুদ্ধ। ঈশান ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,

“ওই শালা আরেক বেইমান। সবকিছু জানার পরেও আমাকে কিচ্ছু জানায় নি সে। ওই লোকটার সাথে মিলে আমার অগোচরে প্ল্যানিং করেছে। তুমি ভাবলে কি করে এতো সহজে আমি ওকে মাফ করে দিবো?”

আমি তব্দা লেগে তাকিয়ে আছি। বলার মতো কোনো উত্তর খুজে পাচ্ছি না। শুধু একটা কথাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে আমার।” এতো রাগ ভালো না ঈশান! একদমই ভালো না”

ঈশানের জেদের কাছে হার মেনে বাধ্যগতভাবেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে আমাদের। আন্টি,আঙ্কেল, সায়রা কারো কাছে এই ব্যাপারে কোনোরকম জবাবদিহি করেননি উনি। আর আমার তো জবাব দেওয়ারও সুযোগ নেই। বর্তমানে ঈশানের কাধে মাথা ঠেকিয়ে ট্রেনে বসে আছি। ঈশান সিটের সাথে মাথা ঠেসে গভীর ঘুমে মগ্ন। রেলগাড়ীটা ছুটে চলেছে আপনগতিতে। এর গন্তব্য কোথায় জানা নেই আমার। জানার প্রয়োজনও মনে করছি না। যেখানেই যাই, অন্তত ঈশান পাশে থাকবেন। আর কি লাগে? আমি জানালা বরাবর তাকাতেই একঝাঁক ক্ষুদ্র আলোর সমাবেশ খুজে পেলাম। বুঝতে পারলাম এখানে জোনাকি পোকাদের মেলা বসেছে। আমি জানালার বাহিরে দৃষ্টি দিলাম। ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি আমার চোখমুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। অম্লান লাগছে এই শিহরণ। সবুজ ঘাসের উপর কয়েক ফোটা শিশিরের ছোয়া যেন মুক্তরুপে ফুটে উঠেছে। ঠান্ডা পরিবেশে থমথমে নিস্তব্ধতা আর অন্ধকারে আচ্ছন্ন এই শহর, সাথে প্রকৃতির আনম্র সৌন্দর্য্যময় স্পর্শ, মনে হচ্ছে যেন এক নতুন জীবনের হাতছানি। পুরনো সব ব্যর্থতা উপেক্ষা করে এক নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে এই যাত্রা আমাদের! কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে?
🍂

চলবে

#তি_আমো❤
#পর্ব_৩৫(অতিরিক্ত)
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ঈশান তড়িৎ গতিতে সম্পুর্ণ ঘরের ডানে বামে ছুটোছুটি করছেন। অস্থিরতার সাথে তীব্র রাগেই নিয়ম করে পাল্লা দিয়ে কাপছে উনার শরীর। রাগটা নিজের বাবার উপর। আর অস্থিরতাটা এ বাড়ি ছেড়ে প্রস্থানের তাগাদা। হন্তদন্ত হয়ে নিজের সমস্ত নিজের জামা-কাপড় গুলো এলোমেলো ভাবেই ব্যাগে ভরছেন উনি। আবার ওয়্যারড্রোপ থেকে কাপড় তুলছেন। আমি ঈশানের সামনে গিয়ে হাত ভাজ করে তাকালাম। ঈশান দৃষ্টি লাল করে ধমকের সুরে বললেন,

“সামনে থেকে সরো তারিন।”

আমি ঈশানকে বুঝানোর চেষ্টা করে বললাম,” বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?”

“কিচ্ছু ঠিক হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আমি এ বাসায় আর কোনোভাবেই থাকবো না। আজকে এবং এখনি যাবো। আর তুমিও আমার সাথে যাবে।”

“তাই? কোথায় যাবো আমরা? আঙ্কেল আমাদের বাসায় ঢুকতে দেবেন?”

ঈশান কাপড়গুলো বিছানায় ছুড়ে দিয়ে বললেন, “কে বলেছে আমি ওই লোকটার বাড়িতে যাচ্ছি?”

“ওই লোক মানে? কাকে ওই লোক বলছেন আপনি? উনি আপনার বাবা।”

ঈশান তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলেন। আমি ঈশানের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে আদুরে গলায় বললাম,

প্লিজ আমার কথাটা শুনুন। এভাবে হুটহাট বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে কারো কিছুই যায় আসবে না। বরং আমরা নিজেরাই বিপদে পড়ব। কোথায় গিয়ে থাকবো আমরা বলতে পারেন?

ঈশান সরুচোখে বললেন,” কেনো? তোমাকে নিয়ে যদি রাস্তায় গিয়ে নামি, ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাখি, থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা না করতে পারি, তাহলে থাকবে না আমার সাথে? ধরবে না এই হাত? ছেড়ে চলে যাবে? ”

আমি ঈশানের মুখ থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালাম। মাথা নিচু করে নিলাম। মুহুর্তেই আমার চোখ দুটো টলমলে হয়ে আসল। ঈশানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কিছুটা অভিমানী সুরে বললাম,

“আপনি আমাকে এই চিনলেন? আপনার সাথে তো জাহান্নামে চলে যেতেও কোনো আপত্তি নেই আমার। ”

ঈশান আমার দুই বাহু ধরে টেনে তুললেন। তারপর বললেন,

“তাই যদি হয়, তাহলে এতো দ্বিধা কিসের? চলো আমার সাথে?”

“আপনার সাথে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু রাগের মাথায় এমন..”

ঈশান আমার ঠোটে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, “কোনো কিন্তু না। তুমি শুধু চলো।”

আমি সামনের দিকে ঘুরে নিজের জিন্সের পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। মিনমিন করে বললাম,

সাফিন ভাইয়াকে আগে ফোন করে সবটা জানাই। দেখি উনি কি বলে। তারপর না হয় একটা সিদ্ধান্তে..

আমাকে বিস্ময়ের চরম শীর্ষে তুলে ঈশান আমার হাত থেকে খপ করে ফোনটা কেড়ে নিলেন। শুধু তাই নয়, ঠাস করে মোবাইলটা জানালা বরাবর ছুড়ে মারলেন। বিকট শব্দ তরঙ্গ বেজে উঠল নিমেষেই। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বাকরুদ্ধ। ঈশান ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,

“ওই শালা আরেক বেইমান। সবকিছু জানার পরেও আমাকে কিচ্ছু জানায় নি সে। ওই লোকটার সাথে মিলে আমার অগোচরে প্ল্যানিং করেছে। তুমি ভাবলে কি করে এতো সহজে আমি ওকে মাফ করে দিবো?”

আমি তব্দা লেগে তাকিয়ে আছি। বলার মতো কোনো উত্তর খুজে পাচ্ছি না। শুধু একটা কথাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে আমার।” এতো রাগ ভালো না ঈশান! একদমই ভালো না”

ঈশানের জেদের কাছে হার মেনে বাধ্যগতভাবেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে আমাদের। আন্টি,আঙ্কেল, সায়রা কারো কাছে এই ব্যাপারে কোনোরকম জবাবদিহি করেননি উনি। আর আমার তো জবাব দেওয়ারও সুযোগ নেই। বর্তমানে ঈশানের কাধে মাথা ঠেকিয়ে ট্রেনে বসে আছি। ঈশান সিটের সাথে মাথা ঠেসে গভীর ঘুমে মগ্ন। রেলগাড়ীটা ছুটে চলেছে আপনগতিতে। এর গন্তব্য কোথায় জানা নেই আমার। জানার প্রয়োজনও মনে করছি না। যেখানেই যাই, অন্তত ঈশান পাশে থাকবেন। আর কি লাগে? আমি জানালা বরাবর তাকাতেই একঝাঁক ক্ষুদ্র আলোর সমাবেশ খুজে পেলাম। বুঝতে পারলাম এখানে জোনাকি পোকাদের মেলা বসেছে। আমি জানালার বাহিরে দৃষ্টি দিলাম। ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি আমার চোখমুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। অম্লান লাগছে এই শিহরণ। সবুজ ঘাসের উপর কয়েক ফোটা শিশিরের ছোয়া যেন মুক্তরুপে ফুটে উঠেছে। ঠান্ডা পরিবেশে থমথমে নিস্তব্ধতা আর অন্ধকারে আচ্ছন্ন এই শহর, সাথে প্রকৃতির আনম্র সৌন্দর্য্যময় স্পর্শ, মনে হচ্ছে যেন এক নতুন জীবনের হাতছানি। পুরনো সব ব্যর্থতা উপেক্ষা করে এক নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে এই যাত্রা আমাদের! কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে?
🍂

চলবে

(কাহিনীর এই মোড়টা কেমন লাগলো জানাবেন সবাই🙄)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে