তি আমো পর্ব-১২+১৩

0
1305

#তি_আমো❤
#পর্ব_১২
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ছাদের দরজা ঠেলে উকি দিতেই দেখলাম ঈশান দেয়ালে হাত রেখে দাড়িয়ে আছেন। হয়তো আকাশ দেখছেন। হাতে চায়ের কাপ। অনবহিত ভঙ্গিতে কাপে চুমুক দিচ্ছেন উনি। আকাশে ভেসে উঠা এক ফালি চাদ যেন রুপোর থালার মতো জ্যাতি ছড়াচ্ছে। ছাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন পারিপার্শ্বিক পরিবেশে সেই আনম্র আলো অনেকটাই ব্যাপিত। আমি নিঃশব্দে ঈশানের পাশে গিয়ে দাড়ালাম। উনি নিজের চিন্তা জগৎ নিয়ে এতোটাই মগ্ন, যে আমার দিকে লক্ষ্য করারও সময় হয়নি। এখনো বিয়ের বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন না তো?আচ্ছা উনাকে কি সত্যিটা বলে দেওয়া উচিৎ? না, সত্যি বলা যাবে না। পরে যদি উনি জানতে চায়, বুড়িটা কেনো এমন করলো? তখন কি বলবো? তার চেয়ে ভালো অপেক্ষা করি।দেখাই যাক উনি কি পদক্ষেপ নেয়। ঈশান আনমনে চায়ের কাপে ঠোট ছোয়াতে যাচ্ছিলেন, সেই মুহুর্তে আমি শব্দ করলাম। ঈশান চমকে উঠলেন। শারীরিক স্পন্দনের দরুন চায়ের কাপে ঠোট ডুবে গেল উনার। ঈশান কুকিয়ে উঠলেন,

আহ!

আমি তড়িঘড়ি করে চায়ের কাপটা হাতে নিলাম।ঈশান চোখ বন্ধ করে ঠোট চেপে ধরলেন। আমি ঈশানের কাধে হাত রাখলাম। বিচলিত হয়ে বললাম,

ঠোট পুড়ে গেছে না? কি দরকার এতো গরম চা খাওয়ার?

ঈশান চোখ তুলে তাকালেন। ঠোটে হাত রেখেই অল্প হাসলেন উনি। আমি ভ্রু কুচকে কাপে চুমুক দিলাম। আর চুমুক দিতেই অবাক হলাম। চা এতোটাও গরম না যে উনার ঠোট পুড়ে গেল। এইটুকু গরম সহ্য করতে পারলেন না?আমি ঈশানের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলাম,

আপনি কি ঢেড়স নাকি? এটুকু গরম সহ্য করতে পারেন না?

ঈশান অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন। উনার চাহনিতে আমার চৈতন্যশক্তি জেগে উঠল। এটা কি করলাম আমি? উনার এটোকাঁটা কাপে মুখ দিয়ে দিলাম? এবার উনি আমাকে ম্যানারলেস ভাবছেন না তো? হাসার চেষ্টা করে মাথা নিচু করলাম আমি। বললাম,

সরি। আমার খেয়াল ছিল না। ভুল করে আপনার কাপে মুখ দিয়ে ফেলেছি। থাক, এটুকু আর আপনাকে খেতে হবে না। ফেলে দিচ্ছি।

চায়ের কাপ হালকা কাত করে অবশিষ্ট অংশ টুকু ফেলে দিতে চাইলাম আমি। কিন্তু ঈশান ফেলতে দিলেন না। আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি চায়ের কাপটা ছিনিয়ে নিলেন। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কাপে চুমুক দিয়ে সবটুকু অংশ শেষ করলেন। আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। লজ্জায় মুখটা আলোহিত হয়ে আছে আমার। এই লজ্জাঘেরা নিরবতা ঠেকিয়ে ঈশানের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলাম,

আচ্ছা? আপনি এখানে কেনো আছেন? এখান থেকে চলে কেনো যাচ্ছেন না?

কথাটা বলে শেষ করতেই ঈশান আমার বাম হাতের বাহু ধরে টান দিলেন। আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,

আমি চলে গেলে তুমি খুশি?

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, না। খুশি কেনো হবো? কিন্তু আপনার তো এখানে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা? আমি তো আপনার ভালোর জন্যই বলছি।

ঈশান আমার হাত ছাড়লেন। সংশয়াপন্ন কণ্ঠে বললেন,

আমার এখানে থাকতে কষ্ট হচ্ছে? তোমার এমন কেনো মনে হলো?

এমনটাই তো স্বাভাবিক। আপনার পরিবেশ আর এই পরিবেশ সম্পুর্ণ আলাদা। ধরতে গেলে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সবকিছুতে আপনার মানিয়ে চলতে হচ্ছে। কষ্ট তো হচ্ছেই।

ঈশান তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন। বললেন,

জানিনা কোন কষ্টের কথা বলছো। কিন্তু আমার তো মনে হয়, নিজের বাসার থেকে এখানেই বেশি শান্তি। অনেক, অনেক শান্তি।

কিভাবে?

ঈশান আমার দিকে ঘুরে আমার গা ঘেঁষে দাড়ালেন। আর বললেন,

মানুষ যখন কঠিন কোনো রোগে আক্রান্ত হয়, তখন পৃথিবীর সবকিছুই তার কাছে অসহ্য মনে হয়। মুল্যহীন মনে হয়। শুধু রোগ নিরাময়ের সেই ওষুধটি ছাড়া। সেইরকম একটা ভয়াবহ রোগে যে আমিও আক্রান্ত তারিন!

আমি চোখ বড় করে বললাম, মানে? কি রোগ হয়েছে আপনার?

প্রেমরোগ। যার নিরাময় শুধু তুমি। তোমাকে ছাড়া এক মুহুর্তও কতটা যন্ত্রণাদায়ক মনে হয় জানো? এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আমি যা কিছু করতে পারি। পুরো পৃথিবীটাও দিয়ে দিতে পারি বিশ্বাস করো। শুধু একবার এই মায়াবী মুখটা দেখার জন্য। তোমার কাছাকাছি থাকার প্রলোভনই তো আমাকে এখানে টেনে এনেছে। অনেকটা ম্যাগনেটের মতো। এখন যে আমি চাইলেও এখান থেকে চলে যেতে পারবো না। আর না পারবো তোমাকে ছাড়া থাকতে। কি একটা সর্বনাশ হয়ে গেল বলো তো আমার? পৃথিবীর কোনোকিছুই এখন আর ভালো লাগে না। পানসে মনে হয় সব। কাঠগোলাপের সুভাষ টাও এখন আর আকৃষ্ট করতে পারে না আমাকে। তুমি যে মনের সবটুকু জায়গা দখল করে নিয়েছো। তোমার মিষ্টি হাসি, ভেজা চুলের মাদকময় সুভাষ ছাড়া আর অন্যকিছুতে আকৃষ্ট হয়না এ মন। আর অন্য কোনো সৌন্দর্য দেখতে চায়না এই চোখ।সেই ইচ্ছেটাই মরে গেছে।

আমি হাবার মতো তাকিয়ে রইলাম।

ঈশান দুই ঠোট চেপে চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হঠাৎই আমার দুই গাল চেপে ধরে আমার কপালে ঠোটের পরশ দিলেন। আর আমি শিহরিত হলাম। তার থেকেও বেশি কম্পিত হয়ে উঠল আমার শরীর, যখন ঈশান আমাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। আমার মাথা গিয়ে ঠেকলো উনার বুকে। অনেক বেশি অস্বস্তি লাগার কথা, কিন্তু লাগছে না। বরং এতেই যেন স্বস্তি। আমি অজান্তেই চোখ বন্ধ করে নিলাম। উনার হ্রদস্পন্দনের ছন্দবিন্যাস করতে ব্যস্ত হলাম। ঈশান তখন বললেন,

শুনতে পাচ্ছো তারিন? এই নিস্তেজ হ্রদয়ের আনন্দধ্বনি! তোমার উপস্তিতিই এই নীরস মনের একমাত্র চাহিদা। এখন সেটা ফিল আপ। তাই তো ওরা উৎসবে মেতে উঠেছে। ফিরে পেয়েছে তাদের সজীবতা, প্রাণোচ্ছলতা।

আমার চোখের পানি বেরিয়ে আসল। উনার শার্ট খামচে ধরে কাদতে শুরু করলাম আমি। আমার কান্না দেখে ঈশান আমায় টেনে তুললেন। আমার কাধ চেপে ধরে ভ্রু কুচকে উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন,

কি হলো?

আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না জুড়েছি। নাক মুছে চোখ মুছে কাদতে কাদতে অস্পষ্টভাবে আমি উচ্চারণ করলাম,

আপনি আমার সাথে এসব কথা বলবেন না। আমার কান্না পায়। খুব কষ্ট হয়।

অনেকটা ভ্যা ভ্যা শব্দ করে কেদে দিলাম আমি। আমার কান্না দেখে ঈশান হতবাক হয়ে তাকালেন। অস্থির গলায় বললেন,

ওকে ওকে! আর বলবো না সরি।

আমি আরও জোরে কাদতে লাগলাম। চোখমুখ ডলছি আর কাদছি। নাকের পানি চোখের পানি মিশে একাকার। ঈশান আমার কান্না দেখে হাসতে নিয়েও থেমে গেলেন। আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে আমাকে দেয়ালের উপর উঠিয়ে বসালেন। ঠাট্টার ছলে বললেন,

আচ্ছা বলোতো তুমি কাদছো কেনো? আগে তো আমার কথা শুনলে তোমার হাসি পেতো। কি যেন বলতে? মিঃ আবেগচন্দ্র, একটা মিষ্টির দোকান খুলে বসে পড়ুন নাহলে মালি পদে নিযুক্ত হয়ে যান। দারুণ মানাবে আপনাকে। শয়তানি বুদ্ধি মাথা ছেড়ে পালাবে। ফ্রীতে উপদেশ দিয়ে দিতে। আর এখন দারুণ দারুণ উপদেশ গুলো না দিয়ে বোকার মতো কাদছো? কেনো?

আমি কান্না থামিয়ে অসহায় মুখ করে তাকালাম। আরেকবার কান্না শুরুর প্রস্তুতি নিয়ে জোড় গলায় বললাম,

কারণ এখন আমিও আপনাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।

বলেই ঈশানের গলা জড়িয়ে ধরলাম আমি। দেয়ালের উপর উঠে থাকায় উনার গলা জড়িয়ে ধরতে খুব একটা অসুবিধা হল না। পুনরায় শুরু করলাম আমার তোলপাড় শব্দের কান্না।

#তি_আমো❤
#পর্ব_১৩(কিছু অংশ)
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমার এমন আচরণে ঈশান অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে সোজামতো দাড়িয়ে আছেন। অতিরিক্ত ধাক্কায় জড়তা ভর করেছে উনার শরীরে। উনার নিরবতা দেখে হোশ আসল আমার। আরেকবার লজ্জিত হতে হল নিজের পাগলামির জন্য। ঈশানের গলা ছেড়ে মাথা নিচু করলাম আমি। ইচ্ছে করছে লাফিয়ে পড়তে ছাদ থেকে। আমার ইচ্ছেটা যেন সঙ্গে সঙ্গে কবুল হল। আকস্মিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে পেছন দিকে হেলে পড়তে লাগলাম।সেই মুহুর্তে ঈশান আমার এক হাত টেনে ধরলেন। আমি হেলানো অবস্থাতেই তাকালাম। ঈশান মোহগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আচমকাই তীব্রবেগে ঈশান আমায় নিজের দিকে টানলেন। আমি তুমুল গতিতে ঈশানের কাধ খামচে ধরলাম। চোখ দুটো বর্তুলাকার বানিয়ে ফেললাম মুহুর্তেই। ঈশান মুচকি হাসলেন। উনার হাসি দেখে এক অবিদিত আতঙ্ক
জেগে উঠল মনে। সেই আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়ে ঈশান হঠাৎ আমার ঠোট আকড়ে ধরলেন। আর আমি কেপে উঠলাম। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমি শেষ। কোনোকিছু অনুভব করতে পারছি না। যেন শরীরের স্নায়ুগুলি তাদের যাবতীয় কাজ স্থগিত করে রেখেছে। শুধুই কাপছি আমি। ঈশান তার সবটুকু তৃপ্তি ঢেলে দিচ্ছে আমার ঠোটে। আর আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখছি। নিদারুণ এই স্পর্শানুভূতি আমার মনের অনুনাদ বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি ছটফট করছি। এমন সময় পেছন থেকে আওয়াজ আসল,

এহেম এহেম, ম্যাথ ক্লাস চলছে নাকি?

আমি আর ঈশান এলোপাতাড়িভাবে সরে পড়লাম দুইজন দুই প্রান্তে। যেন বিকর্ষণ বল কার্যত হয়েছে। নিহা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসল। ঈশান কর্ণারে গিয়ে অপ্রস্তুত ভাবে দেয়াল চেপে ধরে দাড়ালেন। নিহা রসিকতাপূর্ণ কন্ঠে বলল,

আমি কি ডিস্টার্ব করলাম ক্লাসে?

নিহার কথা শুনে আমার ইচ্ছে করল মাটির ফাক করে ভেতরে ঢুকে যেতে। ঈশান বললেন,

অবশ্যই। খুব ডিস্টার্ব করেছো তুমি। ইউ শুড পানিশ ফর দিজ।

নিহা মুখে হাত রেখে উচ্চারণ করল, উপপপসস..! সরি! কিন্তু ঈশান ভাইয়া আমি আপনাকে ছোট একটা এডভাইজ দেই কেমন? এভাবে ছাদের উপর খোলামেলা পরিবেশে ক্লাস করাটা ঠিক নয়। তার থেকে ভালো বিয়ে করে নিন।

নিহা আমার কাধে হাত রাখল। ঈশানের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,

তখন আর ক্লাসে ডিস্টার্ব হবেনা। মনোযোগের সাথে ম্যাথ করা যাবে। খুব জটিল বিষয় তো! খোলামেলায় হয়না, নিরিবিলি পরিবেশ দরকার। কি ঠিক বললাম না তারু?

আমি চোখ সরু করে দাত কিড়মিড়িয়ে বললাম, তোকে জুতোর বাড়ি দিলে ঠিক ভুল বের হবে দাড়া।

নিহা খিলখিল করে হেসে দিয়ে উল্টো দিকে দৌড় লাগাল। আমিও নিহার পিছনে ছুটলাম। নিহা দরজা পেরিয়ে বাহিরে চলে গেল। আমি দরজার বাহিরে পা রাখতেই থেমে দাড়ালাম। পেছন ফিরে একবার ঈশানের দিকে তাকালাম। উনার হাস্যজ্জল মুখটা দেখে নিয়ে আবার ছুটতে লাগলাম নিহার পেছনে।

.

.

কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। বাহিরে থেকে ভাইয়ার চেচানোর তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা যাচ্ছে। কান ঝালাপালা অবস্থা। কৌতুহল নিয়ে উঠানে আসলাম। মা নাশতা বানাচ্ছিলেন। আমি মায়ের পাশে এসে দাড়ালাম। বললাম,

ও মা মা! ওমলেটের জন্য এতো মরিচ নিচ্ছো কেনো? একটু কম ঝাল দেওয়া যায় না?

মা চোখ বড় করে বললেন, কি অদ্ভুত কথা বলিস? আমি ঝাল বেশি দিচ্ছি কই? ঠিকই তো আছে। এর থেকে কম দিলে স্বাদহীন লাগবে।

লাগুক স্বাদহীন। তবুও কম দাও। সবাই কি এতো ঝাল খেতে পারে?

কে ঝাল খেতে পারেনা শুনি?

আছে আছে। তুমি আমাকে দাও তো আমি বানাচ্ছি।

তারু ঝামেলা করিস না তো। সর এখান থেকে। তোর কলেজ আছে না? যা জলদি তৈরি হো। হাতে বেশি সময় নেই।

আমি মুখ ভার করে ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। চোখাচোখি হল ঈশানের সাথে। মুখটা লাল আভাপূর্ণ হয়ে উঠল আমার। সদ্য ঘুম থেকে জাগার কারণে চোখ গুলো হালকা ফুলে আছে উনার। ঘাসের মতো চুলগুলো অগোছালো। ঠিক যেন লম্বা দূর্বা ঘাসের ব্ল্যাক ভারসন। ঘোর লাগানো দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। সেই ঘোর কাটল ভাইয়ার চিৎকারে। সদর দরজার সামনে থেকে ঈশানকে জোর গলায় ডাকছে ভাইয়া। ঈশান এগিয়ে গেলেন। আমি ঘরের দিকে গেলাম। ব্যাগ গুছিয়ে, নিজেকে গুছিয়ে টেবিলে এসে বসলাম। এরই মধ্যে ভাইয়া ঈশানকে বাইক ঠিক করার কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। অপার্থিব লাগছে বিষয়টা। আমাদের বাড়িতে এসে কত কি- ই না করতে হচ্ছে উনাকে। কপাল! মা আমাকে ওমলেটের সাথে পাউরুটি খেতে দিলেন। আমি খাচ্ছি আর মাঝে মাঝে আড়চোখে ঈশানকে দেখছি। বুড়িটা আশেপাশেই ঘুরাঘুরি করছে। হাতে পাউডার নিয়ে মধ্যমা অঙ্গুলি দিয়ে দাত মাজছে। ব্রাশ আর পেস্ট থাকতেও বুড়িটা যে কেন এইভাবে দাত মাজে, সেই কেমিস্ট্রি আজও বুঝলাম না আমি। ভাইয়াকে দেখলাম বাইক স্টার্ট দিচ্ছেন। ঈশান পাশে দাড়িয়ে ঘাম মুছছে। উনার হাতে বাইক ঠিক করার সরঞ্জাম। বাইক স্টার্ট নিতেই ভাইয়া উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন,

বাহ! তুমি তো বেশ কাজের ছেলে। এতো জটিল স্ট্রাকচার ঠিক করে দিলে? এই শোনো ঈশান, আমাদের গলির মাথায় একটা গ্যারেজ আছে। তুমি ওখানে পার্ট টাইপ জব করবে?

ভাইয়ার কথা শুনে আমার গলায় খাবার আটকে গেল। কাশতে শুরু করলাম আমি। বুড়িটা দুর থেকে বলল,

ষাট ষাট! বালাইষাট!

মা রান্নাঘর থেকে পানি এনে দিলেন। আমি পানি খেয়ে আবার ভাইয়া আর ঈশানের আলাপ শুনতে ব্যস্ত হলাম। ঈশান আকার- ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইছেন তার পার্ট টাইম জব দরকার নেই। কিন্তু ভাইয়া নাছোড়বান্দা। ঈশানকে বললেন,

আরে বেশিরভাগ সময় তো বাসাতেই থাকো। পার্ট টাইম জব করলে সময়টা কাজে দিবে। আর ইনকামও ভালো হবে। বোকামি করো না। যা বলছি শোনো। ওরা লোক খুজছে। তুমি বললে আমি ব্যবস্থা করবো।

আমি বিরক্ত নিয়ে উঠে দাড়ালাম। ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

আমি কলেজ যাচ্ছি।

তাই শুনে ভাইয়া বললেন, এই তারু! আজ তুই স্যারের সাথে বের হো কেমন? ঈশান? তুমি এখন গাড়ি নিয়ে বের হবে না? তারুকে কলেজ পর্যন্ত পৌছে দিও। বেশি দূর না, এই পাচ দশ মিনিটের রাস্তা। হাইওয়ে তে নেমে যাস্ট সোজা চলে যাবে। মাঝে একটা বাক পড়বে, তারপরই গোল চত্বর। ব্রিজের এক পাশে নামিয়ে দিলেই হবে। ব্রিজ পেরোল কলেজ বুঝেছো?

ঈশান উৎফুল্ল হয়ে বললেন, বুঝেছি।

আমার ইচ্ছে করছে ভাইয়াকে শক্ত হাতে আলিঙ্গন করতে। কি ভালো ভাই হয়েছে আমার।

🍂

#তি_আমো❤
#পর্ব_১৩(বাকি অংশ)
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমি গাড়ির সিটের সাথে গা এলিয়ে বসে আছি। বেশ আরাম লাগছে। ঈশান ড্রাইভিং এ ব্যস্ত। মাঝে মাঝে আড়চোখে আমার কান্ড দেখছেন। আর আমি মিটিমিটি হাসছি৷ হঠাৎই ঈশানের কাধে কনুই ঠেকিয়ে উনার মুখের কাছে ঝুকলাম আমি। ঈশান স্টেয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে আমাকে দুরে ঠেলে দিয়ে বললেন,

প্লিজ। এভাবে না। এক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।

আমি অবুঝের মতো মুখ করে আহ্লাদী কণ্ঠে বললাম,

আচ্ছা আমরা কি সত্যিই কলেজ যাচ্ছি?

হ্যা! কলেজেই তো যাচ্ছি।

ধুর! আমি আরো ভাবলাম আজকে কলেজ বাংক দিয়ে আপনার সাথে ঘুরতে যাবো। তা না। আপনি আমায় কলেজেই নিয়ে যাচ্ছেন। হাউ আনরোমান্টিক!

ঈশান কাচুমাচু মুখ করে আমার দিকে তাকালেন। অপ্রতিভ স্বরে বললেন,

তুমি কলেজ বাংক দিবে? বাসায় এ্যাবসেন্ট মেসেজ গেলে?

সেইটা নিহা মেনেজ করে নিবে প্রবলেম নেই।

নিহা কিভাবে ম্যানেজ করবে?

আমার হয়ে প্রেজেন্ট দিবে।

আর ধরা পড়ে গেলে?

আমি বাকাচোখে তাকালাম। রোষাবেশ ভাব নিয়ে বললাম,

বুঝেছি। আপনার আসলে আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছাই নেই। সেজন্য কলেজে পাঠাতে চাইছেন আমাকে।

না তারিন। ইচ্ছে থাকবে না কেনো। বরং তোমার থেকে অনেক বেশি ইচ্ছে আমার।

সত্যি? তাহলে চলেন আমরা যাই?

আচ্ছা কোথায় যাবে বলো?

আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন।

উমমম… কোনো পার্কে? নাকি ক্যাফেতে?

আমি হেসে দিয়ে বললাম,

ধুর। আমি তো মজা করছিলাম। আমি কলেজেই যাবো।

এটা কি ধরণের মজা? না না আমি মানছি না। বলেছো যখন এবার যেতেই হবে।

পাগল নাকি? কলেজ বাংক দিলে ধরা পড়ে যাবো না? ক্লাস টিচার খুব রুড। বাসায় ফোন দিয়ে দিবে। তাও একদম ভাইয়ার নম্বরে। তারপর বাধবে আরেক ঝামেলা।

ঈশান হতাশ হয়ে ছোট্ট করে উচ্চারণ করলেন, ওহ! তাহলে যাওয়া হবে না?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, উহুম!

উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি মুচকি হেসে এগিয়ে গেলাম৷ ঈশানের গাল চেপে ধরে একটা টাইট কিস দিয়ে আবার নিজের সিটে গুটিশুটি মেরে বসে পড়লাম। ঈশান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি মুখে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলাম,

সরি।

ঈশান গাড়ি থামিয়ে আমার দিকে অগ্রসর হলেন। এক কথায় আমার সিটের উপর হামলে পড়লেন। আর আমি পারলে চিৎকার দিয়ে বসি। বুঝতে পারলাম “ইটস রিভেঞ্জ টাইম”। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম,

ঈশান, কি হচ্ছে?

ঈশান তার দুই হাতের ভাজে আমার কোমড় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলেন। সয়ংক্রিয়ভাবে আমার দুটো হাত উনার বুকে গিয়ে ঠেকল। উনাকে দুরে সরানোর চেষ্টায় ধাক্কাচ্ছি আমি।কিন্তু সেই চেষ্টা বিফল করে উনি ক্রমশ আমার কাছে আসছেন, খুব বেশি কাছে। আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম,

ঈশান, মানুষ দেখছে।

নিয়ন্ত্রণে থাকার জন্য নিজের মনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করি। তার উপর তুমিই যদি এমন করো, তাহলে আমার অবস্থাটা কি হবে একবার ভেবে দেখোতো? হাউ ক্যান আই কন্ট্রোল মাই সেল্ফ?

সরি আর করবো না। এবার প্লিজ ছাড়ুন। আমার কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। প্লিজ! নাহলে কিন্তু কেদে দিবো।

আমার অনুনয়-বিনয় কার্যকর হল। ঈশান নিজের জায়গায় বসে স্টেয়ারিং চেপে ধরলেন। আমি ব্যাগটা কাধে তুলে করুণ দৃষ্টিতে ঈশানকে দেখলাম। আর বললাম,

যাই হ্যা?

ঈশান আমার দিকে তাকালেন না। ইশারা করে বোঝালেন যেতে। আমি ব্যাগের সাইড পকেট থেকে ছোট চিরুনিটা বের করলাম। ঈশানের দুই গাল এক হাতে চেপে উনার মাথার চুলগুলো এক দিকে আচড়ে দিলাম। ঈশান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বললাম,

মাথায় ওমন ব্ল্যাক ফরেস্ট নিয়ে ঘুরলে মেয়েরা তো হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাবে। কিউটের ডিব্বা একটা!

বলতে বলতে নাক টিপে দিলাম। উনি কিছু বলার আগেই চটজলদি নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। দ্রুতপায়ে সামনের দিকে হাটা দিলাম। পেছন ফিরে তাকাতেও লজ্জা লাগছে। ঈশান আমাকে দেখছেন কিনা কে জানে? আমার একমাত্র উদ্দেশ্য এখন কলেজ গেইট অতিক্রম করা। তবে সেই উদ্দেশ্য নিয়ে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারলাম না। আপনা-আপনি চলার গতি কমে এলো। আমি স্থির হয়ে দাড়িয়ে গেলাম। ব্রিজের সামনে মোটর সাইকেলে বসে থাকা নীল জ্যাকেট পরিহিত কালো সানগ্লাসওয়ালা ছেলেটার দিকে চোখ আটকালো। ছেলেটার আশেপাশে দাড়িয়ে আছে দশ বারোজন সাঙ্গু পাঙ্গু। কলেজ ড্রেস পড়া মেয়েদের উত্যক্ত করছে তারা। আপত্তিকর ভাষায় বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে। এইটা ওদের নিয়মিত কাজ৷ প্রায়শই চোখে পড়তো। কিন্তু এড়িয়ে চলতাম। তবে আজ এড়িয়ে চলার জো নেই। কারণ এবার ওদের সামনে দিয়েই হেটে যেতে হবে আমায়। অন্যান্যদিন বাসে আসতাম বলে ব্রিজের ওই পাড়ে নামতে হতো।আজকে এই পাড়ে নেমেই ফেসে গেছি। ইচ্ছে করছে পেছন দিকে ছুট লাগাতে। ঈশান কি এখনো আছে? থাকলে খুব ভালো হতো।আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ঈশানের গাড়ি নেই। ভেতরটা কেপে উঠল আমার। শুকনো গলায় ঢোক গিলে ভাবতে লাগলাম, সামনে যাবো, কি যাবো না? না গিয়েও যে উপায় নেই। যতক্ষণ দাড়িয়ে থাকবো ততক্ষণ সময় নষ্ট হবে। তার থেকে চলে যাওয়াই ভালো। ওরা আমাকে যাই বলুক আমি কিচ্ছু শুনবো না। শুধু দ্রুতপায়ে ওভারটেক করবো। তাহলেই তো হলো। সাত পাচ না ভেবে এগিয়ে যেতে লাগলাম। অনেকটা কাছে চলে এসেছি। ছেলেগুলো আমায় কিছুই বলছে না। আমি চোখেমুখে গাম্ভীর্য ভাব এনে হেটে চলেছি। যেন ওদেরকে দেখতেও পাচ্ছি না। বাইকে বসা ছেলেটা শুধু সানগ্লাস খুলে আমার দিকে তাকালো।কিছু বলল না। আমি আরো সাহস নিয়ে সামনে এগুচ্ছি। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় হলো না। পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে উঠল,

এইযে আপু?

এতো ভদ্র ভাষার ডাক শুনে অটোমেটিক পেছন ফিরে তাকালাম। ওই ছেলেগুলোর মধ্যেই কেউ একজন ডেকেছে। কিন্তু কে ডাকল বুঝতে পারলাম না। মনের মধ্যে একঝাঁক ভয় চেপে বসলেও চেহারায় তা প্রকাশিত হতে দিলাম না। ভ্রু কুচকে বেশ গম্ভীর ভাব নিয়ে আবার সামনের দিকে তাকাতেই নীল জ্যাকেটের ছেলেটাকে খুজে পেলাম। ছেলেটাকে দেখে ভয়ে আতকে উঠে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলাম আমি। ছেলেটা মুচকি হেসে আমার দিকে অগ্রসর হলো। সানগ্লাস টা টি- শার্টে ঘষতে ঘষতে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

নাম কি?

আমি তোতলানো কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম, ত তারিন।

বলেই মুখে হাত রাখলাম আমি। নামটা বলা উচিৎ হয়নি। আমি তো নাম বলতেও চাইনি। তবুও কি করে বলে দিলাম। ভয়ে, আসলে ভয়ে বলে ফেলেছি। ছেলেটা বাকা হেসে বলল,

তারিন? মানে পাহাড়। পাথুরে পাহাড়।

ম মানে?

মানে তারিন নামের অর্থ পাথুরে পাহাড়।

আমি ভয় ভয় দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম। এবার আমার চোখেমুখেও ভয়টা স্পষ্ট ভেসে উঠেছে। আমার নামের অর্থ আমি নিজেও জানতাম না। কিন্তু এই ছেলে কি করে জানলো? ছেলেটা আমাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। যেন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। ঢোক গিলে বোকার মতো বলে উঠলাম,

ভাইয়া আমি যাই?

আমার কথায় যেন ছেলেটা আরো আগ্রহ পেল। উৎসাহী একটা হাসি দিয়ে বলল,

খুব সুন্দর! নামের মতোই। শুনো একটা কথা বলি। বেশি ভণিতা পছন্দ না আমার। টাইম ওয়েস্ট করে লাভ কি? সোজাসোজি বলে দেওয়াই ভালো।

ছেলেটা নিচু হলে আমার মুখের কাছে ঝুকল। মুখে শয়তানি হাসি এটে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। ক্রাশড অন ইউ।

সোজা হয়ে দাড়িয়ে পেছন থেকে কাউকে আঙুলের ইশারায় ডাকল ছেলেটা। হলুদ শার্ট পড়া একটা ছেলে সামনে এসে দাড়াল। বলল, জী ভাই?

নীল জ্যাকেটের ছেলেটা কানের পেছনে আটকানো সিগারেটটা বের করে গলায় ঝুলানো লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরালো। কয়েক টান একসাথে টেনে কোমরে হাত রেখে মেইন রাস্তার গাড়ি দেখায় মনোযোগ দিয়ে বলল,

ম্যাডামের ফোন নম্বর নোট কর।

হলুদ শার্টের ছেলেটা অর্ডার পাওয়া মাত্র পকেট থেকে ছোট সাইজের একটা প্যাট আর পেন বের করল। আমার দিকে দাত কেলানো হাসি দিয়ে বলল,

নাম্বার কি ম্যাডাম?
🍂

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে