তি আমো পর্ব-১০+১১

0
1299

#তি_আমো❤
#পর্ব_১০
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমার কথা শুনে ঈশান বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,

কি? লাফিং গ্যাস? উনাকে লাফিং গ্যাস খাওয়াতে যাবো কেনো?

প্লিজ! খাইয়ে দিন। রিকোয়েস্ট করছি আপনাকে।

ঈশান খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন,

ধুর! পাগল নাকি? বয়স্ক মানুষ। পড়ে সাইড এফেক্ট হলে? খুব ডেঞ্জারাস জিনিস। স্ট্রোকও করতে পারে। রিস্কি।

আমি আড়চোখে একবার বুড়িকে দেখলাম। বুড়ির রসিকতা যুক্ত হাসি দেখে আমার গায়ে জ্বালা ধরছে। তাই ঈশানের কথার উত্তর না দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলাম ছাদ থেকে।

.

.

ঈশানের ঘরের ছোট্ট টেবিলে ঘেষে পাশাপাশি বসে আছি আমি আর ঈশান। ঘরের দরজাটা খোলা হলেও বাহিরের দিকটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে আকাশের দিকে উকি দিলে, একরাশ ঝলমলে তারার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়। লাইটের মৃদু আলো টেবিলের উপর ছড়িয়ে আছে। সেইসাথে ছড়িয়ে আছে বই খাতা। আমার পড়তে আসার ইচ্ছে একদমই ছিল না। কিন্তু মা আর বুড়ির চোখ পাকানো হুমকির অত্যাচারে এক প্রকার বাধ্য হয়েই পড়তে এসেছি। কিন্তু ঈশান? উনি কিন্তু আমাকে ভুলেও পড়াচ্ছেন না। ম্যাথের ফরমুলা শেখানোর বদৌলতে আমাকে উনি আবেগের ফরমুলা শেখাচ্ছেন। যা আমার জন্য চুড়ান্ত বিরক্তিকর। উনার প্রতিটা আবেগমাখানো কথা আমার জন্য বিষের থেকেও বিষধর মনে হচ্ছে। তার মুল কারণ হল যখন তখন যে কেউ পর্দা সরিয়ে ভেতরে চলে আসতে পারে। যার ফল আমাদের জন্য মোটেও সুখকর হবে না। ঈশানের সেই ভয় না থাকলেও আমার মনে ভয়টা প্রবলভাবে নিজের উপস্থিতির আভাস দিচ্ছে। আমি ঈশানের দিকে তাকালাম। উনি আমার ডান হাতটা চেপে ধরে আছেন বেশ কিছু সময় ধরে। হয়তো গবেষণা চালাচ্ছেন। মানুষের হাত নিয়ে কোনো রিসার্চ বুক বের করবেন নাকি? আমি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলাম,

আপনার সমস্যা কি বলুন তো? কি করছেন এসব?

ভাবনার ডুব সাগর থেকে মাথা তুলে তাকালেন ঈশান। ভ্রু উচু করে দুই ঠোট চেপে উচ্চারণ করলেন,

হুম?

বলছি আপনি কি করছেন? এভাবে হাত ধরে রেখেছেন কেনো আমার?

ঈশান মুচকি হাসলেন। উনার হাসি দেখে আমার মনে হল, যেন উনি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিলেন । আর আমি উনার চিন্তায় ব্যঘাত ঘটিয়ে খুব বড় ভুল করেছি। ঈশান বললেন,

আসলে আমি দেখছি। তোমার হাতের রেখার সাথে আমার হাতের রেখার কোনো মিল আছে কিনা।

মানে?

মানে… মানে আমি তোমার আর আমার ভাগ্যরেখা পরিমাপ করছি।

তাইনা? মিথ্যুক! আমি কিছু বুঝি না মনে করেছেন? আপনি ইচ্ছে করে আমার হাত ধরে রেখেছেন। আর এখন বাহানা সাজাচ্ছেন।

আমার কথায় ঈশান হো হো করে হেসে উঠলেন। ঝকঝকে সাদা দাতের হাসি। উনার দন্তবিকাশের ঝলকে আমার হার্ট ফুলস্পিডে বিট শুরু করে। মনের উপর বয়ে চলা ঝড়কে উপেক্ষা করে আমি রাগী কণ্ঠে বললাম,

দেখুন আপনি যদি এমন করেন তাহলে কিন্তু আমি এখনি বই খাতা উঠিয়ে নিচে চলে যাবো। আর এখানে আসবোও না।

উনি আমার কথার উত্তর না দিয়ে আমার হাতের আঙুলগুলোর ভাজে উনার নিজের আঙুলগুলো পর্যায়ক্রমে বসিয়ে খুব শক্ত করে হাতটা চেপে ধরলেন। আর আমি ক্রমশ ভ্রু কুচকাচ্ছি। কি চলছে উনার মাথায় সেটা আন্দাজ করতেও ভয় লাগছে। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম,

ক কি করছেন এটা?

আমার প্রশ্নে উনি পুর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালেন। এবারও কোনো উত্তর না দিয়ে টেবিলের নিচ থেকে নিজের বাম পা দিয়ে আমার বাম পা চেপে ধরলেন। আর আমি শব্দ করে উঠলাম। স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার চোখমুখ কুচকে বন্ধ হয়ে কম্পন সৃষ্টি হল শরীরে। আমার অবস্থা দেখে ঈশান পৈশাচিক হাসি হাসছেন। আমি দাতে দাত চিপে অস্থিরতা নিয়ে উচ্চারণ করলাম,

প্লিজ ছাড়ুন। এমন করবেন না খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু।

ছাড়ব। আগে একটা গান শোনাও। তারপর।

কি? দেখুন আমি কোনো গান পারি না। আর এই অবস্থায় আমি গান কিভাবে গাইবো। আগে ছাড়ুন আমায়।

গান শোনার পর ডিসাইড করবো। ছাড়া যায় কি যায়না। সো গেট স্টারটেড। ফাস্ট।(টেবিলে করাঘাত করলেন)

ইম্পসিবল। আমি গান বলতে পারবো।

ওকে! তাহলে আমিও ছাড়তে পারবো না।

আচ্ছা, ঠিকাছে গান গাইছি। কিন্তু আগে আপনি ছাড়ুন। আমি পায়ে ব্যাথা পাচ্ছি। আর হাতেও।

এতোটাও রাফলি ধরিনি আমি যে তুমি ব্যাথা পাবে। এরপরেও ব্যাথা পেলে আমার কিছু করার নেই। গান না শুনে আমি ছাড়ছি না। দেটস ফাইনাল। শুরু করো।

ক কি গান?

তোমার ইচ্ছা। তবে আমার পছন্দ না হলে ছাড়া পাবে না। এবার তুমিই সিলেক্ট করো। কোন গানটা স্যুইটেবল হবে।

আমি মুখ ফুলিয়ে চিন্তা করলাম। এই মুহুর্তে গান এর “গ” টা পর্যন্ত মাথায় আসছে না। কম্পিত কণ্ঠনালী নিয়ে গান কিভাবে গাইতে হয় আমার জানা নেই। বেশিক্ষণ চিন্তা করার সুযোগ হলো না। ঈশান আবার বলে উঠলেন,

ওকে ওয়েট। তোমার সিলেকশনে প্রবলেম হলে আমি হেল্প করছি। ওমম,, আমি একটা গান শুরু করছি..যেখানে আমি থামব তার পরের লাইন থেকে তুমি শুরু করবে। গট ইট?

আমি কিছু না বুঝেই মাথা দুলালাম। উনি গান আওরাতে লাগলেন,

শাইনিং ইন দ্যা সেটিং সান লাইক পার্ল আপ অন দি ওশ্যান কাম এন্ড ফিল মি… ও ফিল মি!
শাইনিং ইন দ্যা সেটিং সান লাইক পার্ল আপ অন দি ওশ্যান কাম এন্ড হিল মি… ও হিল মি!
থিংকিং এ্যাবাউট দ্যা লভ উই মেকিং এন্ড এ লাইফ উই শ্যায়ারিং কাম এন্ড ফিল মি… ও ফিল মি!
শাইনিং ইন দ্যা সেটিং সান লাইক পার্ল আপ অন দি ওশ্যান কাম এন্ড ফিল মি, কাম অন হিল মি!

এইটুকু বলেই উনি আমার দিকে ইশারা করলেন। আমি মনের সবটুকু আকর্ষণ যুক্ত করে উনার গানের কণ্ঠে ডুবে ছিলাম। উনার পলক ঝাকানো চাহনিতে সেই ঘোর আমার ছিন্ন হল। আমি চোখ বড় করে কাপা কাপা কণ্ঠে গানের পরবর্তী কলি উচ্চারণ করলাম,

হুয়া যো তু ভি মেরা মেরা… তেরা যো ইকরার হুয়া..
তো কিউনা ম্যা ভি কেহদু কেহদু.. হুয়া মুজহে ভি প্যায়ার হুয়া..
তেরা.. হোনে লাগা হু.. হোনে লাগা হু.. যাভ সে মিলা হু..
তেরা.. হোনে লাগা হু..হোনে লাগা হু.. যাভ সে মিলা হু..

গানের পংক্তিগুলি অভিব্যক্তিরত অবস্থায় ঈশানের দিকে দৃষ্টি যেতেই থেমে গেলাম আমি। উনি পরিতোষের দৃষ্টি নিয়ে গালে হাত ঠেকিয়ে আমাকে দেখছেন। আমি জিহবা দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে উনার দিকে তাকালাম। তাই দেখে উনি গাল থেকে হাত সরিয়ে ভ্রু কুচকে বললেন,

কি হলো থামলে কেনো? বলো!

পেছন থেকে কেউ আওয়াজ দিল, কি কইতো?

ঈশান তৎক্ষণাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দরজা বরাবর তাকালাম। বুড়ি এক হাতে শাড়ির কুচিটা হালকা উচু করে অন্যহাতে ডিশভরতি চায়ের কাপ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। ঈশান জোরপূর্বক হেসে বুড়িকে সালাম দিলেন,

স্লামালাইকুম দাদী।

বুড়ি লাল দাগাঙ্কিত দাত গুলি বের করে হাসল। টেবিলে চায়ের ডিশটা রেখে বিছানায় বসে পরল। এক হাত হাটুর উপর রেখে ঈশানের দিকে তাকিয়ে প্রীতিকর হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

কি জিগাইতাছিলা?

ঈশান অপ্রস্তুত কণ্ঠে উচ্চারণ করল, ফরমুলা। ম্যাথের ফরমুলা।

ও! ফরমলা?

জি দাদি।

পড়াশুনা করতাসো না?

জি।

তুমগো পড়াশুনায় অসুবিদা না হইলে আমি একখান কথা কইতে আইসিলাম। একখান আলাপ।

জি দাদি। বলেন কোনো সমস্যা নেই।

ঈশান খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাটা বললেও আমার যে খোটকা লাগছে। কি জরুরি আলাপ করতে এসেছে বুড়িটা? আবার বিয়ের কথা বলে বসবে না তো! বুড়ির বিশ্বাস নেই।
🍂

চলবে

#তি_আমো❤
#পর্ব_১১
Writer: Sidratul muntaz

🍂
বুড়ি বিছানায় আরাম করে বসে দুই হাত হাটুতে ঘষতে ঘষতে বলল,

কথাডা হইলো আমাগো তারু রে লইয়া। হেই ছুডুবেলা থেকা মাইয়াডারে আগলাইয়া রাখতাসি। বাপ মরা মাইয়া। এতিম। হের প্রতি আমার মুহাব্বত একটু বেশিই আছিল। ওহনো আছে, খুব আদর যত্নে বড় করছি তো!মায়া লাগে বহুত। জীবনে কোনোদিন একটা টুকাও লাগতে দেই নাই শরীরে। তারুর বাপে, মরনের আগে আমার কাছেই তারুর দায়িত্ব দিয়া গেছিল। মাইয়াডারে যেন দেইখা রাখি। মেলা আদরের মাইয়া আছিল আমগো তারু। বাপের দুলালি। হেই কথা মনে পরলে এহনো বুকটাত চিলিক দিয়া উডে।

বলতে বলতে চোখের পাতা ভিজিয়ে কেদে উঠল বুড়িটা। আমি অনেকটা বাকশক্তিহীন হয়ে তাকিয়ে আছি। কি এমন হলো? হঠাৎ বুড়ির ওমন ফ্লেশব্যাকে চলে যাওয়ার কারণটা বোধগম্য হচ্ছে না আমার। এমন আচরণ তো মোটেও সমীচীন নয়। ঈশান বেশ ইতস্ততভাবে বুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। বুড়ি শাড়ির আচল দিয়ে নাকের ডগা মুছে আবার বলতে শুরু করল,

কত স্মৃতি ওহনো চোখে ভাসে। তারু যখন ছোডো আছিল, হেরে গল্প শুনাইয়া ঘুম পাড়াইতাম। গল্প না কইলে ঘুমাইতো না। জিদ কইরা বইয়া থাকতো। আমার পানের বাডা লইয়া মাঝে মাঝে সুপারি কাটতো। লুকায় লুকায় আমি না দেখি যেন। এমনে কয়বার যে হাত কাটছে। মেলা দুষ্টামী করতো। আইজকা এলা কথা কিল্লিগা কইতাছি জানো? বোইনডার আমার বিয়া ঠিক হইছে। আর কয়ডা দিন। তারপর যাইবোগা শশুরবাইত। আর দেখা সাক্কাত কইত্তে? যহন তহন আর ডাকলে ছুইট্টা আইবো না। বুড়ি কইয়া ডাকবো না। তাই আর কি একটু খারাপ লাগতাছে।

কথাটা শুনে যেন আমি হাবা হয়ে গেলাম। নিজেকে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মনে হচ্ছে। ঈশান উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

বিয়ে ঠিক হয়েছে মানে? কার বিয়ে?

কার আবার? আমগো তারুর!

ঈশান যথেষ্ট অভিঘানিত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আর আমার অবস্থা তো তার চেয়েও দিগুন অভিঘানিত। বুড়িটা ঈশানের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টায় গলা খাকারি দিল। বলল,

শুনো ভাই, তুমি আমার তারিফের মতো। আমার নাতির বয়সী। তাই তোমারে কইতাছি। বোইনডার আমার বিয়ার বয়স তো হইছে। এই সতেরোডা বছর ধইরা আমগোর কাছে ছিল। আর ওহন যাইবো একটা অপরিচিত জায়গায়৷ একটা অপরিচিত পরিবেশে। তোমার লগে আলাপ করতে আইছিলাম আর কি পোলার সম্পর্কে। তুমি শিক্ষিত মানুষ। ভালো বুঝবা..

ঈশান বলে উঠলেন,

দাদী এটা তো ঠিক না। যদি আমার অপিনিয়ন চান তাহলে আমি স্ট্রেইট না করবো। মাত্র সতেরো বছর কি বিয়ের বয়স হলো নাকি? এখন তো লেখাপড়ার সময়। বিয়ের জন্য আরও অনেক টাইম আছে। না, দাদী আমি এই বিষয় সহমত হতে পারলাম না।

ঈশান শার্টের কলার ঠিক করছেন। ভীষণ ঘামছেন উনি। ধবধবে নিখুঁত ত্বকে বিন্দু বিন্দু জলের উপস্থিতি আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে উনার চেহারা, গলা, অল্প লোমযুক্ত হাত।

বুড়ি মাথা নিচু করে হতাশাজনকভাবে উচ্চারণ করল,

ওইডা তো জানি। ওহন মাইয়ারা অনেক দুর লেখাপড়া করে, চাকরি বাকরি করে। কিন্তু আমাগো পরিবারটা তো আর হেমন নাই। বুঝোই তো বাপ মরা মাইয়ার বিয়া দেওয়া কি আর সোজা সাপটা ব্যাপার? এহন একটা ভালা সম্বন্ধ আইছে। সবসময় কি আর এমন আয়ে? এই সুযোগ হাতছাড়া করোন ঠিক হইবো কি?

অবশ্যই। ক্যান্সেল করে দিন। কোনো দরকার নেই। মানে আমি বলতে চাইছি যে এখন বিয়ের কি দরকার? পিচ্চি একটা মেয়ে। ও বিয়ে শাদীর কি বোঝে।

আমি সরুচোখে তাকালাম। ঈশান কপালে ভাজ নিয়েই হাসার চেষ্টা করে বললেন,

সময় যখন আসবে, বিয়ে এমনিই হবে। যার নেওয়ার সে এখন হলেও নিবে আর পাচ বছর পরে হলেও নিবে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তারিনের ফিউচার নষ্ট হয়ে যায়, এমন কিছু করবেন না প্লিজ।

বুড়ি বলল, পাচ বছর পর? এমন পোলা কি তামাল পিত্তিবিতে আছে? আমাগো মাইয়ার লাইগা পাচ বছর অপেক্ষা করবো? কি যে কও না! এমন দরদী কেউ নাইগো!

ঈশান বললেন, থাকবে না কেনো? নিশ্চয়ই আছে। হতে পারে আপনাদের আশেপাশেই আছে। কিন্তু আপনারা নোটিস করছেন না।

বুড়ি ঠোট উচু করে হাসল। বলল,

আশেপাশে আছে? কি কও? আমাগো এলাকার পোলারা তো সব মেট্রিক ফেল। কেউ গ্যারজে কাম করে, কেউ দোকানদারি করে, কেউ আবার কাপড়ের দোকানে কাম করে। এমন পোলার কাছে কি বিয়া দেওন যায়?

ঈশান বিরক্তি নিয়ে বললেন, আশেপাশে বলতে কি শুধু এরাই আছে নাকি? আরো ভালো ছেলেও আছে, খুজলেই পাওয়া যাবে।

বুড়ি দুই হাত একত্র করে বলল, ঠিকাছে৷ তাইলে খুইজা দাও দেখি। কত ভালো পোলা পাওন যায়। তোমারে এক সপ্তাহের মতো সময় দিলাম। এর মধ্যে যদি উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান দিতে পারো, তয় এই বিয়া ক্যান্সেল। নাইলে কলাম তারুর বিয়া আমি এইহানেই দিমু। এইডাই আমার শেষকথা। গেলাম ভাই, বোইন গেলাম।

বুড়ি শাড়ির দুই সাইড হালকা উচু করে ধরে ধীর গতিতে হেটে বেরিয়ে গেলো। ঈশান বড় করে হাফ ছেড়ে কপালের ঘাম মুছে নিলেন। ঘাসের মতো লম্বা চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে ডিশ থেকে পানির গ্লাসটা তুলে নিলেন। ঢকঢক করে গিলে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করলেন এক নিমেষে। টেবিলের সাথে গ্লাসের নিম্নতল লাগিয়ে শক্ত ভাবে চেপে ধরে কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। আর আমি? বেশ মনোযোগের সাথে উনার ছন্দোবিশ্লেষণ করছি। ঈশান আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,

বিয়ের কথা আমাকে আগে জানাও নি কেনো?

আমি ঘোর কাটিয়ে জবাব দিলাম। রোষপূর্ণ কণ্ঠে বললাম,

আমি নিজেই তো জানতাম না। আপনাকে কি করে জানাবো?

ঈশান চিন্তিত মুখে উচ্চারণ করলেন, ও আচ্ছা।

আমি বইখাতা গুছাতে গুছাতে বললাম, আচ্ছা এখন নিচে যাই ঠিকাছে? ডিনার টাইম হয়ে গেছে, আপনিও নিচে আসুন।

ঈশান মাথা ঝাকালেন। আমি চটজলদি বইখাতা তুলে নিয়ে নিচে চলে আসলাম। এক দৌড়ে বইখাতা নিজের ঘরে রেখে এসে মায়ের ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই পা বাড়াচ্ছিলাম। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারলাম না। তার আগেই বুড়ির উদ্ভট হাসির শব্দ শুনে থেমে দাড়াতে হল আমায়। আমি শুনলাম, বুড়িটা মায়ের সাথে কথা বলছে। আর খুব মজা নিয়ে হাসছে। বলছে,

বুঝছোনি আয়েশা। পোলার মুখের অবস্থাডা যদি দেখতা। ডরে চিমায় আছিল। কয় না না দাদী। বিয়া দেওয়ার দরকার নাইগগা। আরো ভালা পোলা আছে। আমিও কইলাম খুইজা দেহাইতে। এবার খালি অপেক্ষা করো। বিয়ার প্রস্তাব আইলো বইলা।

আমি কোমরে হাত রেখে চোখ সরু করে তাকালাম। তাহলে এই ছিল বুড়ির মনে? ঈশানের যা অবস্থা দেখে আসলাম, টেনশনে টেনশনে পাগল না হয়ে যায়।

.

.

আজ সন্ধ্যায় নিহা এসেছে আমাদের বাসায়। স্বচক্ষে তার ঈশান ভাইকে দেখার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে। বিশাল অট্টালিকার মালিক থেকে ছোট্ট চিলেকোঠার ভাড়াটে হয়ে কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন তাদের অভদ্র সোসাইটির ভদ্রম্যান? অতিরিক্ত ভদ্রতাও যে স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ, ঈশান ভাইয়া তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। এমনটাই মতবাদ পোষণ করছে নিহা। তবে নিহাকে দেখেও ঈশানের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর হয়নি। তিনি বেশ ভালো করেই জানে নিহা কখনো উনার গুণকীর্তনের বুলি মোহনা আন্টির কানে পাচার করবে না। তাইতো খুব নিশ্চিন্তে বাড়ির সবাইকে এইটা বুঝানোর তালে আছেন, যে আমার পাশাপাশি উনি নিহারও ম্যাথ স্যার। ফুফাতো ভাই থেকে ম্যাথ স্যার। ঈশান আর তারিফ ভাইয়া ড্রয়িং রুমে বসে কার্ড খেলছেন। ভাইয়ার হু হা হাসির অত্যাচারিত শব্দ কানে ভেসে আসলেও ঈশানের কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু মাঝে মাঝে কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বিয়ের বিষয়টা নিয়ে এখনো বেশ চিন্তিত ঈশান। আমি আর নিহা উঠানের উচু অংশে বসে নিম্নাংশে পা দুলাচ্ছি। আমি অনেকটা ঠাট্টার ছলে নিহাকে জিজ্ঞেস করলাম,

কেমন দেখলি তোদের ভদ্র মিথ্যুকম্যানকে?

নিহা আমার দিকে না তাকিয়ে আশেপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে করতে কপালে ভাজ টেনে বলল,

যা বুঝলাম, ঈশান ভাইয়া তোকে মারাত্মক ভালোবাসেন।

আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলাম। নিহা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

শোন তারু, তুই খুব লাকি। ঈশান ভাইয়ার মতো মানুষ পাওয়া কিন্তু চরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। উনার প্রতি বিশ্বাস আর সম্মানটা আমার আগে থেকেই ছিল। আর এখন সেই বিশ্বাস আর সম্মান কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

তাই নাকি? কিভাবে?

নিহার আমার দিকে ঘুরে বসল। আমার কোল স্পর্শ করে বলল,

আচ্ছা তুই এই কথাটা চিন্তা কর। শুধুমাত্র তোকে বাচাতে গিয়ে উনি নিজে কয়টা মিথ্যে কথা বললেন আন্টি আর ভাইয়ার সাথে। যেখানে উনি মিথ্যে কথা বলা সবথেকে অপছন্দ করতেন। আর এখন উনি মিথ্যে বলাটা কি চমৎকার ভাবে আয়ত্ত করে নিয়েছেন। তোর খাতিরে। আচ্ছা নিজের বাড়ি ছেড়ে, একটা ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন জায়গায় নিজেকে খাপ খাওয়ানোটা কি কোনো নরমাল ব্যাপার মনে হয় তোর কাছে? যেখানে উনার পৃথিবী আর তোর পৃথিবী সম্পুর্ণ আলাদা। তুই পারবি নিজের বাড়ি ছেড়ে, ভাইয়া আন্টি কে ছেড়ে ঈশান ভাইয়ার বাড়ি গিয়ে থাকতে? এই কথা চিন্তা করতে গেলেও তো তোর অস্বাভাবিক মনে হয় রাইট?

আমি মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানালাম। নিহা বলল,

কিন্তু বিয়ের পর সব মেয়েদের ঠিকই এডজাস্ট করে নিতে হয় ভিন্ন পরিবেশে। এমন ক্ষমতা আল্লাহ প্রদত্ত। শুধু মেয়েদেরই থাকে। আর একটা ছেলের পক্ষে এই সেইম কাজটা যে কতটা কঠিন সেটা তুই আন্দাজও করতে পারবি না। অথচ এই কঠিন কাজটাই ঈশান ভাইয়া করছেন। উনি যে কতটা স্ট্রাগেল করে এইখানে আছেন, সেটা আর কেউ না বুঝুক আমি বুঝতে পারছি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, নিহা স্ট্রাগেলের কি আছে? মা আর ভাইয়া তো উনার যথেষ্ট যত্ন আদ্দি করছে। উনাকে আমাদের ফ্যামিলির অংশ ভাবছে।

হ্যা বুঝলাম। আন্টি খুব টেক কেয়ার করছে ঈশান ভাইয়ার। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তুই তো ঈশান ভাইয়াদের বাসায় গিয়েছিলি। একবার ভেবে দেখ তো, ওই পরিবেশ আর এই পরিবেশ কতটা আলাদা! বলতে গেলে আকাশ পাতাল তফাৎ। যেখানে উনি এসি ছাড়া এক মুহুর্ত বসতে পারেনা। সেখানে তোদের বাসার টিনের গরমেও উনি ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে নির্দ্বিধায় বসে আছেন ঘন্টার পর ঘন্টা। ফ্যানের শা শা শব্দটাও উনার সহ্য হয়না। অথচ তোদের ওই চিলেকোঠার ফ্যানের ঘটর ঘটর শব্দ শুনেই উনি রাত্রিযাপন করছেন। আন্টি খাবারে যে পরিমাণে ঝাল দেয়, ঈশান ভাইয়া তো জীবনে এতো মশলাযুক্ত খাবার খায়না। কিন্তু এবার উনাকে তিনবেলা মশলাযুক্ত ঝাল খাবার খেতে হচ্ছে। চা কফিতে উনি জীবনেও ঠোট ছোয়ায় না। ঠান্ডা জুস পেলে উনার শান্তি। আর এখন তোদের বাসায় সকাল বিকাল চা খাচ্ছে কি অবলীলায়। ঈশান ভাইয়ার বাগানের পেছনে পাখির বাসা দেখেছিলি তুই? ওই পাখিগুলো উনার প্রাণ। দৈনিক নিজহাতে দানা খাওয়াতেন পাখিগুলোকে। কতটা যত্নে রাখতেন। আমাদের তো পাখি এরিয়ায় ঢুকতেও দিতেন না। পাখি ভয়ে পালিয়ে যাবে বলে। আর এখন প্রাণপাখিগুলোর মায়া ত্যাগ করে উনি এখানে এসে বসে আছেন। তোদের ওয়াশরুম, বেডরুম, ড্রয়িং রুম। সব জায়গাতে উনাকে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে হাসিমুখে। বোঝাতে হচ্ছে উনি খুব ভালো আছেন। খুব শান্তিতে আছেন। কিন্তু আসলেই কি এখানে উনি কমফোরটেবল? এরপরেও বলবি উনি স্ট্রাগেল করছে না? ভাগ্যিস মোহনা আন্টি এখানে নেই। ছেলের এমন পরিবর্তন দেখলে আন্টি স্ট্রোক করে মারা যেতো। সত্যি ভালোবাসার জন্য মানুষ কিনা পারে! নিজের বাড়ি ছেড়ে ছোট্ট চিলেকোঠার ভাড়াটেও হয়ে যেতে পারে। এমনকি উবার ড্রাইভারও হতে পারে। আর কোচিং এর ম্যাথ টিচারও।

নিহা তার বক্তব্য শেষ করে চায়ে চুমুক দিল। আর আমি চিন্তা করতে লাগলাম, আসলেই তো। উনার এখানে থাকতে যথেষ্ট অসুবিধা হওয়ার কথা। ধরতে গেলে প্রতিটা মুহুর্তেই উনাকে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আর এইটা উনার চেহারায় একদমই প্রকাশ পাচ্ছে না। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে তাকালাম। পর্দার আড়াল থেকে ঈশানের মুখটা দেখা যাচ্ছে। ভাইয়ার সাথে কথা বলতে বলতে আনমনে হাসছেন উনি। প্রাণবন্ত হাসি।
🍂

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে