ডুমুরের ফুল ২৫

0
1915

ডুমুরের ফুল ২৫.

মিম্মা হেমলতার নানীর নাম্বারে ফোন দিলো বেশ কয়েকবার কিন্তু রিসিভ হলো না। হেমলতার নাম্বারে ফোন দিয়েও সুইচড অফ পেলো৷
হেমলতার বাবার নাম্বারটা তার কাছে নেই। দিনের বেলা হলে ওর বাসায় গিয়ে উপস্থিত হওয়া যেতো কিন্তু এখন তো রাত। জাদিদকে ফোন দিয়ে কী বলবে সে?
জাদিদ নিজেই ফোন দিলো মিম্মাকে। মিম্মা রিসিভ করলো।
– মিম্মা কথা হয়েছে ওর সাথে?
– ওর নাম্বারটা সুইচড অফ আর নানীর নাম্বারে রিং হচ্ছে বাট কেউই রিসিভ করছেনা।
– ও নানী আমাদের বিষয়ে জেনে গেলো নাকি?
– যদি জেনে যায় তাহলে বুঝে নিও ওর সাথে তোমার আর কস্মিনকালেও দেখা হওয়া তো দূরে থাক কথাও হবেনা।
– ওর নানী অনেক মেজাজী মহিলা।
– আমি আবার ফোন দিয়ে দেখবো। তুমি টেনশন করো না। পড়াশোনা ঠিকঠাক ভাবে করো।
– পড়তে বসতে পারছিনা। মন স্থির হচ্ছেনা কোনোভাবেই। সেই সকালে একবার কথা হয়েছে আর সারাদিনও কথা হয়নি। মন স্থির না করতে পারলে কোনো কিছু করতে পারিনা আমি।
– জাদিদ এতো অস্থির হবার কিছুই নেই। আমি ওর বাসায় যেতাম কিন্তু রাত হয়ে গেছে বিধায় পারছিনা। তুমি মাথা থেকে ওর ব্যাপারটা সরিয়ে ফেলো। ভাবো যে তোমার সামনে এডমিশন নামক যুদ্ধ। আর তোমাকে শহীদ না গাজী হতে হবে। বুঝতে পারছো?
– ৩০ সেকেন্ড কথা বলতে পারলেও হতো।
– কিন্তু সেটা তো সম্ভব না এখন। আমি চেষ্টা করবো কথা বলায় দেয়ার জন্য।
– আসলে কী জানো? আমি খুব একা। বাবা মায়ের সেপারেশনের পরে আমি একা হয়ে পড়েছি। মা গ্রিসে চলে গেলো আর বাবা তো বছরের বেশিরভাগই থাকে শীপে। সেপারেশন তাদেরকে মুক্তি দিলেও আমাকে আমার মাঝেই আটকে দিয়েছে।
নিজেকে ডিপ্রেশন থেকে দূরে রাখার জন্য সারাদিন রাত বই নিয়ে বসে থাকতাম।
এক্সাম হলে গিয়েছি অন্যান্যদের মা তাদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। কীভাবে আদর করে জিজ্ঞেস করে
– বাবা, এক্সাম কেমন হলো?
টিফিন টাইমে বক্সে খাবার কতো যত্ন করে দিয়ে দেয়। আর আমার টিফিন বক্স দেয়ার কেউই নাই।
ঈদের দিনের সকালে মায়ের হাতের সেমাই, পায়েস খেয়ে নামাজে যায় আর আমি…..
জাদিদ আর বলতে পারলোনা। গলায় আড়ষ্টতা আষ্টেপৃষ্টে ধরলো তাকে।

মিম্মা কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। জাদিদের জীবনের অনেক বড় সত্য এতোদিন তার কাছে লুকানো ছিলো। শুধু শুধু ছেলেটাকে সে ফ্রড ভাবতো। তার এখনই হেমলতার বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে।
কিছু একটা বলতে হবে মিম্মার।
– সকালে তোমার সাথে কথা বলিয়ে দিবো। এখন তুমি পড়তে বসো।
– শিওর?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা রাখি।

হেমলতার ঘুম ভাঙলো মিসেস জয়নাবের ডাকে। মিসেস জয়নাব নীরস কণ্ঠে বললেন
– রাতের খাবার খেয়ে নাও। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে।
হেমলতা বিছানায় উঠে বসলো। মাথাটা ভার হয়ে আছে। বিছানা ছেড়ে নামতে গেলেই সে পড়ে যাবে এমন মনে হচ্ছে।
হেমলতাকে ঝিম মেরে বসে থাকা দেখে মিসেস জয়নাব ধমকে উঠলেন।
– এই মেয়ে বলছিনা খাবার দেয়া হয়েছে।
হেমলতা কিছু না বলে বিছানা ছেড়ে নামতে পা বাড়ালো। পা কাঁপছে তার। তারপরও পা মেঝেতে রেখে মনের জোরেই হাঁটতে শুরু করলো।
টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো। লাঈলি বানু হেমলতার সামনে প্লেট রেখে বললেন
– জ্বর বাধিয়েছো নাকি?
হেমলতা শুকনো মুখে বললো
– না।
– তাহলে ওভাবে ঢেঙিয়ে হাঁটছিলে যে?
– ঘুম থেকে উঠলাম তো তাই আরকি।
লাঈলি বানু হেমলতার প্লেটে ভাত বেড়ে দিলেন। মুরগির মাংস পেঁপে দিয়ে রান্না করেছে আর আলু ভাজি।
মিসেস জয়নাব হেমলতার সামনের চেয়ারে বসলেন।
নানীর ভয়ে কোনোমতে খাবার গিললো।
যেভাবে এসেছিলো টেবিলের কাছে ঠিক সেভাবেই বেডরুমে চলে গেলো হেমলতা।
বিছানায় উপর হয়ে পড়ে রইলো।
কিছুই ভালো লাগছেনা, কিচ্ছুনা।
মোবাইলটাও নষ্ট হওয়ার সময় পেলো না।

শাম্মী ল্যাপটপ অফ করে বই নিয়ে বসলো। রুটিন টা কোথায় রেখেছে মনে নেই। রুটিন না হলেও পড়তে বসে লাভ নেই। আগামী ক্লাসে ফিজিক্স – ১ এর দ্বিতীয় অধ্যায় পড়াবে আর সে উদ্ভিদবিজ্ঞান পড়ে গেলো। পুরো ক্লাস বিফলে যাবে তার৷
জাদিদকে ফোন দিলেই হবে। ছেলেটা অনেক পড়ুয়া। আর দেখতেও বেশি মাত্রায় কিউট। ফোন নাম্বার দিতেই চাচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো আমি ছেলে আর সে মেয়ে। আজব ছেলে।
জাদিদকে ফোন দিলো শাম্মী। ছেলেটা খুব সম্ভব হ্যালো শুনলেই বিরক্ত হবে। চোখ মুখ ছোটো ছোটো করে বলবে
– আপনি ফোন দিয়েছেন কেনো?
আচ্ছা ছেলেটা আপনি না তুমি সম্বোধন করে ডাকে তাকে? সে যাইহোক ১০০% শিওর সে বিরক্ত হবে।
জাদিদ আন নাউন নাম্বার দেখে ভাবলো হয়তোবা হেমলতা ফোন দিয়েছে।
উত্তেজিত হয়ে ফোন রিসিভ করলো। ফোন রিসিভ হয়েছে বুঝতে পেরে শাম্মী নরম স্বরে কথা বলতে শুরু করলো।
– হ্যালো।
কণ্ঠ শুনেই জাদিদ বুঝে গেলো হেমলতা ফোন দেয়নি।
– হ্যালো, আপনি কে?
– আমি শাম্মী।
– ওহ, কী কারণে ফোন দিয়েছেন?
– আমি জানতাম তুমি এই প্রশ্নই করবে।
– কারণ বলুন
– তুমি এখন ভ্রু কুঁচকে বসে আছ তাই না?
জাদিদ অবাক হলো কারণ সে সত্যিই এখন ভ্রু কুঁচকে আছে। মেয়েটা জানলো কীভাবে? হেমলতাও তো এটা জানেনা।
– আপনি কীভাবে জানলেন?
– তোমার নাড়ীনক্ষত্র আমি জানি।
– কিন্তু কীভাবে?
– আমার মাথায় ইয়া বড় একটা জট আছে।
– জট থাকলে কী হয়?
– তুমি জানো না বুঝি?
– না
– মাথায় জট থাকলে ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জানা যায়। এইযে আমার মাথায় জট আছে তাই আমি আপনার বর্তমান জানতে পেরেছি।
– আমি বিশ্বাস করিনা এসব।পামিস্ট্রি আমি বিশ্বাস করিনা।
– না করলে। রুটিন আছেনা তোমার কাছে?
– হ্যাঁ আছে।
– আমারটা পাচ্ছিনা। তুমি দেখে বলোতো আগামী ক্লাসে কোন কোন সাবজেক্ট আর টপিক পড়াবে।
জাদিদ রুটিন দেখে সব জানিয়ে দিলো। শাম্মীকে ধন্যবাদ দেয়ারও সুযোগ দিলোনা। ফোন কেটে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
অসহ্য লাগছে তার।
মনোজ সাহেব ধলার মোড়ের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। রাত ৯ টা ৪৫ বেজে গেছে কিন্তু বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা জাগছেনা তার। দোকানী তাকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় থাকেন। কিন্তু মনোজ সাহেব কোনো উত্তর দেননি।
চায়ের বিল পরিশোধ করে দিয়ে নদীর ধারে রাখা সিমেন্টের বসার বেঞ্চিতে বসলেন।
তার সামনে বিশাল নদী আর বিশাল আকাশ। আকাশ জুড়ে তারা আর তারাদের মিছিল।
যদি এই তারাদের মিছিলে হারিয়ে যাওয়া যেতো তাহলে দোলাকে আবার ফিরে পাওয়া যেতো।
দোলাও হয়তোবা তারার মিছিলে আছে এখন। দোলার স্মৃতি এখন শুধুই হেমলতা। একটা মানুষ বেশ কয়েক বছর আগেও ছিলো কিন্তু এখন নেই।
কতো মানুষই তো মারা যায় কিন্তু তারা তো এভাবে মনে দাগ কাটেনা। তাহলে দোলা কেনো এভাবে দাগ কেটে গেলো?
তারই অফিসের কলিগ স্ত্রী মারা যাবার দুই সপ্তাহের মাথায় আবার বিয়ে করেছে। তার চেহারা দেখে কেউই ঠাওর করতে পারবেনা তার প্রথম স্ত্রী মারা গেছে এক মাসও হয়নি। আর দোলা মারা গেছে……

জীবন এমনই। যা চাওয়া যায় তা পাওয়া যায়না। পাওয়া গেলেও ক্ষণিকের জন্য! তারপর আবার সেই শূন্যতা, শুধুই শূন্যতা।

চলবে…….

~ Maria Kabir

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে