ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-২১+২২+২৩

0
393

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_____২১

আজ সোমবার। হসপিটালে আজ ইশার তৃতীয় দিন। সকাল আটটা বাজতেই বাড়ি থেকে সকালের নাস্তা নিয়ে হাজির হলো আরব আর নামিরা। হসপিটালে ইশার থাকে থাকছে শ্রাবণ আর মরিয়ম বিবি। গতকাল ছিলেন আফিয়া বেগম আর শ্রাবণ। ইশার বন্ধ কেবিনে বিনা শব্দে প্রবেশ করলো শ্রাবণ। ঘুমচ্ছে ইশা। ডাক্তার বলেছিলেন সকালের নাস্তা আটটায় করালে ভালো হয়। সেই নিয়ম অনু্যায়ী শ্রাবণের হাতে সকালের নাস্তা। সে ভেতরে ঢুকে টিফিনবক্স গুলো টেবিলের উপর রাখলো। ইশাকে ডেকে উঠাতে হবে। হাতের স্যালাইনের দিকে একবার তাকালো সে। শেষের পথে।

“সুপ্রভাত ইশুপাখি।;

ইশার পানে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে দূর হতেই মনেমনে আওড়ালো শ্রাবণ। স্মিত হেসে এগিয়ে গেলো জানালার দিকে। হাত উঁচিয়ে দু’টো পর্দা সরাতেই একফালি রোদ উপচে পড়লো মেঝেতে। কতক্ষণ গড়াগড়ি খেয়ে ছড়িয়ে যেতে লাগলো সারা ঘরময়। ইশাকেও ছাড়লোনা। অতি দ্রুত গতিতে আলিঙ্গন করলো ইশার কপাল,নাক, ঠোঁট এবং সারা শরীর। চোখের উপর ফকফকা আলো পড়তেই ইশার ঘুমের রেশ পাতলা হতে লাগলো। শ্রাবণ এগিয়ে এলো ইশার দিকে। মাথায় হাত রেখে ডাকতে লাগলো কোমল স্বরে,

“ইশা, এই ইশা!;

ইশা আলগোছে চোখ খুললো। চোখের পলক ঝাপটে সামনে দেখতেই ভেসে উঠলো শ্রাবণের স্নিগ্ধ মুখবিবর। ইশা প্রশান্তিতে মৃদু হাসলো। দুর্বল হাসি। শ্রাবণ ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

“ব্রেকফাস্ট রেডি। জলদি উঠে পড়তে হবে!;

“তুমি খেয়েছো?;

“তোকে খাইয়ে খাবো।;

“মা?;

“মনি, আরব আর নামিরা পাশের কেবিনে খাচ্ছে।;

বলতে বলতে ইশাকে উঠে বসতে সাহায্য করলো শ্রাবণ। ওয়াশরুম থেকে পানি আর ব্রাশ এনে রাখলো ইশার সামনে। ইশা একহাতে মুখ ধুয়ে আস্তে ধীরে ব্রাশ করে নিলো। ততক্ষণে শ্রাবণ বক্স খুলে খাবারগুলো এক এক করে বের করে সাজিয়ে রাখলো। ইশার মুখ ধোঁয়া হলে সেগুলো পূণরায় রেখে এলো ওয়াশরুমে। সেই সাথে নিজেও ফ্রেশ হলো। চোখেমুখে পানি দিয়ে এসে খাবার গুলো ইশার সামনে রাখলো।

খাবার দেখে ইশার মুখ খানা চুপসে গেলো। এখানে সব পাতলা আর ঝোল ঝোল খাবার। দু’তিন পদের স্যুপ আছে তবে সেটাও ঝালনুন হীন! এই খাবার কি মানুষ খায়?

ইশাকে নাকমুখ কোঁচকাতে দেখে শ্রাবণ বলে উঠলো,

“কোনো লাভ নেই। ডক্টর বলেছেন টানা একমাস এভাবেই রুটিন মেনে খাবার খেতে হবে। কোনটা থেকে শুরু করবি বল?;

” আমি খাবোনা।;

“না খেলে কবরে পাঠাবো। কোনটা আগে ঝটপট চুজ কর!;

শ্রাবণের শান্ত স্বরের খাটাস মার্কা হু*মকিতে ইশার মুখ কাচুমাচু হয়ে গেলো। এই টুকু অপরাধের জন্য সে কবরে যেতে চায়না। তাই ভালোয় ভালোয় আঙুল তাক করলো প্রথম বক্সটার পানে। স্যুপ রয়েছে তাতে। শ্রাবণ নীরব চাহনিতে বক্সটা তুলে চামচ নিয়ে ইশার মুখের সামনে ধরলো। ইশার ভেতর থেকে বমি আসছে এসব খাবার দেখে। কোথায় ওর পছন্দের ঝাল ঝাল খাবার আর কোথায় এই নিরামিষ খাবার। এসব মুখে রোচে নাকি?

” হা কর।;

ইশা হা করলো। শ্রাবণ গম্ভীর থেকে খাওয়াতে শুরু করলো ওকে।

মরিয়ম বিবির খাবার সবে শেষ হলো। দুটো পরোটা খেয়েই হাত ধুয়ে উঠে গেলেন তিনি। মেয়ের কেবিনে যাবেন। তাড়াহুড়ো করে নাকেমুখে খেয়েছেন। তিনি কেবিন থেকে বের হতেই আঁড়চোখে আরবের দিকে তাকালো নামিরা। আরব যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো। মনি বের হতেই তেড়েমেড়ে গেলো নামিরার পানে। নামিরা তৈরি হচ্ছে উঠে দৌড়ে পালাবে। তবে সেই সুযোগ আর হলোনা। আরবের বাহুডোরে বন্দী পরতে হলো তাকে।

“এটা কিন্তু মোটেই ভালো হচ্ছে না আরব। আমি কিন্তু চিৎকার করবো!;

আরব ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি এঁটে বলল,

“মনির জন্য এতক্ষণ রেহাই পেলেও এখন কোথায় পালাবে?;

“কেউ এসে পড়বে! আন্টি এসে পড়লে কিন্তু খুব খারাপ হবে। আমি লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারবোনা!;

“দরকার নাই। শুধু আমাকে মুখ দেখালেই চলবে।;

“আপনি কিন্তু বড্ড নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছেন।;

“আচ্ছা? তাই নাকি! তা একটু নির্লজ্জপনা দেখাবো নাকি হু?;

নামিরা আঁতকে উঠলো। অস্থির হয়ে উঠলো আরবের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। সুযোগে দুটো বসালো আরবের কাঁধে। আরব তাতেও টললো না। শব্দ করে হেসে উঠলো।

“ছাড়ুন না!;

“তখন কি বলেছিলাম?;

“কি?;

“ভালোবাসি বলো!;

“বলবোনা।;

“এরজন্যই শা*স্তি।;

“উফফ!;

“এই আরব? আমার ফোনটা কি তোর কাছে?;

দরজার কাছ থেকে ভেসে এলো মরিয়ম বিবির গলা। ভ*য়ে আতংকে দু’জন ছিটকে পড়লো দু’দিকে। মরিয়ম বিবি হন্তদন্ত ভেতরে ঢুকলেন। বেডে, সোফায় একবার নজর বুলিয়ে আরবের দিকে তাকালেন। আরব রীতিমতো স্ট্যাচু হয়ে আছে। যা দেখে মরিয়ম বিবি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।

” কি হয়েছে তোর?;

আরবকে করা প্রশ্নে নামিরারও হুঁশ ফিরলো। নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে ওর ব্যাগের পাশ থেকে মরিয়ম বিবির ফোনটা হাতড়ে উঠালো। মরিয়ম বিবির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“তোমার ফোন আমার কাছে ছিলো আন্টি।;

আরবের থেকে মনোযোগ সরে গেলো মরিয়ম বিবির। নামিরার কাছে নিজের ফোনের সন্ধান পেয়ে খুশি মনে আবার চলে গেলেন। আরব যথা স্থানে দাঁড়িয়ে কোমর বেঁকিয়ে মরিয়ম বিবির যাওয়া দেখলো। সামনের কেবিনে ঢুকে পড়েছে সে। এবার সে সোজা হলো। নামিরার দিকে তাকিয়ে বুকে হাত চেপে বড় করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,

“বাঁচলাম।;

“জি না। বলুন, বাঁচালাম।;

আরব মশা তাড়ানোর ভাব করে বসে পড়লো বেডে। চোরা চাহনিতে নামিরার পানে তাকিয়ে বলল,

“ভালোবাসি কিন্তু বললেনা।;

নামিরা ক্ষেপা চোখে তাকালো। আরব শব্দ করে হেসে উঠলো নামিরার এই চাহনি দেখে।

গুনে গুনে তিনচামচও খেতে পারলোনা ইশা। মুহুর্তেই নাকমুখ কুঁচকে বমি করতে লাগলো। মরিয়ম বিবি হন্যে হয়ে ছুটে গেলেন বালতি আনতে। ততক্ষণে ফ্লোর ভিজে উঠলো। শ্রাবণ অসহায় নেত্রে ইশার কপাল চেপে ধরলো। ইশা কাঁপা কাঁপা হাতটা ঠেকালো শ্রাবণের হাতে। নাড়িভুড়ি সব বের হয়ে এসেছে বলে মনে হচ্ছে ইশার। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। এই সমস্যাটা দু’দিন ধরেই চলে আসছে। কিছু পেটে পড়লেই মুখ উল্টে বমি। এর কারন অবশ্য বলেছেন ডক্টররা। পেটে বি-ষ দ্রব্য পরার কারনে হচ্ছে এমনটা।

“আবারও বমি আসছে!;

কান্না জড়ানো গলায় বলল ইশা। শ্রাবণ ইশার মাথাটা বুকে চেপে ধরলো। বলল,

“সব ঠিক হয়ে যাবে পাখি। একটু ধৈর্য্য ধর?;

ইশা শ্রাবণের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদে। মরিয়ম বিবি এসে দাঁড়ান মেয়ের সামনে। হাতে লেবু নিয়ে এসেছেন। সেটা ইশার নাকের সামনে ধরে বলল,

“এটার গন্ধ নে মা। বমি আসলেও আর হবেনা। কেটে যাবে। নে নে।;

শ্রাবণকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে ইশা। লেবুটা নিয়ে মায়ের কথা মতো গন্ধ শুঁকে। শ্রাবণ খাবার গুলোর দিকে অসহায় দৃষ্টি মেলে দেখে একবার। একটা খাবারও খেতে পারলোনা। ভাবতেই কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। তুর্জকে মে/রে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কেন যে মা*র*লো না তখনই!

তুর্জকে পুলিশ দিয়ে এরেস্ট করিয়েছেন খান সাহেব। বড় দাপটি লোক হওয়ায় ভালো মতো সাজা লিখিয়েছেন পুলিশ স্টেশনে। খান সাহেবের হুকুমে তুর্জ এখন জেলে। কাল তার কেস কোর্টে তোলা হবে। কম করে হলেও দশ বছরের সাজা তো নিশ্চিত।

শ্রাবণ ডক্টরের সাথে কথা বলবে বলে চলে গেলো। আবরও গেলো তার সাথে। নামিরা আসলো ইশার কাছে। পাশে বসে স্নেহ করে একটু আধটু খাওয়ানোর চেষ্টা করলো মরিয়ম বিবির সাথে।

_______

আফিয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। শমসের সাহেব ডেকেছেন গলা চড়িয়ে। অফিস যাবে অথচ ফাইল খুঁজে পাচ্ছে না। ইম্পরট্যান্ট ফাইল। কাল রাতে আগেভাগেই বের করে রেখেছিলেন। আফিয়া বেগম গুছিয়ে আবার কোথায় তুলে রেখেছেন কে জানে?

“কি হলো? এতো ডাকাডাকি কেন সাতসকালে?;

“আমার ফাইলটা কোথায়? এখানেই তো ছিলো। কাল রাতে রাখলাম যে।;

বিরক্ত গলায় শুধালেন শমসের সাহেব। আফিয়া বেগম মনে করার চেষ্টা করলেন তার স্বামী ঠিক কোন ফাইলেন কথা বলছেন। হ্যাঁ মনে পড়েছে। কপালে হাত চেপে বললেন,

“ওটা তো আলমারিতে তুলে রাখলাম সকালে তোমার সামনে। তখন তো জানতেও চাইলাম, ফাইলটা কি তুলে রাখবো কিনা? তুমি যে ‘হু’ বললে?;

আশ্চর্যান্বিত শমসের সাহেব। তিনি কখন কোন ফাইল তুলে রাখার জন্য ‘হু’ বলেছিলেন? মনে পড়লোনা। আফিয়া বেগম আলমারি খুলে ফাইলটা বের করে স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন,

“আজকাল বড্ড অন্যমনস্ক থাকো। কি ব্যাপার? অফিসে কাজের চাপ কি একটু বেশি?;

ফাইলটা পেয়ে আবার অন্যমনস্ক হয়ে যান শমসের সাহেব। বিবির কথা ঢুকলো না মাথায়। আফিয়া বেগম চেয়ে রইললেন। জবাব না পেয়ে তিনিও আর এই প্রসঙ্গে কিছু বললেন না। কথা ঘোরালেন। মনের মধ্যে দু’দিন ধরে একটা কথা ঘুরছে। স্বামীর সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করতে চান। কিন্তু পারছেন না।

“শ্রাবণের জন্য একটা ভালো মেয়ের খোঁজ পেয়েছি। নাম নিলাশা। বাবার বন্ধুর নাতনি। দেখতে শুনতে মন্দ নয়। লক্ষিমন্ত মেয়ে। প্রানবন্ত, হাসিখুশি। ঘরের সব কাজ জানে। মানুষের সাথে বেশ অমায়িক। আমাদের শ্রাবণ যেমন ওর জন্য একদম পার্ফেক্ট হবে বলেই মনে হচ্ছে। দাঁড়াও তোমাকে ছবি দেখাচ্ছি।;

বলতে বলতে পকেট হাতড়ে ফোন বের করলেন শমসের সাহেব। এতক্ষণ বলতে না পারা কথা গুলো বলার উৎসাহটুকু নিমিষেই বিলীন হয়ে গেলো আফিয়া বেগমের। স্বামীর কথায় স্তব্ধ তিনি। শ্রাবণের জন্য পাত্রী ঠিক করলো নাকি? কিন্তু তার ছেলে যে…

আফিয়া বেগমের ভাবনাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন শমসের সাহেব। চোখের সামনে তুলে ধরলেন ফুটফুটে হাস্যজ্বল একটি মেয়ের ছবি। সাধারণ মেয়ে বললে ভুল হবে। এতো যেন কোনো অপ্সরা। কিছু বলতে পারলেন না আফিয়া বেগম। শমসের সাহেব উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্ত্রীর মুখপানে। যেন তার মুখ থেকে মেয়েটার প্রশংসা না শুনে তিনি যাবেন না।

“কি, বলো কিছু?;

“সুন্দর।;

“ব্যস?;

“হু।;

“একসাথে দু’জনকে কেমন মানাবে তা বলো?;

“ভালো।;

জোরপূর্বক হেসে বলার চেষ্টা করলেন আফিয়া বেগম। শমসের সাহেব খুশি হয়ে গেলেন। মাথা নেমে বললেন,

“ভালো মানাতেই হবে। দেখতে হবেনা পছন্দটা কার৷;

মুচকি হেসে ফাইল নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন শমসের সাহেব। আফিয়া বেগম আর কিছু বলার দুঃসাহস করলেন না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন।

_______

ইশা বাড়ি যেতে চায়। তার এই আবদ্ধ পরিবেশে দম বন্ধ লাগে। বাড়ি গেলে সবাইকে চোখের সামনে দেখলেও যেন শান্তি। তাই পরদিনই রিলিজ নিয়ে বাড়ি ফিরলো ইশা। ডক্টর একটা রুটিন চার্ট দিলেন। সেই অনুযায়ী ইশাকে দেখভাল করতে হবে। চার্টটা হাতে নিয়ে সবাই এক এক করে মুখস্থ করলো। একজন যদি ভুলে যায় তবে অন্যজন যেন সময় মতো সবটা করতে পারে। এই নিয়ে একচোট গবেষণাও হলো। বাড়ির সবাই খুব খুশি ইশাকে পেয়ে। তুতুনের আনন্দ সবার উর্ধ্বে। তার মেজআপাকে পেয়ে বাড়ি মাথায় তুলে নাচছে সে। ইশাকে বাড়ি আনতে তিতিরও চলে এলো শশুর বাড়ি থেকে। শাকিল ওকে দিয়ে চলে গেছে অফিসে। বলেছে রাতে ফিরবে।

ভাইবোনরা সবাই মিলে ইশার ঘরে আড্ডায় বসলো। আজকে সকলের স্কুল-কলেজ-ক্যাম্পাস থাকলেও ইশাকে ছেড়ে এক পাও নড়েনি কেউ। আজকের দিনটা শুধু ইশার জন্য। স্কুল কলেজ আবার কাল থেকে।

“চল লুডু খেলি।; বলল তিতির।

আরব নাকচ করে বলল,

“মেয়েদের খেলা। আমি একা ছেলে মানুষ কি করবো?;

“তুই চেয়ে দেখ ভাইয়া।; বলে মুখ টিপে হাসলো তানি।

তুতুন খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,

“ভাইয়া তুমি আর আমি পুতুল খেলি চলো। তুমি হবে আমার পুতুল বউয়ের শাশুড়ী। জল্লাদ শাশুড়ী।;

তুতুনের কথায় আরবের ইজ্জতের দফারফা। নামিরা মুখ টিপে হাসছে ওদের কথা শুনে। আরব নামিরাকে আঁড়চোখে দেখে নিজের ইজ্জত ধরে রাখার তাগিদে বলল,

“তোর পুতুল বউয়ের জল্লাদ শাশুড়ী কেন হতে যাবো! আমাকে দেখে কি তোর মেয়ে বলে মনে হয়? তাও নাকি জল্লাদ!;

হাসির রোল পড়লো এবার। ইশা,তিতির, নামিরা, তানি, তুতুন সবাই হাসলো উচ্চস্বরে। হাসতে হাসতে ইশা বলল,

“তুতুনবুড়ি এক কাজ কর, তুই বরং নামিরা আর আরব ভাই দু’জনকেই নিয়ে নে। নামিরাকে বানাবি বউ আরব ভাইয়াকে বানাবি বর। কেমন?;

নামিরা লজ্জায় হাসফাস করে উঠলো। তুতুন আগ্রহী চোখে নামিরার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই নামিরা বাঁধ সেধে বলল,

“না না না! আ্ আমি পুতুল খেলবো না।;

“কেন নামিরা আপু? খেলোনা একটু। একটু?;

“না সোনা। আমরা বরং অন্য গেম খেলি কেমন? এই ধরো চোর পুলিশ? চ্ চোর পুলিশ খেলি!;

সবাই সহমত পোষণ করলো। চোর পুলিশ খেলবে সবাই। তানি খাতা-কলম নিয়ে এলো। কার্ড বানাতে শুরু করলো। নামিরা এখনও লজ্জায় কাচুমাচু করছে। ইশা ধরতে পারছে ওর ব্যাপারটা। তাই মুচকি হেসে ওকে খোঁচা মে/রে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,

“কি হবি নাকি আমার ভাইয়ের বউ?;

নামিরার উপর যেন এক বালতি লজ্জার বর্ষন হলো। তুবড়ে পড়লো সে। ইশা মুখ টিপে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে দরজার দিকে চোখ পড়তেই চোখাচোখি হলো শ্রাবণের সাথে। হাতে কফির ফ্লাক্স নিয়ে রুমে ঢুকলো সে। পেছন পেছন লতাও আছে। সবার জন্য ভুট্টা ভাজা এনেছে। শ্রাবণ ইশার পানেই চেয়ে ছিলো। দেখছিলো প্রেয়সীর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা।কতদিন হাসেনি মেয়েটা। পরিবারের মানুষগুলোকে পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে নিজের মাঝে।

শ্রাবণকে দেখে আবার ইশার হাসির ইতি ঘটলো। এবার পালা নামিরার। এতক্ষণ ইশা ওকে খোঁচালেও এবার ওর সুযোগ ইশাকে খোঁচানোর। তাই শয়তানি হেসে ইশার কানে কানে বলে উঠলো,

“এসে গেছে তোর হিরো। এবার আমার পালা। বি রেডি ইশুপাখি।;

“একটা ওলট-পালট কথা বললে তক্তা বানিয়ে ফেলবো।;

“ওমা সেকি কথা! শ্রাবণ ভাই রাগ করে চলে যাবার পর যে পাগলামি গুলো করেছিলি সেগুলো বলবোনা উনাকে? না বললে উনি জানবেন কিভাবে?;

ইশা অসহায় নেত্রে তাকালো নামিরার পানে। আকুতি করা গলায় আস্তে করে বলল,

“না প্লিজ, শ্রাবন ভাই আমাকে ক্যাবলা ভাববে। তোর পায়ে পরি ওসব কথা তুলিস না।;

“মোটেই না। তারও তো জানা উচিৎ আমাদের ইশুরানি কতটা পাগল তার শ্রাবণ ভাইয়ের জন্য।;

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব__________২২.

“বলছিলাম কি ভাইয়া…;

রসালো গলায় শ্রাবণকে ডাকলো নামিরা। ইশা আঁতকে উঠে নামিরার হাত চেপে ধরলো। করুন তার চাহনি। যেন এক্ষনি নামিরার পায়ে পরে যাবে ওকে চুপ করানোর দায়ে। নামিরা বাঁকা হাসলো। লতার থেকের ওর কফিটা নিতে অগ্রসর হয়ে একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখালো ইশাকে। পরক্ষণেই আবারও বলে উঠলো,

“স্পেশাল নাকি?;

শ্রাবণ ফ্লাক্স থেকে কফি ঢালছিলো। সবার জন্য নয়, কেবল ইশার জন্য। নামিরার কথাটা শুনে মুচকি হাসলো। মাথা দুলিয়ে ধীর গলায় বলল,

“ইয়েস, ফর স্পেশাল পারসন।;

নামিরা দুষ্ট হাসে। শ্রাবণের কথাটা অবশ্য নামিরা বাদে কেউ শোনেনি। ইশা অসহায় চোখে দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। এরা এতো আস্তে করে কি বলছে? ইশার সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে না তো বেয়াদবটা।

“হাউ লাকি শী ইজ।;

শ্রাবণের ন্যায় বলল নামিরা। শ্রাবণ পূর্বের ন্যায় ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসির রেখা টেনে রাখলো। ফের হাতে কফির মগটা তুলে এগিয়ে গেলো ইশার কাছে। ইশা তটস্থ হয়ে রইলো। কোনো নড়াচড়া নেই তার। যেন নড়লেও শ্রাবণ ধরে ফেলবে তার করা পাগলামি গুলো। নিজেকে এখন চোর চোর অনুভূতি হচ্ছে ইশার।

“এমন উশখুশ করছিস কেন? কি হয়েছে?;

কফিটা এগিয়ে দিলো ইশার পানে। ইশা অন্যমনস্ক হয়ে উশখুশ করছে। যেটা চোখে পড়তেই বলে উঠলো শ্রাবণ। ইশা চকিতে তাকালো শ্রাবণের পানে। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো,

“কই, কিছুনা তো!;

এই বলে কফিটা নিতে গেলেই কফিটা সরিয়ে নিলো শ্রাবণ। সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেই বলল,

“কি? কি লুকাচ্ছিস?;

ইশা পড়লো ফান্দে। কি বলবে এখন? কি লুকাচ্ছে ও?

“ক্ কফি খাবো।;

শ্রাবণ বেশি ঘাটালো না ইশাকে। কফিটা দিয়ে এপাশে এসে বসলো। ইশার একবার ইচ্ছে করলো নামিরার মাথায় বারি দিয়ে ওকে অজ্ঞান করে দিতে। ফাজিলটার জন্য মসিবতে পরতে পরতে বেঁচে গেলো।

কফি আর ভুট্টা ভাজা খেতে খেতে আড্ডা জমলো জমজমাট। আড্ডার মাঝেই চোখাচোখি হচ্ছিলো চারজন প্রেমিক জুগলের। চোরা নজর, আর লজ্জা মিশ্রিত হাসি সর্বক্ষণই লুকিয়ে যাচ্ছে ইশা আর নামিরা। ওদিকে তিতিরও রয়েছে ওদের মাঝে। যদিও তার জুগল তার কাছে নেই, তবে দূরেও নেই। অফিসে বসে সারাক্ষণই চ্যাটিং চলছে দু’জনের। এতে তিতির যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, তার মোটেও নিজেকে একা বলে মনে হয়না। মনে হয় এই তো মানুষটা সঙ্গে রয়েছে।

______

রাতে বেশ দেরী করে বাসায় ফিরলেন শমসের সাহেব এবং সাদ্দাত সাহেব। আজকে নিলাশাকে দেখতে গিয়েছিলেন অফিস শেষে। সাদ্দাত সাহেবকেও সঙ্গে নিয়ে গেছেন শমসের সাহেব। মেয়েটা নিতান্তই ভদ্র-সভ্য ও শান্ত। তাদের পরিবার যেমন ঠিক তেমনই নিলাশাদের পরিবারও। চাঁদের টুকরো পছন্দ করেছেন তিনি ছেলের জন্য। ছেলেটা খুব সুখে থাকবে।

ঘরে ঢুকতেই রোজকারের মতো চেঞ্জ করার জন্য তার জামাকাপড় বের করে রাখলেন আফিয়া বেগম। শমসের সাহেব তাড়া দিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বললেন,

“বাবা কি ঘুমিয়েছেন?;

জবাব দিলেন আফিয়া বেগম,

“না। ব্যবসায়িক আলোচনা জুড়েছে নাতিদের সাথে। ঘুমোবে বলল।;

“বেশ বেশ। তুমি বরং সবার জন্য কফি করো। নিলাশার ব্যাপারে তোমার পুত্রকে এখনি জানিয়ে রাখি। পরে ওর জন্য যেন সবটা ইজি হয়।;

ওয়াশরুমের দরজা লক করার শব্দ হলো। বিরক্তি এবং টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছি আফিয়া বেগমের। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, তার ছেলে অন্য কোনো মেয়ের নাম শুনলেই অদ্ভুত ভাবে রিয়াক্ট করবে। কারন ও তো ইশাকে ভালোবাসে।

বাবার ঘরে উপস্থিত হলেন শমসের সাহেব। ততক্ষণে অফিসের কল পেয়ে চলে গেছে শ্রাবণ। চলে গেছে আরবও। খান সাহেব টিভি ছেড়েছেন। দেশের খবরটা দেখে ঘুমোতে যাওয়ার ইচ্ছে। আনোয়ারা বেগম স্বামীর সঙ্গে টুকটাক কথা বলার মাঝে পান চিবোচ্ছেন।

“বাবা আসবো?;

“এসো এসো। কি ব্যাপার এতো রাতে? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?;

শমসের সাহেব ভেতরে আসলেন। খান সাহেব বসতে ইশারা করলেন। শমসের সাহেব বসে মাকে একবার দেখলেন। অতঃপর আশেপাশে দেখে বললেন,

“আপনার নাতিরা চলে গেছে?;

“হ্যাঁ চলে গেলো তো। শ্রাবণের কল এলো আর আরবের পড়া বাকি। এই বলে সবাই গেলো।;

“যাক। বাবা বলছিলাম যে আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।;

“হ্যাঁ হ্যাঁ বলো।;

ঠিক তখনই আফিয়া বেগম কফি নিয়ে প্রবেশ করলেন রুমে। স্বামীকে আর শশুরকে কফি দিয়ে তিনি চলে যেতে চাইলে শমসের সাহেব তাকে আটকান। ছেলের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবেন সেখানে ছেলের মা না থাকলে কি হয়?

“তুমিও বসোনা।;

আফিয়া বেগম কোনোরূপ দ্বিমত না করে বসে পরলেন। কফিতে চুমুক বসালেন শমসের সাহেব। কয়েক লহমা বিলম্ব করে অতঃপর শুরু করলেন কথা,

“বাবা আজ নিলাশাকে দেখে এলাম একদম বাসায় গিয়ে। খুবই লক্ষিমন্ত আর আদুরে একটা মেয়ে। তার আচার-আচরণ এতো সুন্দর যে বলে প্রকাশ করতে পারবোনা। সাদ্দাতকে সঙ্গে নিয়েছিলাম। ওরও ভীষণ পছন্দ হয়েছে ওকে। আঙ্কেলের সাথেও কথা বললাম। আঙ্কেল মানে আপনার বন্ধু খোরশেদ সাহেব। তিনি বললেন একদিন সবাই মিলে তার নাতনিকে দেখতে যেতে। সবাই বসে আলোচনা করতে। ছেলে-মেয়েদের একে অপরকে পছন্দ হলে তিনি অতি জলদি নাতনিকে তুলে দিবেন।;

“বেশ বেশ। তাহলে সবাই মিলে পাত্রী দেখতে কবে যাবে দিনক্ষণ ঠিক করো।;

“হ্যাঁ বাবা। এই ব্যাপারেই কথা বলতে এলাম। এই শুক্রবার হলে কেমন হয়?;

“বেশ ভালো হয়। তাহলে শুক্রবারেই ডেট ফাইনাল, ঠিকাছে তো।;

“জি বাবা। একদম ঠিকাছে।;

___________

রাতের আকাশটা বড় থমথমে আজ। মেঘলা হয়ে আছে। মেঘেদের আড়ালে লুকিয়ে পরেছে বিশাল চাঁদ খানা। ঘরের জানালা দেখে চাঁদটা একবার চোখে পড়লেও আর দেখতে পেলোনা ইশা। তার এখন চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করছে। নামিরা ওর পাশে শুয়ে শুয়ে গান শুনছিলো। যেটা ইশার সহ্য হলোনা। নামিরার আলসেমি শরীরে চিমটি কেটে দিলো। চিমটি খেয়ে আঁতকে উঠলো নামিরা। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে বলল,

“কি, কি হলো?;

“আমাকে ছাদে নিয়ে চল।;

নামিরা যেন আঁতকে উঠলো। সতর্ক চোখে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,

“ক্ষেপেছিস? এখন বাজে রাত ২টা। এখন তুই এই শরীরে ছাদে যাবি।;

“২টা হোক আর ৪টা। আমার এখন চাঁদ মামাকে দেখতে হবে। নয়তো এনজাইটি হচ্ছে।;

“তুই তো আমাকে মে*রে ফেলার প্ল্যান করছিস ইশু। বাইরে তাকা। শীতের ঠান্ডা বাতাস, তারউপর মেঘলা আকাশ!;

“তুই আমাকে নিয়ে যাবি কি না বল। নয়তো আমি একাই যাচ্ছি!;

এই বলে তাড়াহুড়ো করে শরীর থেকে কম্বল সরাতেই আঁতকে উঠে ইশার হাত চেপে ধরলো নামিরা। গলায় একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে কপাল চাপড়ে বলল,

“যাচ্ছি মা, এতো অস্থির হোস না। তার আগে তুই একটা কাজ কর!;

ইশা প্রশ্নবিদ্ধ মুখে তাকালো। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কি কাজ?;

“দাঁড়া।;

“পারবোনা।;

“আরে ওয়েট।;

অস্থির চিত্তে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো নামিরা। ইশার পড়ার টেবিল থেকে একটা খাতা আর কলম নিয়ে এলো।

“ধর, এখানে সুন্দর করে লিখে দে, এই রাত ২টা বাজে তুই ছাদে যাওয়ার জন্য জেদ ধরেছিস। আর এর জন্য শ্রাবণ ভাই যদি কাউকে মা*র্ডা*র করে এর সব দায় কেবল তোর। নে নে, ধর।;

ইশা প্রথমে উৎসাহিত থাকলেও শ্রাবণের নাম শুনতে তার হাসি হাসি মুখের বিলুপ্ত ঘটলো। শ্রাবণ যদি ভুল ক্রমেও তাকে এতো রাতে ছাদে উঠতে দেখে, নিশ্চয়ই বকবে। মা/রতেও পারে।

“নে ধর। লিখে দে সুন্দর করে।;

ইশা চুপসে যাওয়া মুখে তাকিয়ে রইলো নামিরার পানে। নামিরা বাঁকা হাসলো। পরক্ষণেই বলল,

“তোমার হিরো যে পরিমাণ তারকাটা, আমি জানিনা সে এর শা/স্তি হিসেবে আমাদের মে*রেও ফেলতে পারে।;

নামিরার কথায় যুক্তি একশভাগ প্রমানিত। ঐ গম্ভীর মানুষটা সব করতে পারে।

“প্লিজ এমন করিসনা আমার সাথে! আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে যাবো আর লুকিয়ে লুকিয়ে চলে আসবো।;

“ইশুরে, তুই কিন্তু আমাকে তোর বাসাতেও থাকতে দিবিনা বলে দিলাম।;

“প্লিজ নামু। প্লিজ?;

ইশা ভং ধরলো বাচ্চাদের মতো করে। চোখ দুটো ছোট ছোট করে অসহায় মুখে বলল কথাটা। নামিরার বড্ড মায়া হলো ওর এই মুখ দেখে। কিন্তু মাঝেমাঝে সব মায়ার বাটন কাজ করতে নেই। সে কথা ভুলে গেলো নামিরা। মায়া করে ইশাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। তারপর সবার চোখের আড়ালে চোরের মতো ছাদে নিয়ে এলো ইশাকে। ছাদে উঠতেই হাড় কাঁপিয়ে উঠলো ঠান্ডা বাতাসে। ইশা নামিরার হাত খামচে ধরে অসহায় গলায় বলল,

“এতো ঠান্ডা কেন রে?;

ইশার পরনে কেবল একটা টি-শার্ট আর প্লাজু। সব দিক থেকেই ঠান্ডা লাগছে শরীরে। ওড়নাটা নিয়ে এলে জড়িয়ে থাকা যেত। এখন যে সেই উপায়ও নেই।

“একদম ঠিক হয়েছে। আগেই বলেছিলাম।;

নামিরার কথার প্রতিত্তোরে ভাব নিলো ইশা। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বলল,

“আরে না। ওটা তো মজা করছিলাম তোর সাথে। একদম ঠান্ডা লাগছেনা।;

একথা বলতেও ইশার কাঁপুনি এলো দু-তিনবার। যা দেখে হেসে পরলো নামিরা। বলল,

“এখানটায় দাঁড়া। আমি একটা চাদর নিয়ে আসি। জড়িয়ে বসিস।;

ইশা তুমুল গতিতে মাথা নাড়লো। অর্থাৎ যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে আয়। নয়তো এই ঠান্ডা আমাকে ম*র*ন দুয়ারে পাঠিয়ে দিবে। নামিরা দৌড় লাগালো। ইশা আশেপাশে দেখতে দেখতে বড় করে নিঃশ্বাস নিলো। সামনের দিকে খুড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে দু’হাতের সাহায্যে দু’হাতের বাহু ডলতে লাগলো। ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগতেই আবারও কেঁপে কেঁপে উঠছে।

হাঁটতে হাঁটতে রেলিঙের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো ইশা। দু’হাতে নিজেকে আলিঙ্গন করে রেখে দূর আকাশে দৃষ্টি রাখলো। কালো মেঘে গোটা আকাশটা সুরমা রঙে ছেয়ে গেছে। মেঘ ছুটছে ঘোড়ার গতিতে। ছুটতে ছুটতে চাঁদ মামাকে বারবার প্রকাশ্যে ভাসিয়ে তুলছে। সেদিকেই ইশার স্থির দৃষ্টি। এমতবস্থায় কানের পাশে টুং করে একটা শব্দ ভেসে উঠলো। ইশার মুগ্ধ দৃষ্টি সরে গেলো খোলা আসমান থেকে। নামিরা এসেছে হয়তো। চাদরের আশায় চটজলদি পেছন মুড়ে তাকাতেই সহসা ভড়কে গেলো। রাগি গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে শ্রাবণ। আতংকে চোখ জোড়া ডিম্বাকৃতির ন্যায় হয়ে উঠলো ইশার। পরক্ষণেই ঢোক গিললো। শ্রাবণ দাঁতে দাঁত চাপলো। কঠিন লাল তার মুখশ্রী। আঙ্গুল উঁচালো। কিছু বলবে সে, পরক্ষণেই ইশার ওড়না ব্যতীত কায়ায় চোখ যেতেই চোখ নামিয়ে নিলো সে। স্বভাব সুলভ গলা খাঁকারি দিয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। ইশা পুরো প্রস্তুত ছিলো শ্রাবণের রাম ধমক খাওয়ার জন্য। তবে শ্রাবণের হঠাৎ চুপ হয়ে অন্যদিকে তাকানো ভঙ্গিমা তাকে ভাবাতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে নিজের দিকে তাকাতেই মাথায় যেন ছোটখাটো একটা ঠাডা পরলো। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়ে যত দ্রুত পারলো উল্টো ঘুরে গেলো। ভয়ে লজ্জায় চুপসে গেলো ভেতরে ভেতরে।

“এতো রাতে ছাদে কেন এসেছিস? ভুলে গেছিস তোর শরীর ঠিক নেই? সোজা হয়ে দাঁড়াতে অব্দি পারছিস না!;

দাঁতে দাঁত চেপে চাপা ক্ষো*ভে ফেটে পরলো শ্রাবণ। ইশা আঁতকে উঠে পূণরায় চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলো। কি বলবে এখন এর প্রতিত্তোরে? কোনো জবাব যে নেই ওর কাছে।

“কি হলো, এখন মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না কেন?;

ধমকে উঠলো শ্রাবণ। ইশা চমকে উঠে দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো রেলিঙ। এতক্ষণ কিছু মনে না হলেও শ্রাবণের ভ-য়ে এখন মাথা ঘেরাচ্ছে ওর। ভনভন করে ঘুরছে।

ইশার কোনরূপ জবাব না পেয়ে আরও ক্ষেপে গেলো শ্রাবণ। এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে ইশার হাত চেপে ধরলো শক্ত করে। ইশার পরনের টি-শার্টের হাতা কাঁধ থেকে সামান্যই নীচে। যার দরুণ বাকি খোলা হাত টুকু ঠান্ডা বাতাসে বরফ হয়ে উঠেছে পূর্বেই। শ্রাবণ গলার স্বর মুহুর্তেই পাল্টে গেলো। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

“ঠান্ডায় তো পুরো জমে গেছিস আহাম্মক! হুঁশ জ্ঞান নেই নাকি?;

শ্রাবণের উষ্ণ হাত ইশার বাহু স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠলো ইশা। শ্রাবণ কিছু না ভেবেই ইশাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। ধমক দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে জাগলেও ইশার নাজুক মুখ খানা তাকে নরম হতে বাধ্য করলো। গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠান্ডা গলায় বলল,

“ওড়না কই তোর?;

ইশা বোবা চোখে তাকালো শ্রাবণের পানে। পরক্ষণেই নিজের দিকে একবার তাকিয়ে আড়াল হতে চাইলো। কিন্তু শ্রাবণ তাকে শক্ত করে ধরে রাখে। ফলে আর উল্টো ফিরতে পারেনা ইশা। লজ্জায় ভেতরে ভেতরে ম/রে যাচ্ছে সে।

“এটলিস্ট গরম কাপড় তো নিয়ে আসবি! ইডিয়ট একটা।;

চাপা স্বরে ধমক খেলো ইশা। ভয়, লজ্জা, সংকোচে গলায় জড়তা পেঁচিয়ে গেছে তার। শ্রাবণের কোনো কথাতেই কোনো জবাব নেই মুখে।

“ভাইয়া, আপনি!;

পেছন থেকে নামিরার গলায় ভেসে এলো। নামিরার গলা পেয়ে ইশা আর শ্রাবণ দু’জনে একসাথেই পেছন মুড়ে তাকালো। নামিরা শুঁকনো গলায় ঢোক গিললো। কথায় আছেনা, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়?

“জি আমি। এসে আপনাদের অসুবিধায় ফেলে দিয়েছি মনে হচ্ছে!;

নামিরা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,

“আ্ আমি কিছু করিনি ভাইয়া। আপনার ইশুপাখি.. ন্ না মানে ইশা জ্ জোর করলো!;

শ্রাবণ দানবীয় চাহনি দিলো ইশার পানে। অর্থাৎ আজকে ওর জীবন শেষ। একদম ফিনিশড। নামিরার হাতে চাদর দেখে শ্রাবণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

“যাক কারোর তো এটলিস্ট কমন সেন্স আছে। (নামিরার দিকে তাকিয়ে) চাদরটা কি এই মহারানীর জন্য?;

“হ্ হ্যাঁ ভাইয়া।;

চাদরটা শ্রাবণের হাতে কোনোরকম তুলে দিয়ে এক দৌড়ে পালালো নামিরা। ইশা ওর দৌড়ে পালানোর দিকে এতিমের মতো চেয়ে আছে। ওর এই মহুর্তে দাঁড়িয়ে একটা গান গাইতে বড্ড ইচ্ছে করছে, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে!;

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______২৩.

দৌড়ে সিঁড়ি থেকে নামতেই এক জোড়া হাত বাহুডোরে পেঁচিয়ে নিলো নামিরাকে। ছাদ,সিঁড়ি এবং ইশার রুম এই পুরো এরিয়াটা অন্ধকার এবং নিস্তব্ধতায় নিমজ্জিত হয়ে আছে। অবশ্য এই আহাম্মক মার্কা বুদ্ধিটা তার মগজ থেকেই নিসৃত হয়েছিলো। যার ফল এখন সে ভোগ করবে বলে মনে হচ্ছে।

ঘটনার আকস্মিকতায় নামিরার মনে ভয়াবহ আতংক সৃষ্টি হলো। যার দরুণ হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে নামিরা গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠতে নিলো সাহায্যের আশায়। এতো রাতে, এভাবে করে কোনো মানুষ তাকে ধরতে পারেনা! এ নিশ্চিয়ই কোনো অতৃপ্ত আত্মার কাজ, যে কিনা তার অতৃপ্ত বাসনাকে তৃপ্ত করতে এসেছে।

“শশশ, ডোন্ট শাউট!;

নামিরার মুখে কেউ শক্ত করে হাত চেপে রেখেছে। নামিরা নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা। বড়বড় চোখে সামনে থাকা ব্যক্তিটির পানে তাকালো। না এ কোনো অতৃপ্ত বাসনা বহনকারী আত্মা নয়! এ স্বয়ং তার প্রেমিক পুরুষ।

নিঃশ্বাস নিতে না পারলেও মুখে বলতে পারলোনা নামিরা। হাতপা ছোড়াছুড়ি করে মুখ থেকে আরবের হাতটা সরিয়ে তেতে উঠে বলল,

“আপনি কি মানুষ?;

“চিৎকার করলে এখনই ম/রে ভূত হয়ে যেতাম। সরি!;

বলতে বলতে কানে হাত নিলো আরব। নামিরা বড় বড় দম ফেলতে ফেলতে বলল,

“হয়েছে হয়েছে। আপনি এখানে কি করছেন? এতো রাত হলো এখনও ঘুমোচ্ছেন না কেন?;

“তোমাকে এক পলক না দেখে ম*রেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই এপাশ-ওপাশ করে উঠে এলাম।;

বলতে বলতে আলতো স্পর্শে নমািরার কোমরে হাত রাখলো আরব। নামিরা কেঁপে উঠে আরবের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,

“কেউ দেখে ফেলবে!;

ধাক্কা খেলেও আরবকে নড়াতে পারলোনা নামিরা। আরব বাঁকা হেসে আরও শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরলো নামিরাকে। আরেকটু কাছে এলো সে নামিরার। এতোটা কাছে যে দু’জনের নিঃশ্বাস দু’জনের উপরই ভারী হতে লাগলো।

“মিস করছিলাম!;

নামিরা এতক্ষণ ছোটাছুটি করতে চাইলেও আরবের গভীর ছোঁয়া তাকে নাজুক করে তুললো। চেয়েও ধমকের সহিত কিংবা রাগী গলায় কিছু বলতে পারলোনা।

“এতো মিস করতে হবেনা!;

“কেন হবেনা? বেশি বেশি মিস করতে হবে ম্যাডাম।;

“ইশশ, ঢং।;

_________

“ভালো করে জড়িয়ে নে!;

আদেশের সহিত বলল শ্রাবন। ইশা চাদরটা শরীরে আধাআধি পেঁচিয়ে আঁড়চোখে শ্রাবণের দিকে তাকালো। শ্রাবণ শক্ত চোয়ালে তাকিয়ে থেকে খেঁকি গলায় বলল,

“একটা চাদরও যদি ঠিক ভাবে পরতে পারিস। আশ্চর্য!;

ইশার কপাল মুখ কুঁচকে গেলো। কুঁচকানো কপাল নিয়েই বলে উঠলো সে,

“না পরতে পারার কি আছে? আমার অসুবিধা হচ্ছে না। তাই এভাবে নিলাম।;

“অনুভূতি শক্তিও আছে নাকি তোর? গ্রেট!;

বলেই জোরপূর্বক চাদরটা দিয়ে ইশার পুরো শরীর জড়িয়ে দিলো। ইশা কতক্ষণ হতভম্বের ন্যায় চেয়ে থেকে আনমনে হাসলো। কিন্তু শ্রাবণ এখনও বেশ সিরিয়াস হয়ে আছে। গম্ভীর মুখশ্রী ইশাকে বারবার ঠেলছে তার পানে। গাল টেনে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, ‘বাবু,এতো ক্ষেপে আছো কেন?’

পরক্ষণেই নিজের দুঃসাহসের বলি চড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মিনিট পাঁচেক এভাবেই ব্যয় হয়ে গেলো। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। ইশা উশখুশ করছে। শ্রাবণ ওর গা ঘেঁসে রেলিঙে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণের কাঁধ এসে ঠেকেছে ইশার কপাল বরাবর।

“প্রকৃতি দর্শন হলে এবার রুমে যাই?;

“হয়নি এখনও।;

শ্রাবণের শাসনী গলা ঢাকা পরলো ইশার বাচ্চা সুলভ কন্ঠের কাছে। শ্রাবণ বির*ক্তি ভরা দৃষ্টিতে তাকালো। বলল,

“তোর শরীর জমে যাচ্ছে ঠান্ডায়।;

ইশা গোলগাল চোখ পাকিয়ে তাকালো শ্রাবণের দিকে। হাত দুটো বাড়িয়ে দিলো শ্রাবণের পানে। অতঃপর মৃদু আওয়াজ ভেঙে বলল,

“ঠান্ডা হয়নি। ছুঁয়ে দেখতে পারো।;

ঠান্ডা বাতাসে চোখ জ্বলছে ইশার। ফলে চোখের কোনে জল জমেছে। কিন্তু তারপরও এই মেয়ের কোনো হেলদোল নেই। ইচ্ছে করছে রাম ধমক দিতে। তবে নেহাতই ওর অসুস্থতার জন্য পার পেয়ে যাচ্ছে।

“দেখোনা ছুঁয়ে।;

আবদার করা গলা ইশার। শ্রাবণ বিনা বাক্যে ইশার হাত দু’টো ধরে ক্ষীণ স্বরে বলল,

“হ্যাঁ, একদম ঠান্ডা নয়। তারপরও, এখানে আর থাকা চলবেনা।;

“প্লিজ আর পাঁচ মিনিট।;

“নো মোর ওয়ান সেকেন্ড। গট ইট?;

ইশা চুপ হয়ে গেলো। তর্ক করলে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবেনা। উল্টে মা*র খেয়ে চ্যাপ্টা হতে হবে। সুতরাং এই প্ল্যান বাদ।

শ্রাবণ কিছুটা শান্ত হলো। ইশার হাত ছেড়ে পাশে এসে ওর কাঁধ জড়িয়ে নিলো নিজের বাহুডোরে। ইশা একদম মিইয়ে রয়েছে। একটা টু শব্দ তার মুখ থেকে আসছেনা। শ্রাবণ পা বাড়ায় সামনে। ইশাও পায়ে পা ফেলে শ্রাবণের। গুণেগুণে হাঁটছে তারা। শ্রাবণ বারবার ইশার পায়ের দিকে লক্ষ করছে। ইশা ঠিকঠাক ভাবে হাঁটতে পারেনা এখনও।

“সাবধানে!;

নিজের হাতে শক্ত করে আগলে রেখেও ভরসা পাচ্ছেনা শ্রাবণ। ইশা মনেমনে হাসলো শ্রাবণের অসন্তোষ মনের কথাতে। ইশাকে হাসতে দেখে গলা খাঁকারি দেয় শ্রাবণ। খানিক গম্ভীর স্বরে বলে,

“হাসার মতো কিছু বলিনি!;

“সেকি, এখন হাসতেও পারবোনা নাকি?;

“না, পারবিনা।;

“এ কিন্তু ভারী অন্যায় শ্রাবণ ভাই!;

কথাটা বলেই শ্রাবণের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো ইশা। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে পরলো। অপ্রসন্ন গলায় শুধালো,

“কি সমস্যা তোর? রাতটা কি এখানেই পার করবি!;

” না। আগে আমার কথা শোনো।;

“কি কথা?;

“ভালোবাসো আমায়?;

মাথার উপরে একটা তারা জ্বলে উঠলো। সেই সাথে শ্রাবণের ভেতরটায়ও ছ্যাঁত করে পুড়ে গেলো। তার গম্ভীর মুখশ্রী এখন অবাকের সর্বোচ্চ সীমায় গিয়ে ঠেকেছে। বড় নেত্রজুগলে এক অবিশ্বাস্য চাহনি। সবটাই ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে ইশা পূণরায় বলে উঠলো,

“বাসোনা?;

“না বাসিনা!;

ইশা প্রশ্ন করে ফিরতে পারলোনা, সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবণের জবাব। ইশার দুষ্টুমি ভরা হাসিটা উধাও হয়ে গেলো। শ্রাবণ অবাক হলেও সে হলো আহত। আহত নেত্রজুগল জ্বলে উঠলো।

“ম্ মানে?;

“মানে পরিষ্কার। শুনিস নি?;

“ন্ না..;

“ও শুনিস নি? তাহলে আবার শোন?;

ইশা হোঁচট খেলো। ওর বুকের ভেতর কেউ ক্রমাগত ছুরিঘা-ত করে গেলো মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে।

“ভালোবাসি না! এবার চল রুমে? অনেক কাহিনী করেছিস!;

এই বলে শ্রাবণ ইশার পানে এগিয়ে আসতে নিলেই তাকে হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয় ইশা। নত মস্তিষ্ক ওর। কাঁদছে কি? শ্রাবণের বুকের ভেতর খামচে ধরলো কেউ। প্রশ্নটা নিজের মনে উৎপত্তি ঘটতেই চমকে গেলো সে। ইশা কাঁদবে কেন?

“ইশা, কাঁদছিস?;

ইশা দেখাবেনা ওর চোখের জল। মুখ লুকাতে হাতের সাহায্য নিজের মুখ আড়াল করে কোনো রকমে বলল,

“আমি রুমে যাচ্ছি!;

এই বলে অস্থির চিত্তে হাঁটা ধরতেই পা জোড়া ঘোষণা করলো অবস বলে। অমনি কেঁপে উঠলো পায়ের তলা। পরে যেতে লাগলো নীচের দিকে। শ্রাবণ ছুটে এসে ধরলো ওকে। ধমকের সুরে চেঁচিয়ে উঠল,

“পাগল হয়ে গেছিস নাকি? এক্ষনি পরে যেতি!;

“আ্ আমি ঠিকাছি!;

কান্না চাপা গলায় জবাব এলো ইশার। রাগে শ্রাবণের কপালের রগ ফুলে উঠলো। ইশাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে ছেড়ে দিলেও ওর কথা শুনে পূণরায় চেপে ধরলো ওর বাহুদ্বয়। রাগান্বিত গলায় বলল,

“সমস্যা কি? বল?;

“ছাড়ো!;

“আমার প্রশ্নের জবাব দে আগে?;

“ছাড়ো, আমার লাগছে!;

গাল ভিজে উঠলো ইশার। ইশার চোখের জল গড়াতে গড়াতে শ্রাবণের রাগ আরও তীব্র হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“আমি ধরলেই লাগে তোর?;

“তুমি তো আমাকে ভালোবাসানা, তাহলে কিসের অধিকারে এতো অধিকার ফলাও আমার উপর?;

ভেতর থেকে সজোরে কেউ ধাক্কা দিলো শ্রাবণকে। বোবা চোখে তাকিয়ে রইলো ইশার পানে।

“ভালোবাসিনা! হ্যাঁ, ভালোবাসিনা। ভালোবাসিনা আমি তোকে!;

শেষোক্ত কথাটা বেশ জোরেশোরে গর্জে ওঠা গলায় বলল শ্রাবণ। ইশা কেঁপে উঠলো। এতদিন যে বলতো খুব ভালোবাসে তাকে? তাহলে আজ কি হলো!

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ইশা। শ্রাবণ চলে গেছে হন্তদন্ত হয়ে। একটু পর নামিরা এসে হাজির হয়েছে। ইশাকে এভাবে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখে মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো নামিরার। ছুটে গেলো।

“ইশু, এই ইশু কি হয়েছে? শ্রাবণ ভাই কি বেশি বকাবকি করেছে?;

“নামু আমাকে রুমে নিয়ে চল প্লিজ।;

“হ্.. হ্যাঁ যাচ্ছি। চল। হাত ধর..;

কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে নামিরাকে ধরলো ইশা। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা আর।

___________

চারদিন পর। এই চারিদন সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটলো শ্রাবণের। বিসিএস এর পরীক্ষা ছিলো গতকাল। যেটার দীর্ঘ প্রতীক্ষা ছিলো শ্রাবণের। অবশেষে ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নটা পূরণ হওয়ার সময় এসে গেছে তার।

আজ শুক্রবার। নীলাশাকে দেখতে যাওয়ার কথা আজ। বাবার সাথে কথা বলে পাঁচদিন আগেই খোরশেদ সাহেবকে তার নাতনিকে দেখতে যাওয়ার কথা পাকাপাকি করেছিলেন শমসের সাহেব। সকাল থেকেই তিনি ভীষণ প্রফুল্ল মনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সবাইকে তৈরি হতে তাড়া দিচ্ছেন। কাউকে কাউকে কাজে সাহায্য করছেন। যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব কাজ শেষ করে সবাই মিলে ছেলের হবু বউকে দেখতে যেতে পারে।

শ্রাবণ বাড়িতে নেই। কাল রাতে একটা ইমারজেন্সি কল পেয়ে তাকে ধানমন্ডি যেতে হয়েছে। বাসায় কখন ফিরবে সে কথা কাউকেই জানায়নি। তাই কারোর ভরসা না করে শমসের সাহেব নিজেই কল দিলেন শ্রাবনকে।

“বাসায় কখন ফিরবে?;

“এখনই ফিরতে চেয়েছিলাম। তবে পারবোনা বলে মনে হচ্ছে।;

ওপাশ থেকে গাড়ির শব্দ পাচ্ছেন শমসের সাহেব। এক কান চেপে ছেলের শোনার সুবিধার্থে উচ্চস্বরে বললেন,

“১১টার মধ্যে বাসায় আসতে হবে। এমারজেন্সি আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে।;

“বাবা আমার বন্ধু আলিফকে চিনো না? ওর বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরেছেন। রাত থেকে উনাকে নিয়ে হসপিটালে ছোটাছুটি করছে সবাই! অবস্থা ক্রিটিকাল। এমন সিচুয়েশনে ওকে একা রেখে আমি কিভাবে আসি?;

“ওখানে তুমি ছাড়াও অনেক মানুষ থাকবে বাবা। তোমাকে এতো ভাবতে হবেনা। ১১টার মধ্যে তোমাকে বাসায় দেখতে চাই।;

কল কেটে দিলেন শমসের সাহেব। কারন তিনি জানেন এরপর শ্রাবণ একটা কথা বলবে, সে একটা বলবে! দরকার নেই এতো কথা বাড়ানোর। শুভ কাজে যাওয়ার আগে ছেলের মুডটা খারাপ করবেন না তিনি।

“কি গো, শুনছো?;

গলা উঁচিয়ে আফিয়া বেগমকে ডেকে উঠলেন শমসের সাহেব।

“সবাইকে জলদি জলদি তৈরি হতে বলো।;

বলতে বলতে নিজের রুমে চলে গেলেন শমসের সাহেব। আফিয়া বেগমের হাত থেকে কাঁচের গ্লাসটা পরে কয়েক টুকরো হলো। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন নুপুর বেগম।

“আপা, কি হলো তোমার?;

শ্রাবণের ব্যস্ততার জন্য তিনি এই বিষয়ে কোনো কথাই বলতে পারেননি ওকে! বড্ড অপরাধ বোধে ভুগছেন তিনি। যেটা ঘটতে চলেছে সেটা হলে কারোরই ভালো হবেনা। বরং তিন তিনটে জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।

“মা, ও মা?;

ইশা সুস্থ হয়ে গেছে মোটামুটি। হাঁটতে চলতে এখন আর তোমন অসুবিধা হয়না ওর। শুধু খাওয়াদাওয়াতেই একটু অসুবিধা রয়ে গেছে।আলমারি থেকে শাড়ি বের করছিলেন মরিয়ম বিবি। মেয়ের প্রশ্নে আলমারির দরজা ধরে বাইরে মুখ বের করে বললেন,

“কি হয়েছে?;

“আজকে সবাই মিলে কোথায় যাবো, বলোনা?;

“বলবো। আগে ড্রেস পরে তৈরি হয়ে নে। তারপর বলবো।;

“পরবো, তার আগে তোমাকে বলতে হবে আমরা আজ কোথায় যাচ্ছি?;

“গেলেই জানতে পারবি। রেডি হতে যা এবার।;

“আমাকে এখনই জানতে হবে মা। প্লিজ বলো;

“উফফ, বিরক্ত করিসনা।;

চলে গেলেন মরিয়ম বিবি। ইশা মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। ক’দিন ধরে বাসায় কারোর মতিগতি বোঝা মুসকিল হয়ে যাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। মাথার কাছ থেকে ফোনটা কুড়িয়ে সময়ে নজর বুলালো। ৯টা বাজে। বড় মামা বলেছে সবাইকে নিয়ে এগারোটার মধ্য বের হবে। মাঝে মাঝে খান বাড়িতে এরকম হুটহাট বেরোনোর ছোটখাটো প্ল্যান হয়েই থাকে। তবে প্রত্যেকবার ইশার মনটা বেশ প্রফুল্ল থাকলেও এবার কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না ওর। এর কারণ অবশ্যই শ্রাবণ। কাল তার সমস্ত ব্যস্ততার অন্ত হয়েছে। কিন্তু কোথায় কি, এতোদিন মহারাজকে দেখতে পেলেও কাল রাত থেকে একদমই লাপাত্তা সে।

ইশা বিছানারা উপর থেকে ড্রেসটা নিয়ে চলে গেলো ওয়াশরুমে। গোল্ডেন রঙের উপর পাথরের কাজ করা একটা জামা। সঙ্গে অফ হোয়াইট প্লাজু এবং গোল্ডেন রঙের ওড়না। ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে বের হলো ইশা। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চুল গুলো আঁচড়ে খোলাই রাখলো। মুখে সামান্য পাউডার আর লিপবাম দিয়ে, গলায় একটা লকেট পরে নিলো। জামার হাতা কব্জি অব্দি। চুরি পরলে উদ্ভট লাগবে ভেবে আর পরলোনা। কানে লকেটের সঙ্গে থাকা দুলটা পরে নিলো।

সবাই রেডি। বাবার আদেশ অমান্য করতে পারেনি শ্রাবণ। তাই ১১টার মধ্যে সেও এসে হাজির হলো। ১২টা বাজতেই খোরশেদ সাহেবদের বাসার উদ্দেশ্যে বের হলো সবাই। এখান থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। তাই আর গাড়ি নিলোনা। রিক্সা ডেকে দু’জন দু’জন করে উঠে পড়লো। রিক্সা গিয়ে থামলো খোরশেদ সাহেবের বড় বাড়িটার সামনে। খোরশেদ সাহেব, নিলাশার বাবা আতাউল সাহেব এবং তার মামারা রফিক, সফিক সাহেব আগে থেকে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের অপেক্ষায়।

খান সাহেব রিক্সা থেকে নামতেই জড়িয়ে ধরলেন খোরশেদ সাহেবকে। আতাউল সাহেব খান সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন। রফিক এবং সফিক সাহেবও তাই করলেন। ততক্ষণে পেছনে এসে সবাই এক এক করে দাঁড়ালো। খান সাহেব এক এক করে সবার পরিচয় করাতে নিলে স্বভাব সুলভ খোরশেদ সাহেব বকে উঠলেন খান সাহেবকে। সব কথা কি বাইরেই বলবে নাকি?

লজ্জা পেলেন খান সাহেব। চুপ হয়ে গেলেন তৎক্ষনাৎ। হাসতে হাসতে বললেন,

“ভুলেই গিয়েছিলাম।;

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে