ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-১৯+২০

0
336

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____১৯

পুরো ত্রিশ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করে এলেও ইশাদের রিক্সাটা খুঁজে পেলোনা তারা। শ্রাবণের অবস্থা করুন থেকে করুনতম হচ্ছে। তখন যদি রা*গ করে হলেও ইশাকে আঁটকে দিতো, তাহলে এই অপ্রকৃতিস্থ মুহুর্ত কখনোই তৈরি হতোনা। শ্রাবণের এটা ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হচ্ছে, তুর্জ ইশাকে নিজের সাথে নিয়ে গেলো অথচ ইশা বাঁধা দিলোনা? পরক্ষণেই তার মনে পড়লো, ইশার হাঁটাচলা কেমন অস্বাভাবিক ছিলো। মনে হচ্ছিলো বারবার ঢলে পড়ছে ও। সেই সুযোকেই কি তুর্জ ওকে ওভাবে করে জড়িয়ে রেখেছিলো? আর ভাবতে পারছেনা শ্রাবণ। তার পায়ের র*ক্ত ছিটকে মাথায় উঠে যাচ্ছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেবল তুর্জকে জানেপ্রানে শেষ করে দেওয়ার ক্ষোভ ভেসে উঠছে। তুর্জ এখনও আন্দাজও করতে পারেনি, কার উপর ওর শকুনের নজর দিয়েছে ও!

“ভাই, ঐ রিক্সাটাই তো ছিলো!;

তন্ময়ের বাইকটা হঠাৎ ব্রেক কসলো। সামনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলো কথাটা। কথাটা কানে প্রবেশ করা মাত্র বিকট আওয়াজে শ্রাবণও বাইক থামিয়ে দিলো। তার র*ক্ত চক্ষু জোড়া গিয়ে বিঁধে গেলো সেই রিক্সাটার উপর। হিং*স্র গলায় বাকিদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

“ধর ওকে!;

ওরা চারজন ছুটে গিয়ে চেপে ধরলো সেই রিক্সাওয়ালাকে। এদিকে নামিরা চটজলদি নেমে দাঁড়াতে শ্রাবণও ছোটে সেদিকে। তেড়ে গিয়ে রিক্সাওয়ালার কলার চেপে ধরে বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠে বলে,

“আমার ইশা কোথায়? তুর্জ ওকে কোথায় নিয়ে গেছে বল?;

শ্রাবণের আ*ক্র*ম*না*ত্মক আচরণের ভড়কে গেলো রিক্সাওয়ালা। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলো ক্ষণেই। কাঁপা কাঁপা হাতে হাত জোর করে বলতে লাগলো,

“স্যার, আ্ আমি কিছু করিনাই! আমারে মা*ইরেননা!;

শ্রাবণ যে নিজের হুঁশে নেই, তা তাকে দেখলেই বোঝা যায়। নামিরা ছুটে এসে দাঁড়ায় ওদের সামনে। শ্রাবণকে শান্ত হতে বলে ওদের চারজনকেও একটু ধৈর্য্য ধরতে বললো। এভাবে কথা বললে, রিক্সাওয়ালা এমনিতেও ওদের কথা বুঝবেনা। নামিরার কথায় সবাই একটু ধীরস্থির হতে চেষ্টা করলো। ওদের আর কথা বলতে না দিয়ে নামিরা ইশার একটা ছবি বের করে রিক্সাওয়ালা দেখিয়ে বলল,

“এক্ষনি কি এই মেয়েটাকে আপনি নিয়ে এসেছেন রিক্সায় করে?;

রিক্সা ওয়ালা ইশার ছবিটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। প্রথম দফায় চিনতে পারলোনা। তবে আন্দাজ করে বলল,

“হ আপা। লগে একটা পোলাও আছিলো!;

সবটা এবার জলের মতো পরিস্কার হয়ে গেলো ওদের কাছে। শ্রাবণ ধৈর্য্য হারা হয়ে উঠলো পূণরায়। রিক্সাওয়ালাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিলে রিক্সা ওয়ালা ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে পড়ে দু’পা। তা দেখে নামিরা আবারও শ্রাবকে শান্ত থাকার জন্য বলে, পূণরায় রিক্সাওয়ালার কাছে ইশার কথা জানতে চায়।

“আপনি কি বলতে পারবেন, ওরা এখান থেকে ঠিক কোনদিকে গেছে?;

রিক্সা ওয়ালা কাঁপা কাঁপা হাতটা নির্দেশ করে কোথাও। সবাই সেই নির্দেশিত হাতের পানে তাকাতেই যেন চমকে ওঠে আপাদমস্তক। সামনেই একটা কাজী অফিস। তুর্জ ইশাকে নিয়ে কাজী অফিসে কেন গেলো?

তারা আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না। হন্নে হ’য়ে ছুটে গেলো সেদিক পানে।

কাজীর মাথায় ব*ন্দু*ক ঠেকিয়ে ধরেছে একটা ছেলে। পাশে আরেকটা ছেলে তাকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। তুর্জ আর ইশা ঠিক তার সামনের চেয়ার দু’টোতে বসা। তাদের পেছনে আরও চার জন দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনের হাতে বর কনের মালা, দু’জনের হাতে মিষ্টির প্যাকেট। তুর্জ ঠোঁটের কোনে একটা পৈ*শাচিক হাসি একে ইশার পানে তাকালো। ইশা ঢুলছে ঘুমে। বারবার হাত পা নেড়ে কিছু বলার প্রয়াস করছে। তবে বরাবরের মতোই ফলাফল শূন্য। সে না নিজের হুঁশে ফিরতে পারছে, আর না পুরোপুরি ঘুমের রাজ্যে যেতে পারছে। তার সাথে ঘটতে থাকা প্রতিটা মুহুর্ত সে উপলব্ধি করতে পারলেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা কিংবা প্রতিক্রিয়া করা কোনোটাই সম্ভব হচ্ছে না তার জন্য।

“বউ, ও বউ? শুনতে পাচ্ছো?;

নাকি সুরে বউ বলে ইশাকে ডেকে এক বিশ্রী হাসি হাসলো তুর্জ। ইশা বারবার ঘোলাটে দৃষ্টিতে দেখছে তাকে। ইশা কিছু বলতে পারছেনা দেখে, তুর্জ আরও আনন্দ পাচ্ছে। খেলার আসল মজা তো এখানেই, দেখতে,শুনবে কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করতে পারবেনা।

“ফাইনালি আমাদের স্বপ্নটা পূরণ হতে চলেছে বউ। দেখো তাকিয়ে, আমরা আমাদের স্বপ্নের খুব কাছাকাছি। দেখোনা বউ।;

ইশার মুখ চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে আনলো তুর্জ। ইশা ব্যা*থায় অস্ফুট স্বরে আওয়াজ করলো। তাতে তুর্জর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নিজের আমোদে আরও মত্ত হয়ে ইশার হাতটা চেপে ধরে খাতার দিকে এগিয়ে নিলো সই করবে বলে। ইশা ভেতরে থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানালেও বাইরে থেকে কিছুই করতে পারছেনা। তুর্জ সেই বিশ্রী হাসি হেসে নিজের এক ভ*য়ানক অতীত ফাঁস করলো ইশার কাছে।

ইশার হাতটা খাতার উপর চেপে ধরে ইশার শরীরে একটা বিদঘুটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আস্তে করে বলে উঠলো,

“কংগ্রাচুলেশনস টু বি মাই সেকেন্ড ওয়াইফ মাই ড্রিম কুইন। ট্রাস্ট মি, তোমাকে দেখার পর আমি আর একদিনও আমার বউয়ের শরীর ছুঁয়ে দেখিনি। তোমাকে ছোঁয়ার তীব্র বাসনা নিয়ে প্রতিটা রাত কতটা কাতরে ম*রে*ছি তোমার কোনো ধারণাই নেই। আজ সেই সব বাসনা পূরণ হতে চলেছে। কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তোমাকে পেতে, তুমি তো জানোনা। এই বউ, বউ? আমাকে কংগ্রাচুলেট করবেনা হু? আহ্ থাক, একবারে বাসর রাতেই করো। ওকে?;

বলেই খিটখিটিয়ে হাসতে লাগলো তুর্জ। ইশার চোখ টলমল করছে। ক্লান্ত চাহনিতে একবার তাকায় তুর্জর পানে। পরক্ষণেই আবার নেতিয়ে পড়ে ক্লান্তির কাছে। তু্র্জ ওর হাতটা আবারও এগিয়ে নিয়ে যায় খাতার কাছে। একটা সই হলেই বিয়ে ফাইনাল। তখন আর কেউ চাইলেও ইশাকে ওর থেকে আলাদা করতে পারবেনা।

“সাইন করো বউ। এই এখানটায়।;

ইশার হাত চলেনা। ওকে হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে। যার দরুণ নিজের শরীরের ভার নিজের কাছেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

“আমিও একটা সাইন করে দেই?;

টেবিলের উপর দু’হাতে ভর দিয়ে দাঁড়ালো কেউ। কন্ঠটি বেশ পরিচিত। তুর্জ সন্দিহান চোখে পাশ ফিরে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। নিজের জমকে চোখের সামনে দেখে কেউ এতোটা ভয় পায়না, যতটা ভয় তুর্জর শ্রাবণকে দেখে হলো। তবে এই ভয় স্রেফ কয়েক ক্ষণের জন্যই ছিলো তার চোখে। পরক্ষণেই হিং-স্র দৃষ্টিতে তাকাতেই শ্রাবণ গর্জে উঠে এক লাথি দিলো তুর্জর চেয়ারে। লাথি খেয়ে ঝড়ের বেগে চেয়ার ভেঙে পড়ে গেলো তুর্জ। সঙ্গে সঙ্গে তুর্জর লোকগুলো তেড়ে এসে চেপে ধরলো শ্রাবণকে। কিন্তু তাকে আঁটকে রাখা এতো সহজ হলোনা। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে গা ঝাড়া দিতেই সবগুলো ছিটকে পড়লো খানিক দূরে। ততক্ষণে তুর্জ উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর চোখে মুখে এক হিং*স্র*তার ছাপ। এতদিনের লুকিয়ে রাখা হিং*স্র দানবটা যেন এখন মুক্তি পেলো।

“গায়ে ভালো জোর আছে! না না, আজ বুঝিনি। সেদিনই বুঝেছিলাম। আজ সুযোগ পেয়ে কমপ্লিমেন্ট দিলাম।;

তুর্জর গা জ্বলানো কথা শুনে চোয়াল শক্ত করে তাকালো শ্রাবণ। নামিরা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ইশাকে। নামিরার সাথে সাথে হৃদয়, রফিক, শাফিন আর তন্ময় এসে জড়ো হয়ে দাঁড়ালো শ্রাবণের পেছনে।

“ইশা, এই ইশা? তুই ঠিকাছিস? ইশার কি হয়েছে? আপনি কি করেছেন ওর সাথে?;

নামিরার হুং*কার দেওয়া গলা ভেসে এলো। তুর্জ নামিরার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

“তোমার বান্ধবী যা ত্যাড়া! অল্প কথায় কাজ হলে তো হতোই!;

বলে সামনের দিকে তাকাতেই এলোপাতাড়ি কয়েকটা ঘুষি পড়লো তুর্জর মুখে। তুর্জকে মা*র*তেই ওর সাঙ্গপাঙ্গরা আবারও উদ্যোত হলো শ্রাবণের কাছে তেড়ে আসতে। তবে এবার আর সফল হলোনা ওদের চারজনের জন্য। যে ছেলেটার হাতে পি*স্ত*ল ছিলো, ওরা চালাকি করে আগে সেটা বাজেয়াপ্ত করলো ওদের থেকে। এবং সফলও হলো। পি*স্ত*ল ওদের কাছে ট্রান্সফার হতে ছেলেগুলো দমে গেলো ভ-য়ে। তন্ময় বাঁকা হেসে বলল,

“সব গুলো মেঝেতে বস। নয়তো এক গুলিতে খুলি ঠুস!;

সবগুলো মেঝেতে বসে পড়লো। এদিকে শ্রাবণ যেন কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছেনা। তুর্জকে মা*র*তে মা*র*তে পায়ের তলায় ফেলে হিং*স্র গলায় বলে উঠলো,

“তোর প্রথম ভুল ছিলো ইশার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া, তোর দ্বিতীয় ভুল ছিলো ভালোবাসার নাম করে দিনের পর দিন এই নোংরা চোখ দিয়ে প্রতি মুহুর্তে নোংরা চিন্তাভাবনা করা, আর তোর তৃতীয় ভুল ছিলো ম্যারেড হওয়া স্বত্বেও তোর তীব্র লালসার কাছে হার মেনে ইশাকে বিয়ে করতে চাওয়া! এখানেই শেষ নয়, তবে এখান থেকেই তোর ভুলের শুরু। ইশাকে প্রতিনিয়ত মেন্টাল টর্চার করা, ওকে নিয়ে নোংরা চিন্তা রাখা, ওর গায়ে হাত তোলা আর আজ? আজ তো তোর ভুলের মাত্রাই রইলোনা! তোর সাহস আছে বলতে হবে.. কিন্তু সাহস টা সাহস অব্দি থাকলেই তো ভালো হতো। দুঃসাহস করতে কেন গেলি?;

তুর্জর নাক মুখ ফেটে র*ক্ত পড়ছে জোয়াল দিয়ে। শ্রাবণ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দৃষ্টিতে একবার তাকায় প্রায় অচেতন হয়ে থাকার ইশার মুখবিবরে। ইশার এই অবস্থা শুধু মাত্র তুর্জর জন্য। কথাটা ভাবতেই আবারও এক হিং**স্র দানব ভর করে শ্রাবণের শরীরে। শুরু হয় আবারও এলোপাতাড়ি মা*র। এতো মা*র সহ্য হলোনা তুর্জর। হা করে র*ক্ত বমি করতে করতে বেহুঁশ হয়ে গেলো। তখন গিয়ে শ্রাবণ ছেড়ে দিলো তুর্জকে।

এদিকে ইশার অবস্থাও করুন। হঠাৎ জ্ঞান হারালো সে। নামিরা চেঁচিয়ে উঠে শ্রাবণকে ডেকে উঠতেই, দৌড়ে যায় শ্রাবণ। দু’হাতে ইশাকে আগলে ধরতে গিয়ে উপলব্ধি করে, ইশার শরীরে র*ক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে সারা শরীর বরফের ন্যায় জমে গেছে। এক্ষনি হসপিটালে না নিলে ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারে।

হসপিটালের করিডোরে জয়েন ফ্যামিলির এক গাদা মানুষ ভীড় জমিয়েছে। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলো। সূর্য মামা পশ্চিমাকাশে ডুবুডুবু হয়ে আছে। প্রকৃতি শীতের আমেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। দূরে একটা অতিথি পাখি সুন্দর সুর তুলে ডাকছে। পাশাপাশি তিন সিটের একটা চেয়ারে ওরা তিনবোন মন খারাপ করে বসে আছে। ওদের থেকে একটু দূরে মরিয়ম বিবি আধা অচেতন হয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। তার যে ঐ একটা মাত্র মেয়ে। আজ কিছু হয়ে গেলে ম*রা*র পর তার স্বামীকে কি জবাব দেবে সে? কিভাবে তার মেয়েটাকে লালনপালন করেছে সে যে আজ এই দশা হলো? এর জবাব তখন কি দিয়ে দিবে সে? আনোয়ারা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। ভেজা গলায় বললেন,

“ধৈর্য্য ধর মা, আমার ইশার কিছু হবেনা। ধৈর্য্য ধর।;

বার্ধক্যে পৌঁছেও মানুষ চিনতে পারলেননা খান সাহেব। এই অপরাধবোধটাই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে। তার যে চামড়ার ভাজে ভাজে দক্ষতা। এতো দক্ষ হয়েও কি লাভ হলো? আজ তার নাতনির এই করুন অবস্থার জন্য যদি কেউ দায়ী হয় তাহলে সেটা একমাত্র সে। আর কেউ না।

সবার থেকে বেশ খানিক দূরত্বে বসে আছেন আফিয়া বেগম। তার পাশেই তার ছেলে। শ্রাবণ অন্যমনস্ক হয়ে দেয়ালে পিঠে ঠেকিয়ে বসে আছে। আফিয়া বেগম ছেলের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখে আছেন। আজ তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলেন, তার ইশাকে তার পাগল ছেলেটা কতটা ভালোবাসে। মাকে জড়িয়ে ধরে ইশার জন্য একটা ছোট্ট বাচ্চার মতো কেঁদেছে শ্রাবণ। শ্রাবণের কান্না সবাই দেখেছে! ছেলের কান্নার শব্দ, ছেলের আকুতি সবটা এখনও কানে ভাসছে তার।

ইশাকে কম পাওয়ারি বা অল্প স্বল্প ঘুমের ঔষধ দেয়নি তুর্জ। হাইডোজের বেশ কিছু ঘুমের ঔষধ দিয়েছে ওকে। মুলত একটা জুসের সাথেই তুর্জ তাকে এই ঔষধ গুলো গুলিয়ে দিয়েছিলো। যার ফলে যেকোনো মুহুর্তে ইশার মৃ-ত্যু-র রিস্ক অনেক বেশি বলে জানান ডাক্তাররা। কেউ সু-ই-সা-ইড এ-টে-ম্প করলেও এমন হাই পাওয়ারের ঔষধ খায়না। এই মুহুর্তে ওয়াশ করে সবটা বের না করলে ইশার মৃ*ত্যুু*ও নিশ্চিত হয়ে যাবে।

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব___২০.

হসপিটালের একটা ওয়াশরুম থেকে চোখেমুখে পানি দিয়ে বের হলো নামিরা। ইশার অবস্থায় সেও ভেঙে পড়েছে সবার মতো। তবে সবাইকে সামলানোর লোক থাকলেও নামিরাকে সামলানোর কেউ নেই এখানে। ছোট বেলার কথা আজ বড্ড বেশি মনে পরছে নামিরার। বরাবরই বড্ড নরম স্বভাবের মেয়ে ছিলো নামিরা। স্কুল-কলেজে বরাবরই অন্যের হুকুমে ওঠাবসা ছিলো ওর। যে যা বলতো ভীত মনে সবার কাজ করে দিতো। কখনো প্রতিবাদ করার সাহস টুকু অব্দি ছিলোনা। ওর কোনো বন্ধুও ছিলোনা। সবাই ওকে ছোট বড় করে কথা বলতো। ওর বাবা-মায়ের ছিলো ভাঙাচোরা সংসার ছিল। আজ দু’জন একসাথে আছেন তো, কাল কেউ কারো মুখ দেখছেনা৷ পরিবারের কলহ, বাইরের লোকের নিন্দে, ক্লাসমেইটদের হাতে র‍্যাগিং সব মিলিয়ে একরকম একাকিত্বে পড়ে গিয়েছিলো ও। নামিরার মনে পড়ে সেই দিনটির কথা, একটা মেয়ে ওর টিফিন নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে। ও প্রথমে দিতে চায়না। তাই মেয়েটা ওর গালে দু’টো চড় মে*রে ওর টিফিনটা ছিনিয়ে নেয়। নামিরা কাঁদতে কাঁদতে মুখ ঢাকে বেঞ্চে। কারন সে জানে, সে প্রতিবাদ করতে পারবেনা। আর সেদিন ওর সারাদিনের খাবার কেবল ঐ টিফিনটাই ছিলো। সব মিলিয়ে বিষন্ন মনে কাঁদতে বসে সে। তবে হঠাৎ ওর কান্না বন্ধ হয়ে যায় এক অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়ে। একটা মেয়ে ওর টিফিন কেঁড়ে নেওয়া মেয়েটাকে সজোরে কয়েকটা থাপ্পড় মা*রে এক গাদা স্টুডেন্টদের সামনে। সেই সাথে কড়া গলায় বেশ কয়েকটা হু*মকিও দেয়। ফের নামিরার টিফিনটা ওর থেকে কেঁড়ে নিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে টিফিনটা নামিরার হাতে দিয়ে চলে যায়।

ঐ মেয়েটাকে বলা কথা গুলো শোনেনি নামিরা। তবে একটু ঠিকই বুঝতে পারে, তার এই ছোট্ট জীবনে এর চেয়ে ভালো ঘটনা আর কিছুই হতে পারেনা। কেউ তার জন্য আরেকজনের সাথে লড়াই করবে এ কথা নামিরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেতো না।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কান্নারা পূণরায় দলা পাকিয়ে আসে নামিরার কন্ঠনালীতে। না পারছে গিলতে না পারছে ওগরাতে। সেই থেকে প্রতিটা বিপদে নামিরা সবসময় একটা মুখই দেখতো। যদিও এতো কিছুর পরও নামিরা ইশার বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারেনি। ইশার বেস্ট হতে নামিরাকে আরও অনেক কঠিন কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো। আর সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ ছিলো সবাইকে কড়া গলায় না’ বলা। মানুষের সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো, তারা সহজে না বলতে পারেনা। দেখবেন, আপনি যদি খুব সহজেই লোককে না’ বলতে পারেন, তবে আপনার অর্ধেক সমস্যাই জল হয়ে ভেসে যাবে। আমরা ভাবি, তাকে কিভাবে না বলি? ওকে কিভাবে না বলি? না বলা কি এতোই সহজ? দুনিয়াতে কঠিন কিছুই নয়। আর সবচেয়ে সহজই হলো না বলতে পারা। একবার বলে দেখুন, দেখবেন সেই লোকটি আপনাকে আর দ্বিতীয়বারের মতো কিছু বলতে সাহস পাবেনা।

ইশার এই ট্রিকস কাজে লাগে নামিরার জীবনে। সে যেদিন থেকে সবাইকে না বলতে শিখেছে, সেদিন থেকেই ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড।

“এখানে একা একা বসে আর কতক্ষণ কাঁদবে?;

একখানা অপ্রত্যাশিত গলা নামিরার কানে বারি খেতেই ওর কান্নায় ভাটা পড়লো। মাথা তুলে সম্মুখে তাকাতেই আরবকে দেখে ভেতরটা কেমন করে উঠলো! চটজলদি চোখ মুছে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে পূণরায় আরবের করুন গলাটি পায়,

“আজও এড়িয়ে চলে যাবে?;

এই কথার পিঠে নামিরা দাঁড়িয়ে পড়ে। নাক টেনে ভেজা গলায় জবাব দেয়,

“ওদিকে সবাই আছে, আমি সেখানেই যাচ্ছি।;

” না গেলেও কেউ তোমাকে আলাদা করে কথা শোনাবেনা।;

“না শোনাক, এটা তো আমার দায়িত্ব!;

আরব অসহায় ভঙ্গিতে হাসলো। নামিরার কথাটা মনে মনে একবার আওড়ে দোষ চালানো গলায় বলল,

“দায়িত্ব এড়াতে তো তুমি ভালোই জানো। সে কথা কি তারা জানে?;

নামিরা চমকে ওঠে। পেছন মুড়ে দাঁড়ায়। কিঞ্চিৎ রাগি গলাতেই বলে,

“আমি মোটেই দায়িত্ব এড়ায়নি। যা হওয়ার নয় আপনি কেন সে কথা নিয়ে পড়ে আছেন?;

“তোমাকে চাওয়াটা কি আমার অপরাধ ছিলো?;

“আপনার আগে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর ইশা এসব জানলে কি ভাববে বলুন তো? ওর কি মনে হবেনা, আমি ওর পিঠ পিছে এসব করে বেড়াচ্ছি?;

“এসব মানে কিসব? তুমি কিন্তু আমার ভালোবাসাকে অপমান করছো নামিরা।;

“চাইনা অপমান করতে। তাই তো আমি আপনাকে না করে দিয়েছি।;

কন্ঠ রাশভারি হলেও দমে গেলো আরব। বুকের ক্ষ*ততে আবারও কেউ আ*ঘাত করলো যেন। গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

“ইশা আমার বোন, ও আমাদের ব্যাপারে কখনোই এসব ভাববেনা।;

“ভাবার কোনো পর্যায়ও তৈরি করতে চাইনা আমি।;

এখানেই কথা শেষ করে আবারও উল্টো ঘুরে গেলো নামিরা। চলে যাবে। তবে এবারও যেতে পারলোনা। পেছন থেকে হাতে টান অনুভব করতেই তার সারা শরীর শিউরে উঠলো। আরব ওর হাত টেনে ধরেছে।

“আমার ভালোবাসার কি কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে।;

নামিরার বড্ড কষ্ট হয় এই মানুষটার জন্য। ভালোবেসে এই মানুষটা যতটা অবহেলা পেয়েছে ওর থেকে, সেটা হাজার ভালোবাসা দিয়েও কখনোও পরিশোধ করতে পারবেনা ও।

“আছে। আর আছে বলেই আমি আপনার কাছে যেতে চাইনা। আপনার ভালোবাসাকে আমি সম্মান করি।;

“আমাকে রেখে পালিয়ে যাওয়ার এই সম্মান আমার চাইনা নামিরা। আমি তোমাকে চাই। তোমার ভালোবাসা, তোমার ছোঁয়া, তোমার অনুভূতি.. আমি গোটা তুমিটাকে চাই। কিভাবে বোঝাই তোমায়?;

“ইউ ডিজার্ভ বেটার আরব। আমার থেকেও…;

বেশ জোরেশোরে শব্দ হলো। আরব তীব্র রা*গে নামিরাকে দেয়ালে ঠেসে ধরলো। দু’পাশ থেকে ওর কাঁধ চেপে ধরে রা*গান্বিত গলায় বলে উঠলো,

“এতো বেটার দিয়ে কি হবে যদি ভালোবাসাটাই না আসে?;

নামিরার দুই কাঁধ আরব চেপে ধরেছে এ কথা ভুল। সত্যিটা হলো খামচে ধরেছে। নামিরা ব্যাথায় চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলো। কাতর স্বরে বলল,

“আমার ব্যাথা লাগছে।;

এই কথায় আরবের মনের ঘা যেন আরও বাড়লো। সে অসহায় গলায় বলল,

“আমার মনের ব্যাথা কি তোমার চোখে পড়েনা? এতো স্বার্থপর তুমি!;

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো নামিরা। আর কতভাবে এই মানুষটাকে ও দূরে সরিয়ে রাখবে। আর যে পারছেনা। কোনো ভাবেই পারছেনা।

“কাঁদো! কাঁদো আরও জোরে জোরে কাঁদো। কাঁদতে কাঁদতে সবাইকে জানিয়ে দাও তুমি আমায় কতটা ভালোবাসো। বলো নামিরা, বলো?;

নামিরার কান্নার বেগ বাড়ে। ও সত্যি সত্যিই শব্দ করে কাঁদতে লাগে। আরব আর পারছেনা ওকে এভাবে দেখতে। তাই এক টানে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো তার ভালোবাসার মানুষটিকে। শক্ত করে আগলে রাখলো, চেপে রাখলো বুকের সাথে। তার শূন্য হৃদয়টা ভরাট হচ্ছে। ক্রমশ ভরাট হচ্ছে পূর্ণতায়।

________

ইশার গলা দিয়ে নল ঢুকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা লাগিয়ে ভেতরের পয়জন গুলো ওয়াশ করেন ডাক্তাররা। মেয়েটা এমনিতেই অর্ধমৃ*ত হয়ে আছে, কিন্তু এই প্রসেসিং এ ওকে যেন বাকিটাও মে-রে ফেললো। মৃ-তের মতো বেডে পরে আছে ইশা। সেন্স নেই ওর। ওয়াশ করার সময় বারবার সেন্স হারিয়েছে। শেষবার যখন জ্ঞান হারালো তখন ডাক্তার নিজেই স্যালাইনের সাথে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিলেন। সাথে এও জানিয়ে গেলেন ঘন্টা খানিক পেরোলেই জ্ঞান ফিরবে। ওকে কেবিনে শিফ্ট করা হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। সবাই ওর সাথে দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে ডাক্তার মাত্র কয়েকজনকে এলাউ করলো। মরিয়ম বিবি, খান সাহেব এবং শ্রাবণ গেলো কেবিনের ভেতর।

ইশার ফর্সা মুখটা র*ক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, বা হাতে স্যালাইন,এলোমেলো চুল, উষ্ক-শুষ্ক ঠোঁট সব মিলিয়ে যাচ্ছেতাই দশা বলা যায়। মেয়েকে এই অবস্থায় মেনে নিতে পারছেন না মরিয়ম বিবি। দেয়ালে মাথা ঠোকাতে ইচ্ছে করছে তার। মেয়েটা কতটা কষ্ট পাচ্ছে, আর সে মা হয়েও কিছু করতে পারছেনা। এমন মা হয়ে কি লাভ?

খান সাহেব নাতনির করুন দশা দেখে ভেতর থেকে মড়মড় করে ভে*ঙে পড়ছেন। দাঁড়িয়ে থাকাটাও তার জন্য বড্ড কঠিন মনে হচ্ছে। হাতে ধরে রাখা লাঠিটা নড়বড় করছে। যেকোনো মুহুর্তে তিনি পড়ে যেতে পারেন। তার অবস্থা বুঝলো শ্রাবণ। দ্রুত এসে দাদাজানের কাঁধ ধরে ফেললো দু’হাতে। চিন্তান্বিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

“দাদাজান, ঠিকাছো তুমি? শরীর খারাপ করছে?;

খান সাহেব বাচ্চাদের ন্যায় ফুঁপিয়ে উঠলেন। কাঁপা কাঁপা হাতটা তুলে শ্রাবণের কাঁধের উপর নিজের ভর দিলেন। অপরাধী গলায় বারবার কিছু আওড়াতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারছেন না। ভেতরের অপরাধ বোধটা এতোটাই তীব্র হলো যে, তিনি কথাও বলতে পারছেন না। শ্রাবণ তার মনের অবস্থা ঠিক আন্দাজ করতে পারছে। বয়স্ক মানুষটা ভেতর থেকে একটুও ঠিক নেই। উনার কান্না দেখে শ্রাবণের চোখের কোন চিকচিক করে উঠলো নোনাজলে। মরিয়ম বিবি বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। খান সাহেব মেয়ের আলিঙ্গন পেয়ে কেবল ফোঁপাচ্ছেন। শ্রাবণ তাকে শক্ত করে ধরে রেখে বড়দের মতো করে বলল,

“সব ঠিক হয়ে যাবে। এই ঘটনার জন্য তুমি একদম নিজেকে দোষারোপ করবেনা দাদা। যা হওয়ার হয়ে গেছে। হয়তো এটাই আমাদের ভাগ্যে ছিলো।;

“আ্ আমার নাতনিটা, আ..মার ইশা..;

“ও ঠিক হয়ে যাবে দাদা। তুমি এভাবে ভেঙে পড়োনা প্লিজ। তুমি আমাদের সবার মাথার উপরের বটগাছ। তোমাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখলে, আমরা কিভাবে ঠিক থাকবো? তখন যে সবাই একএক করে ভাঙতে শুরু করবে।;

খান সাহেব নিজেকে সামলে নিলেন। অসহায় চোখে কতক্ষণ ইশার দিকে চেয়ে রইলেন। মনেমনে ওয়াদা করলেন, তিনি তার ইশার সাথে আর কোনো অন্যায় হতে দিবেন না। একদম দিবেন না।

মরিয়ম বিবি বাবাকে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। অসহায় একা দাঁড়িয়ে রইলো শ্রাবণ। অপরাধী চোখ জোড়ায় জলপ্রপাতের ধারা শুরু হয়েছে। ধীর পায়ে এগোতে এগোতে দু’হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে বেডের কাছের ছোট্ট টুলটা টেনে বসলো। ভেরতটায় র*ক্ত ক্ষরণ চলছে। একটু আগে তিতির বলছিলো, গত তিন দিনে ইশা তাকে ১০হাজারের উপর কল করেছে। এমনকি আজ সকালেও! শ্রাবণ সময়ের আন্দাজ করে মেপে দেখলো তুর্জর সাথে ইশার দেখা হওয়ার আগ মুহুর্তেও ইশা তাকেই কল করেছে। আর সে? ওকে ভুল বুঝে যা-তা কান্ড করে ফোন বন্ধ করে রেখেছিলো। এ কথা ভাবতে নিজেকে খু*ন করতে ইচ্ছে করছে শ্রাবণের। আজকে ইশার এই অবস্থার জন্য সে নিজেও কি দায়ী নয়?

বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে তার। না, ভালোবাসার মানুষটাকে মৃ*ত্যুর সাথে লড়তে দেখে নয়, তার নিজের ভুলের জন্য আজ তার ভালোবাসা ম*রতে বসেছে!

শ্রাবণের হাতটা কাঁপছে। সেই কাঁপা হাতেই ইশার ঘুমন্ত হাতটা জড়িয়ে ধরলো। র*ক্ত শীতল হয়ে ইশার শরীর এখনও বেশ ঠান্ডা। ব্যাপারটা বোধগম্য হতে শ্রাবণ চটজলদি ওর হাত ডলতে লাগলো। কতক্ষণ গালে কতক্ষণ বুকে ইশার হাতটা ঠেকাতে লাগলো। পুরুষ মানুষ কত সহজে কাঁদতে পারে? এর ব্যাখ্যা কার কাছে আছে? নাকি এই প্রশ্নটাই ভুল?

“এই ইশা ওঠনা? আর কতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবি? আর কত জ্বা*লাবি এমন করে? সেই ছোট থেকেই জ্বা*লিয়ে আসছিস! তোকে ভালোবেসে দেখি মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেলাম! সুযোগ পেয়ে পেয়ে মাথায় চড়ে গেছিস। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে খুব শাসন করি, জানিস না বানরকে মাথায় চড়াতে নেই! তুই তো বানরই। (হেসে) কিন্তু পারিনা শাসন করতে। শাসন করতে গেলেই তোর অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া দেখে আমার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে পরে। শ্বাসপ্রশ্বাস আঁটকে যায়! কত কষ্ট করে দম নিতে হয় আমাকে। তোর একের পর এক বোকামিতে প্রায় অনেকটা সময় নষ্ট করেছি আমরা। তুইও তো আমাকে খুব ভালোবাসতিস? তাহলে কেন পিছিয়ে পড়লি? ফ্যামিলি মানবেনা বলে? আচ্ছা আমার প্রতি কি তোর একটুও ভরসা ছিলোনা? আমি কি পারতাম না আমাদের ফ্যামিলিকে মানাতে? সব একা একাই ভেবে নিলি। আমাকে কখনোও বুঝতেও দিলিনা এতে তুই নিজেও কতটা গুমরে ম*রেছিস। তুই সত্যিই বড্ড বোকা রে ইশুপাখি, বড্ড বোকা।;

প্রায় ৩০বছর আগের কথা, শ্রাবনের বাবার শমসের সাহেবের একটা প্রেম ছিলো। বাল্যকালের প্রেম। মেয়েটা তাদের পাড়াতেই থাকতো। একসাথে স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় এবং চাকরীর শুরুটাও দু’জনের একসাথেই হয়েছিলো। প্রায় ১৫বছরের প্রেমের সম্পর্ককে একটা পরিনতি দিতে চাইলেই শুরু হলো বাঁধা। তখন পাড়া,মহল্লা এবং শহর জুড়ে ছিলো খান সাহেবের দাপট। প্রেম জিনিসটা বরাবরই তার অপছন্দের ছিলো। তার দাপটে প্রতিবাদ করার মানুষ ছিলোনা বললেই চলে। মেয়ের বাবা বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসে ছেলে-মেয়েদের প্রেমের কথা উল্লেখ করাতে চরম অপমানের স্বীকার হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিলো তাকে! সে আর যাই করুক প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিবেনা। বাবার এই সিদ্ধান্ত ভেঙে পড়েন শমসের সাহেব! একদিকে প্রেমিকা একদিকে বাবা, কাকে ছেড়ে কার কাছে যাবেন তিনি? তবুও তিনি সিদ্ধান্ত নেন প্রেমিকাকেই বেছে নিবেন। কিন্তু পারেন না, সব কিছু ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার বাবার প্রথম হার্ট এট্যাক আসে। বাবাকে নিয়ে হন্নে হয়ে ছোটেন হসপিটালে। টানা তিনরাত পার করেন সেখানে, এদিকে তার প্রেমিকার বাবা অভিমানে ক-ষ্টে জোর করে মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন। এই ঘটনা কারোরই অজানা নয়। শ্রাবণ, তিতির, ইশা, আরব ওরা সবাই জানে এই ঘটনা। এমনকি শ্রাবণের মাও জানেন। এরপর থেকে খান বাড়িতে কেউ আর কখনোও ভালোবেসে বিয়ে করার দুঃসাহস করেনি।

তাই ইশাও চাইতোনা তার বড় মামুর মতো তার শ্রাবণ ভাইও একই ক*ষ্ট বুকে চেপে সারাজীবন পার করুক। তাই তো নিজের ভালোবাসাকে মাটি দিয়ে একজন পরপুরুষকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো। এমনকি তার সাথে এনগেজমেন্ট করে নিয়েছিলো।

“পাখিরে, খুব ভালোবাসি তোকে! খুব ভালোবাসি! খুব…;

ইশার হাতটা দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরে কপাল ঠেকালো শ্রাবণ। ভাঙা কন্ঠনালীতে ভালোবাসার শব্দমালা বুনলো। র*ক্তিম চোখে নোনা জল মুক্তর দানার ন্যায় খসে পড়লো ইশার হাতে। ঠিক তখনই জ্ঞান ফিরলো ইশার। ঘোলাটে দৃষ্টি, শুকিয়ে যাওয়া গলায় অস্ফুট স্বরে কাউকে ডাকছে সে।

“শ্ শ্রাবণ.. ভাই!;

শ্রাবনের হৃদস্পন্দন থমকে গেলো। চকিতে মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো ইশা আধখোলা চোখে তাকিয়ে আছে তার পানে। শ্রাবণের তপ্ত হৃদয় মুহুর্তেই শান্ত,শীতল হয়ে গেলো। উঠে দাঁড়ালো সে। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে পাগলের মতো চুমু আকলো ইশার কপালে। পরক্ষণেই বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বহু আকাঙ্ক্ষিত কথাটি পূণরায় আওড়ালো,

“পাখিরে, ভালোবাসি আমি তোকে! খুব ভালোবাসি।;

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে