ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-৩৯+৪০+৪১

0
339

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_______৩৯

“আমার বাচ্চা লাগবে।; থমথমে গলায় বলল ইশা।
“আবার বাচ্চা!; থতমত খেয়ে, বিস্মিত স্বরে আওড়ায় শ্রাবণ।

কার্ফিউ জারি করেছে ইশা। যতদিন শ্রাবণ বাচ্চার জন্য রাজি না হয়, ততদিন সে কোনোমতেই অন্ন মুখে তুলবেনা। এমনকি জলও স্পর্শ নয়।

তিতিরের প্রেগন্যান্সির সাত মাস পূর্ণ হলো আজ। ঘরে ছোটখাটো একটা আয়োজন করা হয়েছে তিতিরকে বড়দের দোয়া ও ভালোবাসা করায়ত্ত করার জন্য। দিনের শুরু হতেই সবাই এই ছোট্ট আয়োজন টুকু হাতে হাতে শেষ করেছে তিতিরের দুই ভাই। বোনরাও এখন পিছিয়ে নেই কোনোকিছুতে।

কাজ করতে করতে আপাতত ক্লান্ত শ্রাবণ। ঘরে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রেকর্ডিং এর ন্যায় বেজে উঠলো ইশা। ফুল চার্জড হয়েই মন খারাপের সুরে বলল কথাটা।

“হ্যাঁ, বাচ্চা। আবারও শুনতে চাও? আমার বাচ্চা লাগবে। নয়তো, নয়তো আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।;

মুখ ভার করে অন্যদিকে ফিরে বসলো ইশা। শ্রাবণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এখন বাচ্চা? ইশার পড়াশোনার মাঝামাঝি শ্রাবণ কিছুতেই বাচ্চা নিতে রাজি নয়। এটলিস্ট অনার্স কমপ্লিট হলে ভেবে দেখবে সে।

“ও গড! এই মেয়েকে নিয়ে আমি কই যাবো?;

“তোমাকে কোথাও যেতে হবেনা। হবেনা যেতে। আমিই চলে যাবো, অনেকদূর, বহুদূর!;

“এদিকে এসো!;

বুকের উপর হাত চেপে ইশাকে ডাকলো শ্রাবণ। ইশা একবার চেয়ে পূণরায় ফিরে গেলো অন্যদিকে। অর্থাৎ সে আসবেনা। তাই শ্রাবণ ইশার হাত টেনে নিয়ে এলো বুকের উপর। ইশার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলো কিছুক্ষণ। ইশা তবুও শান্ত হলোনা। অশান্ত মনে হাসফাস করতে লাগলো। শ্রাবণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অনুদ্ধত গলায় বলল,

“বাচ্চা লাগবে?;

“হু।;

“এখনই?;

“হু।;

“আর পড়াশোনা?;

“পড়াশোনা লাগবেনা। চাইনা!;

“তাহলে শুরুতেই বন্ধ করে দিতে, অযথা এতো টাকা খরচ করে পড়া কেন?;

ইশার মুখ ভার হয়ে গেলো দিগুণহারে। ছিটকে সরে গেলো শ্রাবণের বুক থেকে। তীব্র বিস্ময় নিয়ে শুধাতে চাইলো,

“তুমি আমায় টাকার খোটা দিচ্ছো?;

কিন্তু পারলোনা। তার আগেই শ্রাবণ ওর ভুল ভেঙে বলে উঠলো,

“আমাদের জীবনের কোনোকিছুকেই তুচ্ছ করে দেখা উচিৎ নয়। একটা আগে শেষ করো, পরেরটা আপনাআপনি চলে আসবে।;

ইশা মানতে পারলোনা শ্রাবণের কথাটা। তবে এটাও বুঝে গেলো, ও না খেয়ে ম/রে গেলেও শ্রাবণ বাচ্চার জন্য রাজি নয়।

“সকাল থেকে কিচ্ছু খাওনি, সবই কিন্তু চোখে পরে আমার। এসব অনিয়ম আমার কাছে চলবেনা।;

এবারের কথাটা একটু গম্ভীর হয়ে বলল শ্রাবণ। ইশা দমে গেলো। রাগ বা অভিমান কোনোটাই আর প্রকাশ করতে পারলোনা। তার আবদার, অভিমান, কিংবা বাচ্চামো সবটাই শ্রাবণের গম্ভীরতার আগে। শ্রাবণ দুম করে রেগে গেলে, তার কপালে যে শনি আছে সেটা ইশার অজানা নয়।

“চলো, খাবে কিছু।;

শ্রাবণ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কথাটা বলতে বলতে ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে এসে ইশাকে নিয়ে নীচে গেলো।

নীচে আসতেই খান সাহেবের মুখোমুখি হলো দু’জন। ইশা পাশ কাটিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরে। শ্রাবণ বসলো খান সাহেবের সাথে। খান সাহেব চিন্তান্বিত হয়ে কথা পাড়লেন,

“আজ নিলাশার বিয়ে। কার্ড পাঠিয়েছে খোরশেদ।;

“আচ্ছা, তাই নাকি? এতো বেশ ভালো কথা।;

“হ্যাঁ, যাবে তোমরা?;

“আমরা বলতে, তুমি যাবেনা?;

“আমার শরীরটা ক’দিন ধরে বেশ খারাপ যাচ্ছে। আমি যেতে পারবোনা।;

খান সাহেবের শরীর খারাপ, অথচ শ্রাবণ জানেনা। শ্রাবণ উত্তেজিত হলো খানিক। অস্থির গলাতে জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার শরীর খারাপ, অথচ আমাকে কেউ জানালো না!;

“ব্যস্ত হয়োনা দাদুভাই। এ বয়সে এসব একটু আধটু হয়েই থাকে।;

“না দাদাজান, শারীরিক অসুস্থতা কোনো হেলফেলা করার জিনিস নয়। তুমি চলো, আমি এখনই তোমায় ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো।;

শ্রাবণ খান সাহেবের হাতটা ধরে উঠাতে চাইলে তিনি বারবার না করতে থাকেন। শেষ অব্দি শ্রাবণ পারেনা তার সাথে। হার মেনে বলে,

“ঠিকাছে, আজ না হোক কাল বা পরশু আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। অমিতকে চিনো তো? আমার বন্ধু?;

“রুপার ছেলে?;

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ও এখন বড় ডাক্তার। ক’দিন আগেই ডিগ্রি পাশ করেছে। অনেক দিন ধরে বলছে দেখা করতে। কাল তোমাকে নিয়ে যাবো। না করবেনা একদম।;

“তুমি অযথাই ব্যস্ত হচ্ছো।;

“আমি কোনো কথা শুনবোনা।;

______

দু’হাতে দুটো শাড়ি ইশার। একটা ফুল ব্লাক আর অন্যটা ফুল রেড। গাঢ় লাল রঙে ইশাকে বরাবরই নতুন বউ মনে হয়। তাই সে খুব ভালো করেই জানে শ্রাবণ তার জন্য কোন রঙটা বাছাই করবে।

“রেড।; একবার দেখেই বলল শ্রাবণ।

ইশা মুচকি হেসে কালো শাড়িটা আলমারিতে তুলে রেখে বলল,

“জানতাম। তোমার পছন্দ মুখস্থ হয়ে গেছে আমার।;

“তাই নাকি? তাহলে সারাক্ষণ বাচ্চা বাচ্চা না করে, আমার মনের কথাটা মেনে নিলেই তো পারো।;

“হু।;

“এই যে, কথা বন্ধ হয়ে গেলো। আচ্ছা, আমি কি তোমার খারাপ চাই বলেই বলি? তুমি কি বুঝোনা?;

“বুঝি।;

“তাহলে মুখ ভার হয়ে গেলো কেন?;

“এমনি।;

“তিতিরের হাইয়েস্ট আর টু মান্থ। নতুন সদস্য অলরেডি আসছে আমাদের বাড়িতে। ওকে নিয়েই আমরা সবাই মেতে থাকবো। ও কি আমাদের পর বলো?;

“না।;

যত যাই বলা হোক, এই বিষয়ে ইশার মন পাবেনা শ্রাবণ। এ কথা সে খুব ভালো করেই জানে। তাই মন ভুলাতে এগিয়ে যায় ইশার সন্নিকটে। কাছে টেনে বারংবার তাকে ছুঁয়ে দেয় ভালোবাসার গভীর স্পর্শে। ইশা ক্ষণকালের জন্য ভুলে যায় ওসব কথা।

শাড়ি পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো ইশা। শ্রাবণও রেডি। সাদা শার্টের উপর ডার্ক রেড ব্লেজার জড়িয়ে নিলো। চুল গুলো ঠিক করতে করতে আঁড়চোখে তাকালো ইশার পানে। ইশা তার লম্বা কেশগুলো খোঁপা বেঁধে নিলো। গলায় পড়লো বড় পাথরের কাজ করা একটা নেকলেস। কানে তারই টপ দুল। মুখে সামান্য পাউডার ঘসে ঠোঁটে হালকা লাল রঙের লিপস্টিক দিয়ে পাশে তাকাতেই চোখে চোখ পরলো শ্রাবণের। ইশা ভ্রু কুঁচকায়।

“তাকিয়ে আছো কেন? কিছু কি কম হয়েছে?;

শ্রাবণ কিছু বলেনা। সে চোখের তৃষ্ণা মেটাতে চেয়েই থাকে। ততক্ষণে ইশা আরেকবার দেখে নেয় নিজেকে। কিছু কম হলো কিনা। পরক্ষণেই ভ্যাবাচেকা খাওয়া গলায় বলল,

“কিছু বেশি হলো না তো? লিপস্টিক! লিপস্টিক বেশি হয়েছে?;

পূণরায় আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে ইশা। শ্রাবণ ওর অস্থিরতা দেখে মুচকি হাসে। নিজেদের মাঝে সামান্য দূরত্ব টুকু ঘুচিয়ে নিয়ে এক ইঞ্চি ব্যবধানে দাঁড়ায়। ইশার সম্পূর্ণ মুখবিবর নিজের দু’হাতে নিয়ে সামান্য উঁচিয়ে ধরে তার মুখোমুখি। ইশা ভড়কে যায়। চোখ জোড়া গোলগাল করে তাকায় তার দিকে।

“চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। তোমার নির্লজ্জ অধরজোড়া নিরলস নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে আমাকে!;

ইশার বক্ষঃস্থল শিহরণে মুষড়ে গেলো। লজ্জায় কঠিন আকারে লাল বর্ণ ধারণ করলো তার গাল।

“উফফ, ছাড়ো তো। ওদিকে দেরী হয়ে..;

“ছাড়তে পারছিনা তো।;

“আমি ছাড়িয়ে দিচ্ছি।;

“না, আগে চুমু তারপর বাকি সব।;

“না, এখন কিচ্ছু নয়। চলো চলো, দেরী হয়ে যাচ্ছে।;

জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো শ্রাবণের থেকে। শ্রাবণ চোখ দিয়ে শাসিয়ে বোঝালো,

“যখন ধরবো, তখন কেঁদেও কুল পাবেনা;

ইশা ওসবে একদমই পাত্তা দিলোনা। সে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো। নিজের শাড়ি, সাজ সব ঠিকঠাক করে শ্রাবণের ব্লেজার ঠিক করে বের হলো একসাথে।

নিলাশার বিয়েতে গুরুজনরা বাদে সবাই এলো। শ্রাবণ, ইশা, আরব,তানি,তুতুন এমনকি তিতিরও। তিতিরের সারাক্ষণ কেবল শুয়ে না হয় বসেই কাটাতে হয়। সেই কথা ভেবেই শ্রাবণ বোনকেও নিয়ে এলো। মা অবশ্য বারন করেছিলো এতো হৈচৈ এর মাঝে অসুবিধা হতে পারে তিতিরের। কিন্তু কেউ শোনেনি বারন। কখনোও কখনোও মায়েদের দুশ্চিন্তাতেই যেন সন্তানের আনন্দ লুকিয়ে থাকে। এ বেলাতেও সেটাই হলো।

নিলাশা এমনিতেই ভয়ানক রূপবতী। আর আজ যেন সৃষ্টিকর্তা দিগুণ রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন তার সৃষ্টিকে। নিলাশাকে উপরের ঘরে দেখতে এলো ইশা আর বাকিরা। ইশা তিতিরকে ধরে ধরে সিঁড়ি পার করালে ইতিমধ্যে সব সিঁড়ি পেরিয়ে নিলাশার রুমের সামনে চলে যায় তানি। নিলাশার রুমের সামনে পৌঁছালেও রুমে ঢুকলোনা সে। আপাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। তবে সেই অপেক্ষা কেউ একজন দীর্ঘায়িত করতে দিলোনা। হাতে হেঁচকা টান খেয়ে ওখান থেকে উধাও হয়ে গেলো তানি। ইশারা উপরে উঠতে উঠতে তানিকে আর খুঁজে পেলোনা। তাই আর অপেক্ষা না করে ঢুকে পড়লো নিলাশার রুমে।

তানির পেছনে বড় একটা আলমারি। আর সেই আলমারির সাথেই লেপ্টে আছে তানি। শ্বাস প্রচন্ড গতিতে ওঠানামা করছে। চোখ জোড়া বন্ধ কোনো অজানা ভয়ের সূত্রপাতে। হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ, তবে কারোর সুঠাম বাহুর নিকট অবরুদ্ধ।

“ঠিক সতেরো দিন, আঠারো ঘন্টা এন্ড মোস্ট প্রব্যাবলি ত্রিশ মিনিট, নো নো একত্রিশ মিনিট! তুমি আমাকে টানা ইগনোর করছো। রিজনটা আমি জানতে পারি?;

খুব কাছ থেকে একটা পরিচিত গন্ধ নাকের ডগায় বারি খেলো তানির। সঙ্গে সঙ্গে তার পরিচিত কন্ঠস্বর এক অদ্ভুত শিহরণ সৃষ্টি করলো তার সর্বাঙ্গে। বুকের ভেতরটা ডাক চিৎকার পাড়ছে অনবরত। না চাইতেও চোখ জোড়া মেলে সামনে তাকাতেই আরেকটু বড়সড় ধাক্কা খেলো। রাগতে চাইলো রণচণ্ডীর ন্যায়। কিন্তু পারলোনা। আরাফের কঠিন অধিকারবোধ তার রাগকে শুষে নিলো।

তানির হাত জোড়া পেছনে মুচড়ে রেখেছে আরাফ। কারনটা খুবই সহজ। এই মেয়ের মুখের চেয়ে হাতটা বেশি চলে। আরাফ তানির হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরলে তানি ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো। আরাফ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,

“যে প্রশ্ন করা হয়েছে, শুধু তারই উত্তর দিবে।;

“হাত ছাড়ুন। আর আপনার সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছিনা। ভাইয়াকে বলে দিবো একদম।;

ভাই বলতে তানি শ্রাবণকেই বুঝিয়েছে। জানে আরাফ। শ্রাবণকে সেও তো ভয় পায়। তবে কথায় আছেনা, ‘পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া’। হ্যাঁ ভালোইতো বাসে সে তানিকে। এই রাগী আর মিষ্টি পাগলি মেয়েটা সে ভালোবেসে ফেলেছে। আর এই কথাটাই বলেছিলো সে তানিকে। আর তারপর থেকেই আজ সতেরো দিন যাবত তানি তাকে সমানে ইগনোর করে যাচ্ছে। কি পাষাণ মেয়েটা।

“ছ্ ছাড়বো, তার আগে তোমাকে বলতে হবে আমাকে কেন ইগনোর করা হচ্ছে?;

“কারন, আপনাকে দেখলেই আমার রাগ হয়। মন চায় এক ঘুষি মে/রে আপনার নাক ফাটিয়ে দেই।;

হকচকিয়ে গেলো আরাফ,

“ত তুমি মেয়ে না ডাকাত?;

“আমি ডাকাত।;

কি সহজ স্বীকারোক্তি তানির। আরাফ কপাল কুঁচকে ফেললো। এবার সে তানির হাত ছেড়ে কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে বলল,

“ওকে, তাহলে আমি প্রুফ করে দিচ্ছি তুমি ডাকাত নাকি মেয়ে?;

আরাফের স্পর্শে কেঁপে উঠলো তানি। তার চোখ ছানাবড়া। আরাফ একহাতে তানির কোমর জড়িয়ে ধরে অন্যহাত তুলে আনলো তানির লম্বাটে মুখ বিবরে। তানি পূণরায় কেঁপে উঠলো। তার গলা শুঁকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে গেলো। নিজের অজান্তেই পূর্বের ন্যায় তার চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেলো। আরাফ মুচকি হাসলো। তানির চোখমুখের অস্থিরতা মেপে আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো। তানির নিঃশ্বাস ক্রমশই ভারী হতে লাগলো। ঘণ হতে থাকলো। আরাফ সবটটাই পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে সন্তর্পণে। আর মুচকি হেসে যাচ্ছে।

“আমি তোমার অনুভূতি হতে চাই তানি, আমি তোমার অনুভূতিতে মিশে যেতে চাই। আমি তোমার হৃৎস্পন্দন হতে চাই, আমি তোমার হৃদযন্ত্রের মালিক হতে চাই। আমাকে একটা সুযোগ দাও। আমি একটা সুযোগ চাই। আমি তোমাকে আমার ভালোবাসায় রাঙিয়ে তুলতে চাই। আমি চাই তুমি আমার হও, আমার হও।;

ছিটকে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো তানি। ঘণ নিঃশ্বাস বিসর্জন দিতে দিতে চোখ তুলে তাকালো আরাফের পানে। আরাফ অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে ওরই পানে। কি করুণ তার চাহনি, যেন এই ভালোবাসার অভাবেই তার মৃ**ত্যু হবে।

“তুমি কি কিছুই বলতে চাওনা?;

“না!;

“কিন্তু কেন?;

“কারন আমি আপনাকে ভালোবাসিনা!;

আরাফ থমকে গেলো। তানি তাকে ভালোবাসেনা! সত্যিই কি বাসেনা? নাকি বাসতে চায়না। তার কোনো কমতি কি তানিকে বাঁধা দিচ্ছে ভালোবাসতে?

“আমাকে ভালো না বাসার কারন?;

“জানিনা।;

“তোমার কি অন্য কাউকে ভালোলাগে?;

“জানিনা;

“কিছুতো একটা জানতে হবে তোমাকে। সব কিছু জানিনা বলে এড়িয়ে গেলে তো হবেনা তানি। আমি তোমাকে ভালোবাসি।;

“উফফ, আমার বি*র*ক্ত লাগে এসব ভালোবাসা-ফালোবাসায়। অসহ্য লাগে।;

আরাফ স্তব্ধ হয়ে গেলো। এরকম হয় নাকি? ভালোবাসা আবার বি*র*ক্তির বস্তু হয়? কি আজব!

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_____৪০

ভোর ৬টায় এলার্মের বিপরীতে যদি কাকের ঐ বিশ্রী গলার কা কা আওয়াজ শুনতে হয়, তবে যে কারোরই মেজাজ তুঙ্গে চড়ে যাবে। ইশারও তাই হলো। বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ কপালের শীর্ষে নিয়ে উঠে বসলো। শীতের দিন। দিবস যতটা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে যায়, রজনী ততটাই ধীর গতিতে কদম ফেলে। তাই সকাল ৬টা, শীতের দিনে ভোর রাত। উষ্ণ বিছানা ছেড়ে উঠতে বড্ড আলসেমি লাগছে ইশার। তবুও ছাড়তে হলো। চোখ ডলতে ডলতে উঠলো সে। অলস পায়ে হেঁটে গেলো ব্যালকনিতে। গার্ডেনে পাহাড় সমান একটা আমগাছ। কাকটা ওখানেই বাসা বেঁধেছে। বাসা বেঁধেছিস ভালো কথা, এমন কা কা করে ঘন্টা বাজিয়ে লোকের ঘুম হারাম করাটা কি খুব জুরুরি?

“হুঁশ, হুঁশ।;

পানি ছুঁড়ে মা*র*লো ইশা। কাকটা সরার নামই নিচ্ছেনা। কেমন পাষাণের মতো ডেকেই যাচ্ছে। মেজাজ খারাপ হলো ইশার। এ কেমন বিচার সাতসকালে।

“ক্ষিদে পেয়েছে তোর? খাবার খাবি? ডাকিসনা মা। অসহ্য হচ্ছে খুব।;

পাগলের ন্যায় একা একা প্রলাপ বকে যাচ্ছে কাকের সহিত। কতক্ষণ পর পুনরায় নতুন করে বি*র*ক্ত হয়ে রুমে চলে এলো। ভাবছে আবারও শুবে, কিন্তু শুলো না। বিছানা হাতড়ে ওড়না আর ফোনটা নিয়ে চলে গেলো নীচে। চা বানাবে। চা খেতে খেতে শ্রাবণকে কল দিবে। দু’দিন আগে মানুষটার সাথে শেষ কথা হয়েছে। আজ দু’দিন ধরে কাজের চাপে একদমই লাপাত্তা।

শীত শীত লাগছে ইশার। ওড়না না এনে চাদরটা আনলে বেশি উপকার হতো। কিন্তু পুনরায় পা চালিয়ে রুমে যেতে ইচ্ছে করছেনা। তাই ওসব ভাবনা ছেড়ে নীচে চলে এলো। আজকের দিনের শুরুটাই কেমন এলোমেলো লাগছে। কেমন অদ্ভূত। যেন ডিসেম্বর বিদায়ের তীব্র বেদনা ছড়িয়ে পড়ছে সারা ঘরময়।

শেষ সিঁড়িটা পার করতে কেমন হোঁচট খেয়ে পড়তে নিলো ইশা। পড়লোনা। সাহায্যের জন্য হাতের কাছে পেয়ে গেলো কিছু একটা। বুকে হাত চেপে বড় করে দম দিলো ইশা। ওরই বা দোষ কি, এই সাতসকালেও ঘরটা কেমন আমাবস্যার ন্যায় হয়ে আছে। আরেকটু হলেই যেতো পরে।

“কে, কে ওখানে?;

বুকের ভেতরটা ধড়াক করে কেঁপে উঠলো ইশার। ফাঁকা ঘরে যেকোনো কিছুরই শব্দ বড্ড জোরে হয়। আর সেটা যদি হয় কারোর কথা। ঝনঝন করে বেজে উঠলো। ইশা চোখ বড়বড় করে সম্মুখে তাকালো। সিঙ্গেল সোফাটায় অন্ধকারে বসে আছে কেউ। ইশা নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। এমন কাকভোরে নানাজান ব্যতীত কেউ নয়। ও প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে গলা ঝাড়লো,

“আমি নানাজান। আমি।;

ইশা জবাবের আশায় রইলো। কিন্তু এরপর আর কোনো জবাব এলোনা সামনের দিক থেকে। ইশা ভাবলো নানাজান নামাজের পর অনেক দোয়াদরুদ পড়েন, হয়তো তাই পড়ছেন। তাই আর ওসবে নিজেকে বেশি ঘাটালোনা। খুব সাবধানে চলে গেলো রান্নাঘরে। গ্যস অন করে পানি বসালো। ফের কেবিনেটের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলো। এবার সে শ্রাবণকে কল করবে। দু’টো দিন খুব সহ্য করেছে, আর করবেনা। কাজে গেলে বাড়িতে বউয়ের কথা একদম ভুলেই যায়। অদ্ভুত পুরুষ মানুষ।

ইশা ডায়াল করবে শ্রাবণের নাম্বারে। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো কেউ। ইশা দ্বিতীয়বারের মতো ভয়ে চমকে উঠলো।

“ব্ বড় মামি!;

আফিয়া বেগম ঢুকলেন রান্নাঘরে। তিনি পেছন থেকে ইশার গলা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। হাতে পানির খালি গ্লাস। ইশা সেদিকে একবার দেখে প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে আফিয়া বেগমের দিকে তাকালে আরও ভীত হলো। চোখমুখ কেমন শুঁকিয়ে আছে আফিয়া বেগমের। যেন তিন রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে মানুষটা।

“কি হয়েছে, তোমার চোখমুখ এমন লাগছে কেন? পানি, পানি লাগবে?;

শেষ প্রশ্নটি ইশা আফিয়া বেগমের খালি গ্লাসটিকে নির্দেশ করে জিজ্ঞেস করলো। আফিয়া বেগম নিরুৎসাহিত ইশার উৎকন্ঠায়। সে সেসবে কান না দিয়ে ইশার হাতটা চেপে ধরে সামনের দিকে খানিকটা টেনে নিয়ে বিপন্ন গলায় বললেন,

“শ্রাবণকে একবার কল দে তো মা। কল তুললে যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে আসতে বলবি। বাবার শরীরটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে।;

বলেই খালি গ্লাস নিয়েই ছুটলেন। ইশা বিস্মিত হলো। বলে উঠলো,

“নানাজানের কি হয়েছে, আমি যে এক্ষনি দেখলাম ওখানে বসে দোয়া দরূদ পড়…;

বলে শেষ করতে পারলোনা ইশা। আফিয়া বেগমের ছায়াখানাও নেই দূর দূরান্তে। চলে গেছেন তিনি। ঠিক সেই মুহুর্তেই গ্যাস পোড়ার গন্ধ ঠেকলো ইশার নাকে। ইশা এমন অদ্ভুত গন্ধ পেয়ে নাক কুঁচকালো। তখনও ওর মাথায় এলোনা, এটা গ্যাস পোড়ার গন্ধ। তবে মনে পড়তে বেশি সময়ের প্রয়োজন হলোনা ওর। হঠাৎ মস্তিষ্ক সিগনাল দিতেই ছুটে গেলো সেদিকে। কি বোকার মতো কান্ড করলো, চুলায় পানি দিলো অথচ চুলা জ্বালালোনা। অন্যমনস্ক হয়ে শুধু গ্যাস অন রেখেছে। এক্ষনি যে একটা অঘটন ঘটে যেতো।

হঠাৎ হাতের ফোন বিকট শব্দে বেজে উঠলো। ইশা পুনরায় চমকালো। ভয়ে এবার হাত থেকে ফোনটা মেঝেতে পড়ে গেলো। বিস্ময়ের মহাসাগরে পড়ে বারবার শুধু ফোনটার দিকে তাকাতে লাগলো ইশা।

ঠিক তখনই পাষাণের ন্যায় কেউ গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। এবার বুঝি ইশা পাগল হয়ে যাবে। আজ হচ্ছে কি খান বাড়িতে। সব কিছু এমন অস্বাভাবিক কেন লাগছে। কান্নার শব্দ বরাবর পাগলের মতো ছুটে গেলো ইশা। কান্নার শব্দটা খান সাহেবের ঘর থেকে ভেসে আসছে। ইশার পদতল থমকে গেলো ঘরের দরজায় এসে। আফিয়া বেগমের বলে যাওয়া কথাটা বারবার মনে পড়তে লাগলো। বারবার কানে বাজতে লাগলো, ” বাবার শরীরটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে” ইশার মস্তিষ্ক ওখানেই বিকলাঙ্গ বলে ঘোষিত হলো। নানাজান কি তবে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন? বুকটা ফাঁকা হয়ে গেলো ইশার। শ্বাসনালি আঁটকে এলো তীব্র যাতনায়। এটা কেন হলো? কেন হলো এটা! কেন? একই প্রশ্ন বারবার করে যাচ্ছে মন! এটা কেন হলো, কেন হলো, কেন হলো? এমনটা তো হওয়ার নয়, এমনটা কেন হলো?

_________

“কে,কে ওখানে?;

হঠাৎ দুঃস্বপ্নের ন্যায় ঘুম ভেঙে গেলো ইশার। নানা জানের গলাটা কাঁচের ন্যায় বারবার ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হচ্ছে কানের পর্দায়। পরক্ষণেই চিৎকার করে ঘুম ভেঙে যায় ওর। শ্রাবণ পাশে থাকে, শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, তবুও শান্ত হতে পারেনা ও। পাগলের মতো কান্না করতে থাকে, আর শুধু মনে পরে একজোড়া স্নেহের হাত। যে শাসনের মুখোশ পড়ে স্নেহের সহিত বড় করেছে ছোট্ট ইশাকে। খুব মনে পড়ে নানাজানের কথা। আজ তার মৃ*ত্যুু*র তিনমাস।

“দুঃস্বপ্ন দেখেছো?;

দরদর করে ঘামছে ইশা। শ্রাবণ ওর হাতটা মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখলো। জোর দিয়ে শুধাল ফের।

ইশা অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছে কিছু, সঙ্গে হাপাচ্ছে বেশ। হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো। শ্রাবণ ভড়কে গেলো। চটজলদি ইশার মাথাটা নিজের বুকের চেপে ধরে কোমল স্বরে বলে উঠলো,

“কাঁদছো কেন পাখি? কি হয়েছে, বলবে তো আমাকে?;

“নানাজান আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো, কেন চলে গেলো, কেন চলে গেলো?;

“এ কেমন প্রশ্ন বলোতো? মানুষ কি চিরকাল থাকে? থাকেনা তো। সবাইকেই একদিন না একদিন চলে যেতে হবে। দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করতে হবে। তোমাকেও, আমাকেও;

“নানাজানকে আমার ভীষণ মনে পড়ে, বুকের ভেতরটা খা খা করে ওঠে মানুষটাকে এক পলক দেখার জন্য। তোমার মনে পড়ে যখন আমার বাবা আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো? নানাজানও ঠিক সেটাই করলো! সবাই ফাঁকি দিয়ে চলে যায়, সবাই পাষাণ!; (কাঁদতে কাঁদতে)

ইশার বাবার মৃ*ত্যু*র পর নানাজানই ছিলো ইশার একমাত্র ভরসার মানুষ, যিনি ওকে কথা দিয়েছিলো, একদিন সবাই ওকে ছেড়ে চলে গেলেও স্রেফ ঐ মানুষটাই যাবেনা। থাকবে ওর সাথে, চিরটাকাল। বাচ্চা মেয়েটার মন ভুলাতে খান সাহেবের শ্রুতিমধুর মিথ্যে বাক্যটা আজও কানে বাজে ইশার। যা ওকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে আহত করে।

“না পাখি, পৃথিবীর নিয়ম মানুষকে পা*ষাণ করে, মানুষ পা*ষাণ নয়। কার না ইচ্ছে করে তার প্রিয়জনদের সাথে অনন্ত কাল পার করতে, কারই না ইচ্ছে করে প্রিয়জনদের নিয়ে এক সাথে অজস্র বছর বাঁচতে। কেউ কি চায় প্রিয়জনদের ছেড়ে চলে যেতে? একদম চায়না। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম মেনে, সৃষ্টিকর্তার আদেশে আমাদের সবারই একদিন মৃ*ত্যু*র স্বাদ গ্রহন করতে হবে। হবেই হবে। দাদাজানের হাতে হয়তো এতটুকুই নির্দিষ্ট সময় ছিলো। কেউ যে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যরেখা ভেদ করে সামনে আাগাতে পারেনা। দাদাজানও পারেনি।;

“আমাকে নানাজানের কাছে নিয়ে যাবে একবার, যাবে?;

“আজ নয়। তোমার শরীরটা একদমই ঠিক নেই। এই শরীর নিয়ে..;

“না করোনা প্লিজ, আমি যেতে চাই। আমাকে নিয়ে চলো!;

ইশার কান্নারত মুখ দেখে শ্রাবণ চেয়েও না করতে পারেনা আর। শ্রাবণ ভাবে কিছুটা সময়। কি করে ইশাকে বুঝিয়ে রাখা যায়। কিন্তু ইশা তার ভাবনার মাঝেও আরও অসংখ্য বার অনুরোধ করতে থাকে যাওয়ার জন্য। যার দরুণ সে ইশাকে শান্ত করার জন্য আশ্বাস দেয়, তাকে নিয়ে যাবে।

তিনমাসে খান সাহেবের কবরের মাটি অনেকটাই শক্ত হয়েছে। প্রথম দিকে কাঁচা মাটির এক অদ্ভুত গন্ধ পাওয়া যেতো। এখন আর সেই গন্ধ অনুভব হয়না ঘাণেন্দ্রিয়তে।

শ্রাবণ আর ইশা দাঁড়িয়ে আছে কবরস্থানের পাশে। হাতজোড়া একত্র করে একমনে কবর জিয়ারত করছে দু’জনে। শ্রাবণ উপরে উপরে শান্ত স্থীর থাকলেও, ভেতরে ভেতরে তার খুব কষ্ট হয় দাদাজানের জন্য। খান সাহেবের প্রথম নাতি শ্রাবণ। আর প্রথম নাতির জন্য তার টান টা বাঙালিকে আলাদা করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই হয়তো। শ্রাবণের প্রথম কথা শেখা খান সাহেবের কাছে। তার মা সবসময় বলতো, শ্রাবণ নাকি সবার আগে দাদাজান বলে ডেকেছিলো। যার দরুণ তার পরের প্রত্যেক নাতি-নাতনিই তাদের ডাকার সাথে ‘জান’ শব্দটা যুক্ত করে।

শ্রাবণের অক্ষিগোলক ভরাট হয়ে ওঠে নিমিষেই। কিছু মধুর স্মৃতি আজ বড্ড দাগ কেটে যাচ্ছে বক্ষঃস্থলে। ইশা কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। জিয়ারত শেষ করে শ্রাবণ স্নেহের হাতজোড়া বাড়িয়ে দিলো ইশার পানে। ইশা কাঁদতে কাঁদতেই মাথা রাখে তার কাঁধে। শ্রাবণ ওর বাহুদ্বয় আগলে রেখে বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলল,

“কাঁদলে দাদাজান কষ্ট পান। কেঁদোনা প্লিজ।;

ইশার কান্না থেমে গেলো এক নিমিষে। তবে শ্রাবণের কথা শুনে নয়, তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো বলে। ইশার দুর্বল দেহটা ঢলে পড়লো শ্রাবণের বাহুডোরে। শ্রাবণ চমকিত দৃষ্টিতে তাকালো ইশার দিকে। বুকটা কেঁপে উঠলো তার। গলা ছেড়ে বিকট শব্দে ধ্বনিত হলো ইশার নামটা।

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______৪১.

সাতদিনের নতুন বউ নামিরা। সাতদিন পূর্বেই ঘরোয়া ভাবে আরব আর ওর বিয়েটা হয়ে গেছে সবার উপস্থিতিতে। সেখানে ছিলোনা বাড়তে কোনো আনুষ্ঠানিকতা। কেবল কাজি ডেকে, কবুল পড়ে নামিরাকে ঘরে তুলেছে আরব। খান সাহেবের চলে যাওয়ার শোক খান বাড়ি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাইতো, বিয়ের আনন্দের চেয়েও মৃ**ত্যুশোকটা এখনও একধাপ এগিয়ে।

“মা, ইশাকে কি একটু স্যুপ করে দিবো?;

রান্নাঘরে কাজ করছে নামিরা। কাজ করতে করতে হঠাৎ ওর ইশার কথা মাথায় এলো। ক’দিন ধরে ওর শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া একদম কিচ্ছু করছেনা মেয়েটা।

নুপুর বেগম তরকারি কাটছিলো। নামিরার প্রশ্নে তিনি মুখ তুলে তাকালেন।

“হ্যাঁ, বানাও। তবে নিজের নাস্তাটা আগে সেরে নাও তো বাপু। সেই কাক ভোরে উঠে রান্নাঘরে ঢুকেছো।;

“আগে সবার নাস্তা হোক, মা। আমি না হয় আপনাদের সাথেই বসবো।;

নামিরা ভীষণ ঘরোয়া মেয়ে। যেদিন থেকে বিয়ে হয়ে এসেছে এ বাড়ি, নুপুর বেগম একদম হিসেব করে বলতে পারবে, মেয়েটা ঠিক কতটুকু সময় নিজের কথা ভেবে রেস্ট নিয়েছে। আরবের ভাগ্যটা সোনায় বাঁধানো। নয়তো এমন মেয়ে কি এতো সহজে মেলে?

নুপুর বেগম তরকারি কাটতে নিয়েও কয়েক মুহুর্তে মনোমুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো নামিরার দিকে। আফিয়া বেগম আর মরিয়ম বিবিও ওখানেই আছেন। তারা অন্য কাজ করছিলেন। তবে তাদেরও কাজে কিঞ্চিৎ বিরতি এলো নামিরার কথা শুনে। আফিয়া বেগম মৃদু হেসে নামিরাকে বললেন,

“শোন মেয়ে, তোকে আমাদের সাথে মোটেও বসতে হবেনা। তুই ওদের সাথে বসে যাবি। তোকে কিন্তু আমরা মোটেও এতো কাজ করতে দিবোনা এই বলে দিলাম। দু’টো দিন সখে সখে করছো ভালো কথা, কলেজ শুরু হলো পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে হবে, বুঝেছিস?;

শাসনের আড়ালে বুকভরা ভালোবাসা শুধু আফিয়া বেগমই দিতে পারেন। এ কথা আর নতুন নয় নামিরার জন্যে। নামিরা সর্বদাই দেখেছে, কত গভীর ভালোবাসা আফিয়া বেগমের। নামিরা তার কথার জবাব দিলোনা। মনেমনে হাসলো খুব।

“মেজ আপা, মেজ আপার কি হয়েছে ভাইয়া?;

আতংক জড়ানো কন্ঠস্বর তুতুনের। রান্নাঘরে নিমিষেই ভয়াবহ ত্রাস ছড়িয়ে দিলো তুতুনের কথাটি। সবাই একদফা চমকে উঠে একে-অপরের মুখ চেয়ে তাকালো। পরক্ষণেই এক এক করে সবাই ছুটে বেরিয়ে গেলো ড্রয়িং রুমের দিকে।

শ্রাবণ ইশাকে পাঁজা কোলে নিয়ে এসে দাঁড়ালো সোফার সামনে। তুতুনের করা প্রশ্নটিতে তার বক্ষঃপিঞ্জরের নিরব আহাজারি বাড়লো বৈ কমলোনা। ইশাকে শুয়ে দিলো সোফার উপর। তুতুনের দিকে চেয়ে শুঁকনো গলায় ঢোক গিলে বলল,

“পানি নিয়ে এসো।;

তুতুন দৌড়ে গেলো পানি আনতে। ততক্ষণে ড্রয়িং রুমে ভিড় জমে গেলো সকলের। এই সময়ে শমসের সাহেব এবং সাজ্জাদ সাহেবও বাসাতেই ছিলেন।

“কি হয়েছে ওর শ্রাবণ? ও বাবা?;

মরিয়ম বিবির চোখের কোনে স্পষ্টতর জল জমলো। নামিরা ভীড় ঠেলে বসে পড়লো মেঝেতে। ইশার গালে, কপালে বারবার করে হাত ছোঁয়াতে লাগলো।

আফিয়া বেগম আর মরিয়ম বিবিও এসে বসে পড়লেন ইশার কাছে। তুতুন পানি নিয়ে এলো। শ্রাবণ চটজলদি সামান্য পানি নিয়ে ইশার চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলো ভালো করে। কিন্তু তাতে কাজ হলোনা।

“তোরা কোথায় গিয়েছিলি?;

প্রশ্ন করলেন আফিয়া বেগম। কন্ঠে তার বেজায় উদ্বেগ। শ্রাবণ পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করতে করতে অপরাধী গলায় বলল,

“বড্ড জেদ করছিলো মা, দাদাজানের কাছে যাবো যাবো করে! কান্না জুড়লো। এরপর আর কি করে না যেয়ে পারি বলো? তাই…;

রেগে গেলেন আফিয়া বেগম। ধমকের সুরে বলে উঠলেন,

“পাগল হোসনি তো তুই? মেয়েটার শরীরের কথা একবার চিন্তা করবিনা? গত তিনমাস যাবত ম*রা*র মতো হয়ে আছে! তোদের কি বলবো, আমার ভাষা নেই আর।;

শ্রাবণ নতশিরে দাঁড়িয়ে রইলো। শমসের সাহেব বললেন,

“এখন কি চেঁচামেচি করার সময় ? আরব, ডাক্তারকে একটা কল করতো।;

“হ্যাঁ বাবাই, করছি।;

“এখন চেঁচামেচি করোনা। ডাক্তার আসুক, তাকে দেখতে দাও।; শমসের সাহেব আফিয়া বেগমের উদ্দেশ্যে পুনরায় বললেন।

“ভাইয়া, তুমি বসো এখানে, আপা সুস্থ হয়ে যাবে, চিন্তা করোনা।;

তানি এসে শ্রাবণের হাত ধরে একটা সোফায় বসিয়ে দিলো। ফের গেলো পানি আনতে। এক গ্লাস পানি এনে, শ্রাবণের হাতে দিয়ে বলল,

“পানিটা খাও।;

শ্রাবণ মলিন হেসে পানিটা নিলো তানির থেকে। কয়েক ঢোকে পুরোটা শেষ করে খালি গ্লাসটা এগিয়ে দিলো তানির দিকে। তানি সেটা হাতে নিতে নিতে উসখুস করতে লাগলো। শ্রাবণ প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালো তানির পানে। শুধালো,

“কিছু বলবি?;

“হু।; তানি মাথা নাড়ে।

“বল?;

“একটু এপাশে এসো।;

শ্রাবণের মনে সন্দেহের বীজ রোপিত হলো। একবার ইশার সরল নিষ্পাপ মুখটায় নজর বুলিয়ে উঠে গেলো অন্যপাশে। তানিও গেলো তার পিছু পিছু।

“বল?;

“আপার উপর তুমি রাগ করোনা ভাইয়া।;

“কেন? কিসের রাগ!;

শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকালো। তানি ছোট্ট একটা ঢোক গিলে আশেপাশে তাকালো। ফের শ্রাবণের হাত ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল,

“আপা প্রেগন্যান্ট!;

চকিতে তাকালো শ্রাবণ। ক্ষণেই তানির হাত থেকে নিজের হাতটা এক ঝাটকায় ছাড়িয়ে নিলো। অদূরে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকা ইশার পানে পুনরায় তাকালো। তখন তানি আবারও বলল,

“দু’মাস চলছে। আপা কাউকে জানতে দেয়নি। অবশ্য জানাতে চায়নি। ভেবেছিলো তিনমাস অতিক্রম করলে সবাইকে জানাবে। আর কেন জানিনা আপা খুব ভয় পাচ্ছিলো। বারবার বলছিলো, তুমি জানলে খুব রাগবে। বকবে আপাকে!;

শ্রাবণ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো তানির দিকে। জানতে চাইলো,

“তুই কি করে জানলি?;

“আপা এই ক’দিন যাবত অনেক বেশিই অসুস্থ। কিন্তু তুমি বাসায় থাকলে আপা বেশিরভাগ সময় আমার ঘরেই কাটায়। কারন, ও খুব ঘন ঘন বমি করতো। পাছে তুমি টের না পাও, তাই আমার ঘরে এসে বসে থাকতো। একদিন ওর অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হয়ে যায়। আমি তোমাদের সবাইকে ডাকতে গেলে আপা আমাকে আঁটকায়। বলে, তোকে আমার কসম কাউকে ডাকবিনা। তাই আমি আর..;

যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে শ্রাবণের। মেয়েটা এবার নিজেকে শেষ করেই ছাড়বে। তুর্জর সাথে ঐ এক্সিডেন্টের পর থেকে ইশা কম বেশি প্রায়শই অসুস্থ থাকতো। শ্রাবণ ডাক্তারের সাথে রেগুলার কথা বলতে থাকে ইশাকে সুস্থ রাখার জন্য। তখন ডাক্তার একদিন শ্রাবণকে এলার্ট করে ইশার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে। জানায়, বাচ্চা নেওয়ার জন্য যেন তারা বেশি তাড়াহুড়ো না করে। ইশার পাকস্থলীতে বিষের পরিমাণ একটু বাড়াবাড়ি হওয়াতে সবকিছুই খানিক প্যাঁচে পড়ে যায়। যা বাচ্চা নিতে গেলে তারা ফেইস করবে। তাই, ইশার সুস্থ হওয়ার পরেও কিছুটা গ্যাব রেখেই যেন তারা বাচ্চা নেয়। তবে, ইশার যে বড্ড বেশি তাড়া। সেদিন এই বিষয়ে কথা উঠলে এই কারনেই শ্রাবণ হাবিজাবি বুঝায় ইশাকে। এখন সে নিজেকেই বকছে মনেমনে। ইশাকে সবটা সহজ ভাবে বুঝিয়ে দিলে ইশা নিশ্চয়ই বুঝতো।

________

সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। অন্তরীক্ষের লাল হলদে আবরণ পশ্চিমের রূপ বদল ঘটিয়েছে নিদারুণ আকারে। মনোমুগ্ধকর। শ্রাবণের ললাটে গুনে গুনে ঠিক তিনটে ভাজ পড়েছে। সে চিন্তিত। মহা চিন্তায় জমে যাচ্ছে। এমন আনন্দিত, প্রীত আর সন্তোষজনক সংবাদ কোনো দীর্ঘ আঘাত, কোনো দীর্ঘ ঘা দিয়ে যাবে না তো তাদের জীবনে? কেন করলে তুমি এমন ইশুপাখি, কেন করলে? নিজের জেদকে জিতিয়ে কি এমন পেলে?

“একি কি করছো!;

একখানা আতংগ্রস্থ কন্ঠ কর্নপাত হতেই চমকে উঠলো শ্রাবণ। ঘুরে পেছনে তাকাতে তাকাতে কন্ঠের মালিক সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। শ্রাবণ তাকে দেখতে পেলোনা সুষ্ঠু ভাবে। তার পূর্বেই সে সজোরে আঘাত করলো শ্রাবণের হাতে। অমনি শ্রাবণের হাত ফস্কে পড়ে গেলো জলন্ত সিগারেটের শেষাংশ। সিগারেটটা নীচে পড়তে হুঁশ ফিরলো শ্রাবণের। চটজলদি ইশাকে নিয়েই দুকদম সরে গেলো পেছনে। আরেকটু হলেই হাত জ্বলে যেতো ছোট্ট অগ্নিকুণ্ডটায়। শ্রাবণ নিজের বোকামিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কপাল ডলতে লাগলো।

“সিগারেট খাচ্ছো?; ইশার কঠিন স্বর শোনা গেলো।

শ্রাবণের সেসবে কোনো হেলদোল নেই। তার কিছু একটা মনে পড়তেই ইশার হাতটা ছেড়ে সরে গেলো খানিক দূরে। ইশা অবাক হলো। অভিমানে ভারি হলো অন্তস্থল।

“কিছু বলবে?;

“কি হয়েছে তোমার? মুখটা ওমন শুঁকনো লাগছে কেন?;

মেয়েটার মাঝে এতো মায়া কেন? এই যে সামান্য এক প্রশ্ন করলো সে, তাতেও যেন একঝাক মায়া ছড়িয়ে দিলো চারপাশে। আতরের খুশবুর ন্যায় ছড়িয়ে পড়লো সেই মায়া। শ্রাবণ পারবেনা ওর সাথে রেগে না অভিমান করে থাকতে। বড্ড দুর্বল সে এই জায়গাটায়।

“যা বলতে এসেছো বলে চলে যাও। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।;

শ্রাবণ বড্ড পাষাণ, আর বরাবরই এই পাষাণ মনোভাব সে আঁকড়ে বসে থাকতে পারে। এতে ইশার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এমনিতেই অপরাধবোধে কারোর দিকে তাকাতে পারছেনা ও। তারউপর শ্রাবণের এই তীব্র অভিমান কি করে ভাঙাবে ও?

“তুমি কি খুব রেগে আছো?;

“রেগে থাকবো কেন? কি এমন করেছো যে আমাকে রেগে থাকতে হবে?;

ইশা থমকায়। শ্রাবণ হয়তো ওর মুখে শুনতে চাচ্ছে ওর করা ভুলের কথা। ইশা বলতে রাজি, কিন্তু এরপরের যে ঝড় ওর জন্য অপেক্ষা করছে, সেটা কি করে সামলাবে?

“আমাকে প্লিজ মাফ করে দাও, আমি হয়তো একটু বেশিই করে ফেলেছি! আমার অবশ্যই ধৈর্য্য ধরা উচিৎ ছিলো। আ্ আমি অনেক ডেস্পারেট হয়ে পড়েছিলাম। আ.. আমাকে ক্ষমা করে দাও…;

কান্নায় সিক্ত হলো তার মায়াবী নেত্রদ্বয়। শ্রাবণ তবুও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে গলবে না, একবিন্দুও নয়।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে