ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
371

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_______২৪.

সবাইকে হল রুমে বসালেন আতাউল সাহেব। ভেতরে আসতে আরও অনেক জনের সাথে পরিচয় হলো সবার। নিশালার দুই খালা-খালু, দুই ফুপা-ফুপি, বড় ভাই, মা এবং দুই মামি। আরও দেখা গেলো অনেককে। যাদের সাথে স্বল্প পরিচয় হলো। হল রুমে বড় বড় তিন খানা সোফা ধরেছে। খান পরিবারকে সেখানেই বসালো। বসানোর সঙ্গে সঙ্গে জুস এবং সঙ্গে হালকা কিছু মিষ্টি খাবার নিয়ে হাজির তিন চারজন কাজের লোক। খাবার গুলো রেখে যেতেই সবাইকে হাতে হাতে তুলে দিলো তারা।

“কত বছর পর আমার বন্ধু আমার বাড়িতে পা রেখেছে। আদর আপ্যায়নের যেন কোনো কমতি না হয়, দেখো তোমরা।;

খোরশেদ সাহেবের বানী শিরোধার্য করলো সকলে। আতাউল সাহেব, রফিস সাহেব, সফিক সাহেব, দুই ফুপা লোকমান সাহেব এবং ফারুক সাহেব, দুই খালু রবিউল সাহেব এবং আসিফ সাহেব সবাই একসাথেই মস্তিষ্ক নীচু করে বুঝালো তা। খোরশেদ সাহেব স্মিত হাসি হেসে মাথা নাড়লো। অতঃপর খান সাহেবের পানে চেয়ে বলল,

“নাতি-নাতনিদের সাথে পরিচয় করাবি না?;

খান সাহেব মাথা ঝাঁকান। প্রথমে বসে ছিলো আরব আর তুতুন। তাই তিনি ওদের দিকে আঙ্গুল ইশারা করে বললেন,

“আমার ছোট ছেলের এক ছেলে আরব আর দুই মেয়ে তুতুন আর তানি। আর এই যে আমার বড় ছেলের একমাত্র লাটসাহেব, আমাদের রাজপুত্র শ্রাবণ। ওর পরে এক মেয়ে, তিতির। বিয়ে দিলাম কিছু দিন আগেই। আপাতত শশুর বাড়িতে। আর এটা আমাদের সবচেয়ে আদরের দুলালি আমাদের ইশানি, মরিয়মের একমাত্র মেয়ে।;

সবার পরিচয় করানোর সাথে সাথে খোরশেদ সাহেবের দিকে চেয়ে ছোট্ট একটা হাসি উপহার দিয়েছে। কিন্তু শ্রাবণ পারেনি। তার এসব কান্ডই উদ্ভট লাগছে। হাসি তো দূর সে একবারও তাকায়নি খোরশেদ সাহেবের দিকে। চরম বির*ক্ত হচ্ছে সে। খোরশেদ সাহেব খান সাহেবের ভালো বন্ধু ছিলেন শুনেছে সে। তবে এতেটাও ভালো বন্ধু ছিলেন না যে, এক বেলা এসে চেটেপুটে খেয়ে যাবে।

“শ্রাবণ দাদুভাই, তুমি তো একদমই কিছু মুখে তুললেনা!;

শ্রাবণের হুঁশ ফিরলো কারোর ডাকে। ডাকের উৎস বরাবর তাকাতে খোরশেদ সাহেবের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা দেখতে পেলো সে। না চাইতেও জোর পূর্বে হাসতে হলো। হেসেই জবাব দিলো,

“জি খাচ্ছি।;

ফর্মালিটি করে বললেও কিছুই মুখে তুললো না শ্রাবণ। খোরশেদ সাহেব আর এই নিয়ে পিছু পড়লোনা শ্রাবণের। নিলাশার ভাইকে আরাফকে ডেকে পাঠালো। আরাফ নিলাশার বড় ভাই। অনার্স শেষ বর্ষে পড়াশোনা করছে।

“হ্যাঁ দাদু, বলো?;

“এসো দাদুভাই। তোমার সঙ্গে তো কারোর পরিচয়ই হলোনা।;

আরাফ নিতান্তই শান্ত স্বভাবের একজন ভদ্র ছেলে। দাদুর কথা মোতাবেক সে স্মিত হেসে তার পাশে বসলো। খোরশেদ সাহেব শ্রাবণকে দেখিয়ে তার উদ্দেশ্যে ক্ষীণ কন্ঠে শুধালো,

“মানাবে বোনের সাথে?;

আরাফ মুচকি হাসলো। সম্মুখে বসে থাকা এই হিরো মাফিক ছেলেটাকে তার বোনের পাশে সবচেয়ে বেশি মানাবে। আরাফের মুখের হাসিই জবাব হলো খোরশেদ সাহেবের প্রশ্নে।

“বাকিদের সাথেও পরিচয় হও দাদুভাই।;

আরাফ ভদ্র সূচক হেসে সবাইকে হাই হ্যালো জানালো। সবাই তার তালে তালে হাই হ্যালো দিলো।

“যাও বোনকে নিয়ে আসতে বলো।;

আরাফ মাথা নেড়ে চলে গেলো। বাচ্চারা বোরিং হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই। এতো গুরুজনদের মাঝে ঠিক মিলমিশ ঘটাতে পারছেনা। তাই এখান থেকে পালানোর রাস্তা খুঁজছে। তানি এবং তুতুন সুযোগ পেতেই উঠে চলে গেলো। যেতে পারলোনা ইশা। কারন সে এখন ততটাও বাচ্চা নয়।

নীল শাড়িতে নীলাঞ্জনা। এক নীলাম্বরী হাজির হলো উপস্থিত মহলে। নীল শাড়ি পরহিতা মেয়েটিকে দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতিতে বুক জ্বালা করতে লাগলো ইশার। ওর বোরিং,বির*ক্তির মুখখানা শুকিয়ে গেলো। মেয়েটা ভয়ানক সুন্দরী। যাকে এক কথায় কোনো অপ্সরার সাথে তুলনা করা যায়। গায়ের রঙখানা চমক দিচ্ছে। হাতে সোনার বালা জোড়া এতো সুন্দর ফুটে উঠেছে যে চোখ ধরে আসে। ইশার মাথায় অদ্ভুত এক খেয়াল এলো। বার কয়েক চোখের পলক ঝাপটে পাশ ফিরে তাকালো। সবার ধাঁধানো চোখ নিলাশার প্রতি। শ্রাবণও কি তাই? তড়াক করে মাথা ঘুরিয়ে ইশা বিপরীত পাশে তাকালো। শ্রাবণ ফোন ঘাঁটছে। কপাল খানায় বির*ক্তির স্পষ্ট রেখা দৃশ্যমান। জ্বলে থাকা স্ক্রিনের আলো আঁচড়ে পরেছে তার গৌরবর্ণ মুখশ্রীতে।

“এসো এসো, অবশেষে রাজকন্যার দেখা মিলল।;

শমসের সাহেবের উচ্ছ্বসিত গলা শোনা গেলো। আতাউল সাহেব এবং আসিফ সাহেব উঠে গিয়ে মেয়েকে এনে বসালেন একটা সিঙ্গেল সোফায়। নিলাশা বিনা বাক্য ব্যয়ে বসলো সবার সামনে। নতশির, ভেতরে ভেতরে দম ফাটছে ওর।

খোরশেদ সাহেবের বলাতে নিলাশা কোমল স্বরে সালাম দিলো সবাইকে। খান পরিবারের প্রত্যেক সদস্য সাদরে সালামের জবাব দিলো। নুপুর বেগম বেশ আনন্দিত। শ্রাবণের সাথে কতটা ভালো মানাবে নিলাশাকে ভাবতেই আনন্দে গদগদ করছেন তিনি। পরীর মতো দেখতে মেয়েটা ক’দিন বাদে তাদের সারা বাড়িময় পায়চারি করে বেড়াবে।

মরিয়ম বিবি মলিন হেসে তাকিয়ে আছেন নিলাশার পানে। ইশা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে প্রতি মুহুর্তে তার কেন যেন মনে হতো ইশা আর শ্রাবণ দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। বিশেষ করে শ্রাবণ, পাগলের মতো করেছে প্রতিটা মুহুর্তে। আফিয়া বেগমের হাত ধরে ছোট্ট বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে শব্দ করে! এসব কি শুধু র*ক্তের সম্পর্কের দায়ে? জানেন না তিনি!

“দেখো গিন্নি, মাশা-আল্লাহ। একটা নীলপরি বসে আছে আমাদের সামনে।;

আফিয়া বেগম কেঁপে উঠলেন। হয়তো হাতে আর মাত্র কয়েক সেকেন্ডই বেঁচে আছে। তার পাগল ছেলে এই যে চিৎকার করে উঠলো বলে।

ইশা আর শ্রাবণ অবাক নয়নে তাকালো খোরশেদ সাহেবের দিকে। একটু আগে তার বলা কথাটা ঠিক কিভাবে নিবে ওরা, বুঝতে পারছেনা যেন। তিনি এক অবিশ্বাস্য বানী শুনিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে ইশা আর শ্রাবণের।

“আমি কিন্তু আজই শ্রাবণ আর নিলাশার এনগেজমেন্টটা সেরে ফেলতে চাই ‘খান। তোর কোনো আপত্তি নেই তো? পছন্দ হয়েছে তো আমার নাতনিকে?;

-“হোয়াট?;

শ্রাবণের শান্ত স্বরে করা প্রশ্নটি একটা গম্ভীর পরিস্থিতি তৈরি করে দিলো মহলে। এনগেজমেন্টের কথা শুনে নিলাশার মা সহ সকল মহিলাগন এসে উপস্থিত হলো এখানে। শ্রাবণের কথায় তারাও কিঞ্চিৎ বিস্মিত। তবে এই বিস্ময় অন্য ভাবনাতে। এমনটা নয় যে, তারা জানেনা শ্রাবণ আগে থেকেই সবটা জানেনা।

খোরশেদ সাহেব মৃদু হেসে বললেন,

-“কেন দাদুভাই, তুমি কি চাওনা আজই তোমাদের এনগেজমেন্টটা হোক? আমরা কিন্তু সবাই চাই। তোমার দাদাজানকে দেখো? কেমন হা করে দেখছে তোমার হবু বউকে!;

মস্তিষ্ক ধপ করে জ্বলে উঠলো শ্রাবণের। তার নরম মুখের আদল মুহুর্তেই শক্ত হয়ে গেলো। খান সাহেবের দিকে তাকাতে তাকাতে তার দৃষ্টিতে বি*স্ফোরক অনুভূতি নেমে এলো।

“চাইবে না কেন আঙ্কেল? অবশ্যই চাইবে।;

বলতে বলতে অপ্রস্তুত মূলক হাসলেন শমসের সাহেব। ব্লান্ডারটা তো তিনি করেছেন ছেলেকে কিছু না জানিয়ে। এখন শ্রাবণের এই অদ্ভুত দৃষ্টি খানা কি করে স্বাভাবিক করবেন তিনি?

আফিয়া বেগমের বুক কাঁপছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। কি হবে? কাকে আঁটকাবেন তিনি? ছেলেকে নাকি স্বামীকে!

এক বিশ্রী অনুভূতি হতে লাগলো ইশার! তবে কি এই পরীর মতো দেখতে মেয়েটা ওর শ্রাবণ ভাইয়ের বউ হবে? এটা ও নিজের চোখে কিভাবে দেখবে? কিভাবে সহ্য করবে?

“তাহল, শুরু করা যাক?;

আনন্দে উপচে পরছে আতাউল সাহেবের গলা দিয়ে। তিনি তার বউয়ের পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে ইশারা করলেন কিছু। নিলাশার মা যেতে যেতে সঙ্গে তার এক বোন এবং নিলাশার ছোট ফুপিকে নিয়ে গেলো।

শমসের সাহেব এবং সাদ্দাত সাহেব একত্রে মাথা দুলিয়ে বলল,

“হ্যাঁ আঙ্কেল। শুরু করা…;

“এক মিনিট বাবা!;

থেমে গেলেন শমসের সাহেব এবং সাদ্দাত সাহেব। শ্রাবণ বাবার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। অবিশ্বাস্য স্বরেই শুধালো,

“হোয়াটস গোয়িং অন বাবা?;

“শ্রাবণ, কি হচ্ছে? এসব কথা বলার সময় পরে অনেক পাবে। এখন থামো।;

গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন খান সাহেব। তিনি অবাক হয়ে যাচ্ছেন নাতির আচরণ দেখে। জেনেশুনে কি বোকার মতো আচরণ করে যাচ্ছে তখন থেকে!

“না দাদা, তুমি ভুল ভাবছো। এসব কথা বলার সময় পরে কেন কখনোই হওয়া ফেয়ার ছিলোনা! আমরা এখানে কেন এসেছি? টেল মি দ্য ট্রুথ!;

খান সাহেবের কপালের মাঝে ভাজ দেখা গেলো। অবাক বিস্ময়ে তিনি শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করতে পারলেন,

“মানে?;

“শ্রাবণ, নিলাশাকে আমরা তোমার জন্য পছন্দ করেছি বাবা। আজ ওকে দেখতেই এখানে এসেছি আমরা। আমরা সবাই চাই, তুমিও ওকে পছন্দ করো। আর দেখো ওকে পছন্দ না হওয়ার কোনো কারন নেই। এতো সুন্দর একটা মেয়ে, আর ওর আচার-আচরণও ভীষণ…;

বাবাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো শ্রাবণ।

“হাউ রিডিকিউলাস!;

চাপা ক্ষোভে ফেটে পরলো শ্রাবণ। শব্দটা উচ্চারণ করেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো সে। আফিয়া বেগম আঁতকে উঠে নুপুর বেগমের হাত খামচে ধরলেন। উপস্থিত মহলের সবাই হতবাক নয়নে তাকালো শ্রাবণের পানে। শমসের সাহেব, সাদ্দাত সাহেব একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। বাকিদের সবার দৃষ্টিতেই অবাকের রেশ ঝেকে বসলো।

“কি হলো দাদুভাই? খান? শমসের? কোনো সমস্যা হয়েছে?;

আশ্চর্যান্বিত হয়ে প্রশ্ন করলেন খোরশেদ সাহেব। আতাউল সাহেব, রফিক সাহেব, সফিক সাহেব এবং মেয়েপক্ষের বাকিরাও বিস্ময়কর দৃষ্টিতে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

“শ্রাবণ, বসো এখানে। বসো বলছি।;

“তোমরা আমাকে না জানিয়ে আমার বিয়ে পাকা করে ফেলেছো। দ্যাটস আ নাইস থিংস দাদাজান। বাট আই এম সরি টু স্যে, আমি তোমার বড় ছেলে নই!;

“শ্রাবণ!;

গর্জে উঠলেন শমসের সাহেব। সাদ্দাত সাহেব অবাক নয়নে তাকালেন স্রেফ। তার মুখ থেকে কোনো কথা এলোনা।

“নো বাবা। এই কথাটা তুমিও ভালো করে জেনে রাখো!;

“কি হচ্ছেটা কি এখানে?;

অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন খান সাহেব। নিজের বাল্যকালের বন্ধুর সামনে নিজের সম্মান সচক্ষে ভেসে যেতে দেখছেন তিনি।

“সাদ্দাত ওকে বসতে বল প্লিজ। বাইরে আমাদের একটা সম্মান আছে, ও কি ভুলে যাচ্ছে সেটা!;

সাদ্দাত সাহেব শ্রাবণকে কিছু বললেন না। তিনি ভাইকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।

“তুমি তোমার ছেলেকে কিছু বলোনি শমসের?;

রাগে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছেন খান সাহেব। দাঁতে দাঁত চেপে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন। বাবার রাগান্বিত গলা শমসের সাহেবের কাছে মৃ/ত্যু সমতূল্য। তিনি ভড়কে গেলেন। কাঁপা গলায় বললেন,

“না বাবা! সময় মেলেনি!;

“সময় মেলেনি ফাজলামো করছো? একঘর বাইরের লোকের সামনে তোমার ছেলের এই অপমানসূচক কথা গুলো শুনতে সময় মিলছে তো?;

ভয়নাক রকমের রেগে গেলেন খান সাহেব। খান পরিবার এক নিমিষে মুষড়ে পড়লো আতংকে। খান সাহেবকে এতোটা রাগতে বোধহয় ত্রিশ বছর পূর্বেই একবার দেখেছিলো সবাই।

“খান, শান্ত হ। কি করছিস?;

খোরশেদ সাহেবের কথায় রা*গের আগুনে আরও ঘি পরলো যেন। তিনি শান্ত হতে পারলেন না। উল্টে আরও রাগলেন। কিন্তু মুখে কিছু বলার পূর্বে খোরশেদ সাহেব শ্রাবণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,

“দাদুভাই, তোমার কি আমার নাতনিকে পছন্দ হয়নি?সমস্যাটা আমাকে খুলে বলো। আমি তোমাকে সমাধান দিচ্ছি।;

শ্রাবণ অসহায় চোখে তাকালো দাদাজানের দিকে। মানুষটা অসুস্থ হয়ে পরবেন হয়তো তার এই জবাবে। কিন্তু, এ ছাড়া আর কোনো উপায় এই মুহুর্তে তার জানা নেই।

“আমি আপনার নাতনি কেন, কাউকেই পছন্দ করতে পারবোনা। কারন আমি.. আমি ইশাকে ভালোবাসি। যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি, ঠিক সেদিন থেকেই। জানিনা ঠিক কত বছর, কত মাস, কত সপ্তাহ কিংবা কত দিন! হিসাব করে রাখলে হয়তো এই দাবীতে বিশেষ প্রাইজ জিতে নিতে পারতাম। বিশ্বাস করুন, এক মুহুর্তের জন্যও ওকে ছাড়া দ্বিতীয় কারোর কথা ভাবতে পারিনি আমি। কারোর কথা না।;

স্তব্ধ হয়ে গেলো গমগম পরিবেশ। মুখে হাত চাপলেন আফিয়া বেগম। মরিয়ম বিবি রিয়াকশন দিতে ভুলে গেলেন। নুপুর বেগম বড় বড় চোখে তাকালো শ্রাবণের দিকে। শমসের সাহেব, সাদ্দাত সাহেব, খান সাহেব এমনকি আরবও! সবার কানের পাশ থেকে ভো শব্দ করে যেন কিছু উড়ে গেলো। সর্বশেষ ইশা! ওর মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেলো ক্ষণেই। এতক্ষণ ঝৈঝামেলা এক মুখী হয়ে দেখলেও ক্রমশ সবার দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ হতে মস্তিষ্ক আরও ভোঁতা হতে লাগলো।

খোরশেদ সাহেবের পরিবারের মাঝে গুঞ্জন শুরু হলো। তাদের হাসি হাসি মুখে মুহুর্তেই চটলা পরে গেলো শ্রাবণের কথায়। অনেকের বাঁকা দৃষ্টি এসে পরলো ইশার প্রতি। শ্রাবণ কারোর তোয়াক্কা না করে ইশাকে হেঁচকা টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো। মিশ্র এক অনুভূতি ঝড় তুলেছে দু’জনের ভেতেরই। ইশার চোখ ভিজে উঠেছে প্রায়। যা দেখে শ্রাবণ ধমক দিয়ে বলে উঠলো,

“কান্না ছাড়া আর কিছু পারিস না?;

ইশা ফুঁপিয়ে উঠলো। শ্রাবণ আবারও বলল,

“আজই আমাকে বিয়ে করতে হবে! পারবি?;

ইশার কান্না থেমে গেলো। কিছু বলবে তার পূর্ব পূণরায় শ্রাবণ বলে,

“দুমনা হয়ে কোনো জবাব দিবিনা। যদি এই সমাজ আর পরিবারের বাইরে ভাবতে পারিস তবেই জবাব দিবি। চেয়ে দেখ, এখানে পঞ্চাশজন মানুষের প্রত্যেকেই আমাদের বিরূদ্ধে। এখন তোর জবাব কি ‘না’ হবে?;

ইশা এবারও জবাব দিতে পারলোনা। শমসের সাহেব তেড়েমেরে উঠলেন। তেড়ে এসে শ্রাবণের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,

“অনেক হয়েছে! বাকি কথা বাসায় গিয়ে হবে।;

শ্রাবণ শান্ত ভঙ্গিতে নিজের হাত থেকে বাবার হাতটা ছাড়িয়ে দিলো। পকেট হাতড়ে একটা বক্স বের করলো। লাল রঙের ছোট্ট একটা বক্স। শমসের সাহেব আঁতকে উঠলেন,

” এতে কি? কি আছে এতে?;

জবাব দিলো না শ্রাবণ। বক্সটা খুলতেই একটা সোনার আংটি জলজল করে উঠলো। দূর হতে আফিয়া বেগম কান্নাভেজা চোখে মৃদু হাসলেন।

শ্রাবণ ইশার হাতটা টেনে নিয়ে আংটিটা পরিয়ে দিয়ে খালি বক্সটা বাবার হাতে ধরিয়ে দিলো। শমসের সাহেব এবার নির্ঘাত হার্ট এট্যাক করবেন। একি অসভ্যতা শুরু করেছে তার ছেলে?

পরক্ষণেই, ইশার হাত ধরে ধীরপায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো শ্রাবণ। একঘর লোক স্রেফ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো ওদের যাওয়ার পানে।

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব____২৫

“এসব প্রেম ভালোবাসা এই খান পরিবারে আগেও হয়নি, এখনও হবেনা।;

খান সাহেবের কাঠকাঠ গলা। বয়স বেড়ে চামড়ায় ভাজ পরলেও সবসময়কার মতো ভারী কন্ঠখানা তার একটুও নরম হয়নি। পূর্বের সেই তেজ, সেই ঔদ্ধত্য এই টুকুও যায়নি। তারউপর খোরশেদ সাহেবের নাতনির সাথে শ্রাবণের বিয়ে ভাঙাতে ক্ষোভ প্রকাশ করতে ছাড়েননি খোরশেদ সাহেব। ছোট বড় অনেক অপমান মুখ বুজে সহ্য করে ফেরত আসতে হয়েছে তাদের।

“এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে আমার তেমন কোনো অসুবিধা হবেনা দাদাজান। ইশাকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমি ভালো ভাবেই পালন করতে পারবো। এটা ভেবোনা, আমি এই খান পরিবার ছাড়া অচল!;

কন্ঠে দৃঢ়তা এখনও একই শ্রাবণের। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালেন শমসের সাহেব। দাদাজানের সাথে কথা বলার ভদ্রতা টুকুও ভুলে গেছে তার ছেলে। ইচ্ছে করছে লাঠি পেটা করতে।

“শোনো তোমার ছেলের কথা! এতকাল ধরে এই শিক্ষায় বড় করেছো একে!;

হাসফাস করছেন খান সাহেব। শ্রাবণ প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ল। কিছু একটা ভেবে এগিয়ে এসে দাদাজানের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। খান সাহেব তাকে সরিয়ে দিতে চাইলে শ্রাবণ জোর করে তার হাত ধরে রাখে। ঠোঁটের কোনে এঁটে দেয় মৃদু হাসির রেখা। অতঃপর লম্বা নিঃশ্বাস টেনে বলতে শুরু করে,

“আমি আমার বাবার শিক্ষায় বড় হয়নি দাদাজান। আমি তোমার শিক্ষায় বড় হয়েছি। এই যে ভালোবাসার প্রতি জেদটা দেখছো, এটাও তোমার থেকেই শিখেছি। তুমি বলতেনা, একসাথে দশটা কাজ হয়না। তেমন একসাথে দশজনকেও রাখা যায়না। ভালোবাসো একজনকেই, এবং সঙ্গে রাখো সেই একজনকে। দুনিয়া এফোড় ওফোড় হয়ে যাক নিজের অধিকারে কখনও আরেকজনের কুদৃষ্টি সহ্য করবেনা। যে জিনিস তোমার সেটা কেবলই তোমার থাকুক। আমি আর কারোর মতো হতে পারিনি দাদাজান। আমি শুধু তোমার প্রতিরূপ। শুধু পার্থক্য আমাদের ভাবনাটুকু। তুমি ভালোবাসার মতো এতো সুন্দর গীতিটাকে জঞ্জাল ভাবছো। তুমি সুন্দর পবিত্র প্রণয়কে শ্রীহীন দূষিত ভাবছো! তোমার ভাবনাটা ভুল দাদাজান৷ ভালোবাসা অপবিত্র নয়, ভালোবাসা শ্রীহীন দূষিত নয়। ভালোবাসা পবিত্র দাদাজান।;

একরাশ নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে গেলো সারা ঘরময় জুড়ে। খান সাহেব অবাক হয়ে শুনছিলেন শ্রাবণের কথাগুলো। শ্রাবণ থামতে তার প্রসন্ন মুখে ভাটা পরলো। থামলো কেন শ্রাবণ? আরও কি কিছু বিশ্লেষণ করা যায়না?

খান সাহেবের মন নরম হওয়ার আচ বুঝি শ্রাবণ পেয়ে গেছে। পলকহীন চেয়ে রইলো দাদাজানের অবনত দৃষ্টির পানে। খান সাহেবের ন্যায় শমসের সাহেব এবং সাদ্দাত সাহেবও চুপ হয়ে গেলেন। নুপুর বেগম আফিয়া বেগম একজন আরেকজনের হাত ধরাধরি করলেন। সাদ্দাত সাহেব শমসের সাহেবের কাঁধে হাত চেপে বললেন,

“বেটার ভালোবাসার দম আছে ভাইজান।;

শমসের সাহেব আর রেগে থাকতে পারছেন না ছেলের প্রতি। ভালোবাসলে বুঝি এমনই আগলে রাখতে জানতে হয়। তিনিও যদি একটু চেষ্টা করতেন, তাহলে হয়তো আজ তার প্রথম প্রেম থেকে যেতো।

মরিয়ম বিবি দূরে দাঁড়িয়ে মলিন হাসলেন। তিনি ভুল ছিলেন না। শ্রাবণ তার পাগলী মেয়েটাকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসে। আর এই ভালোবাসার ভীষণ জোর। তার কাঠখোট্টা বাবাকেও নরম করে ফেললো ছেলেটা। সাধুবাদ জানাতে হয়।

“ইশানিকে ডাকো।;

বাসায় ফেরার পর থেকে আর ইশার মুখ দেখেনি কেউ। দাদাজানের ক্রোধান্বিত মুখশ্রী দেখার মনোবল ওর নেই। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে সে।

শ্রাবণের বুঝানোতে ঠিক কতটুকু বুঝলো খান সাহেব? ধরা গেলোনা। নুপুর বেগম দোতলায় গেলেন ইশাকে ডাকতে। খানিক বাদে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়েও এলেন ওকে। ভয়ে কদম ফেলতে পারছেনা ইশা। এখন কি সবাই মিলে ওকে বকবে? পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ যে ওদের বিরুদ্ধে! কি হবে ওদের ভাগ্যে?

“দ্ দাদাজান!;

বিচলিত গলায় ডাকলো ইশা। খান সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন। শ্রাবণ তার পাশেই বসে আছে নত মস্তিষ্কে। সবার মুখই কম বেশি গম্ভীর। সবার এমন ভাবমূর্তি ইশার আত্মা অব্দি কাঁপিয়ে তুললো। কি হতে চলেছে? কি হবে? মাথা ঘুরছে ওর। ভাবতে পারছেনা কিছু।

“এদিকে এসো।;

কেঁপে উঠলো ইশা। শ্রাবণ আঁড়চোখে দেখছিলো ইশাকে। ভীষণ ভ/য় পাচ্ছে বেচারি। ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে হাত ধরে নিয়ে আসতে।

ইশা কম্পিত মনে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। খান সাহেব সামনের খালি সোফাটায় ইশারা করে বসতে বললেন। বসলো ইশা। বারবার ঢোক গিলছে শুঁকনো গলায়। কারোর মুখের দিকে তাকানোর দুঃসাহস করতে পারছেনা। ঠিক তখনই কঠোর গলায় বলে উঠলেন খান সাহেব,

“যা জিজ্ঞেস করবো একদম সোজাসাপ্টা জবাব দিবে!;

“জ্ জি নানাজান।; (ভয়ার্ত গলায়)

“এই পাগলকে কবে থেকে পছন্দ করো?;

ইশার বুকের ভেতরটায় শব্দ করে ঢোল পিটিয়ে উঠলো কেউ। জ্বলে যাচ্ছে ভেতরটা। মুহুর্তেই ঢোক গিললো পূণরায়। গলা ধরে আসছে ওর।

“আগেই বলেছি একদম সোজাসাপ্টা উত্তর চাই!;

“ক্ কবে থেকে আমি জানিনা নানাজান। হয়তো যেদিন থেকে দুনিয়ার ভালোমন্দ বুঝতে শিখেছি। সেদিন থেকেই মনে হয়েছে শ্রাবণ ভাইকে আমি ভ্ ভালোবাসি।;

শ্রাবণের শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেলো ইশার জবাবে। ঠিক মেরুদণ্ড হয়ে ফুড়ুৎ করে দৌড়ে নেমে গেলো শীতল র*ক্তস্রোতের ধারা। তৃপ্তি দ্বায়ক হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের কোন জুড়ে।

হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়লেন খান সাহেব। রাগতে চাইলেন ভীষণ। কিন্তু এই মায়াভরা মুখ দুটো তার ভেতরটা ক্রমশই উদ্বেগরহিত করে দিয়ে যাচ্ছে। চেয়েও পারছেন না ওদের বিরোধিতা করতে। মন বলছে চুলোয় যাক খোরশেদ আর ওর অপমানজনক কথা। সে তার পরিবারে সুখ সচক্ষে দেখতে চায়। তার একটু একটু করে যত্নে তৈরি করা সুখের সংসার। তিনি কোনো মূল্যেই হারাতে চান না। আজ বড় অপরাধবোধ হচ্ছে তার বড় ছেলের কথা ভেবে। নিজের জেদের জন্য ছেলেটাকে কতটা কষ্ট দিয়েছিলেন তিনি। ধিক্কার জানান তিনি নিজেকে। আর যাই হোক, কোনোদিন ছেলের চোখে আর বেস্ট বাবা হতে পারবেন না তিনি। কোনোদিন না।

“আগামী শুক্রবার খান বাড়ির এ যাবত কালের সবচেয়ে বড় এবং এলাহি আয়োজনে আমি তোমাদের চারহাত এক করে দিতে চাই। আমি তোমাদের সুখ চাই, আর কিছু না।;

নিঃশব্দে একটা বি*স্ফো*র*ণ ঘটলো খান সাহেবের সিদ্ধান্তে। সবাই মুখে কিছু বলতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে যেন চিৎকার করে উঠলেন আনন্দে। ইশা স্তব্ধ হয়ে গেছে। শ্রাবণও তাই। দাদাজান এতো সহজে ব্যাপারটা মেনে নেবেন, আদৌও ভাবেনি কেউ।

খান সাহেব লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আনোয়ারা বেগম স্বামীর উঠে দাঁড়ানো দেখে সেও উঠে পরলো। খান সাহেব ধীর পায়ে হাঁটা ধরলেন রুমের দিকে। আনোয়ারা বেগম তার পিছু পিছু। সবাই তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। যেইনা দু’জন রুমের ভেতরে চলে গেলো অমনি আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলো আরব। সাদ্দাত সাহেব এক লাফে ষোল বছরের কিশোরে পরিনত হলো। হৈ হৈ করতে করতে শিষ বাজালেন। শমসের সাহেব দূর থেকেই মুচকি হাসলেন। নুপুর বেগম নাচছেন রীতিমতো। আফিয়া বেগম মরিয়ম বিবির কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে। সবার নাচনকোঁদন দেখে হেসে উঠলো শ্রাবণ। ইশা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো সবার নাচানাচি দেখে। ওর পক্ষে এই মুহুর্তে আর এখানে বসে থাকা সম্ভব নয়। তাই সবার চোখের আড়াল হয়ে চলে গেলো নিজের ঘরে।

“এতো কিছু ঘটে গেলো!;

নামিরার অবাকিত গলা শুনে ইশা লজ্জা মিশ্রিত হাসলো। বাঁ হাতের অনামিকা আঙুলটায় জ্বলজ্বল করছে শ্রাবণের পরিয়ে দেওয়া সোনার আংটিটা। সেদিকেই স্থীর দৃষ্টি রেখে লজ্জা মিশ্রিত গলায় বলল,

“হ্যাঁ রে। আমার এখনও নিজেকে পাগল পাগল লাগছে জানিস।;

“আর পাগল পাগল লেগে লাভ নেই মেরি জান। এবার প্রাকটিক্যালি পাগল হওয়ার জন্য রেডি হও।;

আঁতকে উঠলো ইশা। ধমকের সহিত বলল,

“নির্লজ্জ মেয়ে, মুখে কিছু আঁটকায় না?;

“আঁটকাবে কেন? জাস্ট ইমাজিন ইশুপাখি, আর সাতদিন বাদে তুই শ্রাবণ ভাইয়ের বউ হয়ে যাবি। তারপর থেকে রোজ তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবি। কথায় কথায় লজ্জায় আঁচড়ে পরবি তার বুকে। আর শ্রাবণ ভাইকে আমি যতটা চিনেছি সোনা, সে তোমাকে একটা দিনও শান্তিতে থাকতে দিবেনা!;

কান জোড়া যেন ধ্বসে পরলো ইশার। বুকের ভেতরটায় কেউ ধুম ধুম করে ইট ভাঙছে বলে মনে হচ্ছে। এই অসভ্য মেয়েটা দিনকে দিন বড্ড পাঁজি হয়ে যাচ্ছে। কোনো কথায় যদি লাগাম থাকতো।

কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিলো ইশা। বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। যা ও ভাবতেও পারছেনা, সেটাই নামিরা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্লেষণ করে দিচ্ছে।

ফোনটা বিছানার উপর ফেলে গলা থেকে ওড়নাটা খুলে বিছানায় ফেলতেই কেঁপে উঠলো কারোর গভীর স্পর্শে। শ্রাবণ এসেছে। ইশা কেঁপে উঠে পেছন ফিরতেই শ্রাবণ নাক ডুবিয়ে দিলো ইশার খোলা চুলে। দু’হাতের মাঝে বন্দি করলো তার মনোহারিণীকে।

“ইশুপাখি..;

শ্রাবণের ক্লান্তস্বর। লজ্জা মিশ্রিত অনুভূতির সাথে এই ভয়ানক অনুভূতিটা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো ইশার। কাঁপা কাঁপা গলায় ঢোক গিলে জবাব আওড়ালো,

“আমাদের কি সত্যি সত্যি বিয়ে হবে শ্রাবণ ভাই?;

“হুম।;

“তুমি কি হ্যাপি?;

“ভীষণ। আর তুই?;

“জানিনা। অদ্ভুত সব অনুভূতিদের যাঁতাকলে পিষে যাচ্ছি আমি। খানিক ভয়, খানিক অস্থিরতা.. কেমন কেমন অনুভূতি।;

শ্রাবণ নিঃশব্দে হাসলো। ইশাকে আরেকটু টেনে নিলো নিজের বক্ষদেশে। হাতের ছোঁয়া আরেকটু গভীর করে বলল,

“আই এম সরি পাখি!;

“ক্ কেন?;

“তোকে আমি ভ*য়ানক রকমের ভালোবাসি।;

“জানি তো। তবে সরি টা কিসের জন্য?;

“জানিনা।;

“তুমি এখনও সেদিনের কথা ভাবছো?;

শ্রাবণের হাতের বাঁধন আলগা হলো। ইশা সেই সুযোগে শ্রাবণের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। ঠোঁটের কোনে মলিন হাসি টেনে দিলে শ্রাবণ বকার সুরে বলল,

“এমন অসহায় মুখ করে হাসবিনা।;

ইশা শব্দ করে হেসে ওঠে,

“তবে কেমন করে হাসবো?;

একটু আগে নামিরার কথাগুলো শুনে যেভাবে লজ্জা পেয়ে হেসেছিস। ঠিক ওভাবে হাসবি।;

ইশার চোখ জোড়া বড়বড় হয়ে গেলো।

“ত্ তুমি সব শুনেছো?;

শ্রাবণ বাঁকা হাসলো। যা দেখে ইশা অসহায় গলায় বলল,

“এটা কিন্তু একদম ঠিক হয় শ্রাবণ ভাই! তুমি আমাদের কনভারসেশন কেন শুনবে?;

শ্রাবণ শব্দ করে হেসে উঠলো। ইশা লজ্জায় আবারও লাল হতে শুরু করেছে। ইশা যত লজ্জা পাচ্ছে, শ্রাবণের হাসির শব্দ ততই গাঢ় হচ্ছে। এক পর্যায়ে ইশা পালাতে চাইলো শ্রাবণের সামনে থেকে। কিন্তু পারলোনা। শ্রাবণ ওর হাত ধরে আঁটকে দিলো। পরক্ষনেই হেঁচকা টান দিয়ে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে।

“আমি তোদের কনভারসেশন একদমই শুনিনি। ট্রাস্ট মি। তবে আন্দাজ করেছিলাম তোর লজ্জা মাখা মুখখানা দেখে। জানিস, লজ্জা পেলে কতটা অভিলাষী লাগে তোকে?;

বলতে বলতে পূর্বের ন্যায় ইশার পেছনে চলে এলো শ্রাবণ। পেছন থেকে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে কাঁধে থুঁতনি রেখে সামনের দিকে হাত ইশারা করলো। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ফুটে উঠেছে একজোড়া প্রতিবিম্ব।

ইশার নিশ্বাস ভারী হলো ক্রমাগত। ওর কানে বাজতে লাগলো শ্রাবণের বলা কথাটা। “জানিস, লজ্জা পেলে কতটা অভিলাষী লাগে তোকে?” দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন।

শ্রাবণ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সম্মুখে। শুঁকনো গলায় ঢোক গিললো পরমুহূর্তেই। ফের সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাসফাস করা গলায় বলল,

“সাতদিনই তো, কোনো ব্যাপারনা। আমি নিজেকে সামলাতে পারি।;

ইশা বিস্মিত হলো।

“কি হয়েছে?; কোমল স্বরে শুধালো।

শ্রাবণ মাথা চুলকে বলল,

“কিছুনা।;

বলেই চলে গেলো ইশাকে কিছু বলতে না দিয়ে। ইশা তাকে ডাকতে নিয়েও ডাকতে পারলোনা। শ্রাবণ বেরিয়ে যেতেই একরাশ দুশ্চিন্তা চেপে ধরলো ইশার কপাল। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিছানার দিকে চোখ যেতেই আঁতকে উঠলো ইশা। একবার নিজের দিকে তো একবার বিছানার দিকে তাকাতে লাগলো। ওড়নাটা তো সেই কখন খুলে রেখেছিলো। নিজের এই বোকামির জন্য এখন সেন্টি খেয়ে বেহুঁশ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ওর।

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_______২৬.

আজ রবিবার। ইশার ঘুমের তেরোটা বাজিয়ে সকাল সকাল ওকে উঠিয়ে বসিয়ে রেখেছে বাড়ির লোক। ওদের বিয়ের প্ল্যানিং চলছে, অথচ ওদেরই কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কথায় বলে, যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া পড়শির ঘুম নেই। খান বাড়ির বর্তমান অবস্থা। খান সাহেব অব্দি এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছেন, আত্নীয় স্বজনদের দাওয়াত দিতে দিতে অস্থির হয়ে উঠছেন। অথচ তার নাতি নাতনির এই নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথাই দেখছেননা। এটা নিয়েই তার অস্থিরতা আরও দিগুণ করে বাড়ছে। তাই আজ আদেশ এসেছে, দু’জনকে যেন ভোর ভোর তুলে দেওয়া হয়। বাড়িতে ডেকোরেশন থেকে শুরু করে সব কিছুতে তে তাদের দু’জনের পছন্দ অপছন্দ জানতে হবে। না জানলে কি করে হবে?

ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে বিছানা ছাড়লো ইশা। ব্যস্ত পায়ে রুমে ঢুকলেন আফিয়া বেগম আর মরিয়ম বিবি। ইশার ব্লাউজের মাপ নিবেন তারা। ইশার অবস্থা এমন নাজুক দেখে তারা কপাল চাপড়ে আবার বেরিয়ে গেলেন। যেতে যেতে বলে গেলেন মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে শ্রাবণের ঘরে যেতে। দু’জনের জুতার মাপটা নিতে হবে।

ইশা তাদের কথা ঠিক কতটুকু বুঝলো বোঝা গেলোনা। কেবল ঘুম ঘুম চোখে হু হু করে মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। ওদিকে শ্রাবণকে এক ডাকেই পেয়ে গেলো আফিয়া বেগম আর মরিয়ম বিবি। হন্তদন্ত পায়ে ঢুকলেন শ্রাবণের ঘরে। শ্রাবণ ফ্রেশ হয়ে আধশোয়া হয়ে বসলো।

“উঠেছিস? ব্রেকফাস্ট করবি?;

“ঘুম পূরণ হয়নি মা। যা কাজ আছে জলদি বলো, শেষ করে আরেকটু ঘুমাবো!;

“এখন আর ঘুম পূরণ করার সময় নেই রে। হাতে মাত্র চারদিন বেঁচে আছে। কত কাজ বাকি বলতো?;

“মা, এখন কি নিজের বিয়েতেও কাজ করবো?;

অসহায় গলায় বলল শ্রাবণ। আফিয়া বেগম আর মরিয়ম বিবি মুখ টিপে হাসলেন। আফিয়া বেগম ছেলের মাথার চুল গুলো নেড়ে দিয়ে বললেন,

“কাজ নয় বাবা, দায়িত্ব। দায়িত্ব পালন করতে হবে।;

“কি দায়িত্ব?;

শ্রাবন উদ্বেলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো। আফিয়া বেগম মুচকি হাসলেন। বললেন,

“ব্রেকফাস্ট করে ইশাকে নিয়ে আলতাফ মামার দোকানে যাবি। বিয়ের যত গহনা মামার থেকেই নিবো। বাবা বলে দিয়েছেন।;

শ্রাবণ মনে করার চেষ্টা করলো মায়ের আফতাফ মামার কথা। হ্যাঁ মনে পরেছে। সম্পর্কে তার নানা হন তিনি। বড় একটা শপিং মলে আজ ১০ বছর যাবত বিশাল জায়গা জুড়ে দোকান তার।

“ঠিকাছে। আর কিছু?;

“না আজকের জন্য শুধু বিয়ের গয়না কেনা হবে। বাকি কাজ কাল থেকে।;

“ঠিকাছে।;

আরও টুকটাক কথা বলার মাঝে এসে হাজির হলো ইশা। ঘুম এখনও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে ওর নেত্রদ্বয়। শ্রাবণ এক পলক দেখলো ওকে। পরক্ষণে চোখ নামিয়ে মায়ের কথায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো।

জুতার মাপ নিয়ে সেই সাথে ইশার ব্লাউজের মাপ নিয়ে তারা চলে গেলেন। এবং সেই সাথে বলে গেলেন নীচে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হবে, খেতে আসতে।

মা আর মনি চলে গেলে এবার সরাসরি ইশার পানে তাকালো শ্রাবণ। ইশা মাথা কাত করে ঘুমোচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ইশার অবস্থা দেখে হেসে উঠলো শ্রাবণ। দেয়ালের বুকে লক্ষ্য স্থীর করতে দেখলো সবে ৬টা। এতো সকালে ইশার ঘুম ভাঙানো খুব মুশকিল। তাও তো পেরেছে আজ।

“ঘুম কি বেশি আসছে?;

শ্রাবণ জিজ্ঞেস করলো। ইশার কোনো হেলদোল নেই। হয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গভীর ঘুমে চলে গেছে। শ্রাবণ মুখ টিপে হাসলো। এই সুযোগ আর কখনও আসবেনা। তাই ফট করে একটা ছবি তুলে নিলো। ছবি তুলে ফোনটা বিছানায় রেখে এগিয়ে গেলো ইশার কাছে। কতক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে দু’হাতে ইশার কোমর আলিঙ্গন করে টেনে আনলো নিজের বুকে। হঠাৎ চমকে উঠলো ইশা। ধর থেকে মাথা আলাদা হওয়ার মতো অনুভূতি হলো ওর। চমকিত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকাতেই খানিক উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে উঠলো ভেতরে থেকে। চোখ জোড়া তখন কোটর থেকে লাফিয়ে পড়ার উপক্রম। ডিম্বাকৃতির ন্যায় দৃষ্টি সম্মুখে ছিটকে যেতেই শ্রাবণ গভীর ভাবে সমাহিত হলো ইশার ওষ্ঠদ্বয়ে। ইশার নিঃশ্বাস তখন অস্বাভাবিক গতিতে ওঠানামা করছে। পারছেনা চেঁচিয়ে উঠতে। শ্রাবণ ওকে ছাড়ার নাম নিচ্ছেনা। এমন অপ্রত্যাশিত ছোঁয়া যাতনা দিলেও অদৃশ্য সুখের প্রতিবিম্ব ছুঁতে পারছে।

এক পর্যায়ে এসে ইশাকে ছেড়ে দিলো শ্রাবণ। এই সুযোগ, এখন পালাতে না পারলে ও নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে পরে থাকবে মেঝেতে।

“ভালোবাসার কোমল পরশ সব ক্লান্তি দূর করে দেয়, জানিস?;

শ্রাবণের গাঢ় কন্ঠস্বর প্রতিধ্বনি তুলে ইশার কর্ণকুহরে। নিঃশ্বাসের চঞ্চলতা এখনও স্থায়ীত্ব ইশার বক্ষঃপিঞ্জরে। শ্রাবণের হাত জোড়া যে এখনও তার কোমর জড়িয়ে আছে। বিচরণ করছে এদিক সেদিক।

“ঘামছিস কেন?; বিচলিত হলো শ্রাবণের গলা।

ইশা দম আঁটকে তাকালো তার পানে। ঢোক গিলে ছাড়া পেতে চেয়ে বলল,

“নীচে চলো। ব্রেকফাস্ট করবে।;

শ্রাবণ হেসে উঠলো। শ্রাবণ ভীষণ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। একথা কারোরই অজানা নয়। তবে অজানার বিষয়টি হলো শ্রাবণের হাসিখানা হৃদয়ে ছিদ্র করার মতো যথেষ্ট। এবং সেই সাথে আশ্চর্যের বিষয় হলো সেদিনের পর থেকে অতি ক্ষুদ্র বিষয় গুলোতে খুব হাসে মানুষটা। প্রশান্তিতে মন ভরে যায় ইশার। ইচ্ছে করে দেখতেই থাকি, দেখতেই থাকি।

“ঘুম তো কেটে গেছে, তাইনা?;

হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো শ্রাবণ। এই মুহুর্তে শ্রাবণের হাসির কারন ইশা না জানলেও কোনো অজানা কারনে ভীষণ লজ্জা লাগছে ওর।

“হ্ হ্যাঁ!;

ইশার হ্যাঁ সূচক জবাব পেয়ে শ্রাবণ আরও সশব্দে হাসতে লাগলো। অতএব সে সফল হয়েছে। এই গভীর ছোঁয়া ইশাকে উপহার দেওয়ার মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিলো ইশার ঘুম গায়েব করা।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে কাউকেই প্রত্যাশা না করলেও সবাইকেই দেখা গেলো। দাদাজান,দাদীজান, বাবা, বাবাই এবং আরব। সবাই খাওয়া অলরেডি শুরু করে দিয়েছেন। আরবকে এতো সকাল সকাল উঠানোর কারন হলো আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইশা আর শ্রাবণের বিয়ের কার্ড পৌঁছানো। সঙ্গে আফিয়া বেগমের বাবার বাড়ি থেকে তার ভাইয়ের এক ছেলে আর এক মেয়েও থাকবে। তাদের বাড়ি থেকেই ওদের দু’জনকে নিয়ে যাবে আরব।

বিকেলের দিকে আফিয়া বেগমের ভাই ভাবী, নুপুর বেগমের দুই ভাই-ভাবী সবাই এক এক করে আসবেন। মরিয়ম বিবির শশুর বাড়ি থেকে তেমন কেউই নেই, একমাত্র ইশার চাচা বাদে। ইশার বাবার বড় ভাই হামজা সাহেব। হামজা সাহেবকে আজই আসার জন্য অনুরোধ করেছেন খান সাহেব। হয়তো সন্ধ্যা হতে হতে চলে আসবেন তার বউ এবং একমাত্র ছেলে তাসরিফ কে নিয়ে। বাকি আত্নীয় স্বজনরা কার্ড পেলে তবেই আসবে।

ঘুম কেটে গেলেও শরীরের ম্যাজমেজে ভাবটা কাটেনি ইশার। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ক্লান্ত হাতে একটা চেয়ার টেনে বসতে নিলেই ধপ করে বসে পড়ে শ্রাবণ। ইশা চকিতে পাশ ফিরে তাকালো। ইশা তাকাতেই সবার দৃষ্টির অগোচরে শ্রাবণ চোখ টিপে দিলো। ইশা লজ্জা পেয়ে হাসফাস করে উঠলো। লজ্জার কোনো বালাই নেই শ্রাবনের। টেবিলে এতো গুলো মানুষের সামনে কি করছে এগুলো? কেউ দেখলে কি ভাববে?

“কি নানুভাই? দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?;

খান সাহেবের হাস্যমুখর স্বর শোনা গেলো। ইশা সম্মুখে তাকালো। খান সাহেব স্মিত হেসে চেয়ে আছেন ওর পানে। নানাজানের ন্যায় ইশাও ঠোঁটের কোনে হাসি ফোঁটালো। তবে নিতান্তই জোর পূর্বক। ওর জায়গায় বসার জন্য শ্রাবণকে মনে মনে দুচারটে বকা দিয়ে শ্রাবণের সামনের ফাঁকা চেয়ারটায় বসলো। বসতেই লতা এলো পাঁউরুটি, জেলি আর ডিম নিয়ে। যা দেখে ইশার খানিক অরুচি ধরলো। দু’দিন ধরে ওর সব কিছুতেই ভীষণ অরুচি লাগছে। যেন কিছু খেয়েই শান্তি পাচ্ছেনা, হজম হচ্ছে না।

ইশার খাবারের প্রতি অনীহা কেউ খেয়াল না করলেও আফিয়া বেগম ঠিকই খেয়াল করলেন। তাই সবার জন্য এক খাবার আনলেও ইশার জন্য তিনি কিছু ব্যতিক্রম খাবার নিয়ে হাজির হলেন।

ইশার সামনে একটা স্যুপের বাটি রাখলেন আফিয়া বেগম। স্যুপ দেখলে ইশার এখন রীতিমতো বমি পায়। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে বাড়ির লোক যে পরিমান স্বাদহীন স্যুপ ওকে গিলিয়েছে। তাতে বমি পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

“আমি এটা খাবোনা, দয়াকরো আমার উপর!;

অসহায় নেত্রে আফিয়া বেগমের শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো ইশা। আফিয়া বেগম যেতে নিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লেন। ইশাকে স্যুপ দিতে দেখে শ্রাবণ মনেমনে মায়ের প্রতি বেজায় খুশি হলো। এখনও নিয়ম করে ইশাকে এমন পাতলা খাবারও দেওয়া উচিৎ। কিন্তু মহারানীর অসহায় মার্কা মুখ দেখে সেও আর কিছু বলতে পারেনা।

আফিয়া বেগম সবার পানে চোরা চোখে তাকালেন। অতঃপর ইশার কাছে এসে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,

“ঝাল দিয়ে বানিয়েছি। খেয়ে নে।;

ইশার অহসায় নেত্রদ্বয় হঠাৎই জ্বলজ্বল করে উঠলো আফিয়া বেগমের বানীতে। শ্রাবণ তাদের দু’জনের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। আফিয়া বেগম ইশাকে খোঁচা মে*রে পূর্বের ন্যায় বললেন,

“আমাকে কেস খাওয়াসনা মা। মুখটা আগের ফর্মেটে ট্রান্সফার কর।;

আফিয়া বেগমের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই ইশার হাসি হাসি মুখ এমনিতেই গায়েব হয়ে গেলো। কষ্ট করে আর গায়েব করতে হলোনা। পূণরায় ইশার অসহায় ঘেরা মুখটা দেখে সে আর কিছু না ভেবে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।

________

নামিরার ফোন বাজছে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে। আরব ওর বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আধঘন্টা যাবত কল করে যাচ্ছে ওকে। কিন্তু কোনো খবরই নেই। দিন-রাত এক করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। আরব বির*ক্ত হয়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হঠাৎ তার মাথায় এক বুদ্ধি এলো। সে তৎক্ষণাৎ ইশাকে কল দিলো।

“ভাইয়া, বলো?;

“আমি নামিরার বাসার সামনে।;

“সে কি? কেন?; (অবাক গলায়)

“কেন টেন পরে। তোর আমাকে একটা হেল্প করতে হবে।;

“হ্যাঁ বলো কি হেল্প।;

“আমি এখন নামিরার বাসায় যাবো।;

“মানে?;(আঁতকে উঠে) কেন ভাইয়া? তুমি ওকে কল করে বাইরে ডেকে নাও না। ওর মা আর মামু খুব ডেঞ্জারাস! একবার যদি কিছু টের পায়, তবে আমার নামুর কপালে দুঃখ আছে।;

“আহা কিচ্ছু হবেনা। তুই শোন..;

“বলো?;

“তুই নামিরার মাকে কল করবি। কল করে বলবি, আমি নামিরাকে নিতে আসবো। যদি কারন জিজ্ঞেস করে, তাহলে বলবি তোর আর শ্রাবণ ভাইয়ের বিয়ের কার্ড দিতে যেতে হবে আমাদের আত্মীয়দের বাসায়। আরব ভাইয়া একা পারবেনা, তাই ওকেও সঙ্গে যেতে বলেছে মনি। বুঝেছিস?;

“আমার মাথা ঘোারাচ্ছে ভাইয়া। তুমি কি রিস্ক নিতে চাচ্ছো বলো তো?;

“প্লিজ বইন, কোনো প্রশ্ন করিসনা। অনেক ভেবে চিন্তে বাঘের গুহায় রওনা হচ্ছি। বুক কাঁপছে আমার।;

“ভাইয়া তুমিও ম*র*বে আর আমাকেও মা*র*বে।;

“দোয়া আর দয়া দুটোই একসাথে কর। যা।;

কল কেটে ফেনটা পকেটে রেখে দিলো আরব। বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বারবার কয়েক ফু দিলো বুকে। কে জানে, আজ আদৌও এই গুহা থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে কিনা।

পাঁচমিশালি কাজ করা অসম্ভব সুন্দর দেখতে একটা নেকলেস ইশার সামনে রাখলেন আলতাফ সাহেব। এক দেখাতেই চোখে ধরলো তাদের। এতক্ষণ যাবত এতো এতো কালেকশন দেখালেও কোনোটাই ঠিক পছন্দ করে উঠতে পারেনি ইশা। এবার হয়তো পছন্দ হবে।

“কি পছন্দ হলো?; মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন আলতাফ সাহেব।

ইশাও মুচকি হাসলো। হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে নেকলেসটা হাতে তুলে দেখতে নিলে আলতাফ সাহেব পূণরায় বলে উঠলেন,

“চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা। মানুষ দেখলেই বুঝতে পারি কার কি পছন্দ হবে।;

তার কথায় সায় জানিয়ে শ্রাবণ বলল,

“তা যা বলেছেন নানা।;

“নানাভাই, আপনি আপনার বউকে একটু পরিয়ে দেন ওটা? ট্রায়েল দিয়ে নেন। আমার জহরির চোখ বুঝলেন। আমি হলফ করে বলতে পারি আপনার বউ এই গয়না পরলে কারোর চোখ আর বউয়ের থেকে সরবে না।;

বলতে বলতে হাসলেন তিনি। শ্রাবণ মৃদু হেসে মাথা দুলালো। তাদের সামনেই বড় আয়নাটার সামনে গেলো দু’জনে। ইশার হাত থেকে নেকলেসটা নিয়ে ধীরস্থির হয়ে পরিয়ে দিলো ইশার গলায়। চোখে চমক দিলো শ্রাবণের। আলতাফ সাহেব ঠিকই বলেছেন। এই গয়না ইশা একবার পরলে আর কারোর চোখ সরবে না ওর উপর থেকে।

“ভালো লাগছে?; ইশা প্রশ্ন করে।

“মন কাড়িয়া নিলো সে মনোহারিণী।;

শ্রাবণের এহেম জবাবে গাল লাল হয়ে উঠলো ইশার। শ্রাবণ তৃপ্তি মুলক হেসে ইশার মাথায় আলতো ছুঁয়ে চুমু খেলো। ফের আস্তে করে বলল,

“কারোর নজর না লাগুক।;

“এক্সকিউজ মি?;

শ্রাবণের বলতে দেরী হলেও কারোর কুদৃষ্টি পড়তে সময় নিলোনা তাদের একান্ত সময়টাতে। পেছন থেকে একটা মেয়েলি গলা পেতে দু’জনেরই ভ্রম কাটে। ডাকের উৎস খুঁজতে দু’জনে একত্রেই আয়নার ভেতর তাকায়। তাদের পেছনে অত্যন্ত সুন্দরী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ল্যাভেন্ডার কালারের একটা কামিজ। চুল গুলো খোলা, আর ওড়নাটা এক পাশে ফালানো। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। কালারটা ওর উপর খুব মানিয়েছে। যেন এই রঙটা কেবল ওর জন্যই আবির্ভূত হয়েছে এই পৃথিবীতে।

মেয়েটাকে চিনতে ইশার তেমন বেগ পেতে হয়নি। তবে শ্রাবণের চিনতে মোটামুটি অসুবিধাই হলো। আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইশাকে নিয়েই পেছন মুড়ে তাকালো শ্রাবণ। স্বাভাবিক গলায় মেয়েটার উদ্দেশ্যে পাল্টা প্রশ্ন করলো,

“ইয়েস?;

“চিনতে পেরেছেন?;

কি স্নিগ্ধ গলার স্বর মেয়েটির। বুক জ্বলতে লাগলো ইশার। সেই সাথে এক অপরাধবোধ। শ্রাবণ আর ওর ভালোবাসার মাঝে মেয়েটা অকারণেই ভিলেন হলো। এবং সেই সাথে মেয়েটাই হলো ভিকটিম। যার সাথে অ*ন্যায় করেছে ও। কিছু বা করেও ভ*য়াবহ অন্যায় করলো মেয়েটার সাথে। ওর কারনেই মেয়েটার বিয়েটা ভেঙে গেলো।

“সরি! কে আপনি?;

নিলাশার কোমল স্নিগ্ধ দৃষ্টি খানায় কেমন অবিশ্বাস্য অভিপ্রায় ধরা দিলো। যেন শ্রাবণের করা প্রশ্নটা অযৌক্তিক, হাস্যকর।

“আমি.. নিলাশা!;

নিলাশা স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলো। তবে ইশা উপলব্ধি করলো নিলাশার কন্ঠের তাচ্ছিল্যতা। তাকে না চেনার তাচ্ছিল্যতা।

শ্রাবণ মনে করার চেষ্টা করলো। মস্তিষ্কে খানিক চাপ দিতে মনেও পরে গেলো নিলাশার কথা। যার সাথে দু’দিন আগে তার বিয়ে ঠিক করার কথা হয়েছিলো।

“ও, নিলাশা?;

“জি, চিনতে পেরেছেন?;

“হু। আপনি এখানে? ভালো আছেন!;

ভদ্রতা বজায়ে শুধালো শ্রাবণ। নিলাশা নত মস্তিষ্কে অদ্ভুত হাসলো। নিলাশার হাসিতে অপ্রস্তুত বোধ করলো শ্রাবণ। একবার ইশার পানে তাকাতে চোখাচোখি হলো দু’জনের।

“জি ভালো আছি। আপনি.. সরি, আপনারা?;

প্রশ্নটা করে নিলাশা ইশার পানে তাকালো। ইশাও তাকিয়ে ছিলো নিলাশার দিকে। দু’জনের দৃষ্টি একত্রেই একজন আরেকজনের প্রতি পড়তে দু’জনেই স্মিত হাসতে চেষ্টা করলো।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে