ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩২

0
1850

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সুখময় মুহুর্ত গুলো অতিবাহিত হতে বেশি সময় লাগে না । আল্লাহ পাক হয়তো এই নিয়ম গুলো এইভাবেই করে দিয়েছেন । যেমন বিপদের রাত অনেক দীর্ঘ হয় , সেই রাতের ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার যেন প্রকৃতিকে গ্রাস করে নেয় । কিন্তু রাত যতই গভীর হোক না কেন এক সময় না এক সময়ে ভোরের আলো তো ফুটে উঠেই । ঠিক তেমনটাই এইখানে , বেলীর দুঃখের দিন গুলো দীর্ঘ হলেও এখন সুখের দিন গুলো অনায়াসেই পার হয়ে যাচ্ছে ।

সব মিলিয়ে প্রায় দুইমাস পেরিয়ে গেল । ইরফান আর রুবির মিউচুয়াল ডির্ভোস হয়ে গেছে । তাদের দুজনের মধ্যে এখন আর কোন রকম যোগাযোগ নেই । কিন্তু তবুও কোথাও যেন ইরফানের মনে শান্তি নেই । কিছু একটা যেন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত । বেলীর ব্যাপারে সে খুব পজেসিভ । যেন বেলীকে সে চোখে হারায় । বেলীর শরীরের একটু আঘাত যেন তার কলিজাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় । বেলী মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারে না , এটা ইরফানের ভালোবাসা নাকি পাগলামি । না হয় কোন পুরুষ কোন নারীকে এতটা ভালোবাসতে পারে ?

যেই পুরুষ আগে দিন রাত তার স্ত্রীকে মারধর করতো আজ সেই পুরুষ সেই স্ত্রীকেই চোখে হারায় । এতটাই চোখে হারায় যে রাতের মিলনেও বেলীর মুখের উফফফফ শব্দটাও তার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে স্তব্ধ করে দিতে বাধ্য করে । সে ভালোবাসে তার বেলীফুলকে । বেলীও এখন অনেকটাই স্বাভাবিক । অস্বাভাবিক থাকারও কারণ নেই । বেলীও যে ভালোবাসে তার বরকে । কোন শর্ত ছাড়াই ভালোবাসে সে তার বরকে । জীবনের গল্প গুলো যদিও ছবির মত হয় না । আবার অনেক সময় ছবিকেও হার মানিয়ে নেয় ।

ইরফান বেলীকে আবার পড়াশোনা শুরু করতে বলে । সে নিজের করা ভুল গুলো শুধরে নিয়েছে অনেকটাই । এইবার বেলীকে পড়াশোনাও করাতে যায় সে ,

– বেলী ,,,,,,,,?
– হু ,
– তুমি কেন মানছো না ?
– কি মানছি না ?
– এইযে পড়াশোনা করতে চাইছো না , কেন ?
– এখন আর ভালো লাগে না এইসব ।
– তুমি তো প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছিলে ।
– যা বন্ধ হয়ে গেছে তা শুরু করতে চাই না ,
– এটা কিন্তু ঠিক না ।
– আমি এভাবেই ভালো আছি , এইসবে আর টানবেন না ।
– আমি বুঝলাম না এতে তোমার সমস্যা কোথায় ।
– ঘুমিয়ে পড়ুন , অনেক রাত তো হলো ।

বেলী এইসব বিষয়ে কোন কথাই বলতে চায় না । তাই সবটাই এড়িয়ে যায় । বেলীর কেন জানি পড়াশোনায় অনিহা চলে আসছে ।

গ্রাম থেকে ইরফানের বাবা এসেছ । আজ প্রায় অনেক দিন পর তিনি এলেন এই শহরে । জমি নিয়ে কিছু কাজ ছিল আবার ছেলে ছেলের বউকেও দেখার ইচ্ছা ছিল । তাই দুটো কাজই সম্পন্ন করেছেন তিনি । কথায় আছে শেষ ভালো যার সব ভালো তার । রুবির বিদায় হওয়া , আর তার পর পরই ইরফানের বাবা তার বাসায় আসা সব কিছুই একটা গোলকধাঁধা ।

রাতে খাবার পর , বেলীকে আর বাবাকে নিয়ে ড্রইং রুমে বসে ইরফান । আজকে ইরফান কিছু কথা বলতে চায় তার বাবাকে । তার অতীতের কৃতকর্মের জন্য সে আজ অনুতপ্ত । সে যেমন বেলীর কাছে অপরাধী , তেমন সে তার বাবার কাছেও অপরাধী । ওইদিক থেকে দেখতে গেলে সে তার বাবার কাছে আরও বেশি অপরাধী কারণ সে তার পিতার সু-পূত্র হয়ে উঠতে পারে নি । নিজের করা কৃতকর্মের জন্য হয়তো আখিরাতে তার পিতাকেও হাশরের ময়দানে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে । তাই আগেই সে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিতে চায় তার বাবার কাছ থেকে ।

ইরফান তার বাবার সামনে মাথা নিচু করে বসে । মিনুও পাশে দাঁড়িয়ে আছে । বেলী মাথায় ওড়না পরে ইরফানের বাবার পাশেই বসা তার মাথা নিচু হয়ে আছে । বেলীর মনে ঠিক খবর হয়ে গেছে , ইরফান কি বলবে তার বাবাকে । বেলী শুধু ভয় পাচ্ছে , এটা ভেবেই ভয় পাচ্ছে যখন তার শ্বশুর এইসব শুনবেন তখন কি হবে ।

এদিকে রহমান আলী মানে ইরফানের বাবা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন । তার মন তাকে জানান দিয়ে দিয়েছে যে তার ছেলে হয়তো কোন অপরাধ করেছেন , যার জন্যে তার নজর আজ নিচু হয়ে আছে ।

– ইরফান , নজর নিচে কেন ? কিছু একটা শুনার জন্যেই তো আমাকে এইখানে বসানো হয়েছে । সেটা কি ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– ইরফান ,,?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– বউমা , কি হইছে ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– দুজনেই চুপচাপ , কেন ?

ইরফানের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না । অন্যদিকে , ভয়ে বেলীর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি বের হচ্ছে । ইরফানের স্তব্ধতা যেন অনেক কিছুই ইংগিত করছিল । তবুও রহমান আলী আবার প্রশ্ন করেন ,

– ইরফান , কি হইছে ?

বহু কষ্টে নিজেকে শক্ত করে মুখ দিয়ে কথা বের করে ইরফান ,

– বাবা , আমি কয়েকটা কথা বলবো । আপনাকে শুনতে হবে ।
– হ্যাঁ , শুনতেই তো আছি ।
– বাবা কিছু অপরাধ করছি , যার কখনো ক্ষমা হয় না । জানি না এই মেয়েটা কিভাবে আমায় ক্ষমা করে দিছে ।

আঙুল তুলে বেলীকে উদ্দেশ্য করে ইরফান কথা গুলো বলে । বেলীর চোখে তখন পানি । মিনুও পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদে দেয় । কারণ মিনুর সামনে তখন তার রাগী ইরফান ভাই ছিল না । তার সামনে তখন একজন অনুতপ্ত নিঃস্ব অসহায় পুরুষ বসেছিলেন । যার মুখটা দেখলে যে কারোই মায়া হয়ে যাবে । তার থেকেও বড় ভয়টা হচ্ছে সে তার বেলী ভাবীর কাছে শুনেছিল রহমান সাহেব অনেক রাগী মানুষ । কারোই জানা নেই , এইসব শুনার কি রিয়েকশন হবে । এইসবের মাঝে রহমান আলী আবারও বলে ওঠে ,

– কি এমন অপরাধ করছো তুমি ?
– বলতেছি বাবা ,

তারপর বেলীকে ঢাকা নিয়ে আসার পর থেকে রুবিকে ডির্ভোস দেয়ার দিন পর্যন্ত সমস্ত কিছু বলে দেয় ইরফান তার বাবাকে । এমন কি বেলীকে মারধরের বিষয়টাও বলে দেয় সে তার বাবাকে । ইরফানের বাবা তার ছেলের কথা শুনে স্তব্ধ । ওনার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় । রাগ কিনা জানা নেই কিছু দুঃখে ওনার চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে । বেলীও চাপা কান্নায় ব্যস্ত । মিনুও মুখে হাত দিয়ে নিরবে কেঁদে যাচ্ছে । ইরফানের কথা না বলাই ভালো কারণ সে তখন তার বাবার পায়ে ধরে নিজের দোষ গুলো বর্ণনা করছিল তার কাঁদছিল । ইরফান তখন মিনুকে উদ্দেশ্য করে বলে ,

– বাবা আমার সব অত্যাচারের সাক্ষী ছিল এই মিনু । আমি বেলীকে মেরে আধমরা করে রেখে যেতাম এই মিনুই ও-কে সামলে নিয়েছে । মিনুর অনেক রাগ আমার প্রতি । হয়তো অনেক বকা বাধ্যও করেছে আমাকে ।

মিনু এইসব শুনছিল আর চোখের পানি ফেলছে । রহমান আলী শুধু নিচের দিকে চেয়ে আছে । তারপর ইরফান আবারও বলে ,

– বাবা , আমি অনেক অপরাধ করছি । হয়তো এই অবরাধের ক্ষমা হয় না । আমি আপনার সু-পূত্র হতে পারি নাই বাবা । আপনার আদর্শে নিজে গড়ে তুলতে পারি নাই । আমায় ক্ষমা করে দিন বাবা ।

ইরফানের কথায় রহমান আলী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে দিলেন । তারপর দু’হাত এক করে বেলীর দিকে এগিয়ে আসলেন । তখন কেন জানি ওনার-ই নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল ।

– মাগো , আমি ভুল করছি গো মা । আমি বুঝতে পারি নাই যে আমি আমার কথার দাম রাখতে গিয়ে এক এতিমকে এক নরপিশাচের হাতে তুলে দিছি । আমায় মাফ কর মা ।

নিজের বাবার মুখ থেকে এই কথাটা শুনে ইরফানের কলিজাটা যেন ফেটে যাচ্ছিল । বেলীও ঢুকরে কেঁদে দেয় । ইরফান তখন তার বাবার পা জোড়া আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে । তখন রহমান আলী পা ঝাড়া দিয়ে ওঠে ,

– খবর দার , তোমার ওই পাপী হাতে আমার পা ধইরো না । আমি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি । আমার শরীর অপবিত্র কইরো না তুমি ।
– বাবা,,,,,,,?
– কে বাবা , কিসের বাবা । আমার কোন ছেলে নাই ।
– বাবা ,,,,,,,?

রহমান আলী তখন বেলীকে বলতে শুরু করে ,

– তুই আমার কাছে চলে গেলি না কেন রে মা ? তোকে কে বলছে এই পশুর কাছে থাকতে । আমরা দুইজনে এক বাড়িতে থাকতাম । আর ওই মেয়ে কেন তালাক দিলো ? তুই কেন দিলি না মা , তুই কেন দিলি না । কেন এই পশুর কপালে লাত্থি মাইরা আমার কাছে আসলি না রে মা ?

রহমান আলীর কথায় বেলী অবাক হয়ে যায় ।

– বাবা আপনি এইসব কি বলেন ?

রহমান আলী একদম ভেঙে পড়েছেন । তার নিজের ছেলে এত জঘন্য অপরাধ করতে পারবে তা ওনার জানা ছিল না । চোখের পানি মুছে ছেলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন ,

– তোমার মায়ের কাছে কথা দিছিলাম , সেই কথা রাখতে পারি নাই আমি , তুমি মানুষ হলে না তুমি অমানুষই রয়ে গেলা । তোমার মায়ের শরীরে আমি কখনো ফুলের টোকা লাগাই নি আর সেই তুমি আমার ছেলে হয়ে এই ফুলের মত এতিম মেয়েটাকে মারছো । আমি আল্লাহ পাকের কাছে কি জবাব দিবো । আমি হাশরের ময়দানে এই নিষ্পাপ মেয়ের বাবার কাছে কি জবাব দিবো ?

তখন তিনি বেলীকে আবারও বললেন ,

– মারে এর কপালে লাথি মারলি না কেন রে মা ।

শ্বশুরের কথায় বেলী তখন একটা কথাই বলে ,

– যে নিজ কর্মে অনুতপ্ত তাকে কিভাবে দূরে ঠেলে দিবো বাবা ? সে আমার সব কিছু বাবা । আমি পারি নাই , আমি পারি নাই বাবা ।

.
.

চলবে……………………..

গল্পের আগের সবগুলো পর্বের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে