ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩৮

0
1961

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩৮
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

হাত পা ফুলে গেছে বেলীর । শরীরে জোর নেই বললেই চলে তবুও সে মনের দিক থেকে শক্ত আছে । আর এক এক সময় বাবু ভেতরে ফুটবল খেললে তো বেলীর দফা রফা হয়ে যায় । ইদানীং বাবু ভেতরে ভালোই খেলাধুলা করে । সে হয়তো খেলে মজা পায় কিন্তু এদিকে উপরে বেলীর অবস্থা খারাপ হয় ।

রাতে বেলী শুয়ে আছে , ঠিক শুয়ে আছে বললেও ভুল হবে খাটের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে বসে আছে । ইরফান বেলীর পা গুলো বালিশের উপর তুলে দিয়েছে । কিন্তু বেলীর মনে শান্তি নেই । কারণ আজ অফিস থেকে আসার পর ইরফানকে অন্যরকম লাগছিল যা বেলীর চোখে সহজেই পড়ে যায় । অন্যান্য দিন ইরফান বেলীর সাথে কথা বলে , হাসিখুশি থাকে কিন্তু আজ একদম অন্যমনস্ক । কিছু তো একটা হয়েছে যা বেলীর মন ধরতে পেরেছে । আস্তে করে উঠে গিয়ে অতি সাবধানে হেটে হেটে ইরফানের পাশে গিয়ে বসে বেলী । ইরফান গালে হাত দিয়ে লেপটপ দেখছে । ইদানিং ইরফানও কেন জানি সুন্দর হয়ে যাচ্ছে । ছেলের বাপ হবে নাকি মেয়ের হবে কে জানে তবে বাপ মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর হয়ে গেছে সাথে মাও । পেটে হাত দিয়ে ইরফানের পাশে বসে বেলী । ইরফান এতটাই মগ্ন আছে যে বেলী যে তার পাশে এসে বসেছে তার কোন ধারণাই নেই । এতেই বেলী আরও বুঝে গেছে যে ইরফানের কিছু তো একটা হয়েছে । বেলী আস্তে করে ইরফানের কাঁধে ধরে ।

– কাজ করতেছো ?

বেলীর হাতের স্পর্শ আর মুখের কথা শুনে অত্যন্ত শান্ত নজরে ইরফান বেলীর মুখের দিকে তাকায় । বেলীর চেহারার মাঝে এক অসাধারণ আকর্ষণ আছে যা অন্যের মন মানষিকতাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে বেশি সময় নেয় না । হালকা মিষ্টি হেসে বেলীর গালে স্পর্শ করে উত্তর দেয় ,

– একটু বাকি আছে ,
– কি হয়েছে তোমার ?
– কোথায় কি হয়েছে ?
– লুকিও না , তোমার কিছু তো হয়েছে , বলো না কি হয়েছে ?
– আরে নাহ রে পাগলী , কিছুই হয়নি । আমি ভালো আছি ।
– মিথ্যা কেন বলো ,

বেলীর মনটা ছোট হয়ে যাক ইরফান চায় নি । আবার বেলীকে মিথ্যাও বলতে চাচ্ছে না সে । তাই বাধ্য হয়ে সত্যিটাই বলে দেয় সে ।

– আজকে অফিস থেকে বের হয়ে যখন আসতে যাবো তখন একজনকে দেখলাম ।
– কাকে দেখলা ?
– রুবিকে ,

রুবির কথা শুনে ধক করে বুকে একটা মোচড় দিয়ে উঠে বেলীর । হঠাৎ রুবির সাথে দেখা । কি চায় রুবি এখন ? নানান চিন্তা এক নিমিষেই বেলীর মুখে ভেসে ওঠে । যা ইরফানের মনে দাগ কাটতে এক মিনিটও লাগে নি । ইরফান বুঝে গেছে এত কিসের চিন্তায় ডুবে গেছে বেলী । মুখে না বললেও ভেতরটা তার ফেটে যাচ্ছে তাও ইরফানের জানা আছে । আলতো করে বেলীকে বুকে টেনে নেয় ইরফান ।

– ইরফান বেলীফুলেরই থাকবে । সে আর দ্বিতীয়বার অন্যপানে যাবে না । সে ভালোবাসে তার এই সহজ সরল বেলীফুলকে । যে কিনা তাকে এক নতুন প্রাণের সন্ধ্যান দিয়েছে । আমি ভালোবাসি আমার বেলীফুলকে ।

ইরফানের কথা গুলো শুনে বেলীকে ইরফানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয় । নিশ্চুপ মুখ করে শুধু চোখ থেকে পানি ঝড়াচ্ছে বেলী । কিচ্ছু বলছে না সে । বেলীর এই অসাধারণ কিছু আচরণ যা ইরফান চাইলেও অদেখা করতে পারে না । আরও জড়িয়ে নেয় সে বেলীকে ।

– কেঁদো না , আমি রুবিকে দেখেছি অন্যভাবে । নতুন বিয়ে করেছে । গত দুই মাস আগে বিয়ে হয়েছে তার । ছেলে নাকি তার পূর্ব পরিচিত । রুবি সেই লেভেলের মেয়ে যে কিনা সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয়ে যায় । তার থেকে নোংরা আর কা-পুরুষ তো আমি যে কিনা,,,,,,,,,,,,,,

ইরফানকে আর কিছু বলতে দেয় নি বেলী । ইরফানের মুখে হাত দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় সে ইরফানকে । ইরফান চুপ করে চোখের পানি ছেড়ে দেয় । বেলীও কাঁদতে থাকে মুখ বুঝে । এর মাঝেই ইরফান বেলীর ভারী পেটে হাত রাখে আর বলে ওঠে ,

– আম্মাজান আমার কেমন আছে গো ?

চোখ মুছে ইরফানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে সেও বলে ,

– লাথি মারে তোমার আম্মাজান ।
– হা হা হা , ওমেন্স ফুটবল টীমে ভর্তি করাবো আম্মাজানকে ।
– আর আমায় যে যন্ত্রণা দেয় তার বেলায় ?
– তাকে আসতে দেও আর তুমি সুস্থ হও , সব যন্ত্রণা সুখে পরিণত করে দিবো ।
– হুপ ,
– হা হা হা ,

ইরফানের হাসিটা মাশা-আল্লাহ । এক পলকে চেয়ে আছে বেলী ইরফানের দিকে । ইরফান দিন দিন অনেক হ্যান্ডসাম হয়ে যাচ্ছে আর অনেক সুন্দরও । এরই মাঝে ইরফান বলে ওঠে ,

– আর তো কয়েকটা দিন । তারপর আম্মাজান চলে আসবেন আমার ।
– আল্লাহ পাকের দোয়ায় ।
– হুম ,

হ্যাঁ বেলী আর ইরফানের মেয়ে হবে । লাস্টবার আল্ট্রা করিয়েছিল তারা । সেখানেই ডক্টর সুনিশ্চিত করেছেন যে তাদের মেয়ে হবে । ইরফান অনেক খুশি তার মেয়ে হবে বলে । হঠাৎ করেই বেলী দুই হাতে পেট চেপে হালকা চিৎকার করে ওঠে ,

– মাগোওওও ,,,

ইরফান বেলীর চিৎকার শুনে আৎকে উঠে । হট করেই বেলীকে ধরে ফেলে সে ।

– কি হয়েছে বেলী ,
– লাথি মারলো , উফফফফ ।
– তাই ?
– উফফফফ ,
– অনুভূতি কেমন বেলী ?
– এ এক অজানা অনুভূতি , এই অনুভূতিটুকু না হয় আমারই থাক ।
– কেন , আমাদের হওয়া যায় না ?
– হ্যাঁ , তাও যায় । এই অনুভূতিটুকু না হয় আমাদেরই থাক ।
– হ্যাঁ থাক আমাদের হয়ে , এখন চলো ঘুমাবে ।
– তোমার কাজ ?
– শেষ , চলো ।
– চলো ।

ইরফান বেলীকে ধরে উঠায় । পেট টা বেশ বড় হয়ে গেছে । নয় মাস চলছে বেলীর পেট তো বড় হবেই । বিছানায় নিয়ে গেছে ইরফান বেলীকে । আলতো করে শুইয়ে দেয় সে বেলীকে ।

– পা ব্যাথা করে ?
– মাজা থেকে শুরু করে পায়ের আঙুলের মাথা অবদি । এত ব্যাথা আর কি ফুলে গেছে দেখছো ।
– আমি টিপে দেই ?
– আরে নাহ , লাইট অফ করে আমার পাশে আসো । ঘুমাও ,
– তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো ।
– তুমি পাশে আসো , আমি তোমার বুকে হাত দিয়ে রাখবো না হয় ঘুম আসবে না ।

বেলীর কথায় হাল্কা হেসে ইরফান লাইট অফ করে বেলীর পাশে এসে শুয়ে যায় । ইরফান শোয়ার পর বেলী কাত হয়ে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে । কিন্তু ইরফানকে নিজেকে ধরতে দেয় না বেলী । কেউ ধরলে নাকি বেলীর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে । তাই চুপ করেই ইরফান এক হাত দিয়ে বেলীর হার ধরে আর অন্য হাতে বেলীর চুলে বিলি কেটে দেয় যাতে বেলী ঘুমিয়ে যায় । এক সময় বেলী আসলেই ঘুমিয়ে যায় । বেলীর মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে ইরফানও ঘুমিয়ে যায় ।

ভালোবাসা গুলো এখানে আস্তে আস্তে ধরা দেয় সুখ রুপে । যা এসেছে ইরফান আর বেলীর মাঝে ।

শেষ রাতের দিকে বেলীর চিৎকার শুনে ইরফানের ঘুম ভেঙে যায় । বিছানায় বসে ইরফান বেলীকে দেখতে পায় না । হঠাৎ ওয়াসরুমের দিকে নজর দেয় ইরফান । শব্দ সেইখান থেকেই আসে । ইরফানের কলিজায় আর পানি নেই । ধুপ ধাপ করে তাড়াহুড়ো করে নেমে ওয়াসরুমের কাছে যায় ইরফান । ওয়াসরুমের দরজা খোলা ছিল । ইরফান ভেতরে ঢুকে যায় , দেখে বেলী ফ্লোরে বসে আছে । প্রচন্ড কাঁদছে মেয়েটা । ইরফান কি করবে না করবে বুঝতে পারছে না । এই মুহুর্তে তাকে পাগল পাগল লাগছিল । ইরফান দৌড়ে গিয়ে বেলীকে তোলার চেষ্টা করে । বেলী উঠতে পারছে না । ইরফান প্রায় কেঁদেই দিয়েছে ।

– মাকে ডাকো , মাকে ডাকো ।

বেলীর মুখ থেকে মায়ের কথা শুনে ইরফানের মাথায় আসে তার শ্বাশুড়ির কথা । ইরফান বেলীকে বলতে শুরু করে ,

– তুমি একা একা কেন আসলা ?
– আহহহ , মাকে ডাকো আহহহ
– আমাকে ডাকলা না কেন ?
– তুমি ঘুমাচ্ছিলে , মাকে ডাকো ,
– হু ,

ইরফান দৌড়ে গিয়ে বেলীর মাকে ডাকে । জামাইয়ের মুখ থেকে এই খবর শুনে বেলীর মা দৌড়ে আসে । মেয়েকে এইভাবে পড়ে থাকতে দেখে বেলীর মা কেঁদে দেয় ।

– কেমনে পড়ছত রে মা ,
– মা ধরো আমারে ,
– হায় হায় গো , জামাইরে ডাকলি না কিলিগা ।

ইরফান আর বেলীর মা মিলে বেলীকে তুলে । বেলীর লেবার পেইন উঠে গেছে । বেলীকে উঠানোর সাদা টাইলসের দিকে নজর যায় ইরফানের । ফ্লোরে রক্ত দেখে আৎকে উঠে ইরফান । ওর মুখ দিয়ে আচমকাই বের হয়ে যায় ,

– মা , রক্ত,,,,,,,,,,,

ইরফানের কথা শুনে বেলীর মা ফ্লোরে তাকায় সাথে বেলীও । বেলীর রক্ত ছুটে গেছে । বেশিক্ষন অপেক্ষা করা যাবে না । যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে তাকে । এইদিকে ব্যাথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা বেলী বার বার চিৎকার করে উঠে । মিনু চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে আসে । বেলীর মা কোন রকম বেলীর মেক্সি পালটে দেয় আরও কিছু জামা কাপড় নিয়ে নেয় । মিনুও কেঁদে দেয় বেলীকে দেখে ।

ঘড়িতে রাত প্রায় সাড়ে ৩ টা । এত রাতে এই বিপদ । কথায় আছে বিপদ সব সময় রাতেই আসে । রাতেই এসেছে বিপদ । ভয়ানক বিপদ যা উলটে পাল্টে দিচ্ছে ইরফানকে । বেলীর কান্না তার কলিজায় গিয়ে লাগছে । পেট ধরে বার বার চিৎকার করছে বেলী । কোন রকম সি এন জি একটা নিয়ে হাসপাতাল রওনা দেয় ইরফান । মিনুকে বাসায় রেখে গেছে সবাই । মিনু বার বার বলেছে যাবে সাথে । কিন্তু বাসা খালি থাকায় তাকে আর নিয়ে যায়নি ইরফান । বেলীর মা বেলীকে জড়িয়ে রেখেছে আর পাশে ইরফান বসা । যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতাল যাচ্ছে তারা ।

ব্যাথার যন্ত্রণায় বার বার ইরফানের হাতটা চেপে ধরে বেলী । কোন রকম হাসপাতালে নিয়ে যায় বেলীকে । ডক্টর তখন অফ ডিউটিতে ছিল । তাকে ফোন করে আনানো হয় । সে এসে চেঁচামেচি শুরু করে দেয় ।

– কিভাবে পড়েছে ?
– হয়তো পিছলে গিয়ে ,
– হয়তো , আপনি কোথায় ছিলেন ? ব্লাড ছুটেছে , নার্স O.T রেডি করেন এক্ষুনি ।

নার্স ডক্টরের কথায় দ্রুত O.T রেডি করতে চলে গেছে । ১৫ মিনিটের মাথায় বেলীকে O.T তে নিয়ে যাওয়া হয় । যাওয়ার সময় বেলী খুব কেঁদেছে ইরফানকে ধরে । অনেক কেঁদেছে নিজের মাকে ধরে । ডক্টরের তাড়াহুড়োয় বেলীকে O.T তে নিয়ে যাওয়া হয় ।

এইদিকে ইরফানের শরীর কাঁপা শুরু হয়ে যায় । বেলীর রক্ত দেখে আর ব্যাথা দেখে ইরফান হতভম্ব হয়ে আছে । ইরফান পাগলের মত করতে থাকে । এই সময়ে ভরসা একমাত্র আল্লাহ পাক আর বেলীর মা । বেলীর মা বার বার বড় খতমের দোয়া পাঠ করছেন আর জামাইকে সান্তনা দিচ্ছেন । এরই মাঝে O.T রুমের লাইট টা জ্বলে উঠে । আর ইরফান তা দেখে নিজের হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় ।

.
.

চলবে…………………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে