ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_২১

0
2303

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_২১
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

বুকের মধ্যে নিমিষেই এক তুফান শুরু হয়ে যায় বেলীর । আসলেই কি সুখের মিলন হতে দেয়া যায় ? অসলেই কি একটু সুখের মিলন হলে খুব বেশি ক্ষতি হবে ? তবুও কেন যেন কোথাও একটা বাঁধা কাজ করে বেলীর মাঝে । আবার নাও করতে পারে না , যতই হোক স্বামী তো তার । বিয়ের পর বাবা মায়ের পর স্ত্রীর উপর তার স্বামীর অধিকার থাকে বেশি । কিন্তু বেলীর ভেতরটা হু হু করে কেঁদে ওঠে তখন যখন ইরফানের করা সমস্ত খারাপ আচরণ গুলো মনে পড়ে যায় । যখন মারধরের দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে । বেলী তখন নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না ।
আজও ব্যাতিক্রম কিছু ঘটে নি তার সাথে । সুখের মিলনের সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সেইসব বিষাদের দিন গুলো মনে পড়ে যায় বেলীর । ইরফানের হাতের স্পর্শ পাওয়ার সাথে সাথে অন্তরখানা পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে তার । নিজের ভেতরে উথালপাতাল শুরু হয়ে গেছে বেলীর । কেন যেনো মানতে পারে না সেও । এতটা কষ্ট কি তার পাওনা ছিল ? নিজের কাছে এইসব জিনিস গুলো লজ্জাজনক লাগে বেলীর কাছে ।
বেলী আর সহ্য করতে পারেনি । পিছন ফিরেই ঝাপটে ধরে ইরফানকে । বেলীর এইভাবে ঝাপটে ধরা দেখে একটু হতভম্ব হয়ে যায় ইরফান । বেলী শব্দ করেই কেঁদে দেয় ইরফানের বুকে । দুইহাতে নিজের মুখ ঢেকে ইরফানের বুকে হাতে আবদ্ধ সেই মুখটি লুকিয়ে রেখে কেঁদে ওঠে বেলী । এক সময় ইরফান বেলীর পিঠটা নিজের হাত দিয়ে আগলে ধরতে যাবে তখনই বেলী ধুপ করে কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ে । একে তো শরীর খারাপ তার উপর এইভাবে কান্না করাটা তার শরীরের পক্ষে খারাপ হতে পারে । মুহুর্তের মাঝে ইরফান চমকে যায় , বেলীর কান্না আরেকটু জোর শব্দে পরিণত হয় । ফ্লোরে বসে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে মেয়েটা । ইরফান হাটু গেড়ে নিচে বসে পড়ে বেলীর কাছে । হাতটা দিয়ে বেলীর মাথায় রাখে ।

– কি হলো ? এইভাবে কাঁদছো কেন ?
-…………….
– এই বেলী এইভাবে কাঁদছো কেন ?
-………………

কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে মেয়েটার । ইরফান বেলীর কান্না থামানোর জন্যে গ্লাসে এনে পানি দেয় তাকে খাওয়ার জন্যে । কিন্তু বেলী খায়নি । তারপর কেন জানি নিজ থেকেই ইরফানের হাতটা টেনে নিজের কাছে বসায় সে । কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করে দেয় বেলী ।

– আপনি আমায় অনেক মারছেন । আপনি জানেন আমি কত ব্যাথা পাইতাম তখন ? আমার অনেক ব্যাথা লাগতো আমি তবুও কিছু বলতাম না আপনাকে । আরে ভালো না বাসতেন তাই বলে এইভাবে মারবেন ? আপনার এক একটা লাথি এক একটা ঘুষি অনেক ব্যাথা দিত আমার এই শরীরটাকে । আপনি জানতেন না আমি কত রাত ব্যাথার যন্ত্রণায় ঘুমাইতে পারি নাই । সেইবার শলার ঝাড়ু দিয়ে পর্যন্ত মারছেন । এমন ভাবে মারছেন যে শলা পর্যন্ত ঢুকে গেছে শরীরে । এইভাবে বুঝি কেউ কাউকে মারে , হ্যাঁ ।
এই দেখেন৷, এইদিকে দেখেন , আমার এই শরীরটা যখন স্বামীর ছোয়া পেতো তখন এই শরীরটা স্বামীর মাইর পাইছে । এই ইরফান সাহেব , আমাকে এত মারছেন কেন ? আমাকে বললেই হইতো আমি চলে যেতাম । বা ভাতের সাথে বিষ দিয়ে দিতেন খেয়ে মরে যেতাম । তবুও না মারতেন । এইদিকে দেখেন , এই যে দেখেন আমার পিঠটায় কত দাগ এখনও আছে । সেইবার বেল্ট দিয়ে মারছেন । আচ্ছা একটুও মায়া হয় নাই , তাই না ? বেলীকে যে এইভাবে মারি ওর শরীরটা কি এত মাইর নিতে পারে ? একবার জানতে চান নাই , তাই না ? ওইদিন চা দিতে একটু
দেরি হয়ে গেছিলো বলে এইভাবে মারছিলেন । আপনি আমায় মেরে কেন ফেলান নাই ? হ্যাঁ , কেন মেরে ফেলান নাই আমাকে আপনি ? শুনেন না , এইদিকে তাকান আমার দিকে , আমি কিন্তু অনেক ব্যাথা পাইতাম যখন মারতেন , কিন্তু শব্দ করতাম না । বলেন করতাম কিনা , বলেন না , আমি কি মারার সময় কোন শব্দ করতাম ?

বেলী নিজের মাঝে তখন ছিল না , সে অনেকটা উন্মাদ হয়ে গেছে মনে হচ্ছিলো । চোখের পানি নাকের পানি এমনকি লালা চলে আসছে মুখ দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে । হয় অনেক সময় এমন । মানুষ যখন অতি শোকে পাথর থাকে তারপর সেই পাথর গলে গেলে তখন যেই পতিক্রিয়া হয় এখম সেই প্রতিক্রিয়াটা হচ্ছে বেলীর । ইরফানের ভেতরের কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে বেলীর এমন পাগলামি দেখে । সে একদম নিশ্চুপ হয়ে ফ্লোরে বেলীর সামনে বসে আছে । বেলী হাত ধরে জোড়াজুড়ি করছিল উত্তর জানার জন্যে । তখন বাধ্য হয়েই ইরফান জবাব দেয় ৷

– উহু কোন শব্দ করতে না ।

তখন বেলী আবারও কেঁদে দেয় । এইবার ইরফানের দুই হাত ধরে নিজের কাছে আনে বেলী । তারপর আবার বলা শুরু করে সে ,

– যখন দেখতেন আমি শব্দ করতাম না তখনও কি মায়া হতো না আমার উপরে । খালি মেরেই গেছেন মেরেই গেছেন । আমি কি ব্যাথা পাই না বলেন ? আমিও ব্যাথা পাই ।
– হু , আমি তো অমানুষ , আমি বুঝতেই পারি নাই এটা যে একটা ফুল । যেই ফুলটা একদম নিষ্পাপ , সেই ফুলটাকেই এত অবহেলা করে বসলাম ।
– আমি কি করছিলাম হ্যাঁ , কি করছিলাম , আপনি আমায় একটুও দেখতে পারেন নাই , বলেন । আমি কি বলছিলাম যে আমাকে বিয়ে করেন , তখন তো আমার বাবা আর আপনার বাবা বললেন আমি কি করতাম । বাপ আমার মরে গেল , তখনও আপনার বাবা বিয়ের কথা বলে গেছে আমার মাকে । আমার কি অপরাধ ছিল । আমি একদিন নামাজ পড়তেছিলাম সাড়া দিতে পারি নাই বলে জুতা নিয়ে আসছেন আমাকে মারার জন্যে । আমার তখন কি অন্যায় ছিল , বলেন তো ?
– অন্যায় তোমার না , অন্যায় ছিল আমার । আমিই খারাপ মানুষ , আমিই কষ্ট দিলাম তোমাকে ।
– আমার বাপ মা আমায় মারে নাই , আমি তাদের কাছে ফুল ছিলাম তাদের শখের বেলীফুল , আর সেই ফুলটারেই আপনি ছিড়ে ফেললেন এইভাবে ? এর থেকে ভালো ছিল আমায় বিষ দিয়ে মেরে দিতে । আমি টু-শব্দটাও করতাম না ।

ইরফানের আর সহ্য হয়নি । এক টানে বেলীকে নিজের বুকে এনে ফালায় সে । তারপর বসা অবস্থাতেই শক্ত করে ধরে রাখে বেলীকে । ইরফান আজ কাঁদছে , ছেলেরা কম কষ্টে কাঁদে না । তাদের তেমন কষ্ট হলেই তারা কাঁদে । ইরফান আজ নিরবে কাঁদছে । বেলীকে নিজের কলিজায় ঢুকিয়ে রাখতে ইচ্ছা করছে তার । এইটুকুন একটা মেয়ে সে অথচ এই বয়সে সে কি কি সহ্য করে গেছে , তবুও মুখ খুলে নি । বেলী তখন ইরফানের বুকে থেকেই বলতে শুরু করে ,

– বুঝবেন বুঝবেন একদিন ঠিক বুঝবেন , আমি যেদিন থাকবো না সেদিন খুব করে বুঝবেন । আমি তখন আকাশের তারা হয়ে যাবো , আমি আর আমার বাবা তখন উপর থেকে দেখবো আপনি কিভাবে কান্না করেন । হারিয়ে যাবো আমি আপনার জীবন থেকে , তখন বুঝবেন , হ্যাঁ , দেইখেন তখন বুঝবেন ।

বেলীর কথা শুনে ইরফান বেলীকে আরও শক্ত করে ধরে রাখে আর বলে ,

– চুপ , একদম চুপ । তোকে হারাতে দিলে তো হারাবি ।
– বেলীফুল ঝরে যাবে ।
– কখনো না ,
– হ্যাঁ , দেইখেন আপনি বেলীফুল ঝরে যাবে । সেইদিন বেলীফুলের কবরের পাশে বসে শুধু চেয়ে দেখবেন আপনি আর বেলীফুল তখন মিশে থাকবে মাটির সাথে ।

বেলীর কথা শুনে ইরফান আবারও ধমক দিয়ে থামায় বেলীকে ।

– থামবি তুই , না হয় আবার মারবো কিন্তু ,
– মারেন , আরও মারেন ।
– হ্যাঁ মারবোই তো এইবার সত্যি সত্যি মারবো ।
– মারেন ,
– এখন কিন্তু মার খাবি বলে দিলাম ,
– হ্যাঁ মারেন , মেরেই ফেলেন আমাকে ।

ইরফান এইবার বেলীকে ছেড়ে দেয় । নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় বেলীকে । তারপর উঠে দাঁড়ায় সেইস্থান থেকে । বেলী তখনও বসা অবস্থাতেই আছে । ইরফান বেলীকে সেইভাবেই কোলে তুলে নেয় । কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয় বেলীকে । অঅন্ধকার রুমে ড্রীম লাইটের আলোয় যতটুকু দেখা যায় তাই-ই অনেক । পাশে থাকা টাওয়ালটা দিয়ে বেলীর চোখের পানি নাকের পানি সব মুছে মুখটা পরিষ্কার করে দেয় ইরফান
। তখন বেলী চুপ করে থাকে আর ইরফানের দিকে চেয়ে থাকে । ইরফান বেলীর মাথায় হাত রাখে ,

– ঘুমাও , আর একটা কথা না । কাল সব শুনবো আমি ।
-………………
– আর হ্যাঁ আমি আসলেই খারাপ মানুষ , কি করার আল্লাহ পাক তোমার ভাগ্যে এই খারাপ মানুষটাকে রাখছে । তাই কিছুই করার নাই । কাঁদবা না একদম , চুপচাপ ঘুমাবা ।

বেলী একদম চুপ করে শুয়ে আছে । চোখে তার ঘুমের নেশা । চোখ গুলো টিপ টিপ করছে আর বুজে আসছে । ইরফানের বেলীর মাথায় হাত বুলানোটা কাজে এসেছে । ইরফানের ডান হাতটা ধরে আছে বেলী । তারপর একটা সময় বেলী আস্তে করে ঘুমের রাজ্যে চলে যায় ।
বেলীর ঘুমন্ত চেহারার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ইরফান । বেলীর আজকের কথাগুলো ইরফানের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিয়েছে । বেলী ঘুমানোর পর ইরফান বেলীকে রেখে নিজের রুমে যায় ।

ইরফান কখনো বাসায় স্মোক করে না । তবে আজ সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্মোক করছে । ঘড়িতে প্রায় ২ টা বাজে । রাত গুলো হয়তো এমনভাবেই কাটবে তার । এমন নির্ঘুম আর নিস্ত নিস্তব্ধ । বেলীর কথাগুলো বার বার কানে বাজতে থাকে ইরফানের , বেলীর কষ্ট গুলো বার বার বেলীকে মনে করিয়ে দেয় তার প্রতি ইরফানের করা পৈশাচিকতা গুলো । যা সে ভুলতে ভুলতেও ভুলে নি । হয়তো ভুলতেও পারবে না ।

একদিকে রুবি অন্যদিকে বেলী । রুবিকে সে ছাড়তে পারবে না যদি না রুবি চায় আর বেলী চাইলেও বেলীকে সে ছাড়তে পারবে না । এক সাথে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না । তেমনি দুই বউ নিয়ে চলা যায় না । হয়তো চলা যায় তবে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় । সেইজন্যেই হয়তো বলে সবাই ,

” ভাবিয়া করিও কাজ , করিয়া ভাবিও না ”

হাতে থাকা সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে আগুন নিভিয়ে নিচে ফেলে দেয় ইরফান । বেলীর সাথে করা সমস্ত অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তাকে । অনেক সময় লস হয়ে গেছে । আর সময় নষ্ট করা যাবে না । পর মুহুর্তে বেলীর বলা কথাটা মনে পড়ে যায় ইরফানের ,

” দেইখেন আপনি বেলীফুল ঝরে যাবে । সেইদিন বেলীফুলের কবরের পাশে বসে শুধু চেয়ে দেখবেন আপনি আর বেলীফুল তখন মিশে থাকবে মাটির সাথে ”

বেলীর কথাটা অন্তরে দাগ কেটে গেছে । সে বেলীকে এইভাবে ঝরে যেতে দেবে না । আগলে রাখবে নিজের বুকের সাথে অতি যতনে ।

– বেলী আমি তোকে চলে যেতে দিবো না । মন পিঞ্জরে যতন করে আটকে রাখবো তোকে । তুই দেখে নিস এই ইরফান তোকে সেই সব খুশি দিবে যা তোর প্রাপ্য । আমার মনের মধ্যে রাখা পুরো জমিনেই তোর রাজত্য চলবে । দেখে নিস তুই ।

বিছানায় শুয়ে এইসব ভাবতে কখন যেনো ঘুম চলে আসে তার চোখে । মনের ভুলে বেলীর রুমেও যেতে ভুলে গেছে সে । নিজের রুমেই ঘুমিয়ে যায় সে নতুন এক ভোরের আশায় সেই সাথে নতুন করে সব ঠিক করার আশায় । যা আদৌ সম্ভব কিনা জানা নেই কারো ।

.
.

চলবে……………………..

[ ভেবেছিলাম দিবো না , পোস্টও দিয়ে দিছিলাম , কিন্তু পরে কেন জানি লিখতে ইচ্ছা হলো । অনেকে নক করে বললেন আপু অপেক্ষায় ছিলাম , তাদের জন্যে আর বাকি সবার জন্যে আবার লিখতে বসলাম মাগরিবের পরেই ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে