ছোট্ট একটু ভালোবাসা

0
1106
বউয়ের কথা ভাবছি। আমার মত বদমেজাজি একজন মানুষের সাথে এই মেয়েটি কী করে এতদিন সংসার করে যাচ্ছে? এই কথাগুলো ভাবছি অন্ধকার ঝোঁপে বসে। মানুষ প্রকৃতি থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। আবার প্রকৃতি অনেক সময় আমাদের ভুলগুলো শুধরে দেয়। এক বন্ধু তার প্রেমিকা নিয়ে পালাবে। মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মেয়েও পালিয়ে যেতে রাজি আমার বন্ধুর সাথে। মেয়ে বের হবে রাত একটায়। গাড়ী ছোট বাজারের কাছে রাখা। ড্রাইভারকে এক প্যাকেট সিগারেট দিয়ে আসলাম, যেন না ঘুমায়।
ঝোঁপের আড়ালে আমরা তিনজন বসে আছি। আর তখনই আমাদের সাথে হঠাৎ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল একদল মশা। কোন ঢাল তলোয়ার ছাড়া সরু শুড় দিয়ে কুটুস কুটুস করে কামড়াচ্ছে। অন্ধকারে দেখতে না পারার কারণে মশা কামড়ায় এক জায়গায়, থাপ্পড় দিচ্ছি আরেক জায়গায়। বুঝতে পারলাম এই মূহূর্তে ধৈর্য ধরে সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। আর তখনই মনে পড়ল বউয়ের কথা। বউ আমাকে কেমন করে সহ্য করে? মশা মনে করে? তবে কখনো আমি আমার বউকে মারিনি। কিন্তু আমার কথাই বিষ মাখানো তীরের মত কলিজায় লাগে। বন্ধুর প্রেমিকা এল তার ভাবীর সাথে। তাড়াতাড়ি গাড়ীর কাছে এসে দেখি ড্রাইভার ঘুমুচ্ছে। ধাক্কা দিয়ে সজাগ করলাম। গাড়ি চলতে লাগল গ্রাম থেকে আমাদের নরসিংদী শহরের দিকে। সাথের বন্ধু বলছে, “আমরা তোদের দুজনের জন্য কত কষ্ট করছি। নিজের প্রেমিকা বা বউ হলেও করতাম না। বন্ধু বলেই জঙ্গলে বসে মশার কামড়ও খেয়েছি। আবার বউটির কথা মনে পড়ল। তার জন্য কি কখনো কোনো কষ্ট করেছি আমি? আমার খুব ইচ্ছে ছিল পল্লী গ্রামের মেয়ে বিয়ে করব। বাবা মা আমার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে গ্রামেই বিয়ে করাল। বউ খুবই লক্ষ্মী। কিন্তু আমি নিজেই মনে হয় ঠিক নেই। মনে হয় না, এখন মনে হচ্ছে আমার মাঝে কোনো ভালোবাসাই নেই। বন্ধুর ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে পালানোর জন্য জঙ্গলে বসে মশার কামড় খেতে পারি কিন্তু নিজের বউটিকে কখনো বিদ্যুৎ চমকালে বুকে নিয়ে বলা হয়নি, “বউ তুমি ভয় পেওনা, আমি আছিতো।”
ড্রাইভার বলছে, “দেখেন ভাই, যদি কোনো পুলিশ কেস টেস হয় আমি কিন্তু আপনাদের নাম বলে দেব। আমি ভাই ডান্ডার বাড়ি খেতে পারব না। মেয়েটি বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। ইটাখোলা মোড় পার করলাম। আর বেশিক্ষন লাগবে না নরসিংদী পৌঁছতে। বন্ধুর কাঁধে মেয়েটির মাথা রেখে ঘুম দেখে আমার বড্ড হিংসে হচ্ছে। আমার আজও ভালোবাসা শেখা হয়নি। বউয়ের হাতের রান্না খেয়ে পেট উপরের দিকে দিয়ে নাক ডেকে ঘুমানো ছাড়াও যে ভালোবাসার অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেছে এখন বুঝতে পারলাম। আমি কালই বৌকে নিয়ে ঘুরতে যাব। আর কখনো কটু কথা বলব না। এমন করে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে বলব। বন্ধুর খালাকে রাত তিনটায় ডেকে তুলে সব বিস্তারিত বললাম। সে তার প্রেমিকা নিয়ে খালা বাড়িতে ঢুকে গেল।সকালে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। যাবার সময় বলল, “তোদের মত দোস্ত হয়নারে। তোরা কলিজার টুকরা।” বলে ভিতরে ঢুকে গেল। ড্রাইভার বলে উঠল, “ভাই আমার ভাড়াটা দিয়ে দেন আমিও চলে যাই।” এই সেরেছে। রাত জেগে জঙ্গলে মশার কামড়ও খেতে হবে আর ভাড়াও দিতে হবে আমাদের দুজনেরই। গাড়ীতে উঠে আমার বাড়ির সামনে এসে নামলাম। ভাড়া চুকিয়ে দিলাম। চোখে অনেক ঘুম, ঢুলু ঢুলু ভাব। বাড়িতে ঢুকে আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছি দরজায়। দুবার টোকা দিতেই দরজা খুলে দিল সোমা। – এত দ্রুত দরজা খুললে কী করে? বিছানা থেকে উঠতেইতো দুই মিনিট লাগার কথা। – আমি ঘুমাইনি, জেগে ছিলাম। – বলে কী? জেগে ছিলে কেন? দিনের বেলা তো ঝিমাবে। এত রাতে কেউ জেগে থাকে? – তোমার ফোন বন্ধ। এত রাতেও বাড়ি ফিরছ না। আমি ঘুমাই কী করে? মা জেগে আছে। আগে উনাকে বলে আসো তুমি যে এসেছো। ছেলের জন্য চিন্তা করছেন। পাশের ঘরে গিয়ে দরজায় টোকা দিতেই মা দরজা খুলে দিল। “কিরে বাবা কোথায় ছিলি এত রাত পর্যন্ত?” -মা এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম। চার্জ না থাকায় ফোন বন্ধ ছিল। আমি ঠিক আছি, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। মনে মনে ভাবছি আমার জন্য সবাই এত ভাবে আর আমি চলি আমার মত। নিজেকে পাল্টানো দরকার। রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। বউকে বলছি, “সোমা বাতিটা নিভিয়ে দাও।” -বাতি নিভিয়ে দেব মানে? খাবে না তুমি? -এত রাতে আবার খায় নাকি কেউ? -আমি যে এখনো তোমার জন্য না খেয়ে বসে আছি। -বাংলা সিনেমা বাদ দাও। পেটে ক্ষিধা রেখে অযথা অপেক্ষা করতে হবে না। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়িও, আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে। সোমাও আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল। -কী ব্যপার তুমি না খেয়ে চলে এলে কেন? -এত রাতে কেউ খায় নাকি? আমারো ঘুম পাচ্ছে। আমার কথা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। অপরাধী লাগছে নিজেকে। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছি না। আমি খুব অন্যায় করছি। আমার মাঝে ভালোবাসা নেই কেন? কীভাবে ভালোবাসতে হয় আমি বুঝি না কেন? উঠে বসে পড়লাম। সোমা ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, -বসে পড়লে কেন? – সোমা আমার ক্ষিধে পেয়েছে। এক প্লেট ভাত আনো আমরা দুজনে ভাগ করে খাব। বউ শরীর থেকে কাঁথা ফেলে দ্রুত উঠে গেল। আকাশের চাঁদ মনে হয় হাতে পেয়ে গেছে। ভাত নিয়ে এসে বলছে, “নিচে নেমে এসো।” -না। আজ বিছানায় বসে খাব। সোমা ভাত মাখছে এক পাশ দিয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, তুমি ভাত মাখবে না? – আমার হাতে আর ভরিয়ে লাভ কী? তুমি মেখেছো তুমিই খাইয়ে দাও। সোমা মনে হয় লজ্জা পাচ্ছে। চোখ আর গালে সে লজ্জা স্পষ্ট। সে ভাতের লোকমা তুলে দিল আমার মুখে। দুই লোকমা দেয়ার পর তার খুশি মনটা হঠাৎ দুঃখী ভাব হয়ে গেল। কারণটা খুঁজে বের করতে হবে। হ্যাঁ পেয়েছি। আমাকে দুই লোকমা মুখে তুলে দিয়ে নিজেও এক লোকমা মুখে দিতে যাচ্ছে মন খারাপ করে। আমি বউয়ের হাত ধরে বউয়ের হাতের লোকমা তারই মুখে তুলে দিলাম। হেসে দিয়েছে, আমি দেখেছি দুঃখী দুঃখী মুখটা মূহূর্তে হেসে দিল। এটাই কি তাহলে ভালোবাসা? আমি তাহলে ছোট ছোট ভালোবাসাগুলো খুঁজে পাচ্ছি। হঠাৎ সোমার চোখে পানি, কিন্তু মুখে হাসি। এর কারণতো খুঁজে পাচ্ছি না। এই খুশি, এই দুঃখী, এই হাসি, এই কান্না। আমার শুকনো হাতে বউয়ের গাল বেয়ে নামা পানি মুছে দিচ্ছি আর বলছি, “আমি শিখছি অল্প অল্প করে তোমাকে ভালোবাসা। শেখা হলেই পূর্ণ করিব তোমার মনের আশা।” সোমা আমাকে প্লেট রেখে জড়িয়ে ধরল। আমি বাঁধা দেইনি। থাকুক না কিছুক্ষন এভাবে। একটু পর কানের কাছে ফিস ফিস করে বলছি, “কাল আমরা পার্কে ঘুরতে যাব, যাবে?” আরো শক্ত করে ধরে রাখল। এবার বলছি, “ছাড়ো না এবার, ভাত তো গায়েও মেখে দিচ্ছ। ঘুমাতে হবে না আমাদের?” সোমা ছেড়ে দিল। লজ্জা পাচ্ছে আর মুচকি হাসছে। আমি পেরেছি। পেরেছি আমি ছোট ছোট ভালোবাসা খুঁজে বের করতে। আমার মাঝেও ভালোবাসা আছে। শুধু প্রকাশ করার বাকি। লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,, ,,,,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবণ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে