শেষ দেখা

0
689
স্যার একজন বৃদ্ধ লোক আপনার সাথে দেখা করতে চায় । বয়স প্রায় ৭০ এর কাছাকাছি । আমি ওনাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখেছি । চোখটা ভারী হয়ে আসে চল্লিশোর্ধ মি.সাইফের । একজন বৃদ্ধ তার সাথে এবারো দেখা করতে এসেছে ? এই লোকটি অনেক বছর বেঁচে থাক এটাই চায় মি.সাইফ । নিস্বঙ্গতা নিয়ে হাজার বছর যেনো বেঁচে থাকে এই লোকটি । চোখের কোণায় কি যেনো জমতে থাকে মি.সাইফের । লোকটা কি একাই এসেছে , ওনার ছেলে-মেয়েরা কেউ আসেনি ? _জ্বি না স্যার , বলে উওর দেয় সহকারী ছেলেটা । ১ কাপ চা করে দাও লোকটাকে । উনি কিছুক্ষন থেকে চলে যাবে । যাওয়ার সময় গাড়ি করে দিয়ে এসো । আরাম কেদারায় বসে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নেয় চল্লিশোর্ধ মি.সাইফ । এই দিনে এই লোকটা আসে। ছেলে বেলায় যাকে শত খুঁজে পাওয়া যেতো না সে হঠাৎ নিয়ম করে আসা শুরু করেছে এই দিনে । আজ মি.সাইফের জন্মদিন । এই দিনটায় মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ে মি.সাইফের ।
চিনি ছাড়া চা মুখে দিতেই হারিয়ে যায় পুরনো দিনে । এই দিনে মা পায়েস রান্না করতেন । পোলাও চালের সাথে দুধ , চিনি মিশিয়ে দিয়ে তৈরি হতো মায়ের হাতের অমৃত (পায়েস)। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির সকল খরচ মিটিয়ে মা ঠিকই ম্যনেজ করে ফেলতো ভালো খাবার এবং পায়েস এর খরচ । মা খুব যত্ন নিয়ে তার সন্তানদের খাবার টেবিলে ডাকতেন । অন্যদিনগুলো যেমন তেমন এই দিনটা কখনোই খারাপ যেতো না মি.সাইফদের । মায়ের হাতের পায়েস গ্লাসে করেই খেতেই পছন্দ করতেন মি.সাইফ । অথচ এখন ডায়াবেটিসের কারনে চিনি ছাড়া চা খেতে হয় তাকে , পায়েস তো ভয়ঙ্কর জিনিস । বয়সের কারনে কিছু অভ্যেস মানুষকে ছাড়তে হয় । ইস যদি তখন অনেক গুলো টাকা থাকতো । তাহলে নিশ্চই মায়ের একা এতো কষ্ট করতে হতো না । অথচ এখন কারি কারি টাকা। বোনদের কত্ত ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে । শুধু একা লড়াই করে যাওয়া মা টাই বেঁচে নেই । ডায়নিং টেবিলের ওপর কত দামী দামী ঔষধ সোভা পায় । শুধু কেও ওই রকম পায়েস রান্না করে গ্লাস হাতে ডাকে না ‘ সাইফ এদিকে আয় । তোর পছন্দের পায়েস রান্না করেছি মা। মায়ের বাধাই করা ফ্রেমের দিকে তাকায় মি.সাইফ । বুক ফেটে কান্না আসে তার।মায়ের মাগফেরাতের জন্য দোয়া চায় আল্লাহর কাছে । মসজিদে ইমাম সাহেব কে প্রতি বছরের ন্যায় আগে থেকেই বলা আছে মাগরিবের নামাযের পর মায়ের জন্য মিলাদ ও মোনাজাতের কথা । চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় সে , অনেক কাজ বাকী । মি.সাইফ দুর থেকে দেখতে পাচ্ছে ড্রইংরুমে বৃদ্ধ লোকটা গুটি গুটি পায়ে হাঁটছে।ঠিক যেনো কোন বাচ্চা ছেলে হাঁটছে এ-মাথা থেকে ও-মাথা । কাধ কুঁজো করে লোকটি হাঁটছে । ঠিক যেমন বাচ্চা কোন ছেলে অভিমান করে মাথা নিচু করে হাঁটতো । লোকটি তার ছেলের জন্য অপেক্ষা করছে । ঠিক যেমন ছোট কোন বাচ্চা ছেলে অপেক্ষা করতো তার বাবার জন্য । বার বার দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখছে বৃদ্ধ লোকটা । অপেক্ষা যেনো শেষ হচ্ছে না। হয়তো কোন দিন এ অপেক্ষার শেষ হবে না। বছরের এই দিনটায় লোকটি আসে নিজের কষ্ট কমাতে । প্রায়শ্চিত্ত করতে। কোন বাচ্চা ছেলের মতো মি.সাইফের ইচ্ছে করে লোকটির কাছে ছুটে যেতে।কিন্তুু এখন কি আর মি.সাইফ সেই ছোট্ট ছেলেটি আছে ? আগেই বলেছি বয়সের কারণে অনেক অভ্যেস ছেড়ে দিতে হয় । মি.সাইফ এখন মসজিদে যাবে । সারা রাত মায়ের জন্য নামায পড়ে দোয়া করবে । যাওয়ার আগে দূর থেকে লোকটির দিকে আরেক বার তাকায় । আচ্ছা বাবা কি কখনো এমন হয় ? বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে । লোকটা জোড়ে জোড়ে বলছে আমার ছেলেকে একটু আসতে বলো । আমার সাথে একটু দেখা করতে বলো প্লিজ ! তোমরা একটু বলো । লোকটি হয়তো কাঁদছে
। ঠিক যেমন ছোট্ট ছেলেটি তার বাবার জন্য কাঁদতো । বাবাকে একটু আসতে বলোনা প্লিজ মা । মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরতো । চুপটি করে বুকে জড়িয়ে রাখতো। মি.সাইফের পাশে তার মা ছিলো । কিন্তুু এই বৃদ্ধ লোকটির পাশে আজ কেউ নেই । যাদের জন্য উনি সন্তানদের ছেড়ে গিয়েছিলো , একজন নিষ্পাপ মাকে কষ্ট দিয়েছিলো তাদের কেউতো একদমই নেই । লোকটি কাঁদছে । যা সে অর্জন করেছে সারাজীবন ধরে । তবে মি.সাইফের কাছে এগুলো কান্না মনে হয় না । লোকটি এসেছে তার অনুতাপ কমাতে ,আচ্ছা কমাক । কিন্তুু বৃদ্ধ লোকটির জানা দরকার প্রকৃতি এভাবেই বদলা নেয় ।অন্যায়কারী তার শাস্তি পায়। সময় ঘুরে যায় । যারা সারা জীবন ধরে মানুষকে কষ্ট দেয় শেষ জীবনে সেই মানুষগুলোকে খুঁজে বেড়ায়। আচ্ছা কাউকে সরি বল্লেই কি সব ঠিক হয়ে যায়? মি.সাইফের চোখেও হঠাৎ হঠাৎ কি যেনো পড়ে । চোখ ভরে লোনা জল আসে । এ জন্মে আর কোনদিন লোকটির সাথে মি.সাইফের দেখা হবে না । বৃদ্ধ লোকটি হাউমাউ করে কেঁদেই চলেছে । কে বলে পুরুষ মানুষ কাঁদে না ? এই তো মি.সাইফের বাবা কাঁদছে । অপরাধী একজন বাবা কাঁদছে । কাঁদুক লোকটা । কেঁদে কিছুটা হাল্কা হোক । ওই কান্নার সাথে ভেসে যাক সমস্ত পাপ ।নিষ্ঠুর বাবাটা খুব করে কাঁদুক ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে