খাঁটি পুরষ্কার

0
858
বিলকিস বানু তেল গরম করছেন । পাশেই রসুনের কোয়ার খোসা ছাড়িয়ে জড়ো করে রাখছেন । এসব দিয়ে রসুনের তেল তৈরী হবে । আরেক চুলায় খাঁটি নারকেল তেলও জ্বাল করা হচ্ছে । বিলকিস বানুর নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই । রান্নাঘরের লাগোয়া দরজায় হাফসার মা কতক্ষন হলো দাঁড়িয়ে ! রোজ সকাল সকাল হাফসার মা একবার করে আসে । রাতের বেলা যে ভাত রান্না হয় তার মাড়টুকু বিলকিস রেখে দেন হাফসার মায়ের জন্য । সকালে হাফসার মা আসলে তাকে কিছু ভাতমিশ্রিত মাড়টুকু খেতে দেন । হাফসার মা অবশ্য শুধু মাড়ই চেয়েছিল । বিলকিস বানুর মন কাঁদে শুধু শুধু মাড় দিতে । এক সানকি পানিতে কি অভুক্ত পেট ভরে ? তিনি তাই নিজের রাতের খাবারের অংশ থেকে কিছুটা ভাত মাড়ের সাথে মিশিয়ে রাখেন । হাফসার মা এই ভাত-মাড়ের মিশ্রণটিতে লবন মাখিয়ে হাল্কা ফুটিয়ে সুড়ুৎ করে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর দেয় । তারপর বিলকিস বানুর উঠান টা ঝাঁট দিয়ে রান্নার যোগাড় করে বিদায় হয় ।
আজও সেরকমই হবার কথা । কিন্তু বিলকিস বানু তেল তৈরিতে এতই মগ্ন যে দরজায় খেয়াল করার সময় নেই তাঁর । এদিকে হাফসার মায়েরও সাহসে কুলাচ্ছেনা যে বিলকিস বুজির দৃষ্টি আকর্ষন করে ; কিংবা বিলকিস বুজির তেল তৈরীর মনোযোগ নষ্ট করে । হাফসার মা জানে বিলকিস বুজির মনে এখন কি চলছে। বছরে একবার , কুরবানী ঈদের সময় দিন তিনেকের জন্য বিলকিস বানুর ছেলে গ্রামে আসে। বৌ বাচ্চা নিয়ে মায়ের সাথে ঈদ করে। কেবল এই তিনটা দিনের জন্য বিলকিস বানু সারা বছর প্রতীক্ষার প্রহর দিয়ে কল্পনায় মালা বোনে । সত্তর বছর বয়সী শরীরটাকে টেনে টেনে নিয়ে যায় রান্নাঘরে । দুর্বল পেশিযুক্ত কাঁপা কাঁপা হাতে একমাত্র নাতির জন্য তৈরী করে নারকেলের নাড়ু , মুড়ির মোয়া , চিড়েভাজা । বিলকিস বানুর শহুরে নাতি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর চিকেনের সাথে পরিচিত হলেও মুড়ি মুড়কি ছুঁয়ে দেখতেও নাক সিটকায় । কিন্তু মুড়ির মোয়া কে বল মনে করে এদিক ওদিক ছুঁড়ে খেলা করতে পছন্দ করে। বিলকিস বানু ফোকলা দাঁতে খিলখিলিয়ে হাসে । তার ছেলের বৌটার মাথাভর্তী চুল । কি যে সুন্দর ! বিলকিস বানুর খুব ইচ্ছে করে বৌমার চুলে তেল দিয়ে টানটান করে খেজুরবেণী করে দিতে । ভারী মানাবে মেয়েটাকে। কিন্তু নিপা একদম পছন্দ করেনা চুলে বেণী করা । সে চুল খুলে রাখতেই পছন্দ করে । বিলকিস বানু তাই প্রতিবছর বাড়ির পেছনের নারকেল গাছ থেকে নারকেল পাড়িয়ে রাখেন । সেই নারকেল থেকে তৈরী করেন খাঁটি তেল । নিপার হাতে তেলের শিশি তুলে দিয়ে বারবার করে বলে দেন, সপ্তাহে কতবার মাখতে হবে তেল । নিপা তেলের শিশি কোনমতে চোখের আড়াল করার জন্য ব্যাগে ঢোকায় । এরপর সেই তেল কোথায় যে নিয়ে ফেলে দেয় তা ভাবনারও ঊর্দ্ধে! ঢাকা শহরের নামীদামী পার্লারে প্রোটিন ট্রিটমেন্ট, স্পা করিয়ে চুলের রক্ষনাবেক্ষন করা মেয়েটির কাছে বৃদ্ধা গেঁয়ো ফোকলা দাঁতের শ্বাশুড়ির তৈরী করা নারকেল তেলের যে কোন মূল্য নেই । তবে এই ভাল যে বিলকিস বানুর অত গভীরে বোঝার অবকাশ নেই। নইলে শীতে কাঁপতে কাঁপতে নারকেলের ছোবড়া ছেলার কষ্টকে বহুগুনে ছাপিয়ে যেতো তাঁর তৈরী ভালবাসাময় তেলটিকে অবমূল্যায়নের কষ্ট ! সে যা হোক , মুদ্রার এপিঠে বিলকিস বানুর পরম যত্নে রসুন তেল তৈরী হয়ে গিয়েছে। সরিষার তেল আর রসুনের খাঁটি গন্ধ ছেয়ে গেছে সারা রান্নাঘর , উঠান । তাঁর ছেলেটার পিঠের ব্যামো আছে । সোজা হয়ে একনাগাড়ে বসতে পারেনা। এই রসুন তেল মালিশ করলে ছেলেটা আরাম পায় । সারা বছর কয় বোতল লাগতে পারে , সঠিক হিসেবটা বৌমা দিতে পারেনা। বিলকিস বানু তাই নিজের আন্দাজে পাঁচ বোতল ব্যাগে ভরে দেয় । বিলকিস বানুর কখনোই জানা হয়না যে শহরে ফিজিওথেরাপীর ব্যবস্থা থাকে। তেল মালিশ করে হাত গন্ধ করার দিন এখন নেই । বিলকিস বানুর পাঠানো তেলগুলো অনাদরে অবহেলায় একসময় ছত্রাক আক্রান্ত হয়ে ডাস্টবিনে ঠাঁই নেয় । ভাগ্যিস সে কথাও বিলকিস বানু জানেনা ! বৃদ্ধা তেলের শিশিগুলো সামলে দরজায় নজর দিলো। – ওমা! হাফসার মা , কনে আইলি ? – ম্যালাক্ষন। – কইবিনা আমারে ? – দরজায় খাড়াইয়া রইসি, বুজি তুমি মোরে দ্যাখোনাই ? – আল্লাহ রে! দ্যাখলে কি তোরে ভাত দিতাম না ? আয় আয় , ঐ যে চেয়ারের ওপর ঢাকনা দেয়া। যা একটুখানি গরম কইরা খাইয়া ল । আইজ আমার ম্যালা কাজ । খোকা আইতাসে বিকালের মইধ্যে । – হ সেটা বুঝবার পারসি বুজি । তাড়াতাড়ি খাইয়া তোমার লগে হাত লাগামু । – আইচ্ছা ।তুই খাইয়া ল । বিলকিস বানু বাড়ি আছেন ? অপরিচিত পুরুষের গলায় থমকে গেলো বিলকিস আর হাফসার মায়ের কথোপকথন । বিলকিস বানু আঁচল দিয়ে বিশাল ঘোমটা টেনে বের হলেন। মাটির সানকি পুনরায় চেয়ারে রেখে বিলকিস বানুর পেছন পেছন গেলো হাফসার মা । – বিলকিস চাচীর বাড়ি এইটা ? – জ্বী। আমিই বিলকিস বানু । – আসসালামুআলাইকুম চাচী ।আপনি ভাল আছেন ? – জ্বী, বাবা । আমনে ক্যাডা ? – আমি আমজাদ । আপনার ছেলে মামুন সাহেবের অফিসে কাজ করি । – আমার ছাওয়াল কই? হ্যার কি কিসু হইসে? আইজ তো হ্যার আসার কথা । – চাচী আপনার ছেলে ভাল আছেন । স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে একটা খবর দিতে । – কি খবর বাবা ? আমার নাতি বৌমা ভালা আসে তো? – চাচী ,সবাই ঠিক আছে । মামুন স্যার এইবার গাঁয়ে আসতে পারবেননা। অফিসের কাজে বিদেশে যেতে হচ্ছে । স্যারের সাথে ম্যাডাম এবং ছোট রাজপুত্রও যাবে। তাই স্যার আমাকে বলেছেন এই খবরটা আপনাকে জানাতে। আরও বলেছেন আপনাকে একা একা গ্রামে রাখতে স্যারের খুব চিন্তা হয় ।তাই আমি এসেছি আপনাকে নিয়ে যেতে । – আমি কোথায় যাবো বাবা ? ছাওয়াল আসবে তার বাপের ভিটামাটিতে । সে অন্য সময় বিদেশ গ্যালোনা ক্যানে ? বছরে একবারই তো আসে । এইবার তাইলে আইবোনা ? নাতিডারে দেখুম না ?
– চাচী আপনি বুঝতে পারেননি । আমি আপনাকে যেখানে নিয়ে যাবো সেখানে আপনার সময় খুব ভাল কাটবে । স্যারকেও আপনি প্রায়সময়ই কাছে পাবেন । এই গাঁয়ে কি আছে বলুন ? কখন আপনার কি অসুখ হয় , স্যার খুবই টেনশানে থাকেন । – কিন্তু বাবা আমার বৌমা তো একা থাকতে পছন্দ করে । সেই জন্যই খোকা আমারে শহরে নেয়না । এখন আমি শেষ বয়সে আমার খোকা আর বউমার সংসারে অশান্তি করবার পারুমনা । তুমি আমারে নিওনা । – আরে চাচী ! আপনাকে তো স্যারের বাসায় নেবোনা । আপনার জন্য খুবই আধুনিক এবং সকল সুযোগসুবিধা সম্পন্ন একটি ওল্ডহোম বুক করেছে স্যার ! – কি কইলা বাবা ? – ওহ আপনি তো ইংরেজী বুঝবেননা । ওল্ডহোম মানে বৃদ্ধাশ্রম । আপনার মত বয়স্ক মানুষেরা একসাথে গল্পগুজোব খাওয়াদাওয়া করে জীবনের শেষ সময়টুকু কাটায় । আপনি গেলেই মুগ্ধ হয়ে যাবেন । স্যার আপনার জন্য বেস্ট রুম বুক করেছেন । স্যার কে তো চেনেনই , বিশাল মনের মানুষ । আপনার খুবই ভাল লাগবে । আর সপ্তাহান্তে স্যার ম্যাডাম তো আপনার সাথে দেখা করবেই । বছরে নয় চাচী , সপ্তাহে সপ্তাহে দেখা হবে আপনার ছেলের সাথে ! – তুমি আমারে আমার ঘরবাড়ি ছাইড়া অচেনা মাইনষের ভীড়ে লইয়া যাইতে চাও? – আরে চাচী ! এই ভাঙা ভিটেমাটি কামড়ে পড়ে থাকার কি আছে ? স্যার বলেছেন এই পুরো জায়গাটা বিক্রি করে দিবেন । আর বৃদ্ধাশ্রমে কেউ অচেনা নয় । সবাই আপনারই মত । আপনি তাড়াতাড়ি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গুছিয়ে আসুন । আমি অপেক্ষা করছি । – হাঁছা কইসো বাবা । তারা সবাই আমার মত অভাগী । খাড়াও একটু । বিলকিস বানু ভেতরে গিয়ে সকালের বানানো তেলের শিশিগুলো নিয়ে আসলেন। মুড়ির মোয়ার টিনটাও আনতে ভুললেন না । আমজাদের সামনে সব জড়ো করে বললেন, – বাবা , এইগুলান নিয়া আমার ছাওয়ালের হাতে দিও । আমি কোত্থাও যামুনা । এই ভিটামাটিতে বউ হইয়া আসার পর থেইকা এই মাটিই আমার সব । এই দাওয়ায় খাড়াইয়া আমি আমার মৃত শ্বশুড় শ্বাশুড়িরে বিদায় দিসি । স্বামীরে বিদায় দিসি । ছাওয়াল আর তার বৌ বাচ্চারে প্রতি বছর বিদায় দেই । অহন নিজের বিদায়ের অপেক্ষা করি । এইখান থেইকা আমার বিদায় হইবো, যেদিন আমি কবরে যামু । আমার খোকারে কইয়ো , শ্যাষ বয়সে আমার বন্ধু চাইনা , একটুখানি মর্যাদা দিলেই হইবো ! বিলকিস বানু এর এক মিনিট না দাঁড়িয়ে রান্নাঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিলেন । হাফসার মাও দৌড়ে এসে বুজি বুজি বলে দরজা চাপড়াচ্ছে ।ঘরময় এখনও গরম তেলের গন্ধ ! অসহ্য বোধ হলো তাঁর। নাকে আঁচল চাপলেন। তবু খাঁটি তেলের গন্ধ ঠিক নাকে প্রবেশ করছেই ।খাঁটি তেলটাকেই বিষের মত মনে হলো বিলকিস বানুর । তাঁর অন্তরাত্মা যেন ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো , এত দিনের খাঁটি মাতৃত্বই আজ মর্যাদা পেলোনা, ঐসব খাঁটি তেল নিশ্চয়ই নর্দমায় যাবে ! “সমাপ্ত”

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে