চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০৮

0
312

#চিত্রলেখার_কাব্য
অষ্টম_পর্ব
~মিহি

“লেখা, একটু শোন তো।” খুব স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে হঠাৎ যখন বড় ভাই এভাবে ডাকে ঠিক তখনই সমস্ত পাপকর্ম মনে পড়তে থাকে চিত্রলেখার। মাথার এ পাশ ও পাশ খুঁজেও কোনো গ্যাঞ্জামের কথা মনে করতে না পেরে তবুও ভয়ে তটস্থ হয়ে বড় ভাইয়ের সামনে দাঁড়ায় সে।

-ভাইয়া ডেকেছিলে?

-হুম। তোর আর প্রাইভেট পড়াতে যাওয়ার দরকার নেই।

-কেন ভাইয়া?

-তোর সামনে পরীক্ষা, অন্যকে পড়াতে গিয়ে তোর পড়াশোনার ক্ষতি হোক এটা আমি চাই না। আর এর উপর কোনো দ্বিমত আমি শুনতে চাচ্ছি না। বুঝেছিস?

-জ্বী ভাইয়া।

চিত্রলেখার মন খারাপ হলেও কিছু করার নেই। তবে হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে সে খানিকটা বিচলিতই হলো। মন খারাপ করে ঘরে বসে ফোন হাতে নিল। আজকের দিনটা আসলেই খারাপ। রঙ্গনের চলে যাওয়ার এক অজানা মন খারাপ, আশফিনা আহমেদের রাগী দৃষ্টি এখন আবার বাড়িতে এসে ভাইয়ার বকাবকি। চিত্রলেখা ফেসবুকে ঢুকলো। তার নিজস্ব আইডির কথা কেউ জানে না। সে চায়ও না কাউকে জানাতে। আচমকা পিপল ইউ মে নো’তে রঙ্গনের আইডিটা ভেসে উঠলো। কৌতুহলবশত প্রোফাইলে ঢুকলো চিত্রলেখা। প্রোফাইলে সম্ভবত কলেজ লাইফের একটা ছবি দেওয়া। শেষ পোস্টটা নজর কাড়লো চিত্রলেখার।

‘কখনো যদি একাকী শ্রাবণ আমার তরে হাত বাড়ায়,
আমি আলিঙ্গন করে বলবো আমি বৃষ্টি ভালোবাসি
বর্ষণের আড়ালে অশ্রু বিসর্জন করতে ভালোবাসি।’

চিত্রলেখার কৌতুহল দমলো না। প্রোফাইলের প্রায়শই পোস্টেই এরূপ বিষাদমাখানো একটা মায়া মিশে আছে। চিত্রলেখার ইচ্ছে হলো রঙ্গনকে জিজ্ঞাসা করতে কিসের এত দুঃখ তার! নক দিবে কি না এ নিয়ে ভারী দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো সে। ‘যা হবে দেখা যাবে’ ভেবে নক দিলো চিত্রলেখা, “এত স্যাড পোস্ট? কিসের এত দুঃখ আপনার?” টেক্সট করেই অফলাইনে গেল সে। ছোট ভাবী খাবার খাওয়ার জন্য ডাকছে। ফোন রেখে টেবিলের দিকে এগোলো সে।

_______________

আজ সারাদিন ঘর থেকে বের হয়নি রঙ্গন। ক্লাসেও যায়নি। রাহাত অবশ্য গিয়েছিল। বিকেলে অবনীর সাথে ফিরেছে। দুজন সেই থেকে রুমে বসে আছে। রঙ্গনের ইচ্ছে হলো না ওদের প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ করতে। একাকী বারান্দায় বসে ফোন হাতে নিয়ে গুনগুন করছিল সে। অবনীকে ইদানিং অন্যরকম লাগে তার। মেয়েটা আগে তাকে ছোট বোনের মতো যত্ন করতো। এখন অবনীর মধ্যে পরিবর্তনটা বেশ চোখে পড়ার মতো। পড়াশোনায় ভালো মেয়েটা অদ্ভুতভাবে ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করেছে। রাহাত রঙ্গনের সাথে এক ফ্ল্যাটে থাকলেও এখন আর কথা বলে না। দুজনের মধ্যে এ দেয়ালটা অবধারিতভাবে পাকাপোক্ত হয়েছে। অবনী সন্ধ্যের খানিকটা পর রাহাতের ঘর থেকে বেরোল। রঙ্গন কী ভেবে যেন ডাকলো তাকে।

-অবনী শোন তো।

-ওকে ডাকছিস কেন?

-রাহাত, আমি অবনীকে ডেকেছি। তুই কেন উত্তর দিচ্ছিস?

-আমি ওর বয়ফ্রেন্ড। আমি জিজ্ঞাসা করতেই পারি তুই ওকে কেন ডেকেছিস।

-না পারিস না কারণ তোর গার্লফ্রেন্ড হওয়ার আগে ও আমার বন্ধু। বন্ধু হিসেবে আমি ওকে ডাকতেই পারি।

-বন্ধু? হাস্যকর! তুই ওকে বন্ধু ডাকার যোগ্য? বন্ধু হওয়ার মতো কী করেছিস তুই? মেয়েটার মনের অবস্থা একটুও বুঝেছিস? ও যখন তোকে ভালোবাসতো তখন তো পাত্তা দেস নাই, এখন আমি ওকে নিজের করে নিয়েছি বলে জ্বলছে তোর?

রঙ্গন অবাক হলো। রাহাত কী বলছে এসব? অবনী এসে রাহাতকে থামানোর চেষ্টা করলেও রাহাত থামলো না।

-তোর সাথে এই ফ্ল্যাটে আমি আর থাকবো না। তোকে দেখলে আমার রাগ উঠে।

-রাহাত, কী বলছিস তুই? অবনী আমার ছোট বোনের মতো!

-কিসের বন্ধু রে তুই যে অবনী তোরে কী ভাবতো সেটাও বুঝিস নাই! উল্টো মেয়েটার ছোটখাটো এফোর্টগুলোরে এড়িয়ে গেছিস।

এ মুহূর্তে দুজনের মধ্যে বেশ উত্তপ্ত একটা ক্ষোভ উতলে ওঠার উপক্রম। ঠিক সেসময় অবনী মেজাজ হারিয়ে রাহাতের গালে চড় বসিয়ে দিল। রাহাত গালে হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে অবনীর দিকে তাকালো। অবনীর মুখে তখনো রাগ।

-তুই এই কাজটা কী করে করলি রাহাত? তোকে বিশ্বাস করেছিলাম আমি। সেজন্যই রঙ্গনকে পছন্দ করার কথা বলেছিলাম। তারপর এটাও বলেছিলাম আমাদের মধ্যে কখনো কিছু হবে না। তাই যেন এ বিষয় আড়ালেই থাকে। আমি কি তোর সাথে কোনরকম খারাপ ব্যবহার বা তোরে অবহেলা করছি? তাও কেন তুই রঙ্গনকে এসবের মধ্যে আনলি?

-এখন সব দোষ আমার?

-একটা মেয়ে যখন বিশ্বাস করে কিছু একটা শেয়ার করে, তখন সেটা গোপন রাখাটা কি দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা? তুই শুধু আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট করিসনি রাহাত, তুই আমাদের তিনজনের বন্ধুত্বটাও শেষ করে দিলি!

অবনী রেগে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। রাহাত অসহায়ের মতো মেঝেতে বসে কাঁদতে লাগলো। রঙ্গনের তখনো সবকিছু এলোমেলো লাগছে। অবনীকে সে কখনো ছোট বোন ছাড়া কিছু ভাবেনি। তবে এসব নিয়ে ভাবার সময় এখন নয়। রঙ্গন দ্রুত রাহাতের পাশে বসলো। রাহাতকে সামলানোর চেষ্টা করলো। রাহাত কোনভাবেই রঙ্গনের কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। এক পর্যায়ে রাহাত রঙ্গনকে ধাক্কা ছিল। নিজেকে সামলাতে না পেরে রঙ্গন খানিকটা দূরে ছিটকে গেল। ফোনটা আরো দূরে গিয়ে পড়লো।

-রাহাত, তুই অস্বাভাবিকের মতো আচরণ করা থামাবি? তোর এই আচরণের জন্য অবনী চলে গেছে।

-তোর জন্য হয়েছে সব। তুই থার্ড পার্সনের মতো আমাদের সম্পর্কটা শেষ করলি।

-তোর নূন্যতম লজ্জা হয়না? অবনীর বিশ্বাস ভেঙে এখন আমাকে ব্লেইম করছিস? ভাই, মেয়েটা আমাকে পছন্দ করতো কিন্তু তোকে ভালোবেসেছে। আর সেই ভালোবাসার মানুষ যখন বিশ্বাস ভাঙে তখন কী অবস্থা হয় ভাব! আমি মানছি তুই আমাকে সহ্য করতে পারছিস না এখন। এটাই স্বাভাবিক। আমাকে মেরে ফেলিস তবে এখন গিয়ে অবনীকে বোঝা।

রাহাতের কী হলো বুঝলো না রঙ্গন। উঠে চোখ মুছে রঙ্গনকে জড়িয়ে ধরে দ্রুত বাইরে দৌড় দিল। রঙ্গন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঘরটা শান্ত নিস্তব্ধ হয়ে আছে। কেউ বলতে পারবে একটু আগে এ ঘরে কী এক প্রকাণ্ড ঝড় বয়ে গেছে! রঙ্গন মুচকি হাসলো। আপাতত সে এই ফ্ল্যাট থেকে শিফট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। রাহাত এবং অবনীর থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকাই উভয়ের জন্য মঙ্গল। রঙ্গন আশেপাশে তাকিয়ে নিজের ফোনটা খোঁজার চেষ্টা করলো। রাহাতের সাথে ধস্তাধস্তিতে ফোনটা পড়ে যাওয়াতে স্ক্রিনে বেশ কয়েকটা ক্র্যাক দেখা যাচ্ছে। রঙ্গন ভালোমতো খেয়াল করে দেখলো প্রটেক্টরে ক্র্যাক এসেছে শুধু। ফোন অন করলো রঙ্গন। ওয়াইফাই কানেক্ট হতেই মেসেজ টিউন বেজে উঠলো। রঙ্গন খানিকটা অবাক হলো। তার সাথে সবাই মোটামুটি হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে। মেসেঞ্জারে তাকে কে টেক্সট করলো। টেক্সট ওপেন করে মুচকি হাসলো রঙ্গন। স্যাড পোস্ট করা নিয়েও অপরিচিত কেউ খোটা দিতে পারে জানা ছিল না তার। আইডির নামটা বেশ অদ্ভুত, ‘অলকানন্দা’। এটা বাস্তবিক অর্থেই মেয়েটির নাম নাকি ফেক আইডি? রঙ্গন সচরাচর অপরিচিত মেসেজের রিপ্লাই দেয় না তবে এক্ষেত্রে কৌতুহল দমাতে পারলো না। রিপ্লাই করলো,”হ্যাঁ আমার জীবনে অনেক দুঃখ, আপনি কি একটু ধার নিতে পারবেন?” মেসেজ ডেলিভার হলো না অর্থাৎ মেয়েটা অফলাইন। রঙ্গন চুলে হাত চালিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে বিছানায় বসলো। মেয়েটার প্রোফাইল লক করা অথচ নিজে থেকে রঙ্গনকে টেক্সট করেছে বিষয়টা অদ্ভুত লাগলো রঙ্গনের। অবশ্যই এটা পরিচিত কেউ। রঙ্গন অনেকক্ষণ পর টেক্সটের রিপ্লাই পেল। প্রায় সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি সময়ে মেয়েটি রিপ্লাই দিল।

-আপনার দুঃখগুলো ধার নিলে আপনার সাহিত্যচর্চা বন্ধ হয়ে যাবে। আমি একজন উদীয়মান লেখককে সাহিত্যজগত থেকে বিচ্ছিন্ন করার দুঃসাহস দেখাতে চাইনা।

-তবে দুঃখবিলাসী হতে বলছেন?

-মন্দ হয় না। আমারো অনেকখানি দুঃখ আছে। কখনো সুযোগ পেলে দুঃখবিলাস করা যাবে।

-পরিচয় না জানলে দুঃখবিলাস করাটা ঠিক জমবে না। তো জনাবা, আপনার নাম জানালে উপকৃত হতাম।

-অলকানন্দা।

রিপ্লাই করে ফোন অফ করলো চিত্রলেখা। দরজার বাইরে কারো পায়ের শব্দ পেয়েছে সে। চটজলদি ফোন রেখে চোখ বন্ধ করলো চিত্রলেখা। একটু পর তার বড় ভাই এসে লাইট জ্বালালেন। চিত্রলেখার মাথায় আলতো করে হাত বোলাতে লাগলেন।

“তোকে কখনো আমি সৎবোন ভাবিনি। নিজের আপন বোনের চেয়েও বেশি আগলে রাখার চেষ্টা করেছি। সেই তোকে নিয়ে মানুষজন উল্টোপাল্টা মন্তব্য করবে তা আমি মেনে নিব না। আমি জানি তুই মন খারাপ করেছিস কিন্তু আমি সবটাই তোর ভালোর জন্য করেছি।” বোনের কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে লাইট অফ করে বেরিয়ে গেল অর্ণব। চিত্রলেখার চোখজোড়ায় তখন অশ্রুদের দল খেলা করছে। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে রঙ্গনদের বাড়িতে সে আগামীকাল শেষবারের মতো যাবে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে