চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০৭

0
321

#চিত্রলেখার_কাব্য
সপ্তম_পর্ব
~মিহি

হোয়াটসঅ্যাপে অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ভয়েস নোট দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেল চিত্রলেখা। ভয়েস নোটটা ওপেন করতেই শোনা গেল পরিচিত কণ্ঠ,

“যদি কোন চিত্র আঁকি
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী,
সেই চিত্রতে তুমি
পার্ফেক্টলি বসো…”

ব্যস এটুকুই। সিয়ামের কণ্ঠ চিনতে অসুবিধা হয়নি চিত্রলেখার। রিপ্লাই করবে কি করবে না এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো সে। এরই মধ্যে সিয়াম আবারো টেক্সট করলো।

-ঘুমিয়ে পড়েছিস?

-না। গান তো ভালোই গাও তুমি।

-ঐটা আমার গাওয়া নয়, আমার এক বন্ধুর কণ্ঠ।

-ঢপ দিও না, তোমার কণ্ঠ আমি চিনিনা?

-আরে সত্যিই আমার বন্ধুর কণ্ঠ। তোকে এজন্যই দিলাম যে শুনে দেখ তো ওর কণ্ঠ আর আমার কণ্ঠ সেইম কিনা। সবাই বলে এটা। তুইও বললি, বুঝলাম।

-সত্যি বলছো? এত মিল কণ্ঠে, বাহ!

-তো আবার কী? তোকে কেন গান শোনাতে যাবো? এটা বাদ দে, ভাবী বলেছে কিছু?

-না। কিছুই বলেনি। কী যে হয়েছে ভাবীর।

-তোর অত চিন্তা করতে হবে না। কাল আমার ভোরের বাস। তুই ঘুমা, টাটা।

-টাটা।

ফোন রেখে বালিশে হেলান দিল চিত্রলেখা। সিয়াম ভাইয়ের সকালের বাস তার মানে আর দেখা হবে না। চিত্রলেখা মাথা ঘামালো না বেশি। সারাদিনের ক্লান্তিতে বালিশে মাথা রাখতেই রাজ্যের ঘুম নেমে এলো তার চোখজুড়ে।

_______________

সময় বহমান কথাটা প্রকৃতপক্ষেই সত্য। এইতো রঙ্গন ফিরেছিল বাড়িতে এত তাড়াতাড়ি দুই সপ্তাহের বেশি হয়ে গেছে। আজ তাকে ফিরতে হবে। রাতের বাস আছে। রঙ্গন ঠিক করেছে চিত্রলেখার সাথে একবার কথা বলবে, একটা ধন্যবাদ জানানো উচিত। শেষ এক সপ্তাহ ঠিকমতো কথাই হয়নি তাদের। মূলত আশফিনা আহমেদের কড়া নজরদারিতে রঙ্গন সুযোগই পায়নি চিত্রলেখার সাথে কথা বলার। অপেক্ষায় প্রহর গুণছে রঙ্গন। এই বুঝি লেখা আসবে। অপেক্ষা পূর্ণতা পেল না, চিত্রলেখা আসলো না। রঙ্গনের এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু বিরক্ত লাগলো। আবারো ঢাকা শহরের বিষাক্ততার সম্মুখীন হতে বাধ্য সে। রাত এগারোটায় বাস। মাশরুর আহমেদ তাকে রেখে আসবেন বলেছেন। রঙ্গনের না বলার সাধ্য নেই।

এখন নয়টা বাজে। রঙ্গন জানালার ধার ঘেঁষে বসে আছে। রাতের আঁধারে রোডলাইটের স্মিত আলোয় রাস্তাটা জ্বলজ্বল করছে। অথচ রঙ্গনের মন জুড়ে আঁধার বিরাজ করছে। উদাসী চোখজোড়া একদৃষ্টিতে রাস্তার পানে চেয়ে আছে। নেই প্রতীক্ষা, নেই প্রত্যাশা তবুও কোথাও একটা শূন্যতা অনুভব করছে।

অহম ধীর পায়ে এসে রঙ্গনের কোলের মধ্যে ঢুকে পড়লো। রঙ্গন মাঝে মাঝে ভুলেই যায় তার এই ভাইটা কি আদৌ নাইনে পড়ে নাকি ক্লাস টুতে।

-বাচ্চাদের মতো কোলে বসলি কেন?

-ভাইয়া, তুমি আবার কবে আসবে?

-একেবারে পরীক্ষার পর।

-আমার আজ খুব মন খারাপ। ম্যামও আসলো না, তুমিও চলে যাচ্ছো। আমাকে কে সামলাবে?

-তোর আবার কেন মন খারাপ?

-আমার ব্রেক-আপ হয়েছে। ঐ রসায়ন স্যারের মেয়ের জন্য। বেদ্দপ মেয়ে বলে কিনা আমি ওকে প্রপোজ করছি। আমার জিএফ মেনেও নিলো! একটু বিশ্বাস করলো না!

-দেখ, তুই যেমন ছোট, ঐও ছোট। এখন স্বভাবতই বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে তোদের তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে একটা কথা মনে রাখবি, ভালোবাসায় ‘সম্মান’ জিনিসটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোকে সাজেস্ট করবো তোর জিএফকে এখন বেশি বিরক্ত করিস না।

-এখন ওকে না মানালে পরে আবার কথা শোনাবে।

-কথা শোনানোর অপেক্ষা কর। প্রেম করছিস, খুনসুটি কেন মিস করবি?

-তুমিও নাহ ভাইয়া! নিজে তো আমার ম্যামকে পটাতে পারলে না আবার আমাকে লাভ টিপস দিচ্ছো!

-কোল থেকে নাম।

অহম হাসতে লাগলো। রঙ্গন রাগী দৃষ্টিতে তাকালেও অহমের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। রঙ্গনের মন ভালো হয়ে গেল। ভালো থাকার জন্য বড়সড় কারণ লাগে না। ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই মানুষকে ভালো রাখে।

রঙ্গন সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাবার সাথে বের হলো। আশফিনা আহমেদের দৃষ্টিটা পড়তে অসুবিধা হয়নি রঙ্গনের। এ দৃষ্টি শাসনের নয়, সতর্কতার। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। চেনা এক অপরিচিত মহলে আবারো দম বন্ধ করে বসে থাকতে হবে তাকে।

____________________

চিত্রলেখা আজ সময়ের একটু আগেই এসেছে অহমকে পড়াতে। আগেরদিন আশফিনা আহমেদ নিষেধ করায় আসেনি সে। অহমকে আজ বেশ শান্ত মনে হচ্ছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় যথেষ্ট চুপচাপ।

-কী হয়েছে অহম? আজ এত শান্ত যে?

-কাল ভাইয়া চলে গেছে। একা একা ভালো লাগছে না।

-রঙ্গন? মানে রঙ্গন ভাইয়া?

-হ্যাঁ। ঢাকায় চলে গেছে। ভাইয়ার মতো বড় হয়ে গেলে আমিও ভাইয়ার ভার্সিটিতে পড়বো।

-তার জন্য পড়াশোনা করা লাগবে। বই খোলেন।

অহম বই বের করতে লাগলো। রঙ্গনের যাওয়ার খবরটা খানিকটা কষ্ট দিলো চিত্রলেখাকে। রঙ্গন একবার বলেওনি তাকে! পরক্ষণেই মনে হলো সে কে যে রঙ্গন তাকে নিজের সব কথা বলবে। নিজেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অহমকে পড়াতে শুরু করলো সে।

আশফিনা আহমেদের মন গতকাল খানিকটা বিমর্ষ থাকলেও আজ তিনি ফুরফুরে মেজাজে আছেন। তার ভাই নওশাদ আসছে। ভাই তার জন্য সুপরামর্শের ভাণ্ডার তবে কোনক্রমেই এ ভাইটাকে তিনি সংসারমুখী করতে পারেননি। বয়স আটত্রিশ ছুঁলেও দাম্পত্য জীবনের থেকে দুহাত ছাড়িয়ে তিনি। ভাবতে ভাবতেই নওশাদ এসে তার দরজায় টোকা দিল। বুঝতে পেরে আশফিনা আহমেদ হাসলেন। নওশাদ ভেতরে এসে বিছানায় সটান হয়ে বসলো।

-কী বনু? ভুলে গেছো ভাইকে?

-সে আর কোথায়? তুই তো খোঁজ রাখিস না।

-এখন সব দোষ আমার? দোষ না দিয়ে কফি দিলেও পারো।

-দাঁড়া আনাচ্ছি।

আশফিনা আহমেদ চেঁচিয়ে কফি আনার কথা বললেন কিন্তু নিচ থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে বেশ বিরক্ত হলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর নিচ থেকে সম্মতিসূচক বাক্য এলো। বিরক্তির উপর ছাই ফেলে আশফিনা আহমেদ ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলেন।

চিত্রলেখা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাবেয়ার দিকে। তার ডান হাতে বেশ খানিকটা কেটেছে। চিত্রলেখা যাওয়ার সময় আর্তনাদ শুনতে পেয়ে এসে দেখে এ অবস্থা। এরই মধ্যে আশফিনা আহমেদ কফির জন্য চেঁচালে রাবেয়া অনেকক্ষণ পর সম্মতি জানালো। রাবেয়ার অবস্থা দেখে চিত্রলেখার মায়া লাগলো। সে নিজেই কফি বানালো। অতঃপর ট্রে তে করে সাজালো।

-ম্যাডাম, আমাকে দিন আমি দিয়ে আসি।

-খালা, আপনার হাতে লেগেছে। আপনি পারবেন না। আপনি বসুন, আমি দিয়ে আসছি।

-বড় মেমসাহেব রাগ করবেন ম্যাডাম।

-সমস্যা নেই, আমি বুঝে নিব। আপনি ওষুধ লাগিয়েছেন, বিশ্রাম করুন।

রাবেয়াকে বিশ্রাম করতে বলে চিত্রলেখা কফির ট্রেটা নিয়ে আশফিনা আহমেদের ঘরের দিকে এগোলো। দরজাটা একটু চাপানো। এক হাতে ট্রে ধরে অন্য হাত দিয়ে নক করলো চিত্রলেখা। আশফিনা আহমেদ রাগী স্বরে ভেতরে প্রবেশ করতে বললেন। চিত্রলেখা কফির ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আশফিনা আহমেদের রাগ আরো বাড়লো।

-তুমি কেন এসেছো কফি নিয়ে?

-আসলে আন্টি, রাবেয়া খালার শরীরটা…

-কফি রেখে চলে যাও।

চিত্রলেখা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। কফির ট্রে টা রাখার সময় অযাচিতভাবে চোখ পড়লো নওশাদের দিকে। মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের চিত্রলেখার দিকে তাকানোর ভঙ্গিটা অদ্ভুত রকমের। চিত্রলেখার অস্বস্তি হলো। কফি রেখে সে দ্রুত রুম পরিত্যাগ করলো। নওশাদের তীক্ষ্ম দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো। কফির মগটা হাতে নিল সে।

-মেয়েটা কে?

-ও অহমের টিচার।

-এত অল্পবয়সী? এ নিজে এস.এস.সি পাশ করেছে?

-ধূর বাদ দে ওর কথা। তোর দুলাভাই এনেছে। সাথীর কথা মনে আছে না? ওর ননদ।

-সাথীর ননদ? ওহ আচ্ছা।

নওশাদ আর কথা বাড়ালো না। সাথীর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে তার বোন পছন্দ করে না সে জানে। এ বিষয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই তবে সাথীর ননদের প্রতি নওশাদের দৃষ্টিটা বেশ প্রখরভাবেই স্থায়ী হলো। নওশাদের চোখে বারবার চিত্রলেখার অল্প ভীত মুখখানি, লাল আভা মাখানো ঠোঁটটা ভাসতে লাগলো। নিজেকে চরম অতৃপ্ত মনে হলো তার। আর এ অতৃপ্তির কারণটাও সে অনুভব করতে পারছে। নওশাদের মন তখন চিত্রলেখাকে নিয়ে খেলছে, উন্মত্ত এক খেলা।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে