চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০৬

0
305

#চিত্রলেখার_কাব্য
ষষ্ঠ_পর্ব
~মিহি

“সিয়াম ভাইয়া…পানি…” চিত্রলেখার আওয়াজে ঘোর কাটলো সিয়ামের। হাতে থাকা পানির বোতলটা বাড়িয়ে দিল তার দিকে। কিছু মুহুর্ত আগের কল্পনাটা মনে করতেই সিয়ামের মুখে খানিকটা লাজুকতা ভর করে। কল্পনায় কত সহজে মনের কথাটা বলে ফেলল সে তবে বাস্তবতাটা বড্ড কঠিন। এখনো চিত্রলেখাকে মনের কথা বলার সময় আসেনি তা ভালোমতোই জানে সে।

চিত্রলেখা খাওয়া শেষ করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সুবহা তখনো লাস্ট প্লেট বলে আরেকটা প্লেট হাতে নিয়েছে। এ মুহূর্তে চিত্রলেখা খানিকটা বিরক্ত হচ্ছে। তার অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাড়িতে গেলে ভাবী নিশ্চিত ঝাড়বে তাকে। বিষয়টা বুঝতে পেরে সিয়াম সুবহাকে তাড়া দিল। সুবহা তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করলো। বিল পরিশোধ করার পর যাওয়া নিয়ে একটা ঝামেলা বাঁধলো। সিয়াম এক বাইকে দুইজনকে নিয়ে যেতে পারবে না, আবার চিত্রলেখাকে একাও ছাড়তে পারবে না। একবার ভাবলো দুজনকে রিকশায় পাঠাবে তারপর চিত্রলেখার বাড়ি থেকে সুবহাকে পিক-আপ করবে। এমন সময় আচমকা পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেল সে। পেছনে ফিরে দেখলো তার চাচা অর্থাৎ সুবহার বাবা।

-আসসালামু আলাইকুম চাচ্চু।

-এখানে কেন তুমি?

-কালকে চলে যাবো তাই ওদের খাওয়াতে এনেছিলাম।

-সন্ধ্যে হয়ে এসেছে সিয়াম, তোমার খেয়াল রাখা উচিত। আমি সুবহাকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি লেখাকে রেখে এসো।

-আচ্ছা চাচ্চু। আপনি কোনো কাজে যাচ্ছিলেন?

-না, কলেজে একটা মিটিং ছিল। ওখান থেকে বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। এখন ফিরছিলাম। তুমি যাও, দ্রুত লেখাকে রেখে আসো। লেখা মা, যাও ভাইয়ার সাথে।

চিত্রলেখা মাথা নাড়লো। সুবহাকে বিদায় জানালো সে। এশার আযান দিয়েছে। ভয়ে হাত পা কাঁপছে চিত্রলেখার। বড় ভাবী নিশ্চিত আজ ছাড়বে না তাকে।

-বাইকে উঠবি নাকি রেখে চলে যাবো?

-হ্যাঁ উঠছি।

চিত্রলেখা আনমনেই সিয়ামের পেছনে বসে পড়লো। হঠাৎ তার মনে হলো বিকেলে ভাবীর সামনে সে হিজাব পড়ে ছিল না। এখন হিজাব পড়ে গেলে নিশ্চিত ভাবীর বকা বেশি খাবে। সিয়ামকে থামতে বলে হিজাব খুলে ওড়নার মতো মাথায় মেলে দিল।

সিয়াম বেশ জোরেই বাইক চালাচ্ছে। চিত্রলেখা সিয়ামের কাঁধে কোনোরকম একটা হাত রেখে বসেছে। বাতাসে খোঁপার কাঠি খসে পড়লো, কোমড় অবধি চুলগুলো পুরোপুরি না খুললেও ঘাড় অবধি মেলে পড়লো। সামনের অবাধ্য চুলগুলোর তাড়নায় ছটফট করতে লাগলো চিত্রলেখা।

-নড়ছিস কেন? সমস্যা হচ্ছে বসতে? এত মোটা কবে হলি?

-আরে ধূর! আমি মোটা হইনি। চুলগুলো বিরক্ত করছে।

-খুলেই রাখ। আধখোলা রাখলে তো বিরক্ত করবেই।

-তুমি বেশি জানো?

-মেয়েমানুষের সাথে কথা বলাই বৃথা।

-কী বললে তুমি? বেশ, এরপর ভুলেও কথা বলবো না কোনোদিন।

সিয়াম ব্রেক কষলো। চিত্রলেখা বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। সিয়াম তার তোয়াক্কা না করেই বাইক সাইড করে পাশের একটা আইসক্রিমের স্টলের দিকে ছুটলো। দুটো আইসক্রিম এনে একটা চিত্রলেখার সামনে বাড়িয়ে দিল।

-নে আইসক্রিম খেয়ে ঠাণ্ডা হ।

-আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে সিয়াম ভাই।

-আমি কাল চলে যাবো, আমার কত কাজ আছে জানিস? তবুও তোকে সময় দিচ্ছি ভালো লাগছে না তাইনা?

-সময় দিতে বলেছে কে?

চিত্রলেখা মজার সুরে কথাটা বললেও খারাপ লাগলো সিয়ামের। বাক্যটা ছুরির মতো ফালা ফালা করে দিল তার হৃদয়টাকে। তবুও ঠোঁটে হাসিটা বহাল রাখলো সে।

-ভাবী কি এখনো মারে তোকে?

-কাল থেকে হঠাৎ ভালো হয়ে গেছে। বুঝতে পারছি না হঠাৎ কী হয়েছে।

-ভালো হলে তো ভালোই। অত বুঝতে হবে না। আইসক্রিম শেষ কর।

-ওহ হ্যাঁ, তোমাকে ধন্যবাদ নোটসগুলোর জন্য।

-একবারে দেইনি, পড়ে ফেরত দিবি আবার।

-কিপ্টা!

-আমার টাকায় আইসক্রিমের খেয়ে আমারেই কিপ্টা বলো! আচ্ছা ছাড়, মিস করিস না আমাকে একটুও?

-তোমাকে মিস করার কী আছে? দিব্যি তো রাবির বাসে হেলান দিয়ে বেশ আছো।

-এই তুই আমার প্রোফাইল স্টক করিস! তার মানে তুই ফেসবুক চালাস। আগেরবার মিথ্যে বলেছিস।

-ভাবীর আইডিতে দেখেছিলাম তোমার ঐ প্রোফাইল পিকচারটা তাও অনেকদিন আগে।

-মিথ্যা বলার জায়গা পাস না? দুইদিন আগে এটা আপলোড করছি আর তুই অনেকদিন আগে দেখছিস? কেমনে? টাইম ট্রাভেল করে?

চিত্রলেখা ধরা পড়ে বিষম খেল। সমানে কাশতে লাগলো। সিয়াম মুচকি হেসে পিঠে আলতো করে হাত রেখে বলতে লাগলো, ‘বালাই শাঁট!’ অল্পক্ষণেই কাশি থেমে গেল। ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। সিয়ামও বুঝতে পারলো। আর দেরি না করে দ্রুত চিত্রলেখাকে বাড়ি থেকে একটু সামনে নামিয়ে দিল।

-আমি কি ভেতরে রেখে আসবো? ভাবী বকবে না দেরি হলো যে?

-তুমি গেলে বেশি বকবে। তার চেয়ে একাই যাই।

-আচ্ছা শোন আমি কাল চলে যাচ্ছি।

-কয়বার বলবা?

-একবার ভালো করে বিদায় জানাইছিস? রাজশাহী চলে যাওয়ার পর থেকে দেখতেছি তুই আমারে পাত্তাই দেস না।

-আচ্ছা আচ্ছা। সাবধানে যেও।

-তোর নম্বরটা রেখে দিছি। বাসায় গিয়ে নক দিব। খবরদার যদি ব্লক করছিস।

চিত্রলেখা হ্যাঁ-না কিছু না বলেই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। ভেবেছিল বোধহয় তুলকালাম কাণ্ড হবে। সেরকম কিছুই হলো না। বড় ভাবীকে আশেপাশে দেখাই গেল না। বরং সাথী এসে খানিকটা বকাবকি করলো চিত্রলেখাকে এত দেরি করার জন্য। মাথা নিচু করে সবটা শুনে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল চিত্রলেখা। মনে মনে সুবহাকে গালি দিতে লাগলো। বেয়াদব মেয়েটাই নিশ্চয়ই সিয়াম ভাইকে তার নম্বরটা দিয়েছে। আর কিছু না ভেবে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে।

_______________

ফোন স্ক্রল করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়েছে রঙ্গন। ভার্সিটি মিস দিয়ে বাড়িতে এসে বসে আছে। পরীক্ষার শিডিউল নেই দেখে এমন করতে পারছে তবে শীঘ্রই ঢাকায় ফিরতে হবে তাকে। রঙ্গনের আবারো মন খারাপ হচ্ছে। ঢাকা শহরটা কোনোভাবেই আর তাকে টানছে না। ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষাটা দিয়ে ঐ দূষিত শহর থেকে মুক্ত হতে পারলে বাঁচে সে। আনমনে এসব ভাবতে ভাবতেই আশফিনা আহমেদ তার রুমে ঢুকলেন। রঙ্গন খেয়াল করে উঠে দাঁড়ালো।

-আমি কি টিচার যে আমাকে দেখলেই দাঁড়াতে হবে?

-না, মা। আসলে…

-ঢাকায় ফিরবে কবে?

-এক সপ্তাহ পর যাবো ভাবছিলাম।

-ক্যাম্পাসে কিছু হয়েছে? দীর্ঘসময় বাড়িতে থাকার ছেলে তো তুমি নও।

-না মা, কিছু হয়নি। তোমাদের মিস করছিলাম তাই এসেছি।

-রঙ্গন, তুমি যতই বড় হও না কেন আমার কাছ থেকে কিছু আড়াল করতে পারবে না। তুমি আমার খুব আদরের। আমি যখন একটা সন্তানের অভাবে দীর্ঘসময় যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিলাম, তখন তোমাকে পেয়েছি। তোমাকে নিয়ে আমার স্বপ্নগুলো আকাশচুম্বি। মরীচিকার পেছনে আমার ছেলে ছুটবে না। কখনোই না, বুঝেছো?

-জ্বী মা।

-খেতে এসো।

আশফিনা আহমেদ রঙ্গনকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। রঙ্গন আবার আগের মতো বসে পড়লো। বিড়বিড় করতে লাগলো,”মরীচিকা কিনা জানিনা মা তবে চিত্রলেখা আমার জন্য দরকারি কিছু। মরীচিকা হলেও তার সংস্পর্শে থাকতে আমার ভালো লাগে। এটা ভালোবাসা না, এটা বেনামী একটা অনুভূতি। সে আমার বন্ধু, বেনামী বন্ধুত্ব আমাদের।”

খাবার টেবিলে আজ মাশরুর আহমেদকে পাওয়া গেল না। তিনি শহরের বাইরে। অহম নিজের ঘরে বসে খেয়ে নিয়েছে। আবারো মুখোমুখি কেবল আশফিনা আহমেদ এবং রঙ্গন। রঙ্গন আজ বড্ড অস্বস্তিতে ভুগছে নিজের মায়ের সামনে। মায়ের চোখে চোখ রাখতেও ভীত হচ্ছে সে। আশফিনা আহমেদ লক্ষ করেছেন রঙ্গনের এ অস্বস্তি।

-রঙ্গন, তোমার তিরার কথা মনে আছে?

-তিরা? মানে তোমার বেস্টফ্রেন্ডের মেয়ে?

-হ্যাঁ, ওর সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করবো ভাবছি।

-মা, ওকে আমি ঠিকমতো চিনিও না।

-ঠিকমতো না চিনলে সময় কাটানো যায় না?

-না যায় না, মা। যাকে ঠিকমতো চিনিই না, তার সাথে সময় কাটবেই কিভাবে?

-যেভাবে চিত্রলেখার সাথে তোমার সময় কাটে।

বিষম খেল রঙ্গন। পানির গ্লাসটা তার দিকে বাড়িতে দিয়ে আশফিনা আহমেদ বেশ শান্ত গলায় বলে উঠলেন,”রঙ্গন, নিজেকে ভুল পথে এতটা এগিয়ে দিও না যেন পরে অনুতাপে চোখে চোখ না রাখতে পারো।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে