চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০৩

0
335

#চিত্রলেখার_কাব্য
তৃতীয়_পর্ব
~মিহি

“কোথা থেকে এ ভরসন্ধ্যায় আসছে মহারানি তাও আবার এত বড় গাড়িতে? কী করতে গিয়েছিলি তুই? সমস্ত পাড়ার লোক আমাদের বাড়ির দিকে বাকা চোখে তাকাচ্ছে!” বলতে বলতেই চিত্রলেখাকে মারার জন্য হাত উঁচু করলো অপর্ণা। চিত্রলেখা ভয়ে পিছু সরলো।

-ভাবী, আমি তো পড়াতে গিয়েছিলাম। ছোট ভাবীকে বলে গিয়েছিলাম।

-ছোট ভাবীকে বলে গিয়েছিস মানে? খাস আমার স্বামীর টাকায় আর আলগা পিরিত করো ছোট ভাবীর সাথে। থাপ্পড় চেনো? আমার অনুমতি নিছিস তুই? তোর সাহস কী করে হলো আমায় না জানিয়ে এসব করার?

-ভা…ভাবী! আমি আসলে…

চিত্রলেখা নিশ্চুপ হয়ে গেল। অপর্ণা নিজের রাগ ঝাড়ুক সেটাই ভালো। বেশি কথা বলতে গেলে নিশ্চিত মা তুলে গালি দিবে। তার চেয়ে তাকেই অপমান করুক। অপর্ণা কিছু বলার আগেই সাথী এলো সেখানে। চোখের ইশারায় চিত্রলেখাকে সরতে বললো। ভীত চিত্রলেখা নড়ার সাহস পাচ্ছিল না তবুও সাথীর আশ্বস্ত করাতে চুপচাপ সরে গেল। সাথী অপর্ণার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

-আরে আপা! কী করছো কী? এত বোকামি করলে চলে?

-কী বলতে চাচ্ছিস তুই?

-দেখো, ও একটা বড়লোক বাড়িতে পড়াতে যায়। সেখানে সব বড়লোকদের উঠাবসা। তাছাড়া চিত্রলেখার বয়স কম, দেখতে শুনতে খারাপ না। কারো যদি ভুলেও পছন্দ হয়, তাহলে ওর বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের?

-আরে বাহ, তুই তো ভালো বুদ্ধি দিয়েছিস রে। একটা বড়লোক বুড়ো জুটিয়ে ফেললে সে টাকায় আমরাও আয়েশ করতে পারবো। এর বাপ তো দুই বউ রেখে সব টাকা ধ্বংস করে চলে গেছে। এখন ওর থেকে ওসুল করা যাবে।

-হ্যাঁ, সেজন্যই তো ওর সাথে ভালো আচরণ করো এখন। ওকে একটু ভালো পোশাক আশাক পড়াও। পরে লাভ তো আমাদেরই।

-ঠিক বলেছিস। তোর বুদ্ধি আমার পছন্দ হয়েছে। কাল তোকে চটপটি খাওয়াবো।

সাথী মুচকি হাসলো। ভালো মানুষদের ভালো কথায় এবং খারাপ মানুষদের কুমতলব বাতলে দিয়েই আটকাতে হয়। এ কুমতলব যখন অপর্ণার মাথায় ঢুকেছে, তখন নিজের স্বার্থেই সে চিত্রলেখার সাথে ভালো ব্যবহার করবে।

-আচ্ছা ভাবী থাকো, আমি লেখাকে খাবার দিয়ে আসি।

-আরে দাঁড়া, আমি যাচ্ছি। কী তরকারি রেঁধেছিস?

-আলু পটলের ঝোল।

-লেখা তো ঝোল তেমন পছন্দ করে না। ওর জন্য একটা ডিম ভেজে দে।

সাথী মনে মনে হাসলো। মানুষ আসলেই অদ্ভুত! যে এতদিন চিত্রলেখার খাওয়া নিয়েই খোঁজ রাখেনি, আজ সেই মানুষটাই চিত্রলেখার পছন্দ অপছন্দের কদর করছে। সাথী মুচকি হেসেই রান্নাঘরের দিকে এগোলো। অপর্ণা তখন সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে চিত্রলেখার জন্য কয়েকটা জামা কিনতে হবে। চটজলদি অর্ণবকে কল দিল সে। বারকয়েক রিং হওয়ার পরও অর্ণব রিসিভ করলো না। বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকলো সে।

_______________

চিত্রলেখা হাতমুখ ধুয়ে বেরোতেই দেখল রূপসা তার বিছানার উপর বসে আছে। রূপসা হলো চিত্রলেখার ভাতিজি, অপর্ণা এবং অর্ণবের ছোট মেয়ে। রূপসা চিত্রলেখা বলতে পাগল। তাই অপর্ণা চিত্রলেখাকে অনেকটাই অপছন্দ করে। রূপসার বড় ভাই রাদিফ আবার অন্যরকম স্বভাবের। সে শান্ত, কথা খুব কম বলে। পড়ে ক্লাস থ্রিতে তবে হাবভাব দেখলে মনে হবে সে বয়সে যেন সবার বড়। বাচ্চাসুলভ আচরণ তার মাঝে নেই। চিত্রলেখা বিছানায় বসতেই রূপসা চিত্রলেখার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। এতক্ষণ যেন এ মুহূর্তের অপেক্ষাতেই সে ছিল।

-এখন এসেছিস যে? পড়াশোনা নেই? ভাবী দেখলে মাইর দিবে।

-আমার পড়া অনেকক্ষণ শেষ। পড়ি ক্লাস টু তে, পড়া শেষ দুই মিনিটে।

-আরে আরে, রূপ তো কবিতা বলতে শিখে গেছে। রাদিফ এখনো পড়ছে?

-ভাইয়ার পড়া শেষ হয় কখন? সারাক্ষণই তো এ বই, সে বই নিয়েই বসে থাকে। আমার সাথে একটু খেলেও না।

-আহারে সোনাপাখি, চলো আমরা ‘রস-কস’ খেলবো।

-না না, তুমি গল্প শোনাবে আমাকে।

-গল্প? আচ্ছা, কিসের গল্প শুনতে চাও?

রূপসা উত্তর দেওয়ার আগেই অপর্ণা খাবারের প্লেট হাতে উপস্থিত হলো। চিত্রলেখা মনে হয় ভূত দেখার মতো চমকালো। অপর্ণা খাবারের প্লেট হাতে তার ঘরে? রূপসার জন্য বোধহয়।

-ভাবী, তুমি আসতে গেলে কেন? আমি রূপসাকে পাঠিয়ে দিতাম। রূপসা, যাও খেয়ে নাও।

-আরে এটা রূপসার জন্য না। তোমার জন্য ডিম ভাজি-ভাত এনেছি। খেয়ে নাও।

চিত্রলেখা এবার আকাশ থেকে পড়লো। তার ভাবীকে কি জ্বীনভূত আছড় করলো? কেমন কেমন কথা বলছে! তার জন্য কিনা খাবার বেড়ে এনেছে! চিত্রলেখার চোখ গেল দরজার দিকে। সাথী সেখানে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। চিত্রলেখা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সাথীর ইশারাটা ঠিকঠাক ধরতে না পারলেও অপর্ণার কথামতো খাবারের প্লেটটা নিয়ে খেতে শুরু করলো।

_____________

রঙ্গন নিজের ঘরে বসে নিজের বইগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছিল। লক্ষ করলো অহম বারবার তার ঘরের দিকে এসে ফিরে যাচ্ছে। রঙ্গন ঘরে ডাকলো তাকে। অহম এসেই রঙ্গনের বিছানার উপর পা তুলে বসে পড়লো।

-অশরীরী আত্মার মতো আমার ঘরের বাইরে ঘুরছিলি কেন?

-আমার ম্যামটা দেখতে কিন্তু সুন্দর, বলো।

-তাতে তোর কী?

-আমার আবার কী? আমি কোলে নিয়েছিলাম নাকি?

-তুই কিন্তু খুব বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস অহম।

-সত্য কথার দাম নেই আসলে। আমি এসেছিলাম তোমাকে একটা খুশির খবর দিতে আর তুমি অযথাই বকলে। যাও বলবো না এখন।

-কী খুশির খবর বল শুনি।

-চকলেট দাও আগে।

-আমি কি দোকানদার যে সারাক্ষণ চকলেট নিয়ে বসে থাকবো?

-তোমার ব্যাগে সবসময় চকলেট থাকে আমি জানি। দাও চুপচাপ।

রঙ্গন অহমের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অতঃপর ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে অহমের হাতে ধরিয়ে দিল।

-হ্যাঁ, এখন খুশির খবর হচ্ছে তুমি অতি শীঘ্রই আমার ম্যামের প্রেমে পড়তে চলেছো।

-চকলেট ফেরত দে!

অহম চকলেট নিয়ে দৌড় দিল সেখান থেকে। রঙ্গন আর কিছু বললো না। টিন-এজ বয়সে সবার প্রেম কাহিনী এভাবেই সাজাতে ভালো লাগে, এসব ততটাই অবাস্তব যতটা রাজপুত্রের পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে আসা।

______________________

-লেখা, সিয়াম ভাই তোর জন্য নোট খাতা দিয়ে গেছে আমাকে।

-ভাইয়া এসেছে?

-জ্বী। চাচাতো ভাই আমার অথচ আমাকে তো দেয় না নোটখাতা! তোকেই কেন দেয় বুঝিনা।

-আমাদের দুঃখ একরকম তাই হয়তো। উনিও এতিম আর আমিও।

-এসব কথা কেন বলিস? তোর ভাই তোকে কত ভালোবাসে অথচ তুই সবসময় নিজেকে একা ভাবিস।

চিত্রলেখা হাসলো। সুবহা তো জানেনা একজনের ভালোবাসার আড়ালে কতজনের ক্ষোভ সে সহ্য করে! অবশ্য এখন তা অকস্মাৎ কমেছে একদিনেই।

-আচ্ছা বাদ দে, এত ভাবতে হবে না। ভাইয়া পরশু চলে যাবে, তুই কি দেখা করবি?

-দেখা করার সুযোগ কোথায়? ভাইয়াকে আমার হয়ে শুভ কামনা দিস আর অনেকগুলো ধন্যবাদ।

-তুই চাইলেই দেখা করতে পারিস। আজ বিকেলে পড়ার নাম করে চলে আয় বাসায়।

-না, বিকেলে কাজ আছে।

-ভালো! দুনিয়ার সব কাজ তোর! থাক কাজ নিয়েই।

চিত্রলেখা আবারো নিরুত্তর বসে রইলো। সিয়াম ভাই তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। তার অসহায়ত্ব বুঝতে চেষ্টা করেন, বোধহয় অনুভবও করতে পারেন অনেকাংশে তবে চিত্রলেখা তাকে এখন এড়িয়েই চলে। ভুলবশত তার ভাবীর কানে পড়লে সিয়াম ভাইয়ের সম্মানটুকুও ভরাবাজারে নিলামে তুলবেন তিনি।

কলেজ যথাসময়ে ছুটি দিল। চিত্রলেখা আগে আগেই বেরিয়ে পড়লো। সুবহার সাথে গেলেই সুবহা বারবার তার বাড়িতে যেতে বলবে। মাথা নিচু করে দ্রুত পায়ে কলেজ গেট অতিক্রম করছিল চিত্রলেখা। আশেপাশের কোনোকিছুতে তার ধ্যান নেই।

‘চিত্রলেখা’ পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেয়ে আঁতকে উঠলো চিত্রলেখা। পিছু ফিরতেই দেখতে পেল দুপুরের রোদে ঘর্মাক্ত ক্লান্ত চেহারাটা। চিত্রলেখা এড়িয়ে যাওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারতো না কিন্তু পেছনে ফিরতেই দেখলো সিয়াম ভাইয়ের থেকে কিছুটা দূরেই তার বড় ভাবী কৌতুহলী আঁখি মেলে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে আঁতকে উঠলো সে। না জানি কোন ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে তার জন্য!

চলবে …

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে