চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-০৪

0
316

#চিত্রলেখার_কাব্য
চতুর্থ_পর্ব
~মিহি

চিত্রলেখা করুণ চোখে তাকিয়ে আছে নিজের ভাবীর দিকে। পাঁচটা দোকান ঘুরে প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকার তিনটা ড্রেস আরো নানান জিনিসপত্র কিনেছে অপর্ণা। চিত্রলেখা ভুলেও ভাবেনি এসব কেনাকাটা করতে অপর্ণা তার কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে ছিল। ভাগ্য ভালো সিয়াম ভাই এবং তাকে একসাথে দেখে ফেলেনি সে। ঘণ্টা দেড়েক ধরে কেনাকাটা করে সব জিনিসপত্র বুঝে মার্কেট থেকে বের হলো অপর্ণা। চিত্রলেখা বোকার মতো তার পিছু পিছু হাঁটছে। পাঁচটা ব্যাগের দুটো তার হাতে। তাও সে নিজে নিয়েছে। অপর্ণা তার প্রতি অকস্মাৎ এত ভালো কেন হলো বুঝে উঠতে পারছে না সে।

-ভাবী, হঠাৎ এতকিছু কেনার কী দরকার ছিল?

-তোর কাপড়গুলো যথেষ্ট পুরনো হয়েছে। তাছাড়া তোর ভাইকে কল করেছিলাম কিন্তু ধরলোই না। ওহ হ্যাঁ ভালো কথা মনে পড়েছে, তোর জন্য একটা ফোনও কিনতে হবে।

-কিন্তু ভাবী আমার তো বিকালে পড়াতে যেতে হবে। আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে দেরি হয়ে যাবে।

-আচ্ছা তোকে রিকশায় তুলে দিচ্ছি, তুই এগুলো নিয়ে বাসায় যা। বাসায় পৌঁছে সাথীকে বলবি আমাকে কল করতে।

চিত্রলেখা মাথা নাড়লো। এতগুলো জিনিস নিয়ে রিকশা ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। অপর্ণা রিকশা ডাকলো। চিত্রলেখাকে উঠিয়ে দিয়ে ভাড়াটাও নিজে পরিশোধ করলো। চিত্রলেখা অবাক দৃষ্টিতে কেবল এসব পর্যবেক্ষণ করে গেল। তার সাথে কী হচ্ছে এখনো বুঝতে পারছে না সে। সে কি স্বপ্ন দেখছে? রিকশা থেকে লাফ দিয়ে চেক করবে একবার? অদ্ভুত সব খেয়াল ঘুরঘুর করছে তার মাথায়। একজন মানুষ এরকম তড়িৎ গতিতে কিভাবে পরিবর্তিত হতে পারে? ফোনের জন্য অবশ্য ইচ্ছে করেই মানা করেনি সে। বাড়িতে সবারই ফোন আছে। বড় ভাইয়া ব্যবসার কাজে প্রায়শই বাইরে থাকেন তাই ভাবীর একটা ফোন আছে। ছোট ভাইয়া শহরের বাইরে চাকরী করেন। সপ্তাহে একবার কিংবা মাস অন্তর দুইবার আসেন। ছোট ভাবীর জন্যও ফোন আছে কিন্তু চিত্রলেখার নেই। অবশ্য তার লাগেও না। কোনো দরকার পড়লে ছোট ভাবীকে বললেই ফোন পায় সে কিন্তু বড় ভাবীর মাথায় কী চলছে তা বোঝার জন্য চুপচাপ আছে সে। ভাবনা-চিন্তার মাঝেই দরজার কাছে এসে রিকশা থামলো। ব্যাগগুলো নিয়ে নামার সময় আবারো কিছু মানুষ ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। অন্যের কাজে নাক গলানো ছাড়া এদের কোনো কাজ বোধহয় না আছে!

______________

-ভাবী, কী হচ্ছে কী বলো তো। বড় ভাবী হঠাৎ এত ভালো হলো কী করে?

-আম খাও, আঁটি গুণে কী করবা?

-ধ্যাত! ভাবী কল দিতে বলেছে তোমাকে। গেলাম আমি।

সাথী হাসলো। অপর্ণাকে বলা কথা চিত্রলেখার কাছে কোনোভাবেইই বলতে পারবে না সে। দেখা যাবে মেয়েটা অস্বস্তিতে পড়ছে। সাথী ভাবনার পশরা বন্ধ করে অপর্ণার নম্বর ডায়াল করলো।

-হ্যালো আপা, লেখা পৌঁছেছে। তোমার আসতে কি দেরি হবে? বাচ্চাদের খাইয়ে দিয়েছি আমি।

-না, আর আধঘণ্টার মতো লাগবে। শোন, লেখাকে বলবি একটা নতুন জামা পড়ে যেতে। গোলাপি রঙের একটা জামা আছে দেখিস, ওটা পড়তে বলবি। আর একটু পরিপাটি করে পাঠাস।

-সে আবার বলা লাগে আপা? আমি দেখে নিচ্ছি।

-আচ্ছা আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি।

সাথী ফোন রেখে চিত্রলেখার জন্য তরকারি গরম করতে লাগলো। ততক্ষণে মেয়েটা গোসল সেরে নিক। হঠাৎ সাথীর জামার কথা মনে হলো। অপর্ণার কথা না শুনলে অযথা চেঁচামেচি করবে। সাথী রান্নাঘর থেকে চিত্রলেখাকে ডাকলো।

-লেখা! এদিকে আয় তো একটু।

-বলো শুনছি।

-এখানে আসতে পারিস না? আচ্ছা শোন, আপা যে জামাগুলো কিনেছে, তার মধ্যে থেকে গোলাপিটা পড় আজ।

-আজকেই পড়তে হবে?

-পরে এসে চেঁচালে আমার দোষ নাই।

-আচ্ছা বাবা বুঝছি!

চিত্রলেখা আর কী করবে, গোলাপি জামাটা নিয়ে গোসলে ঢুকলো। জামাটা সুন্দর। হালকা গোলাপি রঙের গোল জামা, মাঝ বরাবর সাদা একটা লাইন সুন্দরভাবে ডিজাইন করা আর সাদা বর্ডার। চিত্রলেখা মনে করতে পারলো না এত কেনাকাটা তার জন্য তার ভাবী শেষ কবে করেছিল। বরাবরই পোশাক আশাকের জন্য তার বড় ভাইয়ের কাছেই যেতে হয়। ভাবীর কানে পড়লে বরং ঝামেলা বাঁধে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝর্ণা ছেড়ে দিল সে। ভিজতে ভিজতে হঠাৎ খেয়াল হলো সিয়াম ভাইয়ের কথা। বেচারা মানুষটাকে এড়িয়ে ভাবীর সাথে চলে গেল সে কিন্তু কিছু তো করার ছিল না। সিয়াম ভাই কি বুঝবে ব্যাপারটা? একটা ছোটখাটো দুঃখিত আর ধন্যবাদ পাঠানো অতিশয় প্রয়োজনীয় কাজ হয়ে পড়েছে।

গোসল সেরে বেরিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখল। গোলাপি রঙটা মানিয়েছে তাকে। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, ক্রমেই পিঠ ভিজে উঠলো। চুল ভালোমতো মুছে তোয়ালে মাথায় জড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলো।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠতেই অপর্ণা এলো। চিত্রলেখা মাত্র নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য উঠেছে, অপর্ণা এসে তার সামনে দাঁড়ালো। ফোনের বক্সটা চিত্রলেখার হাতে ধরিয়ে দিল। চিত্রলেখা ভেবেছিল বাটন ফোন আনবে হয়তো অথচ তার ভাবী সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়ে স্মার্টফোন এনেছে! বিগত এক বছরে তার জন্য করা মোট খরচ আজকের একদিনের খরচের চেয়ে কম।

-এই নে তোর ফোন। টিউশনি শেষ হলে বা কোথাও গেলে কল করবি। এত বড় একটা মেয়ে, কখন কোথায় যাস খোঁজ পাইনা! যা রেডি হ।

-আচ্ছা ভাবী কিন্তু এত দামি ফোনের…

-তোর ভাবতে হবে না সেটা। যা রেডি হ।

চিত্রলেখা বাক্য ব্যয় না করে চুপচাপ ফোনটা নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বড় ভাবী যেভাবে তার পেছনে পড়ে আছে, একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই। চুল খোঁপা করে মাত্র ক্লিপ আটকাতে নিয়েছে অমনি আবারো দেবদূতের মতো হাজির বড় ভাবী।

-এই এই, চুল বাঁধছিস কেন?

-হিজাব পড়বো তো ভাবী, চুল খোলা রেখে তো পড়া যাবে না।

-একদম হিজাব-টিজাব পড়ার দরকার নেই। কী সুন্দর চুল। চুল খোলা রেখে যা। সুন্দর লাগবে।

-কিন্তু ভাবী ওখানে আমি পড়াতে যাই, সেখানে খোলা চুলে যাওয়াটা…

-আমি যা বলেছি তার উপর একটা কথাও না।

চিত্রলেখা ভারি মুসিবতে পড়লো। এ কেমন জোরজবরদস্তি! পরক্ষণেই তার মাথায় বুদ্ধি আসলো। ভাবীর সাথে তর্ক না করে সে সম্মতি জানালো। অপর্ণা খুশি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। চিত্রলেখা চটজলদি হিজাব এবং পিনগুলো নিজের ব্যাগে রেখে দিল। গাড়িতে বসে এসব পড়ে নিবে দ্রুত, আবার আসার সময় খুলে রাখবে। অহমদের বাড়িতে খোলা চুলে গেলে বিষয়টা কতটা অস্বস্তিকর হতে পারে তা সে নিজেও আন্দাজ করতে পারছে। এখনো গাড়ি আসেনি এই ভেবে নতুন ফোনটা অন করলো সে। ভাবী নিজেই সিম কিনেছে এবং নিজ দায়িত্বে পরিবারের সদস্যদের নম্বর সেভও করেছে। চিত্রলেখার সুবহার নম্বর মনে ছিল। সেটাও সেভ করলো সে। সুবহাকে কি একবার কল করবে? না থাক, অযথা আবার সিয়াম ভাইয়ের আলাপ শুরু হতে পারে। সুবহা আসলে এখনো বাচ্চা স্বভাবের। সিয়াম ভাইকে নিয়ে আলোচনা করতে তার অস্বস্তি হয়না কিন্তু চিত্রলেখার হয়। একটা মানুষ নিঃস্বার্থভাবে সবসময় তাকে সাহায্য করে এটা ভেবেই সে লজ্জায় পড়ে যায়। গাড়ির হর্ণের শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার। ফোনটাও ব্যাগে রেখে ব্যাগটা নিয়ে বাইরে বেরোলো। বড় ভাবী দরজার কাজে দাঁড়িয়ে ছিল। চিত্রলেখা কিছু বলার আগেই তাদের গাছের জবা ফুল তার কানে গুঁজে দিল। অতঃপর তাকে ঠেলে গাড়িতে তুলে দিল। অদ্ভুত তো! এই মহিলা কি তাকে জোকার বানিয়ে ছাড়বে?

গাড়ি স্টার্ট দিতেই চিত্রলেখা চটজলদি জবাফুলটা খুলে পাশের সীটে রাখলো। চুলগুলো খোঁপা করে হিজাব বাঁধতে শুরু করলো। অভ্যেস থাকাতে আয়নার প্রয়োজন পড়লো না তবে গাড়ি জোরে চালানোর ফলে খানিকটা অসুবিধা হচ্ছিল তার। হিজাব বাঁধতে বাঁধতেই সে বলে উঠলো,’আঙ্কেল, গাড়িটা একটু ধীরে চালান।’

গাড়ি ব্রেক করে সামনে থেকে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে পেছনে ফিরলো রঙ্গন। চিত্রলেখার হাত থেকে পিন নিচে পড়ে গেল।

-কী অদ্ভুত ম্যাম! আপনার চোখের সমস্যা তো মারাত্মক, এখনো ডাক্তার দেখাননি যে?

-আপনি কেন?

-আমার বাবার গাড়ি আমি চালাতে পারি না?

-না সেটা না!

-তবে কথা কিসের? খোলা চুলে খারাপ লাগছিল না আই গেজ!

-সবকিছুর একটা ক্যাজুয়াল রূপ থাকে।

-বাহ বেশ তবে সবকিছুর একটা নিয়মও থাকে। সীটবেল্ট বাঁধুন আগে।

চিত্রলেখা খোঁচাটা ধরতে পারলো। পিনটা নিচে থেকে তুলতে গিয়ে অনুভব করলো আঙুলে খানিকটা আচড় লেগেছে সেটার। রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়েছে অল্প অংশ। সেদিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে সীটবেল্টটা বেঁধে নিল সে। রঙ্গন ফ্রন্ট মিররে দেখলো চিত্রলেখার অস্বস্তি। মেয়েটাকে এখন বাড়িতে না নিয়ে গিয়ে কোনো অজানা জায়গায় নিয়ে গিয়ে যদি সে বলে, আপনাকে কাডন্যাপ করেছি। মেয়েটা কি ভয় পাবে? বোধহয় পাবে। বাচ্চা মেয়ে! নিজের কীর্তিকলাপে নিজেই হেসে উঠলো রঙ্গন।

গাড়ি থামলো রঙ্গনদের বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে বের হলো চিত্রলেখা। দরজা লাগানোর সময় বেকায়দায় আঙুলে লাগলো তার। ব্যথায় ক্ষীণ আর্তনাদ করে উঠলেও তা রঙ্গনের কানে গেল। ‘দেখি কোথায় লেগেছে’ বলে আঙুলটা ধরলো সে। চিত্রলেখার অদৃষ্টের পরিহাসে এ দৃশ্য পুনরায় চোখ জ্বালিয়ে দিল আশফিনা আহমেদের।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে