চন্দ্রকুঠি পর্ব-৩+৪

0
649

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব(৩)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

কেটে গেলো বেশ কিছুদিন। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মুনের পরিক্ষা আজ শেষ। মুন আজকের দিনের অপেক্ষাই ছিলো এতদিন। আজ পরিক্ষা শেষ হতেই মুন বেরিয়ে পড়লো কারাগারের উদ্দেশ্যে। আজকে কারাগারে গিয়েই প্রথমে রাফির সাথে দেখালো হলো, ” আরো মুন তুমি এখানে?”
” আমি আসলে…”
” তোমার আপু পাঠিয়েছে? কিন্তু আমাদের মধ্যে তো তেমন কিছুই হয়নি তবে তোমাকে পাঠালো কেন?”
” না ভাইয়া। আমাকে আপু পাঠাইনি। আসলে আমি নিজে থেকেই এসেছি।”
” নিজে এসেছো কিন্তু কেন?”
” আসলে আমি একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
” কার সাথে?”
” ভাইয়া আগে দেখা করি তারপর বলি?”
” আচ্ছা। কিন্তু কার সাথে দেখা করবে?”
” রেবেকা।”
” ওনার সাথে তোমার কি কাজ? তুমি কি ওনাকে আগে থেকে চেনো?” চমকে উঠে
” না ভাইয়া। আসলে এমনি বাচ্চাটাকে নিয়ে কথা বলতাম।”
” বাচ্চাটাকে তো অনাথ আশ্রমে দেওয়া হয়েছে, তাকে নিয়ে কি কথা বলবে?”
” আসলে….”
রাফি কিছু একটা ভাবলো। তারপর মুনকে দেখা করতে যেতে বললো। মুন এত সহজে অনুমতি পেয়ে হাঁসি মুখে চলে গেলো। অন্যদিকে রাফি মনেমনে বললো, ” হিসাব তো মিলছে না। মুন কেন একজন অচেনা মানুষের সাথে দেখা করতে এলো।”

অন্যদিকে মুনকে সামনে দেখে রেবেকা কিছুটা মুচকি হাঁসি দিলো। তারপর খুব শান্তভাবে বললো, ” আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আর আসবে না। এই ব্যপারটা তোমার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে।”
মুনও মুচকি হেঁসে বললো, ” মুনের মাথা থেকে সহজে কোনকিছু যায় না।”
” তাই। তা কিসের জন্য এলে?”
” আপনি কি এমন অপরাধের করেছেন যার শাস্তি পাচ্ছেন?”
” শুধু এটুকুই।”
” হ্যাঁ।”
” আমি তো তোমার কেউ না, তাহলে কিসের টানে এখানে এলে।”
” কারাগারের টানে…” মুখ ফসকে কথাটি বের হয়ে গেলো
” কি?”
” না কিছু না।”
” আচ্ছা।”
” প্লীজ বলুন না কেন এখানে এলেন আপনি? কি করেছিলেন আপনি?”
” সে অনেক বড় কাহিনি। সেটা জেনে তোমার কোন লাভ নেই।”
” আপনি বলতে চাইছেন তাই তো?”
” ধরে নেও তাই।”
” তাহলে আমাকে যে আসতে বললেন?”
” এমনি।”
” আচ্ছা অপরাধ কি সেটা নাহয় না বললেন, বাচ্চাটির বাবা কোথায় তা কি বলা যাবে?”

রেবেকা কিছুটা ব্যঙ্গ হাসলো। তারপর বললো, ” আমি নিজেই জানি না।”
” মানে?” চমকে
” ও আমার এমন এক অন্ধকার জীবনের ফসল, যে জীবনের অতল গভীরে হারিয়ে গেছি আমি। তাই তো শাস্তি পাচ্ছি।”
” আমি কিছু বুঝতে পারছি না, একটু বলবেন?”
” তুমি অনেক ছোট মুন। এসব জানার জন্য তৈরি নও তুমি।”
” আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। যত খারাপ পরিস্থিতিই থাক না কেন আমি ঠিক সামলে নিতে পারবো।”
” তাই।”
” হ্যাঁ।”
” তবে শোন শুধু আমার নয় আমার মতো অনেক মেয়ের জীবনের গল্প আছে সেখানে লুকিয়ে।”
” কোথায়?”
” তা তো বলবো না। তবে জেনে রাখো তোমার মুখখানি একজনের সাথে খুব মিলে। যার জীবনের অন্ধকারও সেখানে লুকানো।”
” মানে? কি বলছেন আপনি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
” দেখো মুন সেদিন আমি হুট করে তোমাকে আসতে বলেছিলাম। বলতে পারো কিছুটা নিজের অজান্তে। তো এখন বলছি এখান থেকে চলে যাও।”
” কিন্তু…”
” কোন কিন্তু নয়। আমাদের মতো কিছু অপরাধীর কথা ভেবে জীবনের আলোময় সময়টাকে নষ্ট করো না।”
” প্লীজ আমার কথা শুনুন….”
” যাও তুমি মুন।”
” প্লীজ আমার….”
” যাও।” ধমক দিয়ে

মুন নিরুপায় হয়ে চলে গেলো। মুন একটা জিনিস ভেবে পেলো না, সেদিন বলবে বলেও আজ না বলে পাঠিয়ে দিলো তাকে। ব্যাপারটা খুব গন্ডগোলের। এসবের মাঝে মুনের মাথায় আরো একটা কথা ঘুরছে, ” আচ্ছা আমি ঠিক কি খুজছি? আমি তো জানিই না কিসের টানে এখানে বারবার আসছি! এই টানটা যে রেবেকার জন্য নয় সেটা আমি নিশ্চিত। হয়তো বাচ্চাটার জন্য। কিন্তু তাও নয়। কারণ বাচ্চাটির মায়ায় পড়লে অবশ্যই এতদিনে বাচ্চাটিকে দেখার জন্য হলেও একবার আশ্রমে খোঁজ নিতাম। তাহলে আমার টানটা ঠিক কিসের প্রতি?”
নিজের মনকে প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলো মুন। তখনি হঠাৎ মনে হলো সেদিন ঠিক কি হয়েছিলো। সেদিন রেবেকা বাচ্চাটিকে জন্ম দেওয়া, বাচ্চাটির জন্মের পর কেঁদে ওঠা। ঠিক ঐ মূহুর্তের টানে মুন অজানা গন্তব্য ছুটে চলেছে। যেখানে জানেই না আদো এর কোন গন্তব্য আছে কিনা।
_____

পড়ালেখা, প্রেম, বাবার, বোন সবকিছু নিয়ে ভালোই চলছিলো মাধুরির। ভালো সময় মানুষের জীবনে দীর্ঘক্ষন থাকে না। তাই হয়তো বদলে গেলো মাধুরির জীবন। রাফির ফোন থেকে আশা একটা ভিডিও বদলে দিলো মাধুরির গন্তব্য। ভিডিওটি অন করে মাধুরি একদম অনুভূতি-শূন্য হয়ে পড়লো। ভিডিওতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, একটি অন্ধকার ঘরে রাফির হাত-পা বেঁধে রেখেছে কেউ। রাফি শুধু অস্পষ্ট সুরে পানি পানি বলে চিৎকার করছে৷ ভিডিওটি দেখে মাধুরি মেঝেতে বসে পড়লো। এমন সময় ফোনে রাফির নাম্বার থেকে একটি মেসেজ এলো, ” বলেছিলাম তো চলে এসো তোমার বাড়ি৷ এলে না কেন? এখন তার মাসুল দেও। রাফিকে জীবিত চাইলে চলে এসো তোমার বাড়ি।”
মেসেজটি দেখে মাধুরির অন্তর আত্না কেঁপে উঠলো। সেদিনের মেসেজটিকে মজা ভেবে কতবড় ভুল করেছে সে, তা আজ বুঝলো। সে তো ভেবেছিলো কেউ হয়তো তার সাথে মজা করছে কিন্তু এখন ভিডিও মেসেজ দেখে তো মনে হচ্ছে না এটা মজা। মাধুরি কোনকিছু না ভেবে রাফির নাম্বারে কল করলো। প্রথমবার রিং হতেই ফোন ধরলো, ” হ্যালো কে বলছেন? রাফি কোথায়? আপনি কে? কি চান আপনি?”

” আস্তে আস্তে মামুনি। এত প্রশ্ন একসাথে করলে কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবো বলো?”
ফোনের ওপাশ থেকে পুরুষালি এক কন্ঠ ভেসে আসলো। মাধুরি কিছুটা ভয় পেলো। ভয় মার্জিত কন্ঠেই বললো, ” কেন করছেন এমন?”
” তোমাকে তোমার বাড়ি অব্দি নিয়ে আসার জন্য।”
” আমার বাড়ি? কিন্তু আমি তো আমার বাড়িতেই আছি।”
” বলেছিলাম না ওটা তোমার আসল বাড়ি নয়। আসল বাড়িতে চলে এসো।”
” আসল বাড়ি? সেটা কোথায়?”
” সেটা তো তোমাকে নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।”
” কিন্তু আমি তো কিছু জানি না।”

লোকটি কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিলো। ফোনটি কাটার দুই মিনিট পর আরো একটি মেসেজ এলো, ” হাতের ফোনটি ভেঙে ফলো এবং চলে আসো ‘চন্দ্রকুঠি’।”
মেসেজটি পড়ে মাধুরি থ হয়ে গেলো। মনেমনে দু’বার উচ্চারণ করলো ‘চন্দ্রকুঠি’।

মাধুরি রাফিকে খুব ভালোবাসে তাই লোকটির কথা অমান্য করার সাহস হলো না। তাই ঠিক করে নিলো তাকে যেতেই হবে। রাফির জন্য যেতে হবে। কিন্তু বাবা, বোন এদের সামলে যাবে কিভাবে? কিন্তু তাকে তো যেতে হবে। বাবাকে বললে বাবা তাকে ছাড়বে না, তাই না বলেই যেতে হবে। মাধুরি ঠিক করে নিলো রাতে বাসা থেকে বের হয়ে যাবে। জানা নেই সামনে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে কিন্তু তাকে যেতেই হবে। তবে কিছু একটা ভেবে মাধুরি ফোনটি না ভেঙে বন্ধ করে দিলো এবং ফোনটি ঐ ঘরেই লুকিয়ে রাখলো। বেঁচে না ফিরতে পারলেও কোন একদিন হয়তো বাবা বা বোন জানতে পারবে কেন সে রাতের আঁধারে হারিয়ে গেলো।

অন্যদিকে,
মুন অনেক কষ্টে নিজের কৌতূহলী মনকে শান্ত করলো। মনকে বুঝালো মরিচীকার পিছনে ছুটে লাভ নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে।

একজন নিজেকে গুটিয়ে নিলো রহস্য থেকে অন্যজন রহস্যের দিকে পা বাড়াতে লাগলো। কে জানে ভাগ্য তাদের কোথায় নিয়ে যাবে।

রাত ২.৩০,
চোখ মেলে পাশে ঘুমানো মুনের দিকে তাকালো মাধুরি। খুব সাবধানে বোনের কপালে চুমু কাটলো সে। দুই মিনিট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে একমনে বলে উঠলো, ” খুব ভালোবাসি বোন। তুই আর বাবা ছাড়া আমার অস্তিত্ব মূল্যহীন। তাই বলে রাফির অস্তিত্ব আমি অস্বীকার করতে পারি না। রাফির জন্য আমার তোদেরকে একটু কষ্ট দিতে হচ্ছে। আমি চেষ্টা করবো সব বাঁধা পেরিয়ে তোদের কাছে ফিরে আসার।”

খুব সাবধানে রুম থেকে বের হলো মাধুরি। পা টিপে টিপে বাবার রুমে ডুকলো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে দিলো। মনেমনে তাকে সালাম জানিয়ে বললো, ” বাবা তুমি আমার সব। ছোটবেলা থেকে কখনো মায়ের মুখটা অব্দি দেখেনি। আমরা জানি না আমাদের মা দেখতে কেমন। যেদিন মায়ের কথা জিজ্ঞেস করায় তোমার চোখে অশ্রু দেখেছিলাম সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, মায়ের হারিয়ে যাওয়ার যে কারনই হোক না কেন তোমাকে কখনো সে সম্পর্কে প্রশ্ন করবো না। কিন্তু আজ আমি নিরুপায় বাবা। আজ তোমাকে আমার জন্য একটু কাঁদতে হবে। কিন্তু তুমি ভেবো না বাবা, আমি ঠিক ফিরে আসবো।”
মুখে ফিরে আসবো বললেও হৃদয়ের গভীরে প্রশ্নটা থেকেই যায়, মাধুরি কি আর ফিরে আসতে পারবে?

ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো মাধুরি। মেইন রাস্তায় পা রাখতেই কোথা থেকে কালো চাদর মুড়ানো একজন ছুটে এসে মাধুরির হাতে একটি ফোন গুঁজে দিয়ে চলে গেলো। মাধুরি লোকটিকে পিছন থেকে ডাকলো কিন্তু লোকটি এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলে গেলো। তখনি মাধুরির হাতের ফোনটি রিং হলো। ফোনে রাফির নাম্বার দেখে যা বোঝার তা বুঝে গেলো মাধুরি। ফোনটি ধরে, ‘হ্যালো’ বলতেই লোকটি এরপর কোথায় যেতে হবে সেটা বলে দিলো। মাধুরি এগিয়ে যাচ্ছিলো এক অজানা রাস্তায়, যার নাম ‘চন্দ্রকুঠি’।

চলবে,
~~

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (৪)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

কেটে গেলো দুই মাস। সেদিন মাধুরি ঘর থেকে বের হওয়ার পর কোথায় গেছে, কার কাছে গেছে, কেউ জানে না। পুলিশও খোঁজ দিতে পারে না। সকলের ধারনা হয়তো কোন ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। মুনের বাবাও তাই মেনে নিয়েছেন। যতদূর জানতো মাধুরির সাথে রাফির সম্পর্ক ছিলো, রাফি যেহেতু নিখোঁজ তাই ভেবে নেওয়া হয়েছে ওরা দুজন পালিয়ে গেছে। কিন্তু মুনের মন মানে না। যেখানে তারা ওদের সম্পর্কের কথা জানে, এটাও জানে মাধুরির পড়ালেখা শেষ হলেই ওদের বিয়ে হবে, সেখানে পালানোর কি প্রয়োজন ছিলো। অন্যদিকে মুনের বাবা ভাবছেন, ” আমাকে বললেই তো হতো, আমি কি মেনে নিতাম না! এখন ফিরে আসলে আমি মেনে নিবো।” তাই তো বারবার মেয়ে ফিরে আসার অপেক্ষা করছেন। মাধুরির চিন্তায় আরিফ সাহেব ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এখন আর আগের মতো মুনের সাথে কথা বলে না। শুধু তাই নয় প্রয়োজন ছাড়া রুম থেকেই বের হন না৷ বাবার এই কষ্ট মুনের সহ্য হচ্ছে না। মুন বুঝতে পেরেছে বাবার কষ্ট থেকে তাকে মুক্ত করার একটাই উপায় তাহলো মাধুরিকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু মুন মাধুরিকে কোথায় খুঁজবে! মুনেরা রাফির নাম ছাড়া তার বাড়ি, পরিবার সম্পর্কে কিছু জানে না। মাধুরি শুধু বলেছিলো সময় হলে সব জানাবে।

বাবার এই অবস্থা, আপুর নিখোঁজ সবকিছু মুনকে পাগল করে দিয়েছে। মুন কি করে কি করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। অবশেষে ভাবলো মাধুরি আর ওর রুমটা আরো একবার খুঁজে দেখা উচিত, যদি কিছু পাওয়া যায়। গত দুই মাসে প্রায় অনেকবার খুঁজেছে কিন্তু কিছুই পায়নি, তবুও বারবার বৃথা চেষ্টা করে চলেছে। মুন আরো একবার খোঁজা শুরু করলো কিন্তু এবারো কিছু পেলো না। কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়লো। মাথায় হাত দিয়ে ভাবছিলো কি করবে তখনি মনে পড়লো, ” আমরা সবসময় আপুর জিনিস-পত্র খুঁজে চলেছি। আচ্ছা এরকম কি কোনভাবে হতে পারে না, আপা হয়তো আমার জিনিস-পত্রে কিছু রেখেছে।”
যেই ভাবা সেই কাজ। মুন এবার মাধুরির জিনিস রেখে নিজের জিনিস খুঁজতে লাগলো। কিছুক্ষন খোঁজা-খুঁজির পরই মুন নিজের ব্যাগে মাধুরির ফোন পেলো। মুন অবাক হয়ে গেলো, সেই সাথে নিজের বোকামির জন্য কষ্টও পেলে। আগে যদি নিজের জিনিস-পত্রও খুঁজতো তবে ফোনটা আগেই পেয়ে যেতো। ফোনটি হাতে নিয়ে দেখে সেটা বন্ধ। পুলিশ আগেই বলেছিলো ফোনের লাস্ট লোকেশন বাড়িতেই ছিলো।

মুন কিছুক্ষন ভেবে-চিন্তে তারপর ফোনটি অন করলো। ফোন করে সবকিছু ঘাটছিলো ঠিক তখনি রাফির কাছ থেকে আসা সেই ভিডিওটি চোখে পড়লো। ভিডিও মেসেজ সবগুলো চেক করে মুন থ হয়ে গেলো। মনেমনে দু’বার উচ্চারণ করলো ‘চন্দ্রকুঠি’।
এবার মুনের কাছে সব পরিষ্কার। মাধুরি বিপদে পড়ে বাড়ি থেকে চলে গেছে। যে করেই হোক মাধুরিকে খুঁজে বের করতেই হবে। মুন মনেমনে ভাবছিলো, ” আচ্ছা দুই মাস কেটে গেছে, আপুর সাথে কিছু হয়নি তো। না না একদমি না। আমার আপু ঠিক আছে।”
মুন ভেবে নিলো এসব কথা বাবাকে জানানো যাবে না। বাবা জানলে আরো কষ্ট পাবে। এবার মুনকে নিজেকেই কিছু করতে হবে।

__________
থানায় বসে আছে মুন। এতদিন যে অফিসার মুনদের কেসটা দেখছিলো সে নাকি অন্য থানায় বদলি নিয়েছে। এখন নতুন অফিসারের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি দুই মিনিটে চলে আসবে বলে, দুই ঘন্টা ধরে বসিয়ে রেখেছে। অবশেষে সেই মহান অফিসারের আসার সময় হলো। অফিসার আসতেই মুনের কথা বললো একজন। তাই অফিসার সরাসরি মুনের কাছে এলো। পিছন থেকে ডাক দিলো, ” হ্যালো আন্টি।”
মুন চমকে পিছনে তাকালো। মুনকে দেখে অফিসার নিজেই লজ্জা পেলো। মুন যেভাবে বসে ছিলো তাতে পিছন দেখে বোঝার উপায় ছিলো না এ মেয়ে নাকি মহিলা। তাছাড়া লোকটিকে বলা হয়েছিলো ভিক্টিম এর মা এসেছে। মুন কিছু বলতে যাবে তার আগে লোকটি বললো, ” আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না আপনার একটা মেয়েও থাকতে পারে।”
” মানে?”
” মানে আপনার মেয়ে আত্নহত্যা করলো কেন? জানেন কিছু?”
” কিসব বাজে কথা বলছেন।”
অফিসার কিছু বলতে যাবে, তার আগেই একজন এসে বললো, ” সরি স্যার একসাথে দুটো কেস ফাইল ছিলো তাই কি বলতে কি বলে ফেলেছি সব গুলিয়ে গেছে।”
” মানে?” অফিসার
” এই মেয়েটি তার বোনের মিসিং কেসের জন্য এসেছে। আর আত্নহত্যার কেসটি যে নিয়ে এসেছিলো সে… ওখানে বসা আছে৷ ভুলে আমি আপনাকে এখানে পাঠিয়েছি।”
অফিসার দুই মিনিট মুনের দিকে তাকিয়ে তারপর বললো, ” আচ্ছা ঠিক আছে। ঐ কেসটি শিরিনকে দেখতে বলুন, আমি এটা দেখছি।”
” ওকে স্যার।”
কথাটি বলে লোকটি চলে গেলো। অফিসার মুনের দিকে তাকিয়ে বললো, ” সরি আপনাকে আন্টি বলে সম্মোধন করার জন্য।”
” ঠিক আছে। সমস্যা নেই।”
” আচ্ছা বলুন আপনার কেসটি কি? সম্পূর্ণ ডিটেইলস এ বলুন।”
” হ্যাঁ।”
তারপর মুন একে একে সবকিছু বললো। অফিসার এতক্ষন এক ধ্যানে মুনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মুনের কথা বলা শেষে বললো, ” মোবাইল ফোনটি আমাকে দিন। আর যে ভিডিও এবং মেসেজের কথা বলছে সেগুলো দেখান।”
” জ্বী।”

মুন অফিসারকে দেখালো। অফিসারটি সব দেখে বললো, ” ওকে আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি ‘চন্দ্রকুঠি’ কোথায়।”
” একটা কথা বলতে চাই।”
” হ্যা বলুন।”
” চন্দ্রকুঠির লোকেশন পেয়ে গেলে আমাকে জানবেন এবং আমিও চন্দ্রকুঠি যেতে চাই।”
” এরকম তো কোন নিয়ম নেই?”
” প্লীজ। দেখুন আমার যতটা মনে হচ্ছে তাতে চন্দ্রকুঠি ততটা সহজ যায়গা হবে না আমাদের জন্য। আমার ধারণা এখানে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে।”
” এরকম মনে হওয়ার কারন?”
” আপনি মেসেজটি পড়লে হয়তো দেখবেন ওখানে আপুকে এটা বলা হয়নি রাফিকে বাঁচাতে এই বাড়ি আসো। বরং বারবার বলা হয়েছে তোমার বাড়িতে আসো। কিন্তু আমার প্রশ্ন আমরা তো আমাদের বাড়িতেই ছিলাম তাহলে আপুকে ঐ বাড়িটি তার বলার কারন কি?”
” বুঝলাম। আপনি খুব কৌতূহল প্রবণ মানুষ।”
” আপনি যদি তাই ভাবেন তাহলে তাই। আর যদি ভাবেন আমি আমার আপুকে নিজে বাঁচাতে চাই তবে তাই।”
” নিজে বাঁচাতে চাইলে তবে এখানে আসলেন কেন?”
” একা একা তো আমি সব পারবো না তাই আপনাদের সাহায্য নেওয়া।”
” আচ্ছা। তা আপনার নামটি জানতে পারি মিস?”
” জ্বী মুনতাহা মাহযাবিন।”
” ছোট করে মুন। মানে চাঁদ। সত্যি চাদের মতো সুন্দর তুমি।”
শেষের বাক্যটি আস্তে বললো যা মুন শুনতে পেলো না। তাই জিজ্ঞেস করলো,” কি?”
” কিছু না। আমি রিয়াদ রায়হান।”
” হুম।”
এরপর মুন রিয়াদের ফোন নাম্বার নিয়ে চলে এলো, সাথে নিজের ফোন নাম্বার ও তাকে দিলো।

একদিন পর,
মুন বাসা থেকে দূরে বাজারে এলো, বাজার করার জন্য। আজকাল বাবা এসব কাজ করেন না। তিনি রুমে বসে একাকি সময় কাটান। বাজার করে বাসার পথে হাঁটা ধরবে এমন সময় রহিমার সাথে দেখা। মুনকে দেখেই রহিমা বললো, ” কি খবর মুন? তোমার আপা বা রাফি স্যারের কোন খোঁজ পেয়েছো?”
” না এখনি পায়নি।”
রহিমা কিছু বলতে যাবে এমন সময় মুনের ফোনে রিয়াদের ফোন এলো। ফোনটি রিসিভ করলো মুন। ওপাশ থেকে কি বললো তা রহিমা শুনতে না পেলেও মুনের কথাটি শুনলো। যা ছিলো, ” চন্দ্রকুঠির লোকেশন পেয়ে গেছেন। আচ্ছা ধন্যবাদ। আমরা তাহলে কবে যাবো?”
রিয়াদের সাথে কথা বলা শেষ হতেই রহিমা বললো, ” তুমি চন্দ্রকুঠি কেন যাবে?”
” আপুর খোঁজ হয়তো ওখানে গেলে পেতে পারি তাই।”
” আচ্ছা মুন আমাকে একটা কথা সত্যি করে বলবে?”
” কি?”
” রেবেকার সাথে তোমার সম্পর্ক কি?”
” তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”
” তাহলে তুমি চন্দ্রকুঠি কেন যেতে চাইছো?”
” মানে? রেবেকার সাথে চন্দ্রকুঠির কিসের সম্পর্ক?”
” তুমি এই কথাটি জানো না যে রেবেকা চন্দ্রকুঠি থেকেই গ্রেফতার হয়েছিলো। এমনকি ওর আবাসস্থল ঐ চন্দ্রকুঠি।”
” কি?”
মুন অনেকটা চমকে গেলো। মুনের ভাবনায় শুধু একটা কথা তাহলো, ” আমার সেরকমভাবে কখনো রেবেকার জন্য আলাদা কোন আগ্রহ জন্মায় নি। আমার আগ্রহ টান সবকিছু ঘিরে শুধু রেবেকার ঐ অন্ধকার কারাগারে সন্তান জন্ম দেওয়ার বিষয়টি ছিলো। কিন্তু তাহলে রেবেকার সাথে আমার গন্তব্য কেন মিলে যাচ্ছে? কি আছে রেবেকার অতীতে? আচ্ছা রেবেকার অতীত কি চন্দ্রকুঠির রহস্য সম্পর্কে আমাকে জানাতে পারবে?”
মুনের মাথায় এখন নানাবিধ চিন্তা ঘুরছে। মুন কোনমতে রহিমাকে বিদায় দিয়ে চলে গেলো।

______
কাজ হবে না জেনেও মুন আরো একবার রেবেকার কাছে গেলো। রেবেকা একইভাবে বারবার ওকে চলে যেতে বলছে। কিন্তু আজ মুন ফিরে যাওয়ার জন্য আসেনি। তাই হাত জোর করে অনুরোধ করে বললো, ” প্লীজ আমাকে সাহায্য করুন। আমার আপু বিপদে আছি। জানি না এই দুই মাস ওর সাথে কি হচ্ছে। প্লীজ বলুন না চন্দ্রকুঠিতে কি আছে? আপনার সাথে চন্দ্রকুঠিতে কি হয়েছে?”
মুনের করুন মুখ দেখে রেবেকা একটু নরম হলো। খুব শান্তভাবে বললো, ” তোমায় বলার মতো কিছু নেই। আমি নিরুপায়। আমি কিছু বললে আমার সন্তানের ক্ষতি হয়ে যাবে। তবে এটুকু শুনে রেখো চন্দ্রকুঠি এক অন্ধকার যায়গা, যার অন্ধকারে ডুকে কেউ আলোতে ফিরে আসতে পারে না।”
” মানে? একটু খুলে বলুন না?”
” তুমি চন্দ্রকুঠি যাও, নিজেই বুঝতে পারবে সব। আমার তোমার জন্য দোয়া রইলো। আশা রাখবো সুস্থ জীবন নিয়ে ফিরে আসবে তুমি।”
রেবেকা আর কিছু বললো না। মুনকে বাধ্য করলো ওখান থেকে চলে যেতে। রেবেকার কথা শুনে মুন বুঝে গেছে ওর ধারনাই ঠিক। ‘ চন্দ্রকুঠি’ একটা নাম নয় শুধু, ওটা একটা রহস্য। মুন রিয়াদের সাথে কথা বলে কালকেই ‘চন্দ্রকুঠির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়বে।

মুন ‘চন্দ্রকুঠি’ যাওয়ার আগে তার বাবার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। তাই অনেক ভেবেচিন্তে মুন তার বাবাকে তার বন্ধুর বাসায় যাওয়ার অনুরোধ করলো। আরিফ সাহেব যেতে চাইনি তবুও মুন এক প্রকার জোর করে পাঠালো। নতুন যায়গা গেলে ভালো লাগবে, বন্ধুর সাথে সময় কাটালে বাবা ভালো থাকবে। নানাভাবে তাকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলো। মুনকে ছেড়ে যদিও যেতে চায় নি আরিফ সাহেব। তবে তিনি মুনের উদ্দেশ্য কিছুটা বুঝতে পেরে রাজি হয়ে গেলেন। আরিফ সাহেব যাওয়ার সময় মুনের কপালে চুমু এঁকে চলে গেলেন।

বাবাকে বিদায় দিয়ে মুনও বেরিয়ে পড়লো। রিয়াদের বলা যায়গায় চলে এসেছে মুন। সেখানে গিয়ে দেখলো রিয়াদ আগেই গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে। রিয়াদ মুনকে দেখে এগিয়ে এলো, ” চলুন।”
” হুম। আপনি আর আমি একা যাবো?”
” যেহেতু আমরা জানি না ওখানে গিয়ে কাকে ধরতে হবে বা কি করতে হবে সেহেতু টিম নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে বলুন।”
” তাও অবশ্য ঠিক।”
” হ্যাঁ।”
” আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো, আপনি আমার সাথে আপুকে খুঁজতে যাচ্ছেন তাতে…..”
মুনকে কথাটি শেষ করতে না দিয়েই রিয়াদ বললো, ” এটা আমার দায়িত্ব মিস।”
পরক্ষনেই রিয়াদ মনেমনে বললো, ” আমাকে যে চন্দ্রকুঠি যেতেই হতো৷ অনেক কষ্টে চন্দ্রকুঠি অব্দি এসেছি। নিজের সমস্যার সাথে যদি আরো একজনের সমস্যার সমাধান হয় তাতে ক্ষতি কি?”

রিয়াদ আর মুন গাড়িতে গিয়ে বসলো। রিয়াদ গাড়ি স্টার্ট দিলো। মুন হঠাৎ বলে উঠলো, ” আচ্ছা আমাকে তো এটাই বললেন না ‘চন্দ্রকুঠি’ কোথায়? ওটা কি একটা স্থানের নাম?”
” না। ‘চন্দ্রকুঠি’ একটি বাড়ির নাম।”
” বাড়ির নাম?” ভ্রু কুচকে
” হ্যাঁ। এখান থেকে বহু দূরে কদমতলী নামে এক গ্রাম আছে। গ্রামটি আয়তনে অন্যসব গ্রামের থেকে কিছুটা বড়। সেই গ্রামের একটি বাড়ির নাম ‘চন্দ্রকুঠি’। আপাতত এর থেকে বেশি কিছু জানি না। বাকিটা গিয়ে জানতে হবে।”
” আমার মাথায় এই কথাটি আসছে না, একটি গ্রামের একটি বাড়িতে কি এমন রহস্য থাকতে পারে?”
রিয়াদ মনেমনে বললো, ” সেটা তো আমিও জানি না। তবে ওখানে যে রহস্য আছে তা আমি নিশ্চিত।”
মুখে বললো, ” তা তো গিয়ে দেখতে হবে।”
” হুম।”

মুন ছুটে চলেছে নতুন গন্তব্য। সে জানে না তার এই নতুন গন্তব্যে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে। তবে যাত্রাপথে রিয়াদ নামের এই সঙ্গীকে পেয়ে কিছুটা আশ্বাস পেলো। তবে অচেনা মানুষ বলে বেশিটা গুরুত্ব দিতে চাইছে না রিয়াদকে।
অন্যদিকে রিয়াদ সেও কিছুর আশায় এই গন্তব্যে ছুটে চলেছে।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে