গৃহযুদ্ধ পর্ব-১৬

0
1231

#গৃহযুদ্ধ পর্ব ১৬
____________
__________________

রেশমিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে সুপ্তি। আমার কাছে বেশ কয়েকবার প্রশ্ন করেছে, আচ্ছা! ও চলে যাবে কবে!
আমি কোনো উত্তর দেইনি। যাদের ভালোবাসা নির্ভেজাল থাকে, তারা বিশ্বাসঘাতক কোনো ব্যক্তিকে একদম ই সহ্য করতে পারেনা।আমি ওকে বুঝাই, এখন রেশমি এখানে আছে, সেফ আছে। বাইরে কোথাও গেলে ওর জন্য ঘোর বিপদ। বেচারির জীবনটাই হয়ত চলে যাবে।
সুপ্তি আমার সাথে রেশমিকে নিয়ে আর কথা বাড়ায় না।
কিছুক্ষন পরে আমাদের সেভিংস এর রাখা স্বল্প কিছু টাকার পুরোটাই সে রেশমির হাতে তুলে দেয় এবং বলে, আমার জন্য যা করেছিস, সেটার ঋন আমি কখনোই শোধ করতে পারবো না। কিন্তু ঋণের বোঝা একটু হলেও হালকা করতে চাই৷
রেশমি উত্তরে কোন কথা বলে না। সুপ্তি রেশমির ব্যাগে টাকাগুলো রেখে দেয়।
এরপর থেকে সুপ্তি ওকে একেবারেই এড়িয়ে চলে। কারণ ব্যতীত ওর সামনে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। রেশমিও বাসায় খুব কম থাকে। সে অধিকাংশ সময় কাটায় বাড়ির ছাদে পায়চারী করে।
.
.
.
কাজের প্রতি ডেডিকেটেড এবং পরিশ্রমী হওয়ার সুবাদে সুপ্তিকে ওর পূর্বের অফিস থেকে বেশ কয়েকবার কল করে ডাকা হয়। আমার সাথে আলাপ আলোচনা করেই সুপ্তি তার পূর্বের অফিসে পুনরায় চাকরি করা শুরু করে।
খাওয়াদাওয়া নিয়ে এখন কষ্ট অনেকটাই কম হয়। সকাল ও দুপুরে রান্নার কাজটা সামলায় রেশমি।
এদিকে আমি মণিকা ভাবীর রান্নার স্বাদ কিছুতেই ভুলতে পারছিনা। শালা রবিন এসে আমার কপালটা পুড়িয়ে দিলো। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিওর হয়েছি রবিন পুরো দিনের অধিকাংশ সময়ই মণিকা ভাবীর সাথে কাটায়। দু’দিন একসাথে শপিং এও গেলো।
মনে মনে একটু অপমানিত বোধ করলাম! রবিন আমার থেকে কোন দিক দিয়ে বেটার!মানলাম রবিনের চেহারা সুন্দর। কিন্তু ছেলেদের এত বেশি সুন্দর মানায় নাকি!
নাহ, নিজের প্রতি আমার একদম ই খেয়াল নেয়া হয়না। আমাকে আরেকটু স্মার্ট হতে হবে।
.
.
বাসার পাশের সাজিদ চাচার চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি,
হঠাৎ কোথা থেকে যেন উদয় হলো রবিন।
এসে একটা সিগারেট নিলো। আমার পাশে পায়ের উপর পা উঠিয়ে বসে বললো,
কি অবস্থা ভাই, আপনি আমাদের বিল্ডিং এ থাকেন না?
– আপনাদের বিল্ডিং মানে?
– ঐতো, মণিকার বিল্ডিং এ আপনাকে দেখেছিলাম একদিন।
মনে মনে বললাম,
“শালা সারাদিন মণিকা ভাবীর বাসায় সময় কাটালে আমাকে দেখবি কিভাবে! আমি তো ঠিক ই তোকে দেখি।”
মনের কথা মনে চেপে রবিনকে বললাম,
হ্যাঁ ভাই।আমাদের বাসস্থান একই বিল্ডিং এ।
– বেশ, বেশ। রবিন,সাজিদ চাচার দিকে তাকিয়ে বললো, ভাইয়ের কতটাকা বিল হয়েছে?বলুন। আমি দিয়ে দেই।
বাঁধা দিলাম রবিন কে।
বললাম,
কেনো? আপনি আমার বিল কেনো দিতে যাবেন?😅
আপনি কি অনেক টাকা বেতনের চাকরী করেন?
– নাহ, ব্যপারটা আসলে তেমন না। তবে হ্যাঁ চাকরী আগে করতাম একটা। তবে এ বিল্ডিং এ আসার পরে আমার ভাগ্য খুলে গেছে। মণিকা বললো, চাকরী টাকরি না করতে।
আমি এখন মণিকাকে সময় দিচ্ছি। আর টাকাপয়সা যা লাগে মণিকা আমাকে দিচ্ছ।
ওর কথা শুনে হালকা হাসলাম, বললাম বাহ, আপনার ই তো কপাল তাহলে।
পকেট থেকে পাঁচটাকার কয়েন বের করে সাজিদ চাচাকে দিয়ে আসলাম। সাজিদ চাচার কাছে দুইকাপ চায়ের দাম আমি পাঁচ টাকা দেই। এটা নিয়ে চাচা কখনো কোন অভিযোগ করেনি। বরং খুশি হয়েছে।দুই কাপ চা খেয়ে এক কাপের টাকা দিয়ে ” জিতে গেছি” এই আনন্দটা কখনোই রবিন উপলব্ধি করতে পারবে না। যাদের হাতে অনেক টাকা থাকে, তারা অনেক প্রকার নির্মল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়।
সাজিদ চাচার সাথে পরিচয় বেশিদিন হয়নি। রবিন এন্ট্রি মারার পর থেকে বাইরেই চা খেতে হয়।
.
.
.
ছোট খাটো কিছু হাতের কাজ, যা ছিলো সেরে বাসায় পৌঁছালাম।বেশ কিছুক্ষন কাজ করলাম অনলাইনে। ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মাথাটা একেবারে ধরে গেলো।
এবার একটু ব্রেক দরকার। হুট করে মনে পড়লো আমি এ পর্যন্ত এ বাড়ির ছাদে উঠিনি, আজ গিয়ে দেখে আসি,ছাদটা কেমন!
যেই ভাবা সেই কাজ। আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলাম।
গিয়েই আমি পুরো থ, পুরো ছাদটা পরিপাটি, সারি সারি গাছপালা, চারদিকে ওয়াল দিয়ে বানানো আছে ছোট পুকুর। তাতে খেলা করছে সোনালী লেজের লাল টুকটুকে গোল্ড ফিশ। পানিতে আরো আছে শ্রিম্প এবং পদ্ম। সবথেকে নজরকাড়া ফুল সাদা জলগোলাপ আরো সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে।
চারপাশে ওয়াল এবং উপরে টিন শেড দিয়ে ছাদের এক কোনায় বানানো আছে ছোট্ট একটি কুটির। এ কুটিরের নাম আবার বৃষ্টি বিলাস। রেশমিকে দেখলাম ওখানে পেতে রাখা বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা উপন্যাসের বই পড়ছে।
এতদিনে বুঝলাম রেশমি কেনো ছাদে সময় কাটায়, কিভাবে সময় কাটায়।
ছাদে উঠে চারদিকে পায়চারী করলাম। অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ফ্রেশ হয়ে গেলো। ফুরফুরে হয়ে গেলো।
একটু পরে রেশমি আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমাকে বললো, কি ব্যপার রোহান ভাই?
আপনি হুট করে ছাদে কি করছেন?
উত্তর দিলাম, মন ভালো করতে আসলাম।
রেশমি বললো,
আমার মন যতই খারাপ থাকুক এখানে আসলে আমার মন ভালো হয়ে যায়। এজন্যই আসলে এখানে আসা হয়। এখানে সময় কাটানো হয়।
” তোমার মন খারাপ থাকে? হাহা, কেনো?
– আপনি হয়ত সুপ্তির কাছে শুনেছেন পুরোটায় ই৷স্মরনের এবং আমার এফেয়ারের ব্যপারে ও আমাকে বলে নি?
– হুম। বলেছে।
– ঐ বিষয় নিয়েই।
– আচ্ছা।
যাই হোক রেশমী, আমার একটা অভ্যেস আমি মানুষের গল্প জানতে পছন্দ করি। তুমি বলোতো, একদম সত্যি করেই বলবে,
রফিক সাহেবকে ছেড়ে তোমার স্মরনের দিকে আকর্ষণ কেনো গেলো!
রেশমী বললো,
সত্যি জানতে চান?
জবাব দিলাম,
হুম বলো।
আচ্ছা তবে বৃষ্টি বিলাসে বসুন। আমি বলছি।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ছোট্ট কুটিরের দিকে।
একপাশে বসলো রেশমি। একপাশে আমি।
রেশমি বলতে শুরু করলো,
রফিককে আমি কিন্তু কম ভালোবাসিনি। ইভেব আমি ওকে এতটাই ভালোবেসেছিলাম যে ও পুরোটাই আমার ভেতরে ডুবে ছিলো। আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না।আমার প্রতি ওর বিশ্বাসের মাত্রাটা অনেক বেশি থাকায় এবং ওর সম্পত্তির দিকে অন্যান্য লোভী মানুষের লোভ থাকায়, আমার নামে এ টু যেড সবকিছু লিখে দেয়। এরপর কেটে যায় বেশ অনেক বছর, আমার শরীরে মেদ জমে। একটু মোটা হই, এতেই আমার প্রতি আকর্ষণ কমতে শুরু করে রফিকের। এটাও জেনেছিলাম যে ও ওর অফিসে জব করা মেয়েদের সাথে ফিজিকালি এটাচড ছিলো। প্রথম এসব নিয়ে অনেক ডিপ্রেশনে থাকতাম। একা একা কান্না করতাম। কিন্তু একটা সময়ে আমিও ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলি। ভাবি ও যদি সবকিছু করতে পারে, আমি কেন পারবো না। এছাড়াও সিগারেট খেয়ে খেয়ে রফিক ফিজিকালি ও উইক হয়ে পড়েছিলো। এজন্যই আমাকে অন্যদিকে পা বাড়াতে হয়েছে।
ওর কথার একটু সংশোধন করে দিলাম,
অন্য পথ না বলো ভুল পথ।
আকাশ মেঘলা হয়ে আসে খুব। হুট করেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। টিনের চালের ওপর বৃষ্টির কনা ঝুমুর ঝুমুর গান সৃষ্টি করে। গুরুগম্ভীর কন্ঠে ডেকে ওঠে মেঘ। মেঘ ডাকার শব্দে মেয়েরা ভয় পায়। রেশমিও পেলো। হুট করে ভীষন জোড়ে বাজ পড়ায় ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বিরক্ত লাগলো খুব ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে আমি কুটির থেকে বাইরে চলে আসলাম ভারী বর্ষণে ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেলাম। অনড় হয়ে ছাদের মাঝে দু হাত দু দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে দিয়েছি। মস্তিষ্ক সুপ্তির একটা অবয়ব তৈরি করলো। সুপ্তি যেনো আমার পেছনে কয়েকফুট দূরে দাঁড়িয়ে ভিজছে। অপূর্ব লাগছে তাকে। হঠাৎ ও ছুটে এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
ওর দেহের উষ্ণ অনুভূতি আমার প্রতি শিরায় উপশিরায় ভালোবাসার তুফান তুলে দিলো…
চোখ মেললাম কল্পনা দূরীভূত হয়ে গেলো। শরীর থেকে সুপ্তির কাল্পনিক অস্তিত্ব মিইয়ে গেলো আস্তে আস্তে যেটা থেকে গেলো সেটা- ভালোবাসা ভালোবাসা মিষ্টি অনুভূতি, পবিত্র অনুভূতি । বেশি ভিজলে চলবে না। আমাকে সুস্থ থাকতে হবে সুস্থ থাকাটা খুব জরুরী।
.
.
.
সিঁড়ি দিয়ে হেটে নিঁচে নামছি। রেশমি হয়ত আছে এখনও বৃষ্টি বিলাস কুটিরে।
আমার পবিত্র ভালোবাসার কল্পনায় যেমন সুপ্তি স্থান পেলো, রেশমির মত মেয়েরা এভাবে কখনোই কারো কল্পনায় স্থান পায়না। এসব ভাবতে ভাবতে যখন নিচে নামছিলাম, রবিনের বাসার সামনে এসে হুট করে চোখ গেলো ওর ফ্লাটের দরজার নিচের দিকটায়। লাল কিছু তরল দরজার ফাঁকা দিয়ে বাইরে গড়িয়ে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামালাম না।
বাসায় এসে শাওয়ারে গোসল দিতে দিতে ভাবলাম বৃষ্টি থামলে ছাদ থেকে কিছু তরতাজা ফুল নিয়ে চলে যাবো সুপ্তির কাছে।
গোসল করে বের হলাম,
বৃষ্টি থামার নাম নেই।
এর ভেতরে কলিং বেল বাজলো।
দরজা খুলে ভীষন অবাক হলাম, সুপ্তি এসেছে।
ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে সুপ্তিও। দরজা খুলে কিছু বলার আগেই সুপ্তি আমাকে সজোরে একটা চড় মেরে বসলো।
এর ভেতরেই সেখানে উপস্থিত হলেন মনিকা ভাবী।
সুপ্তি আমার গালে চড় মেরেছে সেটা দেখে তিনি অবাক হলেন একটু। তবে তার ভেতর উৎকন্ঠাও ছিলো।। সুপ্তি এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, চার ঘন্টা যাবৎ ফুলী নিঁখোজ। ওকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা৷

লেখক; Hasibul Islam Fahad

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে