গুমোট অনুভুতি পর্ব-১৮ ( প্রথমাংশ ও শেষাংশ)

0
1961

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৮(প্রথমাংশ)

বাগানের পাশটায় বাহারি ধরনের ফুলের গাছ, ফলের গাছ এমনকি সবজি গাছ রয়েছে, চারদিকে যেনো সবুজের সমারোহ!তবে তার মাঝে লাল গোলাপ আর সাদা বেলিফুলগুলো যেনো বিশেষ দৃষ্টি কাড়ছে। এখানে অনেক নাম না জানা ফুলের গাছ রয়েছে যাদের কোনদিন হয়তো দেখাও হয়নি রুশির। তবে ওর দৃষ্টি শুধুমাত্র ওই বেলিফুলগুলোতে সীমাবদ্ধ, একসময় বেলিফুল খুব পছন্দের ছিলো ওর এখনো হয়তো পছন্দের তবে তার গভীরতা কম। প্রায় অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে, ওর বেলিফুল সেদিন থেকে আরো বেশি ভালো লাগতো যখন ওর কাছে আসা চিঠিগুলো থেকে বেলিফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে আসতো! ও প্রান খুলে নিশ্বাস নিতো সেই চিঠিগুলো থেকে, কিন্তু এখন সেই সম্পর্ক ফিকে হয়ে গেছে নেই বললেই চলে তাই এখন আর বেলিফুল তেমন একটা টানে না ওকে। কেমন জানি সেই সম্পর্কের মতো বেলিফুলের গন্ধটাও বাসি মনে আজকাল।

রুশি সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সদ্য ফোটা লাল গোলাপগুলোর দিকে তাকালো, কি সচ্ছ্ব আরা সতেজ! তবে তাতে কাটা আছে যা অনেক কষ্টদায়ক ঠিক ওর জীবনের মতো।বাহ্যিক দিক থেকে কতো সু সুন্দর দেখতে! বড়লোক স্বামী,আলিশান বাড়িতে থাকছে, ওঢেল টাকা, স্টেটাস।কি নেই ওর জীবনে? হাজারো মেয়ে হয়তো এমন একটা জীবনের রোজ স্বপ্ন দেখে কিন্তু ভেতরটা ঠিক কাটার মতো যন্ত্রণার। ওর স্বামী আছে কিন্তু সে অন্যকে ভালো বাসে অর্থাৎ থেকেও নেই আর টাকা!সেটাতো ও কোনদিন চায়নি। চেয়েছে একটা ছোট্ট সংসার যেটাকে ও নিজের ঘর বলতে পারবে, একজন মানুষকে নিজের বলে অধিকার বোধ দেখাতে পারবে।

কিন্তু সবার ভাগ্যে সবকিছু থাকে যেমন ওর ভাগ্যে নেই। কিন্তু ও ভালো আছে বেশ ভালো, এটলিস্ট এখানে ওর একজন মা আর বোন আছে যারা ওকে ভালোবাসে! রুশি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে সেখান থেকে চলে আসতেই নিচ্ছিলো তখন কেউ একজন হাত টেনে ওকে বাগানের এক কোনে নিয়ে যায়, এদিকটায় খুব একটা কেউ আসেনা। রুশি তার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে মানুষটি কে?নাকে বারবার বেলিফুলের মৃদু ঘ্রাণ বারি খাচ্ছে না চিনে কি করে সে?

রুশি কিছু রাফ ভাবে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো তারপর না তাকিয়েই বললো

“এভাবে একটা মেয়ের হাত হুট করে টেনে ধরা কোন ভদ্রতার মাঝে পড়ে মিস্টার ইনান!তাও তার হাত ধরা যে সম্পর্কে আপনার থেকে বড়। ভুলে যাবেন না আমি আপনার ভাবি হই, আপনার বন্ধু এবং আপনার সম্বন্ধীর স্ত্রী। আশাকরি সম্মান বজায় রাখবেন”

“তোমাদের বিয়ের সত্যিটা আমি জানি রুশি তাই আমার সামনে অন্তত ভাবি হওয়ার মিথ্যে নাটকটা করোনা।শুনো সায়ান তোমাকে ভালোবাসে না আর কোনদিন স্ত্রীর মর্যাদা দিবে না তাই তুমি ওকে যথাসম্ভব ডিভোর্স দিয়ে দাও। ওর সাথে তুমি সুখে থাকবে না, ও তোমাকে কোনদিন সম্মান করেনি আর করবেও না।ও তোমাকে জাস্ট নিজের রাখছে ওর সন্তানের জন্য, সন্তান হলেই তোমাকে ছুড়ে ফেলে দিতে এক সেকেন্ডও লাগবে না!”

রুশি এতোক্ষন চুপ করেই থাকলেও এখন আর চুপ করে থাকতে পারলো না, সায়ান ওকে মেনে নেয়নি সেটা ও জানে কিন্তু ওর দায়িত্ব তো ও পালন করছে,সায়ান অন্যকাউকে ভালোবাসে সেটা সেই প্রথম দিন থেকে ও জানে তবে ইনানের মুখ থেকে শুনে কেমনজানি অপমানবোধ করলো তাই কড়া গলায় বললো

“আমার আর সায়ানের মাঝে যা আছে তা সম্পুর্ণ আমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার,এতে নাক গলানোর অধিকার আমি কাউকে দেইনি”

“আমি নাক গলাবো না কেনো যেখানে এটার সাথে আমার জীবন জড়িত, আমি আলবৎ জড়াবো এতে। তোমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার মানে?”

“সায়ান আমার স্বামী তাই স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার ব্যাক্তিগত ব্যাপারই হয়”

ইনান রুশির কথায় রেগে গেলো, তারমানে রুশি সায়ানকে স্বামী হিসেবে মানে! ওর মনে তাদের অতীতের কোন স্মৃতি নেই।সেদিন ও শুধুমাত্র আসেনি বলে আজ ও সায়ানের উপর বেশি ভরসা করছে যে কিনা ওকে ভালোই বাসেনা অথচ ও রুশিকে পাগলের মতো ভালোবাসে! ও রুশির বাহু চেপে ধরে বললো

“তুমি ওকে স্বামী মানো মানে কি?তুমি বুঝতে পারছো না যে তুমি ওদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি!তাও কি করে তুমি তাদের মাঝে কি করে আছো?”

“একটু আগে আপনি বললেন আমার সায়ানকে ছেড়ে দেয়া উচিৎ কারণ সে আমায় সম্মান করেনা অথচ এখন আপনিও আমাকে সম্মান করছেন না। তাহলে সায়ান আর আপনার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এটলিস্ট হি রেস্পেক্টস মি বাট ইউ ডোন্ট”

বলেই রুশি হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে ইনান ওকে জড়িয়ে ধরে আর শান্ত স্বরে বলে

“আমি তোমাকে ভালোবাসি রুশি আগের থেকে অনেক বেশি, তুমি জানো তোমাকে ছাড়া এতোদিন কত কষ্ট হয়েছে আমার?অনেক ভালোবাসি তোমায় রুশি, প্রচণ্ড বেশি। আমি জানি আমি সেদিন আসিনি কিন্তু তার কারণ ছিলো বিশ্বাস করো!এরপর আমি তোমায় অনেক খুজেছি, ফোন করেছি কিন্তু নাম্বার বন্ধ ছিলো তোমার। আমি এই বিয়ে নিজের ইচ্ছেতে করছিনা রুশি, সামু আমাকে ভালোবাসে! আমি ওকে কখনোই ভালোবাসিনি আর বাসতেও পারবো না। তুমি শুধু রাজি হয়ে যাও আমি এখনি সামুর সাথে নিজের এংগেজমেন্ট ভেংগে দিবো। প্লিজ তুমি সায়ানকে ছেড়ে দাও আর আমার কাছে চলে আসো”

রুশি এতোক্ষন স্ট্রাগল করেছিলো ছুটার জন্য, হঠাৎ কোথা থেকে এতো শক্তি এলো ও জানে কিন্তু ও এক ধাক্কায় ইনানকে নিজের থেকে আলাদা করে ফেলে। ইনান পড়ে যেতে নিয়েও সামলে নেয়। রুশি রাগে যেনো ফেঁটে পড়ে, গলার স্বর অনেকটা উঁচু করে বলে

“আপনি ভাবলেন কি করে আপনার মতো নীচ লোকের কাছে আমি ফিরে যাবো?কি ভাবেন কি নিজেকে আপনি। একসময় আমার মন ভেংগেছেন আর আজ আরেকটা মেয়ের মন ভাংতে চাইছেন?ন্যূনতম মনুষত্বো কি হারিয়ে ফেলেছেন?একটা মেয়ে এতোটা ভরসা করে আপনার হাত ধরতে চাইছে, সবকিছু ছেড়ে কয়েকদিন পর আপনার হয়ে যাবে অথচ আপনি আমার প্রতি নিজের পুরোনো ভালোবাসার দোহায় দিয়ে মাঝপথেই হাত ছেড়ে দিতে চাইছেন?তিলেতিলে গড়ে উঠা ওর স্বপ্ন ভেংগে চুরে শেষ করে দিতে চাইছেন?কাল তো অন্যের জন্য আমাকে ছুড়ে ফেলতে দুইমিনিট ভাববেন না। আপনার এই সস্তা ভালোবাসা আমার চাইনা।”

“খবরদার আমার ভালোবাসা কে তুচ্ছ করবে না,তুমি ধারণাও নেই কতোটা চাই আমি তোমাকে! আসলে কি বলোতো,সায়ানের টাকা অনেক বেশি তো!তাই তুমি ওর লাইফে তৃতীয় ব্যাক্তি হতেও দ্বীধাবোধ করছো না। আই অলসো হ্যাভ মানি সো কাম টু মি।”

ইনান কথা শেষ করার প্রায় সাথে সাথে গালে ব্যাথা অনুভুত হলো, ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে।কিন্তু ওর তাতে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই কারণ ও নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না ও কি বলেছে!রাগের মাথায় হুশ হারিয়ে বসে আছে, এতো জঘন্য কথা ও রুশিকে বললো কি করে?ও জানে রুশির কাছে ওর আত্মসম্মান সবচেয়ে বড় আর ও কিনা সেই আত্মসম্মানে আঘাত করলো। ইনান যখন নিজেকে তিরস্কার দিচ্ছিলো ঠিক তখন রুশি ওর কলার চেপে ধরে বলে

“কি ভাবেন নিজেকে? টাকা দিয়ে সব কিনে নিতে পারবেন আপনারা? আপনার কি মনে সায়ান জামিল খানের অনেক টাকা আছে তাই আমি তাকে বিয়ে করেছি?নাহ আপনি ভুল! আমি বিয়ে করেছি আমার সম্মানের জন্য যাতে এই সমাজের মানুষ আমার দিকে আংগুল তুলতে না পারে যে আমি অসতি। আমার বাচ্চাকে যাতে বড় হয়ে শুনতে নাহয় যে সে অবৈধ তার কোন বাবা নেই।আমি কারো তৃতীয় ব্যাক্তি হিসেবে কখনোই ছিলাম না আর থাকবোও না। আপনার কি মনে হয়, একটা মেয়ের বেচে থাকতে হলে ছেলের প্রয়োজন হয়?নাহ আপনি ভুল ভাবছেন। আমার লাইফে কোন ছেলের প্রয়োজন নেই, আমি ঠিক সময়মত তার জীবন ছেড়ে চলে যাবো। তবে হ্যাঁ আমি তার সাথে থাকি আর না থাকি এটা নিশ্চিত থাকেন আমি আপনার জীবনে কখনো ফিরে যাবো না। আজ থেকে আমি আপনাকে চিনি না, আমি ভুলে যাবো আমার জীবনে এমন কোন মানুষ ছিলো যার প্রতি আমার মায়া কাজ করতো,যে আমার ভালো বন্ধু ছিলো।”

বলেই রুশি ইনানের কলার ছেড়ে দিলো আর উল্টোপথে হাটা শুরু করলো, কিন্তু ভেবে আবার থেমে গিয়ে ইনানের দিকে ফিরে বললো

“আপনার আর সায়ানের মাঝে সবচেয়ে বড় পার্থক্য কি জানেন?সে আমাকে সম্মান করে কিন্তু আপনি না। তাই আপনার সাথে থাকার থেকে আমি তার সাথে থাকা প্রিফার করি,আর যাইহোক আমাদের সম্পর্কটা সম্মানের!”

বলেই আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়নি বরং উল্টোপথে হাটা ধরলো, এদিকে ইনান খুব জোরে দেয়ালে আঘাত করলো, হাত ফেটে রক্ত বের হচ্ছে কিন্তু তাতে যেনো কষ্ট হচ্ছে না। মনের কষ্ট তার চেয়ে অনেক বেশি, কি করে পারলো এমন কথা বলতে?এখন তো রুশি ওকে হেট করবে এটা বেঁচে থাকতে কি করে সহ্য করবে?ভালোবাসার মানুষের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখার চেয়ে মরে যাওয়াই তো শ্রেয়!ইনান হাটু গেড়ে বসে পড়লো সেখানে,তার চোখে একরাশ অনুতাপ ফুটে উঠেছে!

রুশি মেইন বাগানে আসতেই থমকে দাঁড়ালো,এতোক্ষন ও কাঁদছিলো কিন্তু এখন যেনো কান্নাও থেমে গেলো। সামনে সায়ান দাঁড়িয়ে আছে, নিশ্চিত সায়ান সব শুনেছে!ইনান আর ওর সম্পর্কে কি তাহলে সব জেনে গিয়েছে? কতোটুকু শুনেছে ও। এখন কি তাহলে ইনান আর সায়ানের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে? আর সামু! সেতো ইনানকে প্রচণ্ড ভালোবাসে তাহলে নিজেকে কি করে সামলাবে সে। ওকি তাহলে এরপর থেকে রুশিকে ঘৃণা করবে?রুশি কি তাহলে ওর বোন হারিয়ে ফেলবে?রুশির চোখে যেনো একরাশ অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে!

#চলছে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৮(শেষাংশ)

পুরো বাগান জুড়ে সাঁশাঁ শব্দ ব্যতীত অন্যকোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না, দুজন নর-নারী বাগানের ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে। একজনের চোখে বিস্ময় ও রাগ আর আরেকজনের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। সায়ানের এই শ্বাসরুদ্ধকর চাহনি দেখে রুশি জড়োশড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কোন শব্দ করার সাহস পাচ্ছে না। সায়ান ঠিক কতোটা রেগে আছে তা অনুমান করতে পারছে না, ক্রমাগত ও নিজের হাত মুচড়ে যাচ্ছে।

মনে মনে ভাবছে কি করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায় আর সায়ানকে ঠান্ডা মাথায় সবটা বুঝিয়ে বলা যায়। কারণ এই মুহুর্তে সকল ছেলের রেগে যাওয়া স্বাভাবিক, নিজের বোনের প্রতি কোন অন্যায় ছেলেরা কখনোই সহ্য করতে পারেনা! সায়ানের চাহনিতে ও নিজের কষ্ট সেই কবে ভুলে গিয়েছে,চোখে জমে থাকা পানি গুলোও যেনো পড়ার সাহস পাচ্ছে না।

এমন না যে ও ভয় পাচ্ছে সায়ান ওকে কিছু বলবে বা কিছু করবে। বরং ওর ভয় লাগছে সায়ান এই মুহুর্তে ইনানের সাথে মারামারি বাধিয়ে দিবে, হয়তো দুজনেই ব্যাথা পাবে। বাড়ির সকল লোক এখানে জড়োশড় হবে আর কারণ জানতে পেরে রুশিকে ভুল বুঝবে, অর্থাৎ ওর হঠাৎ পাওয়া পরিবার আবার হারিয়ে যাবে। মা, বোন যাদের চোখে অনেক ভালোবাসা আর মায়া দেখতে পায় তাদের জন্য ঘৃণা আর বিরক্তি দেখতে পাবে যা ও সহ্য করতে পারবে না। রুশি সায়ানকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সায়ান কিছুটা চড়া কন্ঠে বলে উঠলো

“তুমি এখানে কি করছো তাও একা একা? কতো হাওয়া বইছে দেখছো! শেষে ঠান্ডা জ্বর বাধিয়ে বসে থাকবে, আর তোমার সাথে সাথে বাবুরও ক্ষতি হবে।চলো ভেতরে চলো, গরম কাপড় ছাড়া আর ঘর থেকে বের হবে না আর সাবধানে হাটাচলা করো”

বলেই সায়ান রুশির হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যাওয়া শুরু করলো, রুশি সায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য ভাবে সায়ান এভাবে অধিকারবোধ দেখিয়ে ওকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ওর এক বিন্দুও খারাপ লাগছে না বরং কোথাও একটা ভালো লাগা কাজ করছে। অথচ কিছুক্ষণ পুর্বেও ইনান থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু এখন ও তার কিছুই করছে না। নিজের এমন পরিবর্তনে নিজেই যেনো অবাক হলো রুশি! তবে কি সায়ান রুশির স্বামী বলে ও তাকে বাঁধা দিচ্ছেনা?কিন্তু ও তো সায়ানকে স্বামী হিসেবে মানে না তবে অনুভুতির কারণ কি?

রুশি কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বুঝতেই পারেনি যে ও কাঁদছে,ফুঁফিয়ে কাঁদছে। আসলে সায়ানকে হঠাৎ করেই যেনো আপন মনে হলো ওর, মনে হলো এই বাড়িতে আপন বলতে ওই আছে যার সামনে কাঁদা যায়। চিৎকার করে না হোক নিঃশব্দে হলেও যায়। রুশির ফোঁফানোর আওয়াজে থমকে দাঁড়ালো সায়ান,পেছনে ফিরে রুশিকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে অথচ শব্দ বের হচ্ছে না। শুধু মাত্র কিছুক্ষণ পরপর নাক টেনে উঠছে, শরীর সেই সাথে মৃদু কাঁপছে। সায়ান রুশির মুখটা হাত দিয়ে টেনে উঁচু করলো,রুশির চোখ তখনো বন্ধ।সায়ানের চোখে মুখে চিন্তা ফুটে উঠেছে,ও রুশির চোখের পানি আলতো হাতে মুছে দিয়ে মৃদু স্বরে বললো

“কাঁদছো কেনো হুম?কেউ তোমাকে কিছু বলেছে!তোমার কি মন খারাপ রুশি?”

‘রুশি’ নামটা শুনতেই রুশি চমকে উঠলো, এই প্রথম সায়ান ওকে রুশি বলে ডেকেছে এর আগে রুশানি বলে ডাকতো। যাইহোক রুশি নিজের মুখ আবারও নিচু করে বললো

“নাহ তেমন কিছুনা আমি ঠিক আছি, আর আমি কান্না করছিলাম না, হঠাৎ কি যেনো এসে চোখে পড়ছে তাই চোখের পানি পড়ছে। আপনি ভুল ভাবছেন”

সায়ান রুশির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কতোক্ষণ, সায়ান জানে রুশি মিথ্যে বলছে কারণ ওর ঠোঁট কাঁপছে! ও কিছু একটা নিয়ে আপসেট তাই কান্না করেছে কিন্তু সায়ানকে সেটা বলতে চাচ্ছে না কিন্তু সায়ান বলার জন্য জোর করতে চাইলো না। হয়তো কোন একদিন নিজ থেকেই নাহয় বলবে এই ভেবে সায়ান চুপ মেরে গেলো। তারপর রুশিকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো, রুমে গিয়ে রুশি গরম সুয়্যেটার পরিয়ে দিলো তারপর হাল্কা কড়া স্বরে বললো

“আর যাতে সুয়্যেটার ছাড়া বের হতে না দেখি তাহলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে। এই শীতকাল পুরোটা সাবধানে থাকবে আর একদম ঠান্ডা জাতীয় কিছু ধরবে না”

“জি বুঝলাম!”

এদিকে ইনান একটা বিশাল খোলা পার্কে দাঁড়িয়ে আছে, হাতের আর ঠোঁটের কাটা স্থানে রক্ত জমাট বেঁধে আছে, বেন্ডেজ করা হয়নি। কিন্তু সেদিকে ইনানের খেয়াল নেই বরং ও তাকিয়ে আছে সামনের ছোট্ট সেই বেঞ্চটার দিকে। এই পার্কেই সেদিন রুশির সাথে দেখা করার কথা ছিলো ওর,খুব এক্সাইটেড ছিলো সেদিন ও। নিজের হাতে কার্ড বানিয়েছিলো,একঘণ্টা আগেই রেডি হয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো রুশির জন্য কিছু স্ন্যাকস কিনবে আর সাথে রুশির পছন্দের বেলিফুল!

ও ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো যখন দেখেছিলো তখন ওর মায়ের চিৎকার শুনতে পায়। দৌড়ে বাবার ঘরে যেতেই দেখে সে মেঝেতে পড়ে আছে, আর তার পাশে বসে ওর মা তাকে উঠানোর চেষ্টা করছে। দ্রুত ওর বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় ওরা, জানতে পারে যে ওর বাবা সিভিয়ার হার্ট এটাক করেছে।ও যেনো সম্পুর্ণ ভেংগে পড়ে, বাবার এই অবস্থা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না।এদিকে ওর মা বারবার সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছিলো। পরেরদিন ওর বাবার অপারেশন হয়। ডাক্তার বলেছে বাহাত্তর ঘন্টার পুর্বে জ্ঞান না ফিরলে কিছু করার নেই। দেখতে দেখতে ঘন্টা গুলো পার যাচ্ছিলো, একের টা ঘন্টা যেনো বছরের ন্যায় মনে হচ্ছিলো। ও কান্না করতেও পারছিলো না কারণ তাতে ওর মা আরো ভেংগে পড়বে। অবশেষে ডাক্তার ওর বাবাকে মৃত ঘোষণা করে, ওদের পুরো দুনিয়া যেনো তচনচ হয়ে গিয়েছিলো।

সেই ছোট্ট বয়সে ওকে কোম্পানির হাল ধরতে হয়েছিলো যদিও প্রধান দায়িত্বে ওর দুরসম্পর্কের একজন মামা ছিলো। একদিকে মাকে সামলানো অন্যদিকে কোম্পানি তারউপর ও নিজেই তখন ছাত্রজীবনে ছিলো। ওর মাকে সামলানো সবচেয়ে কঠিন ছিলো, মাত্র সতেরো বছর বয়সে ওর মার সাথে ওর বাবার বিয়ে হয়েছিলো। নিজের প্রাণপ্রিয় সাথির হঠাৎ মৃত্য তিনি সহ্য করতে পারেননি আর যাইহোক ওর মা সাবিনা আন্টির মতো শক্তমনের নয়, অনেক কোমলমতি সে!

তারউপর কোম্পানিতে চলছিলো সবচেয়ে বড় ঝামেলা। ওর বাবার হঠাৎ মৃত্যুর কারণ ছিলো এই কোম্পানি, তার বিজনেস পার্টানার অনেক টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে যার ফলে অনেক টাকা লস হয়েছে আর কোম্পানি প্রায় দেউলিয়া হতে যাচ্ছিলো। এজন্য সেই শকে আর প্রেশারে তিনি হার্ট এটাক করেছেন!সেই কোম্পানিকে তুলতে ওর অনেক সময় লেগেছে, এখনো সেই কোম্পানি সায়ানের কোম্পানির ন্যায় অত বড় নয়। ওর জীবনে এতোকিছু চলছিলো যে ও রুশির খোঁজ নেয়ার সময় পায়নি,তারপরও ও সেই স্কুলে গিয়েছিলো যেখানে রুশি পড়তো কিন্তু কিছুই জোগাড় করতে পারেনি, এমনকি রুশির এড্রেসও না। রুশির যেহেতু কোন বন্ধু ছিলো না তাই রুশিকে খোজাই অসম্ভব ছিলো,অথচ আজ ওর সাথে দেখা হয়েছে তাও সে এখন অন্যাকারো স্ত্রী আর সন্তানের মা!

ও রুশিকে প্রথম দেখেছিলো বাস স্ট্যন্ডে, গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলো এক কোনে। ছোট্ট একটা মেয়ে হাতে মোটা গাইড আর কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ, স্কুল ড্রেসে কাউকে এতো সুন্দর লাগতে পারে ওর জানা ছিলাম না। উঁচু করে করা ঝুটি যেনো সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো,সব মিলিয়ে ও মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছিলো। তারপর স্কুলের একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে ওর নাম রুশি, সেই থেকে গোপনে চিঠি লিখতো তাকে!

সে হয়তো জানতোই না তার আশেপাশে কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে থাকতো! এতোটা বেখেয়ালি ছিলো সে। পরে পরে তার থেকেও চিঠি আসতো, তারপর ফোনে কথা বলা সবকিছুই ঠিক ছিলো। হুট করেই ওর জীবনে অজানা ঝড় এসে সব শেষ করে দিলো। ও রুশিকে প্রথম কয়েকদিন ফোন করতে পারেনি কিন্তু বাবার মৃত্যুর কয়েকদিন পর যখন ফোন করে তখন তা সুইচড অফ ছিলো, তার পর থেকে ওই নাম্বারে হাজারো বার কল করেছে কিন্তু অপরপাশ থেকে কেউ ধরেনি। ও বারবার হতাশ হয়েছে কিন্তু আশা ছাড়েনি আর আজ দেখো কোন আশাই যেনো। সে এখন অন্যকারো কথাটা ভাবতেই বুক চিরে যাচ্ছে, এতো কষ্ট কেনো ভালোবাসায়?যদি সে আমার ভাগ্যে নাই থাকে তবে তার প্রতি অনুভুতি কেনো সৃষ্টি হয়?কেনো এই অনুভুতি গুলো কষ্ট দেয় ওকে।

একেরপর এক সিগারেট শেষ করছে ও, এর আগে কখনো খায়নি তবে আজ খাচ্ছে। মনে হচ্ছে কয়েকমুহুর্তের জন্য হলেও সব ভুলে যাবে কিন্তু তা আর হলো কই?এই কষ্ট যে তাকে আজীবন বহন করতে হবে!

____________________

সায়ান খান বাড়িতে এসেছে প্রায় একমাস হতে চললো,ওর মায়ের সাথে সম্পর্কটা আগের মতো ওতো তিক্ত নেই বরং অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে যদিও দুজনের একজনও ঠিক মতো কথা বলে না তবে রুশির মতে সে দিনও খুব বেশি দেরি নেই। রুশি বেশ অবাক হয়েছে যে সায়ান এই একমাস প্রতিদিন এখানে এসেছে অফিস থেকে এবং নিজের বাড়িতে যায়নি। এমনকি কষ্ট করে সোফায় ঘুমায় রোজরোজ তবুও অন্যরুমে ঘুমায় না।সত্যি বলতে ছেলেটা কি চায় ও জানে না,এই কয় মাস ও ছায়ার মতো রুশির সাথে যতক্ষণ বাসায় ছিলো। আর প্রেগন্যান্সির কারণে রুশির মুডসুইং এতোবেশি ছিলো যে ও মাঝরাতে হঠাৎ বসে কাঁদতো আর সায়ান জেগে জেগে শান্তনা দিতো! কিছুই মুখে দিতে পারতো না বমির কারণে, সায়ানের শরীরে কতোবার বমি করেছে হিসাব নেই তবে সে টু শব্দ করেনি!
আরো ওকে শান্তনা দিয়েছে যে সব ঠিক হয়ে যাবে।

রুশি বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসবই ভাবছিলো, এই একমাসে সায়ান প্রায় ওর বন্ধুর মতো হয়ে গেছে।রুশি না চাইতেও দিনদিন সায়ানের প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, ও জানে এটা ভুল তবুও সেই ভুলটাই করতে ইচ্ছে। খুব বেশি কি ক্ষতি হতো যদি ওদের সম্পর্ক আর পাঁচটা সম্পর্কের মতো নর্মাল হতো?রুশির ভাবনার মাঝেই সায়ান হঠাৎ বলে উঠলো

“তুমি কি কাউকে কখনো ভালোবসেছো রুশি?”

সায়ানের হঠাৎ এমন প্রশ্নে রুশি অবাক হলো তাকিয়ে দেখলো সায়ান অধীর আগ্রহে তাঁকিয়ে আছে ওর জবাব শোনার জন্য। রুশি ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না, আদোও কি ও কাউকে ভালোবেসেছে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে