গুমোট অনুভুতি পর্ব-১৬+১৭

0
2000

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৬

রুশি ভ্রু কুচকে বসে আছে বিছানায়, রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। আজ হঠাৎ করেই কেনো এই মানুষটিকে বড্ড বিরক্ত লাগছে! ঠিক তার সাথে কি করলে শান্তি পেতো তা মাথায় ঢুকছে না, একবার মনে হচ্ছে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে টুপ করে নিচে ফেলে দিক আবার মনে হচ্ছে ফুচকার মতো কটমট করে যদি ভাংতে পারতো তবে হয়তো শান্তি লাগতো। রাগে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে এলোমেলো ভাবে।

ওয়াশরুম থেকে ঝরঝর পানির আওয়াজ আসছে সাথে যেনো ওর মাথার বুদ্ধিগুলো ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দশমিনিট ধরে ভেবেই চলছে যে এই তীব্র অসহ্যকর মানুষটিকে কি করে এই রুম থেকে তাড়ানো যায় কিন্তু কিছুই আসছে না মাথায়। এদিকে নক কামড়াতে কামড়াতে কখন চামড়াতে কামড় দেয়া শুরু করেছে তাতে ওর খেয়ালই নেই।হঠাৎ ব্যাথা অনুভব হতেই “আহহ” শব্দ করে উঠলো, হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে হাত লাল হয়ে আছে। এতে যেনো রাগ তরতর করে আরো কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গেলো

“ইশশ কি মনে পড়ছে না কেনো,এমনিতে তো তোর ভারী বুদ্ধি রুশি তাহলে আজ কি হলো। বুদ্ধির সাগর কি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো?নাহ এই লোকের সাথে এক রুমে থাকা অসম্ভব। ব্যাটা বিয়ে করে বউ মানবে না, বাইরে গার্লফ্রেন্ড রাখবে আবার এখন বউ বলে আদিক্ষেতা দেখানো হচ্ছে?হাহ এমন যেনো গাছের টাও খাবে তলার টাও কুড়াবে। নাহ বাপু এতো সহজে তোমার আশা তো পুরণ হতে দেয়া যাচ্ছে না। এই রুশি সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসকে এক্সেপ্ট করেনা।ভাব রুশি ভাব কিছু তো একটা উপায় আছে যাতে একে জব্দ করা সম্ভব!”

রুশি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে সায়ানের ফোনের দিকে নজর গেলো, খুশিতে ওর চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। এই ফোন দিয়ে নিশ্চই তাকে জব্দ করা যাবে!কিন্তু যতোটা খুশি হয়ে ফোনটা হাতে নিয়েছে তার থেকেও বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রেখে দিলো। পাসওয়ার্ড সেট করা! উফফফফ। হঠাৎ করেই রুশির মাথায় এলো যে চন্দ্রিকা রুশিকে পছন্দ করেনা আর সে যদি কোনভাবে জানতে পারে যে সায়ান ওর কাছে তাহলে সায়ানকে এখানে থাকতে কিছুতেই দিবে না। তাই কথাটা চন্দ্রিকার কান পর্যন্ত পৌছাতে হবে। রুশি শয়তানি হাসি দিয়ে ফোন হাতে নিয়ে ইমার্জেন্সি নাম্বার লিস্টে গেলো কিন্তু চন্দ্রিকার নাম্বার খুজে পেলো না, এমনকি লাভ, লাইফলাইন এমন কিছুও নাই। রুশি রেগে ফোনটা আগের জায়াগায় রেখে দিলো,বিড়বিড় করে বলতে লাগলো

“এই ছেলে কি ওই মেয়েকে ভালোবাসে না নাকি?নিজের ভালোবাসার মানুষের নাম্বার কেউ ইমার্জেন্সি লিস্টে রাখেনা!”

রুশি ফোন রাখতেই ফোনটা বেজে উঠলো আর হাতে নিয়ে দেখে সেটাতে লিখা “ছোট্ট পরী”। রুশি নামটার দিকে তাকিয়ে থাকলো, খুব আদর করে যদি কাউকে এমন নামে ডাকা হয়। রুশি জানে এটি চন্দ্রিকা তাই দেরি না করে ফোন তুলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই ফোনটা হাত থেকে হাওয়া হয়ে গেলো। হাত মুঠ করে পেছনে তাকিয়ে দেখে সায়ান উদাম শরীরে দাঁড়িয়ে আছে, রুশি অন্যদিকে ফিরে দিলো এক চিৎকার।এই ভাবে কেউ খালি গায়ে শুধু একটা তোয়ালে পরে ঘুরে বেড়ায়?এর একটু হলে তো শক খেয়ে হার্ট এটাক করতো। সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফোন তুললো আর অপরপাশ থেকে কেউ একজন কিছু একটা বললো যা রুশি শুনলো না।সায়ান হঠাৎ বলে উঠলো

“আমি ব্যাস্ত আছি তাই ফিরছিনা। তুমি জানো আমি বাড়ি ফিরিনা তাই অযথা আমার জন্য কেনো বসে থাকো? যাও ঘুমিয়ে পড়ো নাহয় অসুস্থ হয়ে পড়বে”

“……………”

রুশি বুঝতে পারলো যে চন্দ্রিকার সাথে কথা বলছে তাই ইচ্ছে করেই বলে উঠলো

“আপনি এই রুমে…”

কিন্তু পুরো কথা বলার পুর্বেই সায়ান মুখ চেপে ধরলো যা রুশি ছাড়াতে পারলো না।ওপাশ থেকে হয়তো কিছু একটা বলেছে তাই সায়ান ওর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো

“কেউ না! শুধু অফিসের কয়েকজন এমপ্লয়ি আছে। তুমি খেয়াল রেখো নিজের দিকে।”

বলেই খট করে কেটে দিলো আর রুশির মুখ চেপে ধরেই বললো

“কথা বলেছিলে কেনো?কারো কথার মাঝে কথা বলতে হয়না জানো না?”

রুশি সায়ানের হাতের বন্ধনী হাল্কা হতেই ঝাড়া মেরে ফেলে দিলো তারপর রাগি কন্ঠে বললো

“কেনো আপনার গার্লফ্রেন্ড এর সামনে সব কুকীর্তি ফাঁশ হয়ে যেতো?ভালোই হতো তাহলে, আপনার স্বভাব ভালো মতো জেনে যেতো সে”

“ওহ তারমানে তুমি প্ল্যান করে বলেছো তাইনা?তারমানে আমার সাথে থাকতে তোমার বড্ড অসুবিধা হচ্ছে?”

“হ্যা সেটাই আপনার মতো অসহ্যকর একটা মানুষের সাথে থাকা জাস্ট অসম্ভব! গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্তেও আবার ছুকছুকানির স্বভাব”

“মুখ সামলে কথা বলো।ভেবেছিলাম সুন্দর মতো এখান থেকে ফ্রেশ হয়ে পাশের রুমে ঘুমাবো বাট গেস হোয়াট! আমি এখন এখানেই থাকবো বুঝলে। যা করার করতে পারো।”

বলেই কাবার্ড থেকে জামাকাপড় নিয়ে পরা শুরু করে দিলো যা দেখে রুশি চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে ফিরে বললো

“আর এইযে একটা মেয়ে ঘরে আছে জেনেও এইভাবে খালি গায়ে ঘুরা কোন ধরনের ম্যানার্স?তারউপর আবার জামাকাপড় চেঞ্জ করছেন। লজ্জাশরমের কি মাথা খেয়েছেন?”

“কারো পার্মিশন ছাড়া তার ফোন ধরা কোন ধরনের ম্যানার্স? তারউপর তুমি কথার মাঝখানে কথা বলেছো আবার ঝগড়াও করছো। আমি কি কিছু বলেছি?তারউপর তুমিই তো বললে আমার ছুকছুকানির স্বভাব তাই এমনটা করা তো আমার কেরেক্টার এর সাথে সম্পুর্ণ যায়”

“আপনার সাথে কথা বলাই বেকার,আমি এতোক্ষন এই রুমে আছিই কেনো উফফ।আপনার রুম আপনাকে মোবারক, থাকুন এখানে”

বলেই গটগট করে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল তারপর দরজা টানতে থাকলো কিন্তু দরজা খুলছে না। রুশি কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন খুললো না তখন বুঝতে পারলো বাইরে থেকে কেউ ইচ্ছে করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। ও অসহায় দৃষ্টিতে সায়ানের দিকে তাকালো আর বুঝতে পারলো সায়ান ব্যাপারটায় বেশ মজা পাচ্ছে!ও রেগে দরজায় দিলো এক লাথি কিন্তু ব্যাথা পেয়ে দমে গেলো। ও বুঝলো রেগে কিছু বলে লাভ নেই তাই শান্ত স্বরে বললো

“প্লিজ দরজাটা খুলে দিতে বলুন”

“তোমার সমস্যা তুমি বলো খুলতে, ইটস নান অফ মাই বিজনেস।তবে আজ বেরুতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না, আমার মন বড় তাই তুমি এই রুমে থাকলে আমি মাইন্ড করবো না সত্যিই!”

বলেই বিছানায় উঠে ব্লাংকেটের ভেতরে ঢুকে পড়লো, রুশি এটা দেখে দেখে আকাশ থেকে পড়লো। এখন কি রুমের সাথে সাথে বেডও শেয়ার করতে হবে নাকি?রুশি তাই মেকি হাসি ঝুলিয়ে বললো

“আপনি যদি বেডে ঘুমান তবে আমি কোথায় ঘুমাবো? তাই যদি আপনি…”

“তুমি বেডে ঘুমাতে না চাইলে সেটা তোমার সমস্যা, আমার বেড শেয়ার করতে কোন সমস্যা নেই। তুমি চাইলেই ওইপাশটায় শুতে পারো। বেড যথেষ্ট বড় আছে”

সায়ান রুশির থেকে দ্বিগুণ হাসি মুখে ঝুলিয়ে বললো তারপর আবার ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। রুশি সেদিকে তাকিয়ে রইলো, ওর পক্ষে সায়ানের সাথে একই বিছানায় ঘুমানো সম্ভব নয়। সায়ান যতোই ওর স্বামী হোক তবে সেটা নামের, তাই ও প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা। রুশির কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে সায়ান মাথা বের করে দেখলো রুশি আগের জায়াগায় দাঁড়িয়ে আছে মাথানিচু করে। তাই সায়ান একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর বালিশ নিয়ে সোফায় যেতে যেতে বললো

“আমার মনটা খুব বড়ো কিনা তাই ভাবলাম একটা অসহায় মেয়েকে বেডে শুতে দেই। আমি নাহয় আজ রাত সোফায় কাটিয়ে দিলাম তবে এরপরের বার কিন্তু বিছানা ছাড়বো না বলে দিলাম”

বলেই সায়ান চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো আর রুশি গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।ওর হঠাৎ মনে হলো নাহ মানুষটিকে ঠিক যতোটা অসহ্যকর মনে হয়েছে সে ততটা নয়!একটু কম অসহ্যকর যেমনটা সহ্য করা যায়।একজন ছেলের হিসেবে সায়ান প্রতি রুশির সম্মানটা বেড়ে গেলো, আর যাইহোক ওর অস্বস্তি বুঝতে পেরেও ওকে বিছানায় শুতে বাধ্য করেনি। চাইলেই সে সো কল্ড স্বামীর অধিকার দিয়ে অনেক কিছুই করতে পারতো তবে সে কিছুই করে নি।রুশির সায়ানকে সম্মান করে কারণ রুশির সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে সে আবার অন্যের মতো নিজের ভালোবাসার মানুষের হাত ছেড়ে দেয়নি।নাহয় আজকাল কিছু মানুষ ভালোবাসার ওয়াদা করে তারপর মাঝপথেই হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যায়, তার থেকে সায়ান অনেক ভালো,নিজের ভালোবাসার সম্মান করতে সে জানে!

রুশি কি মনে করে উঠে বসলো তারপর আলমারি থেকে অতিরিক্ত ব্লাংকেট বের করে সায়ানের গায়ে দিয়ে দিলো। সায়ান বাচ্চাদের মতো সেটাতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো, রুশি নিজের জায়াগায় এসে শুয়ে পড়লো তারপর সায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। ঘুমন্ত অবস্থায়ও লোকটিকে অনেক সুন্দর লাগে। রুশির মাথায় হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন জাগলো

“আচ্ছা বাচ্চাটা কার মতো হবে? আমার মতো নাকি তার বাবার মতো?বাবার মতো হলে নিঃসন্দেহে অনেক সুদর্শন হবে!”

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৭

রুশি পিটপিট করে নিজের চোখ মেললো,বিশাল আকাশে সুর্য মামা কিছুক্ষণ পুর্বেই পুর্ব দিকে উদিত হয়েছে তাই রোদ এখনো প্রখর হয়নি। কানে পাখির কিচিমিচির আওয়াজ শুনা যাচ্ছে, নাকে একটা অনেক মিষ্টি সকালের ঘ্রাণ আসছে। রুশি প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নিলো, চারপাশে সবকিছু নিশ্চুপ! এ বাড়ির মানুষগুলো এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে না তাই হয়তো এতো নিস্তব্ধতা!ওর খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার অভ্যস, বহুদিনের অভ্যস এতো তাড়াতাড়ি ত্যাগ করতে পারেনি। রুশি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর আড়মোড়া ভেঙে মোবাইল নিতে গিয়ে দেখে খুব সুন্দর একটা পিকাচু মগে কফি রাখা আর তাতে ঝুলানো চিরকুট

“এক কাপ গরম কফি এই গরম মানুষটির জন্য”

রুশি চিরকুট হাতে নিয়ে হাসলো, সায়ানের উপর সত্যিই একটু বেশিই মেজাজ দেখিয়েছে ও। ভেবেছিলো সায়ান উল্টো মেজাজ দেখাবে আর এখান থেকে চলে যাবে কিন্তু তার পরিবর্তে সায়ান খুব অস্বাভাবিক ভাবে শান্ত! ওর এতোগুলো কটুকথা শুনানোর পরও সে কিছু বলেনি বরং ঠান্ডা মাথায় সবটা মেনে নিয়েছে। ইদানীং রুশি নিজেই বুঝতে পারছে যে ও খুব খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেছে, অল্পতেই ভিষন ভাবে রেগে যায় আর এমন এমন কথা বলে ফেলে যাতে পরে ওর আফসোস করতে হয়।

সায়ানকে কথাগুলো ও ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলতে পারতো যে ও কোন ঝামেলা চায়না বরং শান্তিতে থাকতে চায়। কিন্তু ও নিতান্তই মেজাজ দেখিয়ে কথাগুলো বলেছে,সায়ান হয়তো এখানে নিজের বেবির জন্য চিন্তা থেকে আসছে আর আশাটাও স্বাভাবিক। রুশির উচিৎ সেই স্পেস করে দেয়া, এবং বেবির বর্তমান পরিস্থিতি কেমন বাবা হিসেবে তা সম্পুর্ণ জানার অধিকার আছে সায়ানের।আর যাইহোক ও যতোই ভালো মা হোক না কেনো কখনোই নিজের সন্তানের বাবার স্থান পুরণ করতে পারবে না, বাবা নামক মানুষটিকে ওর সন্তান আজীবন মিস করে যাবে। আর নিজেও চায়না ওর সন্তান বাবা নামক শীতল ছায়া থেকে বঞ্চিত হোক। ও ভেবেই নিয়েছে এরপর থেকে সায়ানের সাথে ভালোভাবে কথা বলবে, কারণ ভবিষ্যতে তারাই অনাগত সন্তানের বাবা-মা তাই একে অপরের সাথে বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্ক থাকা জরুরি। সব স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ভালোবাসা থাকে ওদের সম্পর্কে নাহয় বন্ধুত্ব থাকলো!তাতে আর যাই হোক ওর সন্তান সুখে থাকবে।

রুশি বারান্দার দিকে এগুলো, ভেতরে ঢুকতেই সায়ানকে কফির কাপ হাতে উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। তারমানে রুশির হাতের কাপ ও সায়ান বানিয়েছে! রুশি সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো, সামনে গিয়ে পাশে দাঁড়াবে নাকি ঘরে ফিরে যাবে সেটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। তখন সায়ান সেদিকে ফিরেই বলে উঠলো

“ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? পাশে এসে দাঁড়াও!”

রুশি বেশ অবাক হলো,ও সবসময় নিঃশব্দে চলাফেরা করে তাই কেউ বুঝতে পারে না কিন্তু সায়ান কি করে বুঝলো যে ও এখানে আছে?কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেললো

“আপনি কি করে বুঝলেন আমি এখানে আছি?আমি তো কোন শব্দ করিনি”

সায়ান রুশির দিকে ঘুরে ওর ওই চোখজোড়ায় তাকিয়ে থাকলো কতোক্ষণ,কালো লেন্সের এই টানাটানা চোখদুটোতে হাজারো মায়া ভীড় করেছে।রুশি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে চোখজোড়া স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড় হয়ে আছে যাতে ওকে আরো সুন্দর লাগছে। ও ঠোঁট কিছুতা প্রসারিত হলো, রুশি এখনো জবাবের আশায় অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। সায়ান ওর চোখে চোখে রেখেই বললো

“কি করে বুঝলাম তা জানিনা, তবে এটুকু জানি তুমি আশে পাশে থাকলেই অদ্ভুতভাবে বুঝে যাই আমি!”

সায়ানের এই ঘোরলাগা দৃষ্টি আর এই ধরনের কথা শুনে রুশি মাথা নিচু করে ফেললো। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে কিন্তু কেনো লাগছে বুঝতে পারছেনা, লজ্জায় সায়ানের দিকে তাকাতে পারছে না। হয়তো প্রথম কোন পুরুষের মুখে এমন কথা শুনেছে তাই হয়তো এমন মনে হচ্ছে। ও টপিক বদলানোর জন্য বললো

“ভালো কফি বানান আপনি!”

“না খেয়েই বলছো ভালো হয়েছে! খেয়ে দেখো হয়তো সত্যিই ভালো লাগবে”

রুশি সায়ানের দিকে এমনভাবে তাকালো যেনো চোর ধরা পড়ে গেছে, এই লোক কি করে বুঝলো কফিতে চুমুক দেয়নি আমি?চোখ না সিসিকেমেরা! কিছুই এড়ায়না। রুশি আমতা আমতা করে বললো

“নাহ মানে দে্ দেখতে যেহেতু ভালো হয়েছে খে্ খেতেও ভালো হবে নিশ্চই!”

“দেখতে ভালো হলেই যে জিনিসটা ভালো তেমন কিন্তু নয় আবার দেখতে কিছুটা খারাপ বলে যে জিনিসটাই খারাপ তাও কিন্তু নয়। সবকিছু টেস্ট করার পর সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিৎ! মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। ডোন্ট জাজ আ বুক উইথ ইটস কাভার”

রুশির কাছে কথাগুলো যুক্তিযুক্ত মনে হলো, বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে কোন কিছুকেই জাজ করা উচিৎ নয়। ও বেশ প্রাউড হয়েই বললো

“ইনডিড ইউ আর আ বিজনেসম্যান!”

জবাবে সায়ান হাসলো, নিঃশব্দে হাসলো তারপর আবার বাইরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলো, রুশিও পাশে দাঁড়িয়ে কফিতে চুমুক দিতে লাগলো। চারপাশের গাছ গুলোর পাতা হাল্কা নড়ছে, বারান্দায় দুটো মানব-মানবী দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। তারা দুজনের কতোটা কাছে অথচ তাদের মনের দুরত্ব কতো বিশাল ঠিক পাহাড় সম!রুশি এসবই ভাবছিলো হঠাৎ ওর হাত থেকে সায়ান কফির মগ নিয়ে গেলো আর রুশি তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। বুঝার চেষ্টা করছে যে সায়ান কি করতে চাইছে তা বুঝতে পেরে সায়ান বললো

“আসলে সব ঠিকঠাক হয়েছে কিনা তা চেক করতে নিয়েছি”

বলেই কফি মগে চুমুক দিলো তারপর রুশির দিকে তাকিয়ে হেসে মগটা দিয়ে দিলো আর বললো

“সব ঠিক আছে, তুমি এবার খাও”

রুশি চোখ ছোট করে তাকিয়ে কফিতে চুমুক দিলো আর ভাবতে হঠাৎ এমন আজব ব্যাবহারের কারণ কি?তারপর কিছু একটা ভাবতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো! এটা কি ইনডিরেক্ট কিস ছিলো?ওই মাই আল্লাহ! সায়ানের তাকাতেই দেখে ও মুচকি হেসে ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিয়ে চলে গেলো। সেই এ ভালো হবে তা ভাবলো কি ও, এ লোক মোটেও সুবিধার না। রুশি বিড়বিড় করে বলতে লাগলো

“আস্ত বজ্জাত একটা!”

________________________

ডায়নিং টেবিলে সম্পুর্ণ ডেড সাইলেন্ট কাজ করছে, চামচের কটরমটর আওয়াজ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। রুশি বর্তমানের টেনশন ঢের বুঝতে পারলো,সবকিছু এনালাইসিস করে যা বুঝতে পারলো তা হলো এরা মায়ে ছেলে এক আরেকজনকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু তা স্বিকার করতে চায়না। একজন রেগে আছে আর আরেকজন অভিমান করে আছে বাট দুজনের মাঝেই কি একটা মিস আন্ডারস্টেন্ডিং চলছে। রুশির শাশুড়ি মা মানে মিসেস সাবিনা খান অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ। এখানে আসার পরে থেকে তিনি সামু আর ওকে একনজরে দেখেন যেনো রুশি তার নিজের মেয়ে। তাই মুলত রুশি এখান থেকে যেতে চায়না কারণ এ জীবনে মায়ের ভালোবাসা ও পায়নি তাই আল্লাহ যখন ওকে একটা মা দিয়েছে তাহলে ও কেনো সেই সুযোগ লুফে নিবে না?ও ইতোমধ্যেই তাকে মায়ের জায়গা দিয়ে ফেলেছে,ও খুব খুশি কারণ ও এখন মিসেস খানকে মা বলে ডাকে। ওরও এখন একটা মা আছে।

খাবার শেষে সায়ান সোফায় বসে সামুর সাথে কথা বলছিলো ঠিক তখনই ইনান আসে। তারা তিনজন কথা বলতে থাকে, সায়ান তো ইনানকে বলতে থাকে ও যদি সামুকে পছন্দ করতো তবে ওকে বলেনি কেনো?বিনিময়ে ইনান শুধু মলিন হাসলো কিন্তু কিছু বললো না। ঠিক তখনি রুশি ট্রে হাতে বসার ঘরে প্রবেশ করলো, রুশি আগের থেকে একটু মোটা হয়ে গেছে তাই দেখতে ওকে আরো আকর্ষণীয় লাগছে। পুর্বে ও মাত্রাতিরিক্ত চিকন ছিলো। ইনান রুশির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তখনি সায়ান বলে উঠে

“আরেহ তুমি এটা নিয়ে আসতে গেলো কেনো?বাড়িতে সার্ভেন্ট আছে তো! তারা এসব করবে তুমি এসব রেখে সামুর পাশে বসো।”

রুশি বাধ্য মেয়ের মতো ট্রে রেখে সামুর পাশে বসে রইলো আর ওর সাথে কথাতে মেতে উঠলো। ইনানের দিকে ও তাকায়নি একবারের জন্যও না। এমনভাবে বসে আছে যেনো সবকিছু স্বাভাবিক, ও ইনান কোনদিন চিনতো না। আদোও কি তাই! অতীত ভুলে যাওয়া কি এতোই সহজ?তবে ও ভুলতে পারছে না কেনো? বরং মনে দিনদিন রুশিকে ও আরো বেশি ভালোবাসে, অনেক বেশি।ও রুশির থেকে চোখ সরিয়ে সায়ানের দিকে তাকাতেই দেখে সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে আছে, নাহ স্বাভাবিকভাবে নয় ঘোরলাগা দৃষ্টিতে। কথায় আছে না

“একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষের মনের অবস্থা ঠিক তখনি বুঝতে পারে যদি তাদের মনে একই জিনিস চলতে থাকে”

রুশির প্রতি সায়ানের এই দৃষ্টি ইনানের সহ্য হলো না আর হবেই বা কি করে?নিজের ভালোবাসার মানুষেত উপর অন্যের দৃষ্টি কোন প্রেমিক পুরষেরই সহ্য হয়না, ওতো তার ব্যাতিক্রম নয়। ও আর চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্নই করে ফেললো

“মেয়েটি কে? আগে কোনদিন দেখিনি তো!”

“দেখার কথাও না। ও হচ্ছে রুশি আমার ওয়াইফ আর আমার অনাগত সন্তানের মা”

ইনান যেনো বিশ্বাসই করতে পারলো না, শক্ত করে হাত মুঠো করে ফেললো। রুশি সায়ানের বউ মানে ও বিবাহিত আর সবচেয়ে বড় কথা ও সায়ানের সন্তানের মা।মানেই রুশি সেই মেয়ে!
এর আগে যদি সায়ানের এই দৃষ্টি তার বউয়ের দিকে দিতো ও হয়তো বেশ খুশি হতো কারণ ওর মনে হচ্ছিলো মেয়েটি স্বামীর ভালোবাসা ডিজার্ভ করে। সায়ানের উচিৎ মেয়েটিকে মেনে নেয়া কিন্তু এখন ও মানতে পারছে না কারণ মেয়েটা অন্য কেউ নয় রুশি যাকে ও প্রচণ্ড ভালোবাসে,প্রতিনিয়ত তাকে চায় নিজের। ও মানতে পারছে না রুশি এখন অন্যকারো! ওর মাঝে ছোট্ট একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে যেটা অন্যকারো অংশ ওর নয়। ও মানতে পারছেনা যে সেই অন্যকেউটা ওর প্রাণ প্রিয় বন্ধু!

সায়ানতো চন্দ্রিকাকে ভালোবাসে তাহলে রুশির দিকে এভাবে তাকানোর মানে কি?ও কি তবে ঘরে একজন বাইরে আরেকজন রাখতে। যদিও ইনান নিজেও বুঝতে পারতো সায়ান চন্দ্রিকাকে ভালোবাসে না, চন্দ্রিকার প্রতি যা আছে তা শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সায়ানকে চন্দ্রিকাকেই ভালোবাসতে হবে!সায়ানের জন্য চন্দ্রিকাই সব, রুশির প্রতি তার কোন অনুভুতি কাজ করতে পারেনা। রুশি শুধুর তার এবং তার। আর কারো না!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে