গানের ওপারে তুমি পর্ব-০৭

0
314

“গানের ওপারে তুমি”
পর্ব- ৭
(নূর নাফিসা)
.
.
এ সপ্তাহেরই বুধবার দুপুরের দিকে মিহির অফিস থেকে একজন সহকর্মীকে সাথে নিয়ে নিটারে এলো। ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই এক দল এসে ভীড় করলো অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফের জন্য। মিনিট দু-তিন ভীড়ের মধ্যে স্থির থেকে ভীড় কাটিয়ে নিয়েছে। সামনে পড়ায় দুতিনজন স্থানীয় ছাত্র নেতা স্বেচ্ছায় এগিয়ে এলো তাদের সঙ্গ দিতে। তারাই ভীড় কমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। হলেই কি, ক’জনকে এড়িয়ে যাওয়া যায়? মিনিট খানেক পরপরই দলবেঁধে এসে ভীড় করে। আবার কাটিয়ে আবার এগিয়ে যায়। এভাবেই ভবন পর্যন্ত গিয়ে দুইটা ডিপার্টমেন্টের টিচারের সাথে দেখা করলো। পরিচিত হয়ে আবার বেরিয়ে এলো। এখানে আসার মূল উদ্দেশ্যই ক্যাম্পাস ঘুরাফেরা। মাঝে মাঝে অবসরে যায় একটু এদিক সেদিক ঘুরতে। তাছাড়া অন্যত্র না গিয়ে এই ক্যাম্পাসেই আসার আরেকটা মূল কারণ রিপ্তি। যেহেতু এটা রিপ্তির ক্যাম্পাস এবং রেগুলার স্টুডেন্ট সে, সেহেতু তার সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক।
এদিকে রিপ্তি সহপাঠীদের মুখে শুনলো হঠাৎ, মিহির খাঁন এসেছে ক্যাম্পাসে। তাতেই যেন একটু বিস্ময় জাগলো। সত্যিই নাকি? কিন্তু কেন? আজ কি কোনো প্রোগ্রাম এখানে? কোথায়, সে তো শুনেনি প্রোগ্রাম সম্পর্কে কিছু! ব্যাপারটা বুঝে উঠতে ফ্রেন্ডের সাথে ভবন থেকে বেরিয়ে এসে একপাশে ভীড় দেখে এগিয়ে গেলো। কাছে গিয়ে দেখলো, মিহিরই! সবাইকেই অটোগ্রাফ দিচ্ছে। সাথের ফ্রেন্ড তো আহ্লাদে তাকে টানতেই শুরু করেছে একত্রে ভীড়ে প্রবেশ করে একটা অটোগ্রাফ সংগ্রহ করতে। কিন্তু রিপ্তির আগ্রহটা প্রকাশ হলো না। মিহিরের সাথে অভিমানের অংশটুকু না ঘটলে হয়তো সে-ও ভীড় ঠেলে ছুটে যেতো একটা অটোগ্রাফ সংগ্রহের জন্য। অথচ আজ যাওয়া হলো না। ওদিকে যারা অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফ পেয়ে গেছে, তাদেরকে বড় ভাইয়ারা ঠেলে সরিয়ে ভীড় কমিয়ে বাকিদের সুযোগ সৃষ্টি করছে। ভীড়টা হালকা হয়ে এলেই অল্প দূরত্বে দাঁড়ানো রিপ্তিকে লক্ষ্য করলো মিহির। ফ্রেন্ড টানছে রিপ্তিকে। রিপ্তি আসছে না তাই বিরক্ত হয়ে একাই চলে এলো সাথের জন। ভীড় কমেছে যখন, এটাই সুযোগ। তাই সুযোগে নিয়ে নিলো অটোগ্রাফ। মিহির মৃদু হাসলো তার অনিচ্ছা দেখতে পেয়ে। এইটুকুর মধ্যে যারা ছিলো, তাদের ইচ্ছে পূরণ করতে করতে রিপ্তির দিকেও লক্ষ্য রাখছিলো সে। ফ্রেন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পেরে তার ফ্রেন্ডকে সবার পরে দিলো অটোগ্রাফ। ভীড়ের সদস্যদের বিদায় দিয়ে রিপ্তির উদ্দেশ্যে বললো,
“রিপ্তি, চলো।”
রিপ্তির ফ্রেন্ড রীতিমতো বিস্ময়ের ডানায় ভর করেছে। রিপ্তিও যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। তাকে ডাকলো নাকি? ঠিক শুনলো তো? কেন ডাকবে তাকে? নিয়ে যেতে এসেছে নাকি! রিপ্তির ফ্রেন্ডদের অনেকেই জানে মিহির খাঁন তাদের এলাকারই ছেলে। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট সম্পর্কের দিক থেকে পরিচিত বলে তো জানে না। রিপ্তিও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। মিহির আবার তাকে হাতে ইশারা করলো গেইটের দিকে যেতে। রিপ্তি ভারি দুশ্চিন্তা নিয়ে ফ্রেন্ডকে টা টা জানিয়ে হাঁটতে লেগেছে ইশারা মোতাবেক। নেতাদের সাথে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিয়ে মিহির এবং তার সহকর্মী বা কর্মসূত্রে সৃষ্ট বন্ধুটিও হাঁটতে লাগলো বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রিপ্তি ধীর পায়ে হেঁটে গেলেও তারা দুজন হাঁটছে ঘন পা ফেলেই। তারা গাড়িতেও উঠে গেছে, অথচ রিপ্তি গেইটের কাছে মাত্র। সাথের জন উঠলো সামনে, মিহির উঠলো পেছনে। দরজাটাও খোলা রেখেছে রিপ্তির জন্য। রিপ্তি গাড়ির কাছে এসে ভাবচাপা মুখে জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাবো?”
ঈষৎ হেসে মিহির বলে,
“উঠে বসো আগে।”
হাসিখুশি চঞ্চল মেয়েটা যেন ভারি অস্বস্তিতে পড়ে গেলো হঠাৎ। রিপ্তি উঠে বসলেই গাড়ি চলতে শুরু করেছে পরিকল্পিত পথে।
“ডেকে তো নিয়ে এলাম। ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস ছিলো আরও?”
মিহিরের জিজ্ঞাসায় রিপ্তি দুদিকে মাথা নাড়লো। মিহির আবার জিজ্ঞেস করে,
“মা গিয়েছিলো তোমাদের বাসায়। দেখা হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“অটোগ্রাফ লাগবে? আজ কলম আছে আমার কাছে।”
রিপ্তি এক পলক তার দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সামনে ফিরিয়ে নিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো। মনে পড়েছে তার, সেদিনের দেওয়া কলমের খোটা। মিহির ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই রিপ্তির হাত টেনে নিলো অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য। দুষ্টু রিপ্তি অভিমানকে স্মরণ করিয়ে দিতে হাত মুঠো করে রাখলো। মুঠো করে রাখা হাতের তালু যেটুকু ফাঁকা পেলো, সেটুকুতেই অটোগ্রাফ দিলো মিহির। লেখা শেষে হাত ছেড়ে দিয়ে কলমটা রেখে দিলো প্যান্টের পকেটে। রিপ্তি হাত নিজের কোলে এনে দৃষ্টি বুলিয়ে চরম বিস্মিত! মুঠো হাতের কোণে লেখা,
“চলো বিয়ে করি…”
সাথে মিহির খাঁনের সিগনেচার। রিপ্তি মুখ চেপে ফিক করে হেসে উঠলো বাইরে তাকিয়ে৷ গাড়িতে না থাকলে হয়তো মন খুলে দিল লাগিয়ে খিলখিলিয়ে হাসতো। সামনে থাকা লোকটা হাসি আন্দাজ করেই মন্তব্য করলো,
“ভাবি খুশি আছে দেখা যায়!”
মন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভালো থাকার বহিঃপ্রকাশ ব্যক্ত করে মিহির প্রত্যুত্তর করলো,
“বুঝলে আকরাম, তোমার ভাবিকে একেকদিন আমি একেকরকম দেখি। কিছুদিন আগে যখন হাসতে আর বকবক করতে দেখলাম, মনে হলো স্কুলের স্টুডেন্ট। পরে সে-ই বললো কলেজে যায় সে। এরপর অভিমান করতে দেখে সত্যিই মনে হলো সে কলেজ পড়ে। দুতিনদিন আগে শুনলাম সে ইউনিভার্সিটিকেই কলেজ বলেছে। এখন দেখলাম সত্যিই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ওই হাসিখুশি আর অভিমানের পরে লাজুক একটা ভাব আছে, যা প্রমাণ করে সে ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে তো এই ভাবটা আসে না। ভেবে পাই না, মানুষ দুয়েক মাসে কিভাবে এতো বড় হয়ে যায়?”
আকরাম হেসে বললো,
“এটাই তো ভালো। একেকসময় একেকরকম বউয়ের স্বাদ পাবে৷ বউকে কখনো বুড়ি মনে হবে না। ভিন্ন ভিন্ন ভাবভঙ্গির কারণে একবার মনে করবে স্কুল পড়ুয়া পিচ্চি বউ, একবার মনে হবে কলেজ পড়ুয়া টিনেজ বউ, আবার মনে হবে ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া যুবতী।”
“আমি ভাবছি, দুদিন পরই আবার না শুনি বউ চাকরিজীবী।”
“তবে তো আরও ভালো। টাকার বিছানায় ঘুমাবে, টাকার প্লেটে খাবে।”
“এখন কি মাটিতে খাই? সব তো টাকায় কেনা-ই।”
“ধুর মিয়া! কথায় শুধু প্যাচ দাও! টাকার প্রাচুর্যে স্বর্ণে খাবে তখন, স্বর্ণে।”
এদিকে মিহিরের দিকে তাকিয়ে রিপ্তি বললো,
“গ্রাজুয়েট হলে চাকরি তো করবোই।”
“সেটা তো দু-তিন বছর পরের কথা। দুদিন পরে আবার এমন কিছু শুনবো নাকি, সেটাই ভাবছি।”
“আপনি সার্টিফিকেট দিলে হয়ে যাবে।”
মিহির একগাল হেসে তার চাঞ্চল্যতার পিঠে মন্তব্য করে,
“পুরনো রিপ্তি। অভিমান ভেঙেছে তবে?”
“না।”
“আসলেই?”
রিপ্তি বাইরে তাকিয়ে হাসলো৷ তার মনটাও বেশ ভালো আছে। অভিমানের বাঁধটুকু ঝড়ো বাতাসে বালির ন্যায় উড়ে গেছে। মনটা উড়ে বেড়াচ্ছে এক অপ্রকাশ্য সুখের ডানায় ভর করে। পথপ্রান্তের ধূলিকণাকে ধূলিসাৎ করে ছুটছে উড়ু উড়ু পিঞ্জরপাখি। পাশাপাশি অবস্থান করা প্রিয়তমের দিকেও না খানিক দৃষ্টি ঢেলে দেয় মনের আঁখি। এই চোখদুটো স্থির না হলেও পিঞ্জরার ফ্রেমে রংতুলিতে আঁকিবুঁকির বিস্তার ঘটছে ব্যাপক। তাকে ভাবছে, তাকে আঁকছে। অনুভবে জড়িয়ে নিচ্ছে অপলক।
রিপ্তিকে সাথে নিয়ে তারা রেস্টুরেন্টে গেলো ড্রাইভার সহ। লাঞ্চ করে আকরাম বিদায় নিয়েছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে গাড়িতে ব্যাক সিটে বসে মৃদু গলায় গল্পসল্প করে গেলো তারা দুজনে।
“বিয়েতে তো আয়োজন হবে না। বউ সাজবে?”
“তো সাজবো না? বিয়ে তো হবে।”
“তা তো ঠিকই। শপিং করতে যাবে কবে?”
“আমি করবো শপিং?”
“আর কে করবে তবে? আমার তো কেউ নেই। তোমার প্রয়োজন তুমিই ভালো বুঝবে, পছন্দমতো কিনে নিবে।”
“আপনিই করলেই ভালো হয়।”
“আমার সাথে তোমাকে যেতে হবে তবে। আর নাহয় টাকা পাঠিয়ে দেই, তুমি ফ্যামিলির কাউকে সাথে নিয়ে করে নিয়ো।”
“উহুম। টাকা নিবো না।”
“ওকে, তবে শুক্রবার রেডি থেকো। নিয়েই যাবো। তোমার ফেসবুক আইডি খুঁজলাম, পেলাম না। কি যেন নাম বলেছো?”
“রিপ্তি কুইন।”
মিহির ফোন নিয়ে তখনই ফেসবুকে সার্চ করে পেয়ে গেলো রিপ্তি কুইনকে। ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েও দিলো। ইনবক্সটাও এবার চেক করে এক ক্রাশিত পাগল ভক্তের সাথে পরিচিত হলো। একেক সময়ের একেকরকম টেক্সট করে রেখেছে, “হ্যালো, মাই লাভ!”, “হ্যালো, ক্রাশ ম্যান!”, “মাই মিহির খাঁন!”, “আই লাভ ইউ!”, “লাভ ইউ, সুপারস্টার মিহির খাঁন!”, “রিপ্লাই দেন না কেন? একটা রিপ্লাই দেন। ফিদা হয়ে যাবো! টু মাচ সিরিয়াস।”
মুখে চাপা হাসি রেখে মিহির মনে মনে সেসব পড়ছে। ফোনের স্ক্রিনে টেক্সটগুলো দেখে লজ্জায় মরি মরি হয়ে যাচ্ছে রিপ্তি। মিহির তার টাইমলাইনও চেক করলো। দুর্দান্ত মেয়ের দুর্দান্ত এক্টিভিটি ফেসবুকে। মিহিরের প্রত্যেকটা অটোগ্রাফের ছবিও আছে এখানে। আর সেই কি দুষ্টু মাখা একেকটা ক্যাপশন! হাসিখুশির পোস্টেই ভরপুর। এক্টিভ ফ্রেন্ডও আছে দু-তিনশোর মতো। রিয়েক্ট, কমেন্টেও দুষ্টামো ফাজলামো হয় ক্লোজ ফ্রেন্ডদের সাথে। মিহির তাকে আজকের অটোগ্রাফকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“এটাও ছবি তুলে ফেসবুকে দিবে?”
“উহুম।”
“কেন?”
“এটা দেখলে জীবনেও বিশ্বাস করবে না কেউ।”
“আমি তোমাকে ট্যাগ করে ম্যারিড স্ট্যাটাস দিলে বিশ্বাস করবে তারা?”
রিপ্তি জিভ কেটে বসে রইলো। মিহির জবাব জানতে জিজ্ঞেস করলো,
“হুম?”
“আপনি স্ট্যাটাস দিলে তখন আমিও সেলিব্রিটি হয়ে যাবো। আপনি তো ভীড় ঠেলে সরে আসতে পারেন। আমি পারবো না বেরিয়ে আসতে। দেখা যাবে চাপা পড়ে ভীড়েই পিষে গেছি। আমার এসব হওয়ার দরকার নেই বাপু! এমনি আছি, ভালো আছি।”
মিহির মজা পেয়ে হাসলো। বড় রাস্তা থেকে ছোট রাস্তায় প্রবেশ করে গাড়িতে থেকেই রিপ্তিকে তাদের বাসাটাও আজ চিনিয়ে দিলো। এরপর তাকে ড্রপ করলো রিপ্তির বাড়ির সামনে। আজ রিপ্তি চাইছিলোই, বাড়িতে টেনে নিয়ে যেতে। খুব শীঘ্রই রিপ্তিকেই নিতে আসছে বলে শুভবিদায় নিয়ে ফিরলো মিহির।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে