গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১৫+১৬

0
173

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৫.

শেষ রাতে ঘুম ভাঙল তনয়ার। গতকালের রেশ মনের মধ্যে কেমন যেন ভয় জাগিয়ে রেখেছে তার। সে ডেকে তুলল স্বরূপকে। “কী হয়েছে?” ঘুম জড়ানো গলায় প্রশ্ন করল স্বরূপ।

তনয়া উত্তর দিল, “নামাজ পড়ব।”

“পড়ো!” বলে উল্টোদিকে ফিরে শুল স্বরূপ।

তনয়া এবার ধাক্কা দিল তাকে। “তুমিও পড়বে। ওঠো!”

“এখন উঠতে পারব না। ঘুম হয়নি।”

“পরে ঘুমিও আবার, এখন ওঠো, প্লিজ!”

স্বরূপ তনয়ার বালিশটা টেনে নিয়ে মাথর ওপর চেপে ধরে কম্বলটা আরেকটু টেনে নিল।

তনয়ার এবার রাগ হতে লাগল। আস্ত পাজি লোক তো! সে স্বরূপের হাত ধরে টানাটানি করল কিছুক্ষণ, কাতুকুতু দেয়ার চেষ্টা করল, ঘরের লাইট অন করে দিল, ওর চোখের সামনে মোবাইলের ফ্ল্যাশলইট অন করে ধরে রাখল। শেষ পর্যন্ত কিছুতেই কাজ না হওয়ায় পানি ছিটিয়ে দিল চোখেমুখে।

স্বরূপ এবার উঠে বসে চোখ ডলতে ডলতে বলল, “কাল রাতে যদি তোমাকে ঘুমাতে দেই তো আমার নাম স্বরূপ না।”

“ওকে, তোমার নতুন নামকরণের ভার আমাকে দিও প্লিজ! আমার অনেক ইচ্ছে ছিল আমার বরের নাম হবে ঝন্টু মিয়া।”

“উইল ইউ শাট আপ?”

“নো।”

স্বরূপ উঠে বাথরুমে ঢুকল। তনয়া একটু পর বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, “ওযু করে বের হবে কিন্তু… তুমি কি ওযু করতে পারো?”

“না না, সব তো তুমি একাই পারো।” ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে বলল স্বরূপ।

একটু পর বের হলো সে। দেখে মনে হলো ওযু করেই বের হয়েছে। তনয়া জিজ্ঞেস করল, “মসজিদে যাবে?”

“না, মসজিদ অনেক দূর। ততক্ষণে সময় শেষ হয়ে যাবে।”

“কাল আরও তাড়াতাড়ি ডেকে দেব তাহলে৷ এখন একটু অপেক্ষা করো। আমি ওযু করে আসি। একসাথে নামাজ পড়ি।”

দু’জন একসাথে নামাজ পড়ল। ভোরের আলো ভালো করে ফুটলে তনয়া জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। ভোরের স্নিগ্ধ শীতল বাতাস ছুঁয়ে গেল তাকে। ঘরটাও আলোকিত হলো। সে মশারি তুলে বিছানা ঝাড়ল, ঘরটা সুন্দর করে গুছিয়ে ফেলল। স্বরূপ জানালার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে রইল। তনয়ার কাজ শেষ হলে সে বলল, “জানো, অনেকদিন পর ফজরের নামাজ পড়লাম।”

“কেমন লাগছে?”

স্বরূপ সেটার উত্তর না দিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।”

দু’জনের আর কথা হলো না৷ চুপচাপ পাশাপাশি বসে রইল তারা। তনয়ার গতদিনের ট্রমা অনেকটা কেটে গিয়েছে। যদিও মন থেকে বিষয়টা মুছতে অনেক সময় লাগবে, তবুও প্রাথমিক ভয়টা কেটে যেতেই শান্তি লাগছে।

গ্রামের মানুষের কাজকর্ম দ্রুত শুরু হয়। জানালা দিয়ে লোকজন দেখা যাচ্ছে সেই আলো ফোটার পর থেকেই। সবাই ভোর থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সন্ধ্যা হতে হতে কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের শহুরে জীবনটাও এমন হলে বেশ হতো! চেষ্টা করা যায় না কি? স্বরূপকে বলে দেখতে হবে তো! মায়ের ডাক শুনে সে বেরিয়ে গেছে একটু আগেই। আজ বাড়িতে তাদের বিয়ে উপলক্ষে খাওয়াদাওয়া হবে। তনয়াকেও তৈরি হতে হবে। রোদের দেখা মিললে সে গোসল করে ফেলল।

*

তনয়া বিয়েতে বিশাল মেকআপ বক্স উপহার পেয়েছে। স্বরূপের হয়ে কেনাকাটা করে দিয়েছে তার বন্ধুরা। এই মেকআপের জিনিসগুলো যে কিনেছে তার চয়েজ অসাধারণ! সব ভালো ব্র্যান্ডের জিনিস। লিপস্টিকের পুরো সেট দিয়েছে। তাতে এত সুন্দর সব রঙ যে তনয়ার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে!

সে যখন সাজতে বসেছে তখন গ্রামের অনেক মেয়েরাই এসেছে তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু এসব প্রোডাক্ট দেখে কেউ ধরতে সাহস পায়নি। তনয়া একাই সাজগোজ করেছে। তারপর নিজেই বলেছে অন্য যারা সাজবে তারা যেন তার কাছে এসে বসে।

এরপর শুরু হলো তার সাজানো। শেষ আর হয় না। তনয়ার মনে হলো সে ভয়াবহ একটা ভুল করে ফেলেছে। বিশাল লাইন পড়ে গেছে সাজবার। তবুও সে হাসিমুখেই অনেককে সাজিয়ে দিল।

একসময় চাচী এসে হায় হায় করে বললেন, “এইটা কী হয়? বউ মানুষ সবাইরে সাজাইতাছো কেন? বিয়া ওগো না তোমার?”

তনয়া হেসে বলেছে, “সাজাই না চাচী, সমস্যা কী?”

“না কুনু দরকার নাই। যা সব, বাইর হ এইখান থেকা।”

তিনি ছাগল তাড়াবার মতো করে সবাইকে তাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি একটু জিরাও। পরে বাইরের ঘরে নিয়া যাব। অনেক আত্মীয়স্বজন আসতেছে। খাওয়া হইয়া গেলেই তারা বউ দেখব।”

চাচী বের হয়ে গেলে তনয়া মোবাইলটা নিয়ে বসল। মাকে ফোন করে কথা বলে নিল। কাল থেকে কথা হয়নি। মায়ের কাছে গতকালের ঘটনা বলতে চায় না সে৷ এমনিতেই ট্রেন মিস করার ঘটনা শুনে মা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। একমাত্র মেয়ে বলেই তার এত ভয়। তনয়ারও খারাপ লাগছে। বিয়ের পর থেকে মায়ের সাথে একটুও দেখা হলো না। এতদিন তো সে মাকে ছেড়ে কখনো থাকেনি।

ফোন রেখে তনয়ার খুব কষ্ট হচ্ছিল। মা বাবাকে আজ দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মা অসুস্থ বলে আসতে পারেননি তারা। তনয়ার বাড়ি যেতে যেতে আরও চার পাঁচদিন। এতদিন মাকে না দেখে থাকতে হবে। তার চোখে পানি চলে এলো।

“আরে আরে নতুন বউ কাঁদে কেন?” গ্রাম্য পরিবেশে শহুরে একটা আওয়াজ তনয়াকে একটু অবাক করল। সে চোখ তুলে দেখল স্বরূপের বন্ধু মিলি। সব বন্ধুবান্ধবকেও দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। তবে সবারই দেখা গেছে কোনো না কোনো সমস্যা। সকালে বলছিল স্বরূপ ওদের কথা। তবে মিলি আপু যে আসবে সেটা বলেনি।

মিলি কাছে এসে তনয়ার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, “বাড়ির কথা মনে পড়ছে?”

তনয়া মাথা নাড়ল। মিলি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “পড়বেই তো। কিন্তু কাঁদলে কি মা আসবে বলো? আরও তার কষ্ট হবে। তুমি খুশি থাকো, দেখবে মাও খুশি থাকবে।”

তনয়া হাসার চেষ্টা করল। মিলি বলল, “তোমাকে যা সুন্দর লাগছে মেয়ে! তোমার বরের তো সারাদিন তাকিয়ে থাকার কথা। কোথায় সে? এসে তো দেখলাম না।”

তনয়া অভিমান করে বলল, “আপনার বন্ধু কি আর সেরকম মানুষ নাকি?”

মিলি ম্লান হেসে বলল, “ও খুব ভালো মানুষ তনয়া। তুমি যদি ওকে ঠিকঠাক বোঝো তাহলেই আর একথা মনে হবে না।”

তনয়ার গতকালের কথা মনে হলো। মিলি আপু হয়তো সত্যিই বলছে।

*

দিনটা ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল। সন্ধ্যার অনেকটা পর যখন সব মেহমান চলে গেছে, তখন ঘরে ঢুকল তনয়া। ইচ্ছে হলো কোনো জাদুমন্ত্রবলে যদি শাড়িটা বদলে নরম জামা হয়ে যেত! আহা!

স্বরূপের দেখা নেই। এখনো হয়তো কাজ করছে। তনয়ার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। যদিও সে বসেই ছিল, তবে কখনো কখনো বসে থাকাটাও খুবই যন্ত্রণাদায়ক।

সে উঠে কাপড় বদলে মেকআপ ধুয়ে এলো। বিছানার চাদর বদলে ফেলল। আজ এত মানুষ এসেছে যে এটাতে শোওয়া যেত না৷ কাজ করতে করতে সে আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বালিশে মাথা রাখতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো।

হঠাৎ একটা শব্দে চমকে উঠল সে। নাঁকি একটা সুরে কেউ যেন গান গাইছে। কান পাতল তনয়া। গান? নাকি কিছু একটা বলছে? গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। বিছানায় পা উঠিয়ে বসল। আবারও ভালো করে শোনার চেষ্টা করল। একসময় কথাগুলো একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে এলো, “স্ব…রূ…প… কো…থা…য়. .তু…মি… তোমা…র…ঘ…রে…কে…এটা… তু…মি…নে…ই…কে…নো…. ও… স্ব… রূ…প… তু… মি…বি… য়ে.. কে…নো… ক…রে…ছো…আমি…তোমাকে…বলেছিলাম…না… স..তী…নে…র…ঘর…করবো…না…”

তনয়া অস্ফুটে বলল, “কে? কে কথা বলে? কে?”

কণ্ঠটা একটু থামল। তারপর কাচের চুড়ি ভাঙার মতো রিনরিনে কণ্ঠে কে বলে উঠল, “আমি চন্দ্রা…চন্দ্রাবতী… তোমার সতীন গো সতীন…”

তনয়া বুঝতে পারছিল না শব্দটা আসছে কোথা থেকে। তবে কি স্বরূপ সত্যিই বলেছিল? কেউ আছে এরকম? ঘরের আলো অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে চারদিকে ছায়ারা জেগে উঠে নাচানাচি করছে। তনয়া ফুঁপিয়ে উঠল। ভয়ে তার গা শিরশির করছে। কতক্ষণ এভাবে কাটল জানে না তনয়া।

একসময় দরজা খুলে গেল। স্বরূপ ঢুকে তাকে দেখে উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে তনয়া? আবার কিছু হয়েছে?”

তনয়া ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। স্বরূপ তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, “আরে কাঁদো কেন? কেউ কিছু বলেছে?”

তনয়ার শান্ত হতে একটু সময় লাগল। তারপর সে সব খুলে বলল। স্বরূপকে খুব চিন্তিত মনে হলো। সে কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে বলল, “আচ্ছা একটা কাজ করো তো…” বলতে বলতে পকেট থেকে মোবাইল বের করল সে। কী একটা অ্যাপ বের করে তনয়ার মুখের সামনে মোবাইল ধরে বলল, “কিছু একটা বলো।”

“কী বলব?”

বলার পরেই অদ্ভূত একটা ব্যাপার হলো। অদৃশ্য কোথাও থেকে নাঁকি সুরে ভেসে এলো, “কী…ব…ল…বো…”

তনয়ার কয়েক সেকেন্ড লাগল বিষয়টা বুঝতে। সে প্রচন্ড রাগে স্বরূপের দিকে তাকিয়ে দেখল সে হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। তনয়া বালিশ দিয়ে ইচ্ছেমতো তাকে মারতে শুরু করল। স্বরূপের হাসি তাতে থামল না। তনয়ার এরপর বলা সব কথা প্রতিফলিত হয়ে নাঁকি সুরে ফিরে ফিরে আসতে লাগল। স্বরূপের হাসিও বাড়তে লাগল। একসময় তনয়া ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল। তারও এখন নিজের বোকামিতে হাসি পাচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল, “কেন করলে এটা?”

স্বরূপ কোনোমতে বলল, “নাম বদলে ঝন্টু হতে চাই না বলে।”

“তোমাকে আমি আজ থেকে ঝন্টুই ডাকব। হুহ…”

স্বরূপ পেট চেপে বলল, “ডেকো, আমি তোমাকে ডাকব ভুতু।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৬.

স্কুলের মাঠের এক কোণে বিশাল দেবদারু গাছের তলায় বসে তনয়া স্কুলের গল্প শুনল। সকালবেলা সে মায়ের সাথে আবদার করে তার স্কুল দেখতে চলে এসেছে। মা এসেই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বেশ কিছুদিন তিনি ছেলের বিয়ের জন্য স্কুলে আসতে পারেননি। প্রচুর কাজ জমে গেছে। তনয়া দেখে এসেছে তার টেবিলে ফাইলের স্তুপ আর অপেক্ষারত দর্শনার্থীদের ভিড়। তনয়া বলে এসেছে সে একাই ঘুরেফিরে দেখবে।

মা অবশ্য একা ছাড়েননি তাকে। স্কুলেরই এক শিক্ষিকাকে বলেছেন তনয়াকে সব ঘুরে দেখাতে। স্কুলশিক্ষিকা সুরমাকে বেশ পছন্দ হয়ে গেছে তনয়ার। মেয়েটার বয়স তার কাছাকাছি। এই গ্রামেরই মেয়ে। তার পড়ানোর বিষয় বাংলা। মেয়েটা ঘুরেফিরে সব দেখল তনয়াকে। প্রতিটা ক্লাসরুম, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে, তাদের কমনরুম, একচিলতে বাগান। সুন্দর গোছানো স্কুল৷ ঘুরেফিরে তারা দেবদারু গাছের নিচে এসে বসলে সুরমা তাকে গল্পটা বলল।

এর আগে ওদের গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না। ওরা যারা পড়াশুনা করত তাদের যেতে হতো দুই গ্রাম পরে সরকারি স্কুলে। সেখানেই একসময় শিক্ষকতা করতেন স্বরূপের মা, মানে সুরাইয়া বেগম। শিক্ষকতার কাজটা তার খুবই পছন্দ ছিল। প্রতিদিন এতটা হেঁটে যেতেন পড়ানোর খাতিরে।

সেবার ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। বন্যায় গ্রামের রাস্তাঘাটের অবস্থা এত খারাপ হয়েছিল যে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। স্কুলও অনেকদিন বন্ধ রয়েছিল। কিন্তু যখন খুলল, তখনো এই গ্রাম থেকে স্কুলে যাওয়ার পথ সুগম হলো না। ছাত্ররা তবু পড়ার তাগিদে কয়েক মাইল হেঁটে ঘুরে যেত। ছাত্রীদের পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল সুরাইয়া বেগমের স্কুলে পড়ানোও। তিনি বেশ ভেঙে পড়লেন।

তার স্বামী তাকে ভীষণ ভালোবাসতেন৷ স্ত্রীর কষ্ট তার সহ্য হলো না। তিনি কথা দিলেন, এই গ্রামেই তিনি স্কুল করে দেবেন। সেই স্কুলেই তার স্ত্রী শিক্ষকতা করবেন।

তিনি ছিলেন সাধারণ চাকুরে। অল্প কিছু বেতন পেতেন মাস শেষে৷ চাকরির টাকায় তার পক্ষে স্কুল করা সম্ভব ছিল না। তিনি নিজের পৈতৃক সম্পত্তির বড় একটা অংশ বিক্রি করে দিলেন। স্কুল হলো।

গ্রামের লোকজন প্রথম প্রথম তার এই কান্ডে হাসাহাসি করতে বাকি রাখল না। কতকিছুই না বলেছিল তারা! সেসব এখন অতীত। স্কুলটা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছিল। সুরাইয়া বেগমের দক্ষতায় এখন এই স্কুলটাই কয়েক গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ভালো স্কুল।

কিন্তু দুঃখেত বিষয় হলো, স্কুলটা ভালো করে চলতে শুরু করার আগেই সুরাইয়া বেগমের স্বামী মারা গিয়েছিলেন। তবে দু’জনের স্বপ্ন আর ভালোবাসা এখনো বেঁচে আছে।

তনয়া চারদিকে তাকিয়ে দেখল কী সুন্দর পরিবেশ! বাচ্চাদের কলকাকলিতে মুখরিত স্নিগ্ধ শীতল বাতাস। ওর মন ভরে গেল। সে স্কুলেই বসে রইল মায়ের কাজ শেষ হওয়া অবধি। টিফিনের সময় মায়ের সাথে বসে বাড়ি থেকে আনা খাবার খেল।

মা বোধহয় তখনই স্বরূপকে ফোন করেছিলেন৷ একটু পর তনয়া দেখল স্বরূপ এসেছে। সাথে মিলি। গতকাল রয়ে গিয়েছিল সে। মিলি অসম্ভব সুন্দর। তনয়ার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর। ওকে তনয়ার এত ভালো লাগে! কিন্তু আজ এই গ্রামের পরিবেশে তার পশ্চিমা পোশাক বেমানান লাগছে।

ওরা একসাথে ঘুরতে বের হলো। এখান থেকে অটোরিকশায় করে বড় বিলে যাওয়া যায়। সেখানে নাকি অজস্র পদ্ম ফোটে।

ওরা বড় বিলে পৌঁছুল বিকেলে। তখন দুপুরের চড়া রোদ নরম হয়ে এসেছে। পাড়ে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় শুধু পদ্ম আর পদ্ম। ওরা একটা নৌকা ভাড়া করে উঠে পড়ল। তনয়া শাড়ি পরে এসেছে। নীল রঙের শাড়ি। পরিবেশ অনুযায়ী খুব মানিয়ে গেছে। মিলি বারবার আফসোস করল, কেন যে শাড়ি পরে এলাম না!

বিলের মাঝ বরাবর গিয়ে দেখা গেল পাড় দেখা যায় না। যেন পদ্মের একটা সমূদ্রে চলে এসেছে তারা! মিলির জামা ম্যাচ না হলেও সে ছবি তুলতে কার্পন্য করল না। স্বরূপকে ক্যামেরাম্যানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হলো। তনয়ার ছবি তুলতে ইচ্ছে করল না। সে চুপচাপ মাঝির পাশে বসে রইল। স্বরূপ আর মিলি কয়েকবার তাকে বলল। কিন্তু সে জায়গা থেকে উঠল না। এত সুন্দর পরিবেশ স্মৃতিতে ধারণ করলেই বরং বেশি ভালো লাগবে। অত পোজ দিয়ে ছবি তুলে বড়জোর প্রোফাইলের ছবি বদলে দেয়া যাবে! আর কী লাভ হবে?

ওর খুব বিরক্ত লাগতে লাগল মিলির ওপর। এই মেয়েটা না থাকলে সে স্বরূপের হাত ধরে বসে থাকত। মিহি বাতাস গায়ে মেখে ওর কাঁধে মাথা রেখে দিগন্তে আকাশ আর জল এক হয়ে যেতে দেখত। স্বরূপকে আবদার করত পদ্ম তুলে দিতে। কিন্তু এদিকে ফটোসেশন শেষ হবার নাম নেই।

অপূর্ণ মনোরথেই তনয়াকে ফিরতে হলো। সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। অটোরিকশায় বসে ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে তারা বাড়ি ফিরল। আগামীকাল তারা ফিরে যাবে। আজ শেষ রজনী।

সারাদিন ঘুরে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তনয়া। স্বরূপ মায়ের সাথে গল্প করছিল বাইরে। সে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। চোখ লেগে এলো কখন যেন৷

গভীর ঘুমে একসময় তার মনে হলো কেউ তাকে যেন টানছে, কিংবা ঠেলছে। তনয়ার ঘুম আধো আধো ভাঙল। চোখ মেলল না সে। তবে বুঝতে পারল পাশের মানুষটা তাকে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়েছে। অভ্যাস হয়ে গেল এই ক’দিনেই? তনয়ার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল।

*

স্টেশনে তনয়াকে নিতে বাবা মা দু’জনেই এসেছেন। ট্রেন থেকে নেমে তাদের দেখতে পেয়েই চিৎকার করে ছুটে গেল তনয়া। জড়িয়ে ধরল মা বাবাকে। ওনারা ওখান থেকেই ওকে নিয়ে যাবে।

স্বরূপের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসল তনয়া। একদিকে বাসায় যাবার প্রচন্ড আনন্দ আবার অন্যদিকে মনে চাপা কষ্টও কাজ করছে। স্বরূপকে অনেকবার বলা হয়েছিল, সে যাবে না। অফিসে যেতে হবে। কত কী নাকি কাজ আছে! বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাবার যে রীতি আছে সেটা পালন করা হলো না। ওদের দার্জিলিং যাবার তারিখ ফিক্সড৷ এখন নাকি অফিসের কাজকর্ম ম্যানেজ করে রাখতে হবে। নইলে এই বিয়ের ছুটির পরপর আবার ছুটি পাওয়া যাবে না।

তনয়া গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। মিলিও এসেছিল ওদের সাথে। সে হাত নাড়ছে। স্বরূপ পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি ধোঁয়াশার মতো। তাতে আবেগ খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হলো তনয়া৷ ওর কি একটুও কষ্ট হবে না? একফোঁটাও না?

*

সারাদিন মা বাবার সাথে কাটিয়ে, মায়ের হাতের রান্না খেয়ে রাতে নিজের ঘরে ঘুমুতে গিয়ে তনয়ার ভারি শান্তি শান্তি লাগল। এতদিন মনে হচ্ছিল সে যাযাবর হয়ে গেছে। আজ শান্তির ঘুম হবে। কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে নরম গদিতে গা ডুবিয়ে আরামে চোখ বন্ধ হয়ে এলেও পরমুহূর্তে চোখ খুলে গেল। সব আছে, তবু কী যেন নেই। তার এতদিনের সঙ্গী কোলবালিশটাকে পছন্দ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পাশে আস্ত মানুষ চাই। মানুষের গায়ের ঘ্রাণ চাই। বুকের উষ্ণতা চাই।

কিন্তু এই কিছুদিন আগেও তো সব ঠিক ছিল৷ এই ঘরে, এই বিছানায় তার সব শান্তি গুটিশুটি হয়ে পড়েছিল।বিয়ে হওয়া মানেই কি তবে নিজের পুরানো অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে দেয়া? নিজেকে দু’ভাগ কর ফেলা?

স্বরূপ এখন কী করছে?

*

স্বরূপ ল্যাপটপে কাজ করছিল। প্রচুর কাজ জমেছে। তার পাশে ধূমায়িত কফির কাপ। স্ক্রিন থেকে চোখ সরছে না মুহূর্তের জন্যও। এসব কাজ তাকে সবসময়ই করতে হয়। কখনো খারাপ লাগেনি। আজ লাগছে। পুরোপুরি বিরক্ত লাগছে। তার রাত জাগার অভ্যাস ছিল। অদ্ভূত কারনে জলদি ঘুমিয়ে পড়া সিন্ডারেলাকে জড়িয়ে ধরলে তার ঘুম চলে আসত। আজও আসছে। কিন্তু সিন্ডারেলা নেই। সে জানে, বিছানায় যাওয়ামাত্র তার ঘুম নির্বংশ হবে। কিন্তু এখন একেকটা হাই তোলা তাকে বারবার ঘুমের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই ঘুম একা একা ঘুমুবার নয়৷ কী বিরক্তিকর বিষয়!

স্বরূপ একসময় ল্যাপটপ বন্ধ করে বারান্দায় গিয়ে বসল। তনয়ার প্রতি তার আকর্ষণটা সে কী দিয়ে ব্যাখ্যা করবে? শরীরী আকর্ষণ? শুধুই কি তাই? তাই হবার কথা। কারন মেয়েটাকে তার সারাক্ষণ মনে পড়ছিল না। এইযে রাতে ঘুমানোর সময় হয়েছে, এখন মনে পড়ছে। স্বরূপ আস্ত সিগারেট শেষ করতে করতে মস্তিষ্কের জটিল চিন্তা সরলীকরণ করে ফেলল। তনয়ার জন্য সে যা অনুভব করছে তার পুরোটাই জৈবিক প্রয়োজন। আর কিছুই নয়। আরেকটা বিষয় হলো মেয়েটা ভালো। তাই কয়েকদিন একসাথে থেকে ওর একটা প্রভাব তার মনের মধ্যে ছাপ ফেলে গেছে।

উঠে পড়ে আবার ল্যাপটপ অন করল সে। তখনই তনয়ার ফোন এলো। ঘড়িতে বারোটা চল্লিশ।

ফোন ধরে সে বলল, “ঘুমাওনি?”

তনয়া আহ্লাদি স্বরে বলল, “না। ঘুম আসছে না।”

“সিন্ডারেলাদের ঘুম আসতে এত দেরি হয় জানতাম না তো।”

“একটা রাক্ষস ওর ঘুম চুরি করে পালিয়ে গেছে।”

স্বরূপ মুখ দিয়ে চু চু শব্দ করে বলল, “আহারে! তা এখন কী করতে হবে?”

“রাক্ষটাকে এসে ঘুম দিয়ে যেতে হবে।”

“পারলে রাক্ষস বধ করে ঘুম নিয়ে যাও।”

“যাহ! কী বলো!”

“যা মনে হলো তাই।”

“কাল এসো না এখানে। তোমাকে মিস করছি।”

স্বরূপ হেসে বলল, “মিস করলে নিজে চলে এসো। আমি পারব না যেতে।”

“তুমি খুব খারাপ।”

“রাক্ষস জাতি ভালো ছিল কবে?”

“গতকালও ভালো ছিল।”

“খারাপ লোকের সাথে কথা বলতে রাত বিরাতে ফোন করছো কেন?”

“স্যরি, বাই!”

“বাই বাই।”

স্বরূপ ফোন কেটে দিল। তনয়া ভাবেনি এভাবে ফোন কাটবে সে। ভেবেছিল তাকে কিছু বলে মানাতে চেষ্টা করবে। আস্ত পাজি তো!

আধঘন্টা পর তনয়ার নাম্বার থেকে ভিডিও কল এলো। এখনো জেগে! স্বরূপ দেরি করল না। তনয়াকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। ছবি বের করতে গিয়েও নিজের মনের সাথে লড়াইয়ে পেরে উঠছিল না। কল ধরে দেখল অন্ধকার। সে বিরক্ত মুখে বলল, “অন্ধকারই যখন দেখাবে তখন ভিডিও কল করেছ কেন?”

তনয়া উত্তর দিল, “তোমাকে দেখতে।”

“দেখা হলো তো? বাই!”

“আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। আমাকে দেখবে?”

“দেখাও।”

তনয়া আলো জ্বালিয়ে দিল। স্বরূপ ছিটকে উঠল। মোবাইলটা আরেকটু হলে হাত থেকে পড়ে যেত। ভয়ানক একটা চেহারা দেখা যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড লাগল তার বুঝতে যে ওটা তনয়া। কাজল আর লিপস্টিক মেখে ভূত সেজেছে৷

তনয়া খিলখিল করে হাসছে। স্বরূপ দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “প্রতিশোধ?”

“না তো, তুমি আমাকে ভুত ডাকো তাই ভূত হয়ে দেখালাম।”

“ভূত ডাকি না, ভুতু ডাকি।”

“সে যাই হোক, আমাকে কেমন লাগছে বলো।”

“ভূতের এক্সিবিশন হলে প্রেজেন্ট করা যাবে, কেউ সন্দেহও করবে না যে তুমি মানুষ।”

“বাহ! তাহলে ভালো সেজেছি বলো!”

“তুমি যা তাই সেজেছ, খারাপ কী?”

“তুমিও তাহলে ঝন্টু মিয়া সেজে বসে থাকো।”

“কেমন করে সাজে?”

“মুখে ছাগলদাড়ি আর মাথায় চারকোনা টুপি পরলেই চলবে।”

স্বরূপ হাসল। কথা চলল আরও অনেকক্ষণ। স্বরূপের আর কাজ করা হলো না। ফোন যখন রাখল তখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে তার।

*

পরপর কয়েকদিন একই রুটিন চলল। সারাদিন দু’জন ব্যস্ত থাকে, রাতে ভিডিও কলে কথা হয়। তনয়াই কল করে। সে প্রথমদিন ভূত সেজেছিল, এরপর থেকে উল্টোপাল্টা সব ফিল্টার দিয়ে রাখে মুখের ওপর। আসল চেহারা স্বরূপকে দেখতে দেয় না। স্বরূপ নানা কথা বলে ফিল্টার সরানোর চেষ্টা করে। তনয়া সরায় না। তার কথা হলো সে স্বরূপকে দেখতে ফোন করেছে। স্বরূপের যদি তাকে দেখতে ইচ্ছে হয় তাহলে যেন নিজে কল করে নেয়।

স্বরূপ করে না। রোজ ইচ্ছে করে, তবুও করে না। একদিন আর থাকতে না পেরে করে ফেলল। তনয়া খুশি হয়ে কল ধরল। কয়েকদিন পর তনয়ার স্বাভাবিক চেহারা দেখে কেমন ভালো লাগতে শুরু করল স্বরূপের। তনয়া বলল, “অবশেষে ফোন করলেন তাহলে!”

স্বরূপ তা স্বীকার করবে কেন? সে বলল, “ভুলে করেছি। আসলে মা’কে ফোন করছিলাম।”

তনয়া সাথে সাথে কল কেটে দিল। স্বরূপ থতমত খেয়ে গেলেও আর কল করল না। তনয়াও সেদিন আর স্বরূপকে কল করল না। তার পরের দিনও না।

স্বরূপের শ্বশুরবাড়ি যাবার কথা ছিল শুক্রবার। সে বৃহস্পতিবার অফিস থেকে ফেরার পথে কী মনে করে শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা দিল। তনয়া দু’দিন ধরে কথা বলছে না। তার রাতের ঘুম তো হচ্ছেই না, কাজকর্মও লাটে ওঠার জোগাড়!

তনয়া স্বরূপের এই অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনে সব রাগ ভুলে গিয়ে হাসিমুখে বলল, “ইশ! তুমি কি এই কদিনে আরো সুন্দর হয়েছ?”

স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “সুন্দর হব কেন? কাজের চাপে আরও শুটকি লেগে গেছি।”

“কিন্তু আমার কাছে আগের চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে।”

*

সেই রাতে তনয়ার ঘুম খুব ভালো হলো। তার মনে হলো এতদিনে তার ঘরের শান্তি ফিরে এসেছে। সব আগের মতো হয়ে গেছে। শুধু ওর কোলবালিশটা বদলে গেছে এই যা!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে