গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব-১৭

0
916

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব-১৭
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

ফুফু এতদিন পরে কল করেছে আমাকে! আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছি। কল্পের কথা কেন বলছিলেন? এতদিন তো কল্পের কথা বলেননি । তবে এখন কেন? এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য নেই তো! এত্ত এত্ত প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে যে আমার মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাব। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। অজানা আশঙ্কা মনের মধ্যে দানা বাঁধছিল। আচ্ছা, আমি কি আবার ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি! আমার মন আর মস্তিষ্ক জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নানান চিন্তা। কী করব আমি একদম বুঝতে পারছি না!

একটু পরেই রাহাত ভাই রুমে ঢুকলেন। আমাকে মোবাইল হাতে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো বসে থাকতে দেখে তিনি বললেন, ‘কী হয়েছে, স্মৃতি?’

আমি অশ্রুতে ছলছল করা চোখে তাকালাম তার দিকে। কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে । অসহায়ের মতো তাকিয়েই থাকলাম। রাহাত ভাই আমার পাশে বসে আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে? বলো আমাকে। তুমি যদি নিজের মনের কথা আমাকে না বলো; তাহলে আমি জানব কীভাবে?’

আমি রাহাত ভাইয়ের কথা শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে ফেললাম। তিনি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘ইচ্ছে মতো কাঁদো আগে। তারপর আমরা কথা বলব।’

আমি তখনো কিছু বললাম না। কেন যেন কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না! রাহাত ভাই নীরবতা ভেঙে বললেন, ‘আচ্ছা স্মৃতি, তুমি কি আমাকে কোনোক্রমে জ্যোতিষী ভাব না-কি?’ খানিক নীরব থেকে আবার বললেন, ‘এই যে আমার সাথে কিচ্ছু শেয়ার করো না। এটা কিন্তু একদম ঠিক না? মনে আছে ছোটোবেলায় কিছু হলেই আমার কাছে এসে বিচার দিতে? আর এখন একদম কিছুই বলো না। আমি জানতে চাইলেও বলো না। এটা কিন্তু একদম অন্যায় । আমি কিন্তু এরকম আর একদম মেনে নিব না।’

আমি রাহাত ভাইয়ের দিকে মুখ তুলে তাকালাম। বললাম, ‘আচ্ছা আপনি তো অনেকের হার্টের চিকিৎসা করেন। আমার হার্টের চিকিৎসা করতে পারবেন না? পারবেন না আমাকে সবকিছু ভুলিয়ে দিতে সেই সমস্ত স্মৃতি যেগুলো আমি ভুলতে চাই?’

রাহাত ভাই আমার দুহাত নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে বললেন, ‘চলো, বারান্দায় গিয়ে বসি। তারপর তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব।’

বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে বসলাম দুজন। রাহাত ভাই আমার একদম সামনে বসেছেন। ব্যালকনির একটা কোণাতে চড়ুই পাখির একটা বাসা আছে । সেখান থেকে পাখিগুলো একটার পর একটা বের হয় আর ডাকাডাকি করছে। আমার মনোযোগ পাখির দিকে থাকায় রাহাত ভাই বললেন, ‘ ওদের দেখার অনেক সময় পাবে। আপাতত আমাকে দেখ।’ আমি বিস্ময়ে ড্যাবড্যাড করে তাকালাম রাহাত ভাইয়ের দিকে। আমার বিস্ময় ভরা চাহনী দেখে রাহাত ভাই বললেন, ‘আমার দিকে তাকাও। তোমাকে কিছু কথা বলি। আশা করি তুমি শুনবে। কি শুনবে না?’

আমি উপর নিচে মাথা দুলালাম। বাচ্চাদের মতো মাথা দুলাতে দেখে রাহাত ভাই হেসে বললেন, ‘তোমার জায়গায় আমার কল্প হলে বলতো ‘হ্যাঁ, পাপা শুনব।’ আর তুমি এত্ত ভারি মাথা দোলাতে থাক। অথচ পাতলা জিহ্বা নেড়ে কথা বলো না।’

রাহাত ভাইয়ের কথা শুনে আমি আবারো বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। এই একই কথাটা নিশান বলতো আমাকে। কতবার বলেছে তার কোনো হিসাব নেই আমার কাছে। আমার চোখ ছলছল করে উঠল। রাহাত ভাই আমার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে বললেন ,’জানো স্মৃতি, মানুষের কখনোই তাদের প্রিয় মানুষকে ভুলে যাবার চেষ্টা করা উচিত নয়। যদি আমরা এই কাজটি করি তবে ভুলতে চাওয়া মানুষগুলোকে আরো বেশি মনে পড়ে। তাই সেই ব্যর্থ চেষ্টাটা কখনোই করা উচিত নয়। স্বাভাবিকভাবে নাও সেই মানুষটির স্মৃতিকে। তবে দেখবে তুমি তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে এবং তার স্মৃতি তোমার বর্তমান জীবনেও কোনো প্রভাব ফেলছে না। আর ভালোবাসার মানুষকে ভুলতে চাওয়া এক ধরনের বোকামি বৈ আর কিছু নয়। তাই সেই চেষ্টা করো না তুমি।’

প্রত্যুত্তরে ঠিক কী বলা উচিত আমি ভেবে পেলাম না। তাই নীরব থাকলাম। তাছাড়া রাহাত ভাইয়ের বলা প্রতিটি কথাই সত্য। আমি নিজেও জানি। তবে কেন যেন নিজের জানা সব কিছুই নিজের জীবনে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আমি অপারগ হয়ে যাই। আমাকে চুপ থাকতে দেখে রাহাত ভাই আবার প্রশ্ন করলেন,’আচ্ছা তুমি কাঁদছিলে কেন? কিছু হয়েছে কি?’

আমি দ্বিধাগ্রস্ত থেকে পরক্ষণেই বললাম,’ফুফু কল করেছিল।’

রাহাত ভাই ভাবলেশহীনভাবে বললেন, ‘এতে কান্না করার কী অছে? কল তো করতেই পারে। এতে আপসেট হবার কী আছে?’

আমি ভয় পাচ্ছি কল্পকে নিয়ে । যদি ফুফা কল্পকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায় তখন কী করব আমি। আমি তো আর বাঁচতেই পারব না। রাহাত ভাইকে মৃদু স্বরে বললাম, ‘কল্পকে যদি ওরা নিয়ে যেতে চায় তবে?

রাহাত ভাইয়ের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। ঠোঁটে বাঁকা হাসি রেখেই বললেন, ‘এটা কখনোই হবে না। আমি আছি না? তোমার এই সব জটিলতা নিয়ে না ভাবলেও হবে।’

আমি রাহাত ভাইয়ের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, ‘সত্যি বলছেন?’

‘আমি কি কখনো মিথ্যা বলেছি?’

‘আমার জানামতে না।’ এটুকু বলেই আমি আবার চিন্তায় পড়ে গেলাম । ভাবছি আসলেই কি ফুফা বসে থাকবেন? আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ফুফা কিছু একটা করবেন আমার বিরুদ্ধে! আমাকে কষ্ট দেয়াটা এখন তার লক্ষ্য হয়ে গেছে আমি তা বুঝতে পারছি। এতদিন খুব একটা কেয়ার করেননি। কারণ আমি অসুস্থ ছিলাম। এখন মনে হয় না তিনি চুপ করে থাকবেন।

রাহাত ভাইয়ের কথাতে আমার ধ্যান ভাঙলো।
‘আচ্ছা তুমি কি আমাকে নিশানের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো সম্পর্কে বলবে?’ রাহাত ভাই কৌতুহল মাখা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন।

‘সুন্দর মুহূর্ত?’ আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।

‘কেন! সুন্দর কোনো মুহূর্ত ছিল না?’ রাহাত ভাই ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।

‘ছিল। তবে নিশান আমাকে সব সময় বিরক্ত করতো। আমার খুব রাগ হতো।’

‘ওটা বিরক্ত করা ছিল না।ওটা ছিল ওর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ । তুমিই বুঝতে পারতে না।’ রাহাত ভাই প্রগাঢ় কণ্ঠে বললেন।

‘হয়তো!’

‘আর এই রাগ কখন ভালোবাসায় রূপ নিলো তা তুমি বুঝতেও পারনি। তাই না?’ রাহাত ভাই আমার হাত দুটো শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোতে আবারও মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে প্রশ্ন করলেন ।

‘হ্যাঁ । একদম ঠিক বলেছেন।’ আমি দৃঢ়তার সাথে বললাম।

‘আচ্ছা, তোমার এডমিশন এক্সাম দেবার পর কি হয়েছিল তা কি বলবে? অবশ্যই যদি তোমার আপত্তি না থাকে।’ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন রাহাত ভাই।

আমি শান্ত স্বরে বললাম, ‘আপত্তি এতদিন ছিল। এখন আর নেই। চেষ্টা করছি অতীতকে মেনে নিয়ে বর্তমানে বেঁচে থাকার। তার প্রথম ধাপ হিসেবে না হয় নিশানের স্মৃতিচারণ ই হোক।’

রাহাত ভাই অতি উৎফুল্লতার সাথে বললেন,’ তাহলে শেষমেশ আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হচ্ছে?’

আমি কটমটিয়ে তাকালাম রাহাত ভাইয়ের দিকে। রাহাত ভাই ভয় পাবার ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ অন্য যেকোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারো কিন্তু দৃষ্টি দিয়ে মেরো না।’

‘আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?’ আমি সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম রাহাত ভাইকে।

‘একদম না। সেই স্পর্ধা আমার এখনো হয়নি।’ রাহাত ভাই জিহ্বাতে কামড় দিয়ে প্রচণ্ড অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললেন।

‘এতদিন না বলেই ঠিক করেছি। আপনাকে বলাই উচিত হবে না।’ আমি রাগ করে উঠে যেতে নিলেই রাহাত ভাই আমার ডান হাতটা ধরে আবার চেয়ারে বসিয়ে বললেন, ‘আরেহ! বসো। আমি শুনছি। একদম মনোযোগী শ্রোতার ন্যায়।’

‘মাঝখানে কোনো প্রকার বাধা দিতে পারবেন না কিন্তু!’

‘জো হুকুম, স্মৃতির বক্স। তুমি বলো। আমি শুনছি।’

রাহাত ভাইয়ের মুখে স্মৃতির বক্স নাম শুনাতে আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। রাহাত ভাই ও হেসে ফেললেন। তারপর একসাথেই দুজন কিছুক্ষণ হাসলাম।

চলবে…ইন শা আল্লাহ্

আগের পর্বের লিংক:

https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/958482671249119/

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে