প্রয়োজন পর্বঃ ১১

0
1399

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্বঃ ১১
লেখায়ঃ তানিয়া তানু

কেটে গেল কয়েকদিন। সেদিনের পর বাবার বুকের ব্যথা কমলেও বেশ দুচিন্তায় আবারও বেড়ে যায়। বাড়ার পর খানিক বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়েও যায়। বাবাকে হাজার করে বেবলি আর আমি বুঝালাম যে ডাক্তার দেখাও, বাবা। কিন্তু তিনি গেলেন না। ডাক্তারের ফি যে অনেক। তার থেকে উনার মতে রাস্তার মোড়ে ফার্মেসীর ট্যাবলেট খেলে কমে যাবে। কমে তবে সেটা কিছুক্ষণের জন্য।
___________________________________

কাল নিলার গায়ে হলুদ। তাই আজই আমি আর বেবলি কাপড় গুছানো শুরু করেছি। আকাশ ভাইয়ার দেওয়া টাকাগুলোও খুব যতন করে তুলে রাখলাম ব্যাগে। আমায় যে দিতে হবে। যাইহোক, আমরা কিছুক্ষণ পরে চলে যাবো। তবে সমস্যা হলো আমার পরিধান করার মতো যোগ্য কোনো জামা নেই। মা আমায় দেখে বুঝে ফেললেন। মা তো। সন্তানের দৃষ্টিতেই বুঝে ফেলেন সন্তান কী চায়? সমাধান হিসেবে দিলেন মায়ের পুরোনো কাতান শাড়ি। সেটা ছিলো নীল কালারে মিশ্রিত। গাঁয়ে হলুদে পড়ার জন্য পূর্বেই একটা হলুদ কামিজ ছিলো। সালোয়ার আর উরনা সাদা রঙের। কিন্তু এবার সমস্যা হলো শাড়ির সাথে গলার আর কানে পরার মতো তেমন কোনো সেট নেই। ভাবতেই মনে পড়ে গেল
হ্যাঁ, আছে তো। দু বছর আগে অপরিচিত এক শুভাকাঙ্ক্ষী একটা গয়নার সেট দিয়েছিলো। সত্যি সেটা দেখে বেশ চমকিত হয়েছিলাম। দারুণ কারুকাজ ছিলো তাতে। কিন্তু কে দিয়েছিলো তা হাজার খানেক সময় নিয়ে ভেবেও উত্তর মিললো না। বেবলির কোথাও বের হয় না বলে ওর জামার কোনো সমস্যা হয়নি।
___________________________________

নতুন টিউশনি যখন বেতন দিলো মনে মনে লাখ লাখ শুকরিয়া জানিয়েছিলাম। উনি নিজেও জানেন না যে নিজ অজান্তেই আমার কত বড় উপকার করলেন! ইনশাআল্লাহ প্রত্যুপকার একদিন দিবো। সেই টাকায় আটশত টাকা দিয়ে জামদানি এক শাড়ি কিনলাম। তবুও মনে অনেক সংশয় হলো। সে এটা দেখে কেমন বোধ করবে? কোন নজরে দেখবে শাহেদা আন্টি?
ব্যাগপত্র গুছিয়ে মা-বাবাকে সালাম জানিয়ে চললাম নিলার বাড়ি। জানি না সেখানে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে?

___________________________________

পুরো বাড়ি আলোর ঝমাকানিতে নতুনত্ব সৃষ্টি করছে। পাশে থাকা বেবলি অবাক নয়নে বিভোর হয়ে তাকিয়ে আছে আলোকসজ্জায় সজ্জিত বাসার দিকে। কিছুক্ষণ পর হুঁশ এলে আমাকে লক্ষ্য করে বললো,
~আপা,আমরা না তোর বিয়েতে এমন ভাবে সাজাবো দেখিস।
অপূরণীয় কথা বলায় মৃদু হেসে বললাম, দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

বাসার ভিতর ঢুকে আরো অবাক হলাম। এত সজ্জায় সজ্জিত পুরো বাসার প্রত্যেক কোণায়। সিড়ি থেকে শুরু করে মেঝে পর্যন্ত বিভিন্ন ডিজাইনে পূর্ণ হলো তাদের কারুকাজ।অন্যদিকে এতো ভীড়ের মধ্যে মনে হলো কেউ আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিচ্ছে। কিন্তু এ শুধু অনুভব করতে পারছি। আশেপাশে এত মানুষের ভীড়ে নিক্ষিপ্ত করা দৃষ্টির মালিককে স্বচক্ষে দেখতে পেলাম না।
হঠাৎ করে পিছন থেকে কেউ একজন বললো,
দীপ্তি, তুই এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছিস?
কন্ঠস্বরে চিনে ফেললাম পরিচিত সেই মানুষটিকে। যেই না হাসিমুখে তাকে দাঁড়ানোর হেতু বলতে যাবো। পিছন ফিরে দেখলাম আকাশ ভাইয়ার পাশে দাঁড়ানো রামিসা। তাকে দেখেই গা যেন অদ্ভুদভাবে জ্বলে উঠলো। নীরব রয়ে মাথা নিচু করে মেঝের ডিজাইন আঁকা শিখতে শুরু করলাম।
~ভাইয়া, এত সুন্দর সাজানো হয়েছে যে এত্তক্ষণ সাজানোটাই দেখছিলাম।
আমি জবাব দিচ্ছি না দেখেই মনে হলো বেবলি জবাব দিয়েছে। বাহ, ওর তো বেশ বুদ্ধি হলো!
~ব্যাগপত্র রাখ। রেখে তারপর নাহয় পুরো বাড়ি দেখিস। (বেবলির দিকে তাকিয়ে)
~শুন্, নিলা তোর জন্য অপেক্ষা করছে। ওর রুমে যাহ্। (আমার দিকে তাকিয়ে)

আমাদের দুই বোনের সাথে আকাশ ভাইয়া যে কথা বলছে সেটা মনে হয় রামিসা সহ্য করতে পারলো না। তাই বললো,
” আকাশ, ঐদিকটায় একটু আয় তো। তোর সাথে কথা আছে।”

এই বলেই দুই হাত দিয়ে আকাশ ভাইয়ার হাত জড়িয়ে টানতে টানতে অন্যদিকে নিয়ে গেলেন। আমিও আশাহত হয়ে নিলার রুমে গেলাম।
___________________________________

নিলার রুমের দরজা ঠেলে ঢুকে দেখলাম, তাকে ঘিরে মেয়েরা বসে আছে। সবাই হাসাহাসিতে মত্ত হয়ে আছে। নিলার দৃষ্টি আমার দিকে পড়তেই বললো,
~আরে তুই দরজায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে ঢুক।
দুই বোনই ভেতরে ঢুকলাম। খানিকক্ষণ ঘরের সাজানো মনোমুগ্ধকর হয়ে দেখলাম। বেশ ভালো সাজিয়েছে।

~দে?
আচমকা ওর দে শব্দটা শুনে অবাক হলাম ওকে আমি কী দেবো। ভাবলাম হয়তো শাড়িটা এখনি চাইছে। তাই চেইন খুলে শাড়িটা যেই আনতে যাবো তখন নিলা বললো,
~তোকে ব্যাগ খুলতে কী বলেছি?
আমি ভ্যাবলাকান্তের মতো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।

~এভাবে কী দেখছিস? তোকে ব্যাগ দিতে বলেছি?
আমিও ওহ একটা লম্বা টানে বলে ব্যাগটা ওর হাতে দিয়ে দিলাম। ও একটা ড্রয়ারে রেখে চাবি আমার হাতে দিয়ে বললো, যখনই দরকার হবে তখনই নিস।
আমিও নিঃসঙ্কোচে চাবিটা হাতে নিলাম।

হঠাৎ বেবলি নিলাকে বলল,
“নিলাপু, তুমি দেখি আজ আরো সুন্দর হয়ে গেলে?”

নিলার স্মিত হেসে বললো,
“তোরা বোনরা যে সুন্দর। তাই ভাবলাম তোরা এখানে এলে আমি পিছে পরে যাবো। আবার তোরা যদি সাজিস তবে আমি না তোদের সবাই কনে ভাববে। তাই একটু সুন্দর হওয়ার চেষ্টা করলাম আর কী!

নিলার কথা শুনে বেবলি যেন লজ্জা পেল। তারপর বললো,
“যাহ্, তুমি বানিয়ে একটু বেশি বলো। আমি তেমন সুন্দরী নই।”

ওর এই কথা শুনে সব মেয়েরা যে উচ্চ হাসিতে উল্লসিত হলো। সবাই প্রশংসা শুনতে আগ্রহী। যা শুনার পর মুখের আদল বদলে যায়। নতুনত্ব আসে চেহারায়। যেমনটা বেবলির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

___________________________________

নিলার রুম থেকে বের হয়ে এলাম। অনেক্ষণ ওর গল্প শুনেছি। ওর হবু হাবির সাথে কী কী কথা বলেছে নিঃসংকোচে সবই এক এক করে লজ্জা নিয়ে বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি বেশি কিছু শুনতে আগ্রহ নই। খুব যে কষ্ট হয়। ভালোবাসাময় কথাগুলো শুনলে নিজের জীবনের কথা মনে পড়ে যায়।

এদিকে সন্ধ্যেও হয়ে গেল। আকাশ ভাইয়াকে টাকা ফেরত দিবো বলে মনে মনে তাকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও না পেয়ে ভাবলাম একটু ছাদে ঘুরে আসি। অনেক তো হন্য হয়ে খোঁজা হলো। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠার আগে একটা রুমের পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। সেই রুমেই শুনতে পেলাম উচ্চহাসির আওয়াজ।তাই আগ্রহটা বেড়ে গেল। তাই দরজা কিছুটা ফাক করলাম। সেই দরজার ফাকে দেখতে পেলাম অনেক ছেলেরা বসে গল্পগুজবে মেতে উঠছে। সেখানেও আকাশ ভাইয়াও বসে আছে। কিন্তু আমার নজর আকাশ ভাইয়ার দিকে ছিলো না। আমি পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে নিয়নের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বিছানায় আয়েশ ভঙ্গিতে শুয়ে টুল পড়া গালে হাসিতে মত্ত হচ্ছে। হাসির নিমিত্তে গোল ফ্রেমের চশমাটা এদিক সেদিক হচ্ছে। উনিও বার বার ঠিক করছেন। চশমাটা না পড়লে এখন কী হয়! অযথা চমশটা উনাকে বিরক্ত করছে। উনার দিকে তাকিয়ে আনমনে কথাগুলো ভাবছিলাম। হঠাৎ দেখি উনিও আমার দিকে হাসি থামিয়ে তাকিয়ে আছেন।অন্যরা হাসছে। আর উনি আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন। আর আমি কত বোকা! আমিও উনার দিকে তাকিয়ে আছি। দুইজনের কেউই চোখের পলক ফেলছি না। হঠাৎ কারোর পায়ের শব্দে হুঁশ ফিরে এলে বিব্রত হলাম। নিজেই নিজেকে খানিক বকা দিলাম। আবার উনার দিকে চাইলে উনি তখন সুযোগ বুঝে চোখ মারলেন। আমিও লজ্জায় সেখান থেকে সরে আসলাম।

___________________________________

দেখলাম শাড়ির কুচি ঠিক ধরে উপরে উঠছেন শাহেদা আন্টি । উনার কাছে পড়তে না চাওয়ার জন্য ছাদের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়। আমার ক্ষেত্রেও একঅই ঘটলো। শাহেদা আন্টি আমাকে ডাক দিলেন। আমিও থমকে গেলাম। দুর্ভাবনায় মাথা ঘামাতে লাগলাম। না জানি এখন কী বলবে এই মহিলা!
~আরে তুমি, চলে এসেছো।
~জি,আন্ট।
~তো এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিলে?
~দাঁড়িয়ে ছিলাম না, আন্টি। ছাদের দিকে যাচ্ছিলাম।
~চুপ!
হঠাৎ করে এত জোরে শব্দ করে বললেন যে আমার আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। ভয়ে হিম শীতল হলো পুরো শরীর। মুখের কথাগুলো কেমন অগোছালো হয়ে গেল।
~তুমি ভালো করেই জানো। আমি মিথ্যে কথা পছন্দ করি না। তাহলে মিথ্যে কথা কেন বললে?
~_________

~তুমি এত্তক্ষণ ঐ দরজার পাশেই ছিলে। কী করছিলে সেখানে?

~ উনি আমার কাছে এসেছিলেন, আন্টি।কিন্তু আমি খোশগল্পে ব্যস্ত থাকায় ডিস্টার্ব আর করেননি। তাই এখান থেকে চলে যাচ্ছিলেন।
এই কথা শুনে দুইজনই পিছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম নিয়নের ভাই এই কথাগুলো এক দমে বললেন।
~ওহ। তা তোমার কাছে কেন? তোমরা পরিচিত নাকি?
~আন্টি, উনি নিয়নের টিউটর। নিয়ন উনাকে ছাড়া কিছু বুঝে না। তাই উনাকে বলেছিলাম, উনি যদি বিয়েতে আসেন। তাহলে আমার সাথে যেন দেখা করেন। নিয়নকে যাতে উনার হাতে দায়িত্ব হিসেবে দিতে পারি।
~ভালো। তো আসি আমি। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। অনেক কাজ আছে তো। দেখতে হবে।
শাহেদা আন্টি চলে যেতেই মনে স্বস্তি নিলাম।
নিয়নের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,

চলবে,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে