গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব – ১৫

0
906

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
গল্প: বিস্মৃতির অন্তরালে পর্ব – ১৫
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

‘সো, মিসেজ স্মৃতি! কি অবস্থা আপনার?’ ডাক্তার আরমানের সরাসরি প্রশ্নে আমি তাকালাম তার দিকে।

‘ভালো।’ একটু থেমে আবার বললাম, ‘আপনি কেমন আছেন?’

‘আমি তো সব সময় ভালো থাকি। রাহাত বলেনি আপনাকে?’ তারপর রাহাত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে প্রশ্ন করলেন, ‘ কী রে, রাহাত! বলিসনি?’

রাহাত ভাই মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘বলার মতো অবস্থা আমার থাকলেও শোনার মতো অবস্থা অবশ্য স্মৃতির নেই। তাই বলা হয়নি।’

আমি রাহাত ভাইয়ের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকালাম। রাহাত ভাই আমার সে দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ডাক্তার আরমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্মৃতি এখনও অতীতে মশগুল । তার জীবনে বর্তমান থেকেও নেই। সে অতীতে বসবাস করতেই বোধহয় বেশি পছন্দ করে।’

‘খুব গুরুতর সমস্যা!’ ডাক্তার আরমান চিন্তিত ভঙ্গিতে গম্ভীর মুখ করে আমার দিকে তাকালেন।

‘কী গুরুতর সমস্যা বলছিস? কেন সমস্যা হবে? তুই না বলেছিস স্মৃতি এখন আগের তুলনায় অনেক ভালো !’ রাহাত ভাই উদ্ভ্রান্তের মতো প্রশ্ন করলেন।

‘আরে, ধুর! তুই এমন পাগলামো করছিস কেন?’ ডাক্তার আরমান রাহাত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে এটুকু বলে একটু থেমে আবার বললেন, ‘তুই একটু বাইরে যা। তুই থাকলে আমি আমার কাজ করতে পারব না। তুই যে পরিমাণ পাগলামি শুরু করেছিস!’

ডাক্তার আরমানের কথা শুনে রাহাত ভাই একটু চুপসে গেলেন । বোধহয় অপ্রস্তুত বোধ করছেন। বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।’

‘আচ্ছা, আপনার সমস্যা কী? জানতে পারি?’ আবারও প্রশ্ন করলেন, ডাক্তার আরমান।

‘আমার তো কোনো সমস্যা নেই।’ আমি নির্বিকারভাবে উত্তর দিলাম।

‘ওকে ফাইন। সমস্যা না থাকলেই ভালো। আমরা কেউই আমাদের জীবনে সমস্যাকে আমন্ত্রণ জানাই না। তাই সে নিজে থেকেই আসে। এমনকি সে নিজে থেকে এলেও আমরা ঝাটা পেটা করে বিদায় করতে চাই।’ হাসতে হাসতে আবার বললেন, ‘তাই না?’

‘জানি না।’ আমি অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম।

‘সব না জানলে তো সমস্যা । আচ্ছা যাইহোক, না জানলেও সমস্যা নেই। এখন আমি আপনাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে বলব। আপনাকে মনোযোগী হতে হবে। আপনি প্রস্তুত তো?’

‘জি।’

‘আপনি ‘দ্যা গড স্টেট অব মাইন্ড’ সম্পর্কে শুনেছেন? কিংবা জানেন কিছু এই ব্যাপারে?’

‘না।’

‘জানতাম আমি আপনি যে এই বিষয়ে জানবেন না। জানলে আপনি বর্তমানে থাকতেন। তবে এই বিষয়টি এখন আপনাকে জানাব এবং আপনাকে এখন থেকেই আমার বলা বিষয়টি অনুসরণ করতে হবে।’

‘আপনি বলুন। আমি শুনছি।’

‘সাইকোলজিতে ‘দ্যা গড স্টেট অব মাইন্ড হলো এমন একটি পর্যায় যেই পর্যায়ে আপনার মন আপনাকে জিনিয়াস বানিয়ে দিবে। যার দরুন আপনি আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের চিন্তা বাদ দিয়ে বর্তমানকে নিয়ে ভাবতে শুরু করবেন। একটু কল্পনা করেই দেখুন যে, আপনাকে আপনার অতীতের কোনো খারাপ স্মৃতি তাড়া করছে না বা আপনি আপনার ভবিষ্যত চিন্তাতেও মশগুল হয়ে বর্তমানকে নষ্ট করছেন না। তাহলে কেমন হবে বা আপনার কেমন লাগবে বলুন তো?’

আমি বললাম, ‘ভালো লাগবে। আমি ভালো থাকতে পারব। কোনো কষ্ট হবে না।’

‘ভেরি গুড। আপনি কিন্তু মনোযোগী শ্রোতা। বাই দ্যা ওয়ে, দ্যা গড স্টেট অব মাইন্ড মানে হলো আপনি অতীতে নয় , ভবিষ্যতে ও নয় বরং আপনি বেঁচে আছেন আপনার বর্তমানে। এই পর্যায়ে এসে মস্তিষ্কের ডোপাপিনসহ অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটার ক্যামিকেল নিঃসরণ শুরু হয়, যা মস্তিষ্কে পজিটিভ সিগন্যাল পাঠায়, এতে আমাদের আশেপাশের কোনো নেগেটিভিটি আমাদের আর বর্তমান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। ফলে এক অসাধারণ ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। ফলে মানুষের মধ্যে থাকা ডিজঅর্ডারসহ ডিপ্রেশন দূরীভূত হয়ে যায় অনেকাংশে। আরো একটু সহজ করে বলছি, এর মানে হলো কোনো একটা নির্দিষ্ট কাজেই ফোকাস করে জাগতিক সব চিন্তাভাবনার উর্ধ্বে চলে যাওয়া। একবার যদি এই পর্যায়ে আসা যায় , তবে আপনি পৌঁছে যাবেন দ্যা ফ্লো স্টেট অব মাইন্ডে। এটি হলো মনকে নির্দিষ্ট কোনো একটি মাত্র কাজেই কেন্দ্রীভূত করতে পারা। এখানে পৌঁছাতে পারলেই কাজ অনেকটা সহজ। অর্থাৎ আপনি তখন আপনার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।’ ডাক্তার আরমান তার দীর্ঘ কথা শেষ করে টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাস থেকে পানি খেতে খেতে বললেন, ‘আপনি কি বুঝতে পেরেছেন?’

‘জি।’

হাত থেকে পানির গ্লাসটা রাখতে রাখতে আবার বললেন, ‘আচ্ছা তাহলে বলুন সফলতার সূত্র কি?’

‘ফোকাস।’

‘ব্রিলিয়ান্ট। আপাকে ফোকাস করতে সাহায্য করবে এই স্টেটটি। আর তাই আপনি এখন থেকে নিয়মিত মেডিটেশন করবেন যাতে আপনি এই স্টেটগুলিতে পৌঁছাতে পারেন।’

আমার আর এইসব আলোচনা শুনতে ভালো লাগছিল না। তাই বললাম, ‘ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব।’

ডাক্তার আরমান টেবিলের উপর রাখা পেপার ওয়েটটা হাতে নিয়ে আমার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘চেষ্টা নয়। ইউ হ্যাভ টু ডু ইট এট এনি কস্ট। আই মিন বাই হুক অর বাই ক্রুক।’ আন্ডারস্ট্যান্ড?’

‘ইয়েস।’

‘ওকে। এবার আর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি আপনাকে। আমি আপনার আর রাহাতের কাছ থেকে যতটুকু জেনেছি তাতে বুঝেছি যে আপনার অতীত জুড়ে কেবল নিশান ছিল। আপনি এখনো সেই নিশানের মধ্যেই বেঁচে আছেন। তার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে। আমি ঠিক বলছি?’

জাক্তার আরমানের মুখে নিশানের কথা শুনে আমার চোখ ছলছল করে উঠল। আমি আবারও বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। কোনোরকমে কান্না চেপে রেখে শুধু বললাম, ‘ হ্যাঁ ।’

‘নিজেকে শক্ত করুন, মিসেজ স্মৃতি । আপনাকে সত্যটা মেনে নিতেই হবে। আপনার তো ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে, আপনি অনেককিছু হারিয়েও আবার অনেককিছুই পেয়েছেন।’

আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম ডাক্তার আরমানের দিকে। তিনি বললেন, ‘রাহাত নিজেই সেই সবকিছু। তার ডেডিকেশন আমি নিজের চোখে দেখেছি। আপনাকে আগলে রাখার জন্য , একটু সহজ স্বাভাবিক করার জন্য সে কী না করেছে! তা যদি আপনি বুঝতেন! আমি দেখেছি আমার বন্ধুটার এমন ব্যাকুলতা।অথচ তার কাছে অনেক বেটার অপশন ছিল।’ একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বললেন, ‘ আপনি প্লিজ মাইন্ড করবেন না। বন্ধুর হয়ে উকালতি করছি তাও ভাববেন না। আমি সত্যটা বলছি।’

আমি নিষ্পলক শুধু তাকিয়ে থাকলাম। খানিক পর বললাম, ‘আমি জানি রাহাত ভাই আমার প্রতি করুণা করেছেন।’

‘ভুল ভাবছেন। এটা কোনো করুণা নয়। তবে এটার ব্যাখ্যা আমি আপনাকে দেব না । আমি চাই এটা আপনি নিজ থেকেই বুঝেন।’ দৃঢ়তার সাথে বললেন তিনি।

আমি এই কথার প্রেক্ষিতে কিছুই বললাম না।

তিনি আবার বরলেন, ‘আপনি নিশানের সাথে কাটানো সমস্ত স্মৃতি রাহাতের সাথে শেয়ার করুন। দেখবেন অতি শীঘ্রই আপনি আপনার অতীত থেকে বের হতে পারবেন। আর মেডিটেশন চালু রাখবেন।’

আমি মাথা উপর নিচ দুলালাম। তিনি এটা দেখে একটু হাসলেন। কিছু বলতে নিতেই, রাহাত ভাই রুমে ঢুকেই প্রশ্ন করলেন, ‘কি ব্যাপার! আজ কি তোর আলোচনা শেষ হবার নয়?’

‘শেষ। ঠিক টাইমে প্রবেশ করেছিস।’

‘ওকে। তাহলে আবার কবে আনতে হবে ওকে? কনসাল্ট কি আরো করা বাকি আছে?’

‘আপাতত ওর সমস্ত কনসাল্টেশন তোর সাথে হবে। এবার দেখবি ও নিজ থেকেই তোকে সব বলছে। এবার আমাকে আর প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না।’

‘না হলেই ভালো।’ রাহাত ভাই হাসতে হাসতে বললেন।

‘আহা! প্রয়োজন শেষে বন্ধুকে ভুলেই গেলি!’ আফসোসের সুরে বললেন ডাক্তার আরমান।

‘তোকে আর মনে রেখে কী হবে বল?’

‘হুম, সেটাই। আমাকে এমনিতেও তুই কবে মনে রাখছিস বল? মানুষের হার্টের চিকিৎসা করে সময় পেলে তবেই না আমাদের হার্টের খবর নিবি। তাই না?’

‘একদম না! আমি তোর খবর রাখি বরং তুইই কোনো খবর রাখিস না। সারাক্ষণ কনসাল্টেশনেই ডুবে থাকিস।’

‘কী করব বল? ওটাই আমার কাজ। তুই যেমন হার্টের চিকিৎসা করিস তেমনি আমি করি মনের চিকিৎসা।’

ডাক্তার আরমান এটা বলতেই দুজন হাসতে লাগল একসাথে। তারপর রাহাত ভাই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আচ্ছা, যাই তাহলে দোস্ত। কল্পটা আবার কান্না শুরু করে দিবে।

‘ওকে। কল্পকে নিয়ে একদিন বাসায় আসিস।’

‘ওকে দোস্ত।’

দুই বন্ধুর কথোপকথনে আমি একেবারেই নীরব দর্শক । কথা শেষে রাহাত ভাই বললেন, ‘চলো, স্মৃতি ।’

চলবে…ইন শা আল্লাহ্

আগের পর্বের লিংক:

https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/957678891329497/

বি.দ্র. আজকে দুটো পর্ব দিলাম।আপনারা আমাকে এত ভালোবাসা দিয়েছেন এবং গল্পটার জন্য অপেক্ষা করেছেন। তাই এটা লিখে মাত্রই দিয়ে দিলাম। আজকের পর্বটা কার কেমন লেগেছে জানাবেন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে