গল্প: ছোঁয়ার শিহরণ পর্ব: ০১

0
3807

গল্প: ছোঁয়ার শিহরণ
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

ক্লাস টেনের স্টুডেন্টরা হুড়মুড় করে ক্লাস রুমে প্রবেশ করছে। ঘন্টা পড়েছে। এক্ষুণি ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। সব স্টুডেন্ট অস্থির হয়ে প্রবেশ করছে। সবার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ! মনের মধ্যে শঙ্কা । না জানি আজ কার বারোটা বাজাবে জাঁদরেল স্যারটা!

মোসাদ্দেক আহমেদ ক্লাস টেনের ম্যাথ টিচার। দেখতে মোটাসোটা। মোটা গোফ ওয়ালা । তার উপর ক্লাসে ঢুকেই তার ভিতরের সমস্ত বজ্রপাত বর্ষণ করেন কারো না কারো উপর। আর এতেই ছেলে মেয়েরা বজ্রাহত হয়ে যায় । আর এই বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য ক্লাসের সব ছেলে মেয়েগুলি নিতান্ত অসহায় গোছের আচরণ তো করেই তার উপর একেবারে বিনয়ী, ভদ্র, সুশীর যাকে বলে সেই ভাবেই মোসাদ্দেক স্যারের সামনে নিজেদের উপস্থাপন করে। বলতে গেলে ক্লাসের অধিকাংশ ছেলে মেয়েই এক প্রকার অভিনয় করে তার সামনে । খোলস খুলে বের হলেই কুপোকাত করে ফেলবে স্যার এই ভয়ে সবাই জড়োসড়ো, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। তবুও প্রতিদিন কেউ না কেউ এই জাঁদরেল স্যারের খপ্পরে পড়েই যায় ।

ছোঁয়া এই জাঁদরেল স্যারকে প্রচণ্ড ভয় পায় । সে দেখেছে ক্লাসের কয়েকজনকে দেয়া স্যারের নিত্যনতুন শাস্তি। নিজেও একবার শাস্তি পেয়েছিল। কী ভয়ানক সেই শাস্তি । ছোঁয়া সেই শাস্তির কথা ভাবলে এখনো আৎকে উঠে। সেই থেকে ছোঁয়ার মনে জেঁকে বসেছে পাহাড়সম ভয়। কিন্তু আজ তাও দেরি হয়ে গেলো তার। কখনো দৌঁড়াচ্ছে তো কখনো দ্রুতপায়ে হাঁটছে । তাকে দেখে মনে হচ্ছে দৌঁড় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া কোন প্রতিযোগী। যে কি না টলতে টলতে ঢলতে ঢলতে হলেও প্রতিযোগীতার সামনের কাতারে আসতে চায়।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ছোঁয়া ক্লাসরুমের দরজায় পৌঁছাল । দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে সে। ভিতরে জাঁদরেল স্যার খুব মনোযোগ সহকারে ক্লাস নিচ্ছে ।আর প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট একেবারের সুশীল, ভদ্র, নির্বাক প্রাণীর মতো স্যারের লেকচার শুনছে। পুরো ক্লাস জুড়ে এক ভয়াবহ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ছোঁয়ার মনে হলো একটা পিন পড়লেও বোধহয় তার আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যাবে। ছোঁয়া মিনমিনিয়ে বলল,’মে আই কাম ইন স্যার?’

মোসাদ্দেক স্যার মাথাটাও ঘুরালেন না। তিনি যথারীতি ক্লাস নিচ্ছেন। তার মানে ছোঁয়ার গলার আওয়াজ স্যার এর কর্ণকুহর ছুঁতে পারেনি। ছোঁয়া মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিলো। বলল,’ইউ ক্যান ডু ইট ছোঁয়া ।’

গলার আওয়াজ খানিক বড় করার প্রয়াসে যেই না সে বলতে যাবে ঠিক তখনই পিছন থেকে তার গলার চেয়েও বড় এক কণ্ঠ শুনে তার কানের পর্দা কাঁপতে লাগলো। মোসাদ্দেক স্যার চকিতে ঘাড় ঘুরালেন।

‘মে আই কাম ইন স্যার?’ স্যার এবার নিজের হাতের মার্কার টেবিলে ঠাস করে ফেলে প্রজ্জ্বলিত চোখে তাকালেন। তার চোখ দুটো থেকে যেন আগুন ঝরে পড়ছিল। ছোঁয়ার মনে হলো সে আগুনে সে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। স্যার এর দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও তাকালো তার পাশের মানবটির দিকে। ছোঁয়া অবারো চমকে উঠল। কিন্তু তার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটি নির্বিকার। কতটাই না স্বাভাবিক তার চাহনী। হালকা সবুজাভ চোখ জোড়া । মাথাভর্তি ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো মাথার চুল। ক্লাসের প্রতিটা মেয়ের ক্রাশ শিহরণ। শিহরণের পাশে সে দাঁড়িয়ে আছে! তার ভাবতেই অবাক লাগছে । যে ছেলেটাকে এতদিন সে শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে, দূর থেকে ভালো বেসেছে সেই শিহরণ তার পাশে! ভাবা যায়!

গগণবিদারী এক চিৎকারে ছোঁয়া যেন তার ভাবনার জগত থেকে কোনো প্রকার পাসপোর্ট আর ভিসার তোয়াক্কা না করেই বেরিয়ে এলো। কী সুন্দর ছিল ভাবনাগুলো। অথচ এই জাঁদরেল স্যার আজ তার আর তার ভালোবাসার রাজপুত্তুর শিহরণের ব্রেকিং নিউজ বানিয়ে ছাড়বেন! ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার চোখে মুখে উৎকন্ঠা, উদ্বেগ। ভয়ে যেন প্রাণটা গলার উপর উঠে এসেছে।

তবে মোসাদ্দেক স্যার আজ অদ্ভুত এক নতুন শাস্তির ব্যাবস্থা করে বসলেন। শাস্তি হলো ছোঁয়া আর শিহরণকে একসাথে ডিটেনশন দিবেন। এতে করে তাদের দুজনকে একসাথে অনেকগুলো কাজ করতে হবে তথা শাস্তি ভোগ করতে হবে। তবে সবচাইতে ভয়ানক যে ব্যাপারটা ঘটলো তা হলো তাদের শাস্তির মেয়াদ হলো এক মাস!

ছোঁয়ার মনে হলো সে বোধহয় বেহুঁশ হয়ে যাবে। পরক্ষণেই তার সঙ্গী হিসেবে শিহরণকে পাবার কথা ভাবতেই তার মনের মধ্যে থাকা ভালোবাসার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাপড়িগুলো ডানা মেলতে লাগলো। তার মুখে ফুটে উঠলো এক দুর্বোধ্য হাসি ।

অপরদিকে, শিহরণের চেহারাতে শ্রাবণের কালো মেঘের ঘনঘটা। বিরক্তি আর রাগে তার কান লাল হয়ে উঠছে। সে ভাবছে আজ সকালে কার মুখদর্শন হলো কে জানে! এত বাজে ঘটনা তার সাথে ঘটে গেলো। সে ভাবতে পারছে না, পারছে না মানতে। ক্লাসের যে মেয়েটাকে দেখলে তার বিরক্তি চলে আসে শেষ পর্যন্ত তার সাথেই তাকে জাঁদরেল মশাই শাস্তি দিলো । এর চেয়ে বরং তাকে এক মাস উপোস থাকতে বলতো! তাতেও বোধহয় শিহরণ এতটা কষ্ট পেত না। এই মেয়েটাকে দেখলে শিহরণের কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। ক্লাসের মধ্যে এই সেই মেয়ে যাকে সে একদম সহ্য করতে পারে না। তার উপর মেয়েটাকে সে মাঝে মধ্যে লুকিয়ে তার দিকে তাকাতেও দেখেছে। তখন শিহরণের মনে হয়েছিল কষে গালের মধ্যে থাপ্পড় লাগিয়ে দিতে। প্রচণ্ড বিরক্ত ও লাগতো সে সময় । অথচ এখন সেই বিরক্তিতে ভরপুর মেয়েটার সাথেই স্যার তাকে এক দিন নয়, দুদিন নয় , এক সপ্তাহ নয়, দুই সপ্তাহ নয় , পুরো এক মাস ডিটেনশন দিলো! কিন্তু এখন উপায়? কী করে এই মেয়েটাকে সে সহ্য করবে?

ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। সব স্টুডেন্ট বাড়ি চলে যাচ্ছে । শিহরণ অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সে আহত কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল,’ হুয়াই দিস ব্লাডি মিসটেক আই হ্যাভ ডান? হাউ আই উইল টোলারেট দিস বায়োস্কোপ নাউ?’

স্যার প্রথমদিন তাদের দু’জনকে খুব ভোরে উঠে পুরো মাঠ পরিষ্কার করতে বললেন। শিহরণ আঁৎকে উঠল এই কথা শুনে । তার মাম্মি ড্যাডি তাকে দিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো কাজ করায়নি। আর এই জাঁদরেল স্যার কি না তাকে দিয়ে স্কুলের পুরো মাঠ পরিষ্কার করাবেন! এত বিশাল মাঠ পরিষ্কার করা তো আর চারটি খানি কথা নয়। বললেই হলো না কি? কিন্তু স্যারের সাথে তর্ক ও করতে পারছে না। এই স্যারের অবাধ্য সচরাচর কেউই হয় না। সবাই স্যারকে খুব বেশি ভয় পায় । স্যার ভালো পড়ান তবে নিয়মের ক্ষেত্রে তিনি বাড়াবাড়ি রকমের কঠিন!

মূলত ছোঁয়া আর শিহরণ দুজনেরই প্রায়সময় দেরি হয়ে যায়। স্যার বেশ কিছুদিন যাবত এসব খেয়াল করেছেন। মনে মনে তিনি বিশাল এক পরিকল্পনা করে রেখেছেন । সে বিষয়ে কেই বা জানত! আর স্যারের তো এখন মহাসুখ অনুভব হচ্ছে এই দুজনকে একসাথে শাস্তি দিতে পেরে।

স্কুল থেকে এসে ছোঁয়া রাতের খাবার প্রস্তুত করতে লাগল। তার মাথায় এখন রাজ্যের চিন্তা। এক দিকে হৃদয়ের কোনো এক ক্ষুদ্র জায়গায় সুখ সুখ অনুভূতি। ঠিক বিপরীতে মস্তিষ্কের সমস্তটা জুড়ে দুশ্চিন্তার রাজত্ব। তার সৎ বোনেরাও একই স্কুলে পড়াশুনা করে। তবে তাদের মতো সুযোগ সুবিধা ছোঁয়ার নেই। বরং ছোঁয়াকে বাসার সমস্ত কাজ করেই স্কুলে যেতে হয়। নয়তো তার সৎ মা প্রচুর পরিমাণে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার করেন। যা অসহনীয় । তাই সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে কাজে কোনো ভুল যাতে না হয়। কাজে ভুল হলেও তাকে বেদম মার খেতে হবে । তার উপর স্কুলের শাস্তি! রাতে ঘুমুতে যেতে যেতেও বারোটা বেজে যায় । মাঝে মধ্যে একটাও বেজে যায়। সবার খাবার খাওয়ার পর সে খাবার খায়। তারপর সবকিছু পরিষ্কার করে ঘুমুতে যায় । এভাবেই চলে প্রতিদিন। এর ব্যত্যয় হলেই তার দাম দিতে হয় তার শরীরকে!

আজো ঘুমুতে যেতে বারোটা বেজে গেলো। ছোঁয়া মোবাইলে সাড়ে চারটার অ্যালার্ম দিলো যাতে কোনোক্রমেই দেরি না হয়।

শিহরণের মাথা প্রচণ্ড ব্যথা করছে। রাগে কপালের শিরাগুলো দপদপ করছে । সে কিছুতেই স্যারের সিদ্ধান্তটা মেনে নিতে পারছে না। এই স্যারের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে । যে মেয়েটাকে সে একদম সহ্য করতে পারে না, যাকে দেখলে তার রীতিমতো অস্বস্তি অনুভব হয় তার সাথে দীর্ঘ একটা মাস থাকতে হবে! শিহরণ আর ভাবতে পারছে না। তার মাথা ব্যাথাটা যেনো তার কষ্টানুভূতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


অবশেষে শিহরণ ঠিক করলো সে স্যারের কথা শুনবে না। সে যথাসময়ে ক্লাসে যাবে। তবে গ্রাউন্ড পরিষ্কার করার কাজ সে করবে না। কখনোই না। কিন্তু স্যারকে একথা কোনোভাবেই বুঝতে দেয়া যাবে না। সব কাজ ওই পাগলাটে মেয়েটা করবে। তবে ক্রেডিট সেও ভাগ করে নিবে। মেয়েটা যে কি পরিমান ভীতুর ডিম তা শিহরণের ভালোই জানা আছে। তাই সে দরকার হলে মেয়েটাকে ব্ল্যাকমেল করবে তবুও তার সাথে কাজ করবে না। মেয়েটাকে কয়েকবার দেখেছে শিহরণ হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতে। তার মনে তখন কয়েক মুহূর্তের জন্য খারাপ লাগা তৈরী হতো। তবে তার রেশ বেশিক্ষণ থাকতো না।

হঠাত্ শিহরণের মনে হলো মেয়েটার কী যেনো নাম! শিহরণের তার নামটা মনে পড়ছে না। সে সবসময় এই মেয়েটাকে ‘পাগলাটে মেয়ে’ বলে অথবা ‘পাগলী’ বলেই সম্বোধন করেছে। কখনো নামই বলেনি। তবে বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন অবশ্য মেয়েটার নাম তার সামনে উচ্চারণ করেছিল। কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করার পরেও তার নামটা মনে করতে ব্যর্থ হলো শিহরণ। তার উপর তার বন্ধু অতল তো এই মেয়েটার জন্য যারপরনাই পাগল। একেবারে পাগল দিওয়ানা যাকে বলে! শিহরণ বুঝতে পারে না কি আছে মেয়েটার মধ্যে যার জন্য অতল এত পাগল মেয়েটার জন্য। পুরোই পাগলের মতো চলাফেরা মেয়েটার । ঠিকমতো চুলটাও কখনো আঁচড়াতে দেখেনি সে। মুখটা থাকে ফ্যাকাশে । যেনো এই মেয়েটা প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করে। হঠাৎ শিহরণের মনে হলো সে কেন এই মেয়েটাকে নিয়ে ভাবছে। সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সমস্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে চাইলো।

চলবে…..ইনশাল্লাহ্

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে