গল্প: ছোঁয়ার শিহরণ পর্ব-২৬

0
1950

গল্প: ছোঁয়ার শিহরণ পর্ব-২৬
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়ে অতল বেরিয়ে এসেছিল শিহরণদের বাসা থেকে। রাগে তার মাথার শিরাগুলো দপদপ করছে। সে কোনোভাবে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। রাস্তায় এলোপাথাড়ি হাঁটছে সে। পায়ের পাশে একটা কোকের ক্যান পেলো কিছুদূর যাবার পর। তখন থেকে ওটাকেই লাথি মেরে মেরে হাঁটছে সে। যেন এই মুহূর্তে এটাই তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যেন এই কাজটি তাকে তার সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। তেমন মনোযোগী হয়েই ক্যানটাকে লাথি মেরে মেরে পথ মাড়াচ্ছে। তার ঠোঁটের কোণায় এখনো রক্ত আছে। কিছুদূর যাবার পর একটা বিশাল আকারের বটগাছ এলো। গাছটি থেকে পাঁচ কি সাত মিনিটের রাস্তা হেঁটে যাবার পরেই অতলের বাসা। সে বটগাছটার নিচে না বসে বটগাছের ঠিক অপোজিটে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মরচে পড়া ল্যাম্পপোস্টের নিচে গিয়ে বসল। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় অতলের চেহারার ক্ষত স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। সে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ঠোঁটের কোণায় জমে থাকা রক্তবিন্দু মুছে সেটা চোখের সামনে এনে দেখতে লাগলো । তার ঠোঁট দুটো খানিক বেঁকিয়ে সে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে। তারপর বিড়বিড় করে আওড়ালো,’ভালোবাসার প্রতিদান কি এটা? ভাইয়ের মতো ভালোবেসেছি তোকে, শিহরণ। কিন্তু তুই আমার কথা বিশ্বাস করলি না!’

তারপর আবার ব্যঙ্গাত্মকভাবে স্বগতোক্তি করল,’বিশ্বাস! বিশ্বাসের প্রশ্ন তো তখন আসবে যখন তুই আমার কথা শুনতি! আমার কথা একটা বার শুনলি না! এই তোর বন্ধুত্ব? আজ থেকে তোর সাথে আমার কোনো বন্ধুত্ব নেই। ইউ আর নো ওয়ান ফর মি!’
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


‘ইউ আর নো ওয়ান’ কথাটা আওড়াতে আওড়াতে অতল হেঁটে চলল। বাসায় পৌঁছানো পর্যন্ত কথাটা আওড়ালো সে।

অতল বাসায় এসেই শুনতে পেল তার বাবার ট্রান্সফার হয়ে গেছে। তাদের এখন রাঙ্গামাটি চলে যেতে হবে। এই খবরটা শুনে অতলের ভালো বা খারাপ কোনো অনুভূতি হয়নি । স্বাভাবিক পরিস্থিতি হলে তার খুব খারাপ লাগত। কিন্তু এখন সেই অনুভূতি হচ্ছে না। বন্ধুদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবার কষ্টটাও অনুভব করতে পারছে না। খবরটা শুনেই সে তার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। লাইট জ্বালাল না। এখন তার অন্ধকারেই থাকতে মন চাইছে । তার ভাবনায় এখন শুধু বহ্নির চিৎকার ভেসে আসছে।তার বারে বারে বলা কথাগুলো মাথার মধ্যে দপ দপ করছে। আর থেকে থেকেই উঁকি দিচ্ছে শিহরণের তার প্রতি বিশ্বাসহীনতার কথা। বুকের মধ্যে শেলের মতো বিঁধছে। খুব কষ্ট হচ্ছে অতলের। মনে হচ্ছে কোনো এক কষ্টের সমুদ্রে সে ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছে । বাঁচার জন্য হাত পা ছুড়ছে কিন্তু কোনো অবলম্বন খুঁজে পাচ্ছে না। এমনকি এক টুকরো খড়কুটো ও না!
________________

পড়ন্ত বিকেল মানেই ভালোবাসাময় এক ক্ষণ। যখন চারিদিকে শান্ত, স্নিগ্ধ এক আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। এক ধরনের বিশুদ্ধতায় ভরা অনুভূতি হয় তখন। আর এমন সময় ইচ্ছে হয় পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে এক গাছের ডাল থেকে অপর গাছের ডালে। সবুজের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কিছু ইচ্ছে হয় পূরণ না করার জন্য, শুধুই মনকে ভাবনার জগতের তৃপ্তির স্বাদ যোগানোর জন্য ।

ছুটির কারণে এখন ছোঁয়া বাসায় একদম একা। নাহ্! একা থাকতে তার ভয় লাগে না। অভ্যেস হয়ে গেছে। সে বাগানে পানি দিচ্ছিল। পানি দিতেই দিতেই তার চোখ গেল সামনে দণ্ডায়মান আগন্তুকের দিকে। আর সেই আগন্তুক আর কেউ নয় স্বয়ং অতল। অতল এখানে, তার বাসায় কী করে! প্রথমেই তার মাথায় এই প্রশ্নটা এলো। সে অস্ফুটে বলল,’অতল।’

অতল ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ছোঁয়ার দিকে। তার সামনে সটান হয়ে দাঁড়াল । তারপর বলল,’দেখতে এলাম শেষ বারের মতো।’

‘শেষবার?’ ছোঁয়া ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল।

‘হুম। চলে যাচ্ছি রাঙ্গামাটি । আব্বুর ট্রান্সফার হয়েছে। আর তোমাদের সাথে দেখা হবে না। তাই শেষ বারের মতো একটা বার না দেখে থাকতে পারলাম না।’

ছোঁয়া পূর্ণদৃষ্টিতে একবার তাকাল অতলের দিকে।তারপর আবার মনোযোগ দিল গাছে পানি দেবার কাজে। অতলের বিধ্বস্ত অবস্থা ছোঁয়ার চোখ এড়ায়নি। সে কিছুক্ষণ পর বলল,’চা খাবে?’

‘তুমি বানাবে?’ অতল সহাস্যে প্রশ্ন করল ।

‘আর কে বানাবে? আমি ছাড়া তো এখন আর কেউ নেই ঘরে।’

‘সে কি! তুমি একা মানে? তোমার ফ্যামিলি মেম্বাররা কই?’ চিন্তিত স্বরে বলল অতল।

‘ছুটি কাটাচ্ছে। হয়তো ভালো কোনো জায়গায় ঘুরতে গিয়েছে।’ ছোঁয়া খুব গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘তোমাকে সাথে নিয়ে যায়নি কেন?’ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল অতল।

‘আমার এসব ঘোরাঘুরি একদম ভালো লাগে না। তাই আমি যাইনি। আর আমি চলে গেলে এই যে তুমি আসলে আমাকে কি পেতে?’ ছোঁয়া মৃদু হেসে বলল।

‘এমনিতেই বা কই পেলাম?’ অতল যেন স্বগতোক্তি করল।

ছোঁয়ার মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। সে কথা এড়ানোর জন্য বলল,’চা কি খাবে তুমি?’

‘হু। ঠিক আছে। খাওয়া যায়।’ অতল হেসে বলল।

অতল চা পান করছে। চা পান করতে করতে অতল গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,’সে কে?’

ছোঁয়া প্রথমে বুঝতে পারেনি। সন্দিহান কণ্ঠে বলল,’কার কথা বলছ?’

‘যে মানুষটা ভুল অথচ সৌভাগ্যবান।’ অপ্রসন্ন কণ্ঠে বলল অতল।

ছোঁয়া নিস্তেজ গলায় বলল,’বাদ দাও তো এসব। এসব বলে তো কোনো লাভ নেই।’

‘নামটা অন্তত বলো।’ অতলের চোখে মুখে জানার প্রবল আকাঙ্ক্ষা।

ছোঁয়া গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,’তাকে তুমি চেনো। সে তোমার খুব কাছের একজন। তবে আমি তার নাম তোমাকে বলতে চাইছি না। আমি এর জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থী তোমার কাছে।’

চা পান শেষে অতল চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল । একটু হেটে চলে যাবার পর আবার ঘুরে দাঁড়াল । ছোঁয়া তার ঠিক পিছনেই ছিল। অতল দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল,’ক্যান আই হাগ ইউ ফর দ্যা ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট টাইম?’

ছোঁয়া চোখ বড় বড় করে তাকাল অতলের দিকে। তাকে বিভ্রান্ত দেখাল। সে কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না! এমন একটা কথা অতল বলে ফেলবে সে কখনোই ভাবে নি। অতল পুনরায় বিমর্ষ গলায় বলল,’ওকে। ইফ ইউ আর নট ইন্টারেস্টড দ্যান ইটস্ ফাইন।’ অতল তার প্যান্টের পকেট থেকে হাত দুটো প্রসারিত করে শেষের কথাটি বলল।

একটু থেমে আবার বলল,’ইউ নো, অ্যাকচুয়ালি আই ডোন্ট ডিজার্ভ এনিথিং গুড।’ বিষাদগ্রস্ত শুনাল অতলের কণ্ঠ।

ছোঁয়া হাগ করার কথা ভাবেইনি কখনো। অতলের বিধ্বস্ত অবস্থার কথা ভেবে সে আমতা আমতা করে বলল,’ইয়েস, ইউ ক্যান।’

অতলের মুখে তৎক্ষনাত আনন্দের ঝিলিক দেখা দিল। সে সহাস্যে বলল,’থ্যাংকস, ইটস্ অ্যা প্রেশাস গিফ্ট ফর মি।’ কথা শেষ করে সাথে সাথেই ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরল। ছোঁয়ার অস্বস্তি লাগছিল। মন থেকে না চাইলে যা হয় আরকি!

শিহরণ অনেক দিন হচ্ছে ছোঁয়াকে দেখছে না। তাকে দেখার জন্য তার মন আনচান করছিল। দূর থেকেই না হয় দেখবে তবুও তার এক পলক দেখা চায় ছোঁয়াকে। তাই শেষমেশ তাকে এক পলক দেখার জন্য এসেই ছোঁয়াকে অতলের সাথে দেখল। সে যা বুঝার বুঝে নিয়েছে । দরজা হাট করে খোলা থাকার কারণেই সে ছোঁয়াদের বাসার বাগান থেকেই সবটা স্পষ্ট দেখেছে । দেখা মাত্র সে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। তার ইচ্ছে করছে সবকিছু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে। সব কিছু চুরমার করে দিতে। সব কিছু ভেঙ্গে ফেলতে। সে কোনোভাবে বুঝে উঠতে পারছে না একজন মানুষ এতটা নীচে কীভাবে নামতে পারে? কীভাবে?

শিহরণ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই একটা গোলাপ ফুলের টপ ছিল। খুব সুন্দর গোলাপ ফুটেছে গাছটাতে। রক্তিম বর্ণের গোলাপ। সে অতল আর ছোঁয়াকে দেখতে দেখতেই ডান হাতে গোলাপ ফুলটা সজোরে টেনে ছিড়ল। তারপর হাতের মুঠোয় দুমড়ে মুচড়ে ফেলল গোলাপ ফুলটা । এতে তার হাতে গোলাপের কাঁটা বিঁধে গেছে। সেখান থেকে দরদর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে । শিহরণের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। সে যেন কোনো কষ্ট অনুভব করছে না। তার মনের কষ্টটাই এখানে মুখ্য, শরীরের নয়। অতল ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরতে দেখে সে নিজেকে আর কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। ডান পা দিয়ে সজোরে লাথি মেরে ফুলের টপটা ভেঙ্গে ফেলল। ফুলের টপটা বাগানের মাঝ বরাবর গিয়ে পড়ল। শিহরণ আর
এক মুহূর্ত ও দাঁড়াল না।

চলবে….ইন শা আল্লাহ্

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে