গল্প: ছোঁয়ার শিহরণ পর্ব: ১৪

0
2011

গল্প: ছোঁয়ার শিহরণ পর্ব: ১৪
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

ছোঁয়া দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে গেল। পিছনে ফিরে যদি দেখতো তবে দেখতে পেত শিহরণের রক্তচক্ষু । কেমন অগ্নিঝড়া দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে। অথচ তার এভাবে তাকিয়ে থাকার কোনো মানে নেই। সে কোনোভাবেই এভাবে তাকানোর অধিকার রাখে না। ছোঁয়ার প্রতি তো তার কোনো অধিকার নেই। যেখানে কোনো অধিকার নেই সেখানে অধিকার বোধের তো প্রশ্নই আসে না।

তারপরেও কিছু মানুষ বড্ড পাগল । পাগল তার ভালোবাসার মানুষের জন্য। আর এই মাত্রাটা আরো বেশি বেড়ে যায় যখন সেই মানুষটি অজ্ঞাত থাকে তার ভালোবাসার অনুভূতি সম্পর্কে । শিহরণের ও ঠিক তেমনই হচ্ছে।

অতল তখনো দাঁড়িয়ে দেখছিল ছোঁয়ার চলে যাওয়ার দৃশ্য। ভালোবাসায় সব সুন্দর! সব! ভালোবাসার মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ত্রুটিগুলোও সুন্দর। সেগুলো সুন্দর কারণ এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ত্রুটি অক্ষির সম্মুখে ত্রুটি হিসেবে প্রদর্শিত হয় না। এই ত্রুটি গুলো প্রদর্শিত হয় ছোটো ছোটো ভালো লাগা হিসেবে। আর তাই ভালোবাসায় সব সুন্দর হয়ে যায় । ভালোবাসা দেখার দৃষ্টিভঙ্গি নিমিষেই পরিবর্তন করে দেয় ।

আর তাই যে ছোঁয়া অন্য সকলের দৃষ্টিতে পাগল, পাতলা আর রোগাটে। এলোমেলো স্বভাবের। সেই ছোঁয়ার মাঝে ভালোবাসার এক বিশাল সমুদ্র খুঁজে পায় অতল। ভালোবাসা আসলেই অদ্ভুত ক্ষমতার এক আধার। যে আধার নিমিষেই অনেক কিছু পরিবর্তন করে দেবার ক্ষমতা রাখে।

ছোঁয়াকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। দৃষ্টির দৃশ্যপটের আড়ালে চলে গেছে সে। অবশ্য মনের দৃশ্যপটে তো ভালোবাসার মানুষের সার্বক্ষণিক বিচরণ! অতল এবার ছোঁয়ার চলে যাওয়ার দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরালো স্কুলের মেইন গেটের দিকে। শিহরণ অতলের দৃষ্টির পরিবর্তন বুঝতে পেরে সরে গেল। সে চায় না অতল তাকে দেখুক তার এমন উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় । অতল সেখানে দাঁড়িয়ে একটা প্রলম্বিত শ্বাস নিল। তারপর কাঁধে ঝুলানো ব্যাগটা একটু ঠিক করে নিল। তারপর নিজের গন্তব্যে রওয়ানা হলো।

অতল চলে যাওয়ার পর শিহরণ বের হলো। আজ কিছুই ভালো লাগছে না তার। তার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে। কিন্তু তার বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু না গিয়েও তো উপায় নেই। সে বিষণ্ণ মন নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল।

হালকা সবুজাভ চোখের ছেলেটার চোখে রক্ত লাল বর্ণ হানা দিয়েছে । ঝাঁকড়া কোকড়ানো চুলগুলো হয়ে আছে এলোমেলো। চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে তার। মনের গহীনে উদিত ক্রোধের সমস্তই ভেসে উঠছে উজ্জ্বল ফর্সা রঙের, হালকা সবুজাভ চোখের অধিকারী ছেলেটার মুখমণ্ডলে।
________________________

ছোঁয়া হাঁটছিল। তাদের বাড়িতে আসার পথিমধ্যে পড়ে একটা শুনসান গলি। তার ঠিক বামপাশে ময়লার একটা ডাস্টবিন। ছোঁয়া সেই জায়গার কাছাকাছি যেতেই ব্যাগ থেকে অতলের দেয়া চিঠিটা বের করল। তারপর চিঠিটা একদম টুকরো টুকরো করে ছিড়ে সেই ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। চিঠিটা ফেলতেই সে এক ধরনের শান্তি অনুভব করল। যেন ঘাড় থেকে অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেল।

মেয়েদের সবকিছু ভেঙ্গে বলার দরকার হয় না। যদিও ভেঙ্গে বলাটাই শ্রেয়। কারণ ভেঙ্গে বললে কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে না। ছোঁয়া তো স্পষ্টতই বুঝতে পারছে যে, অতল তাকে লাভ লেটার দিয়েছে। সে অন্য কোনো মেয়েদের মতো নয় যে তা নিয়ে খুব আনন্দ উল্লাস করবে বা জনে জনে বলে বেড়াবে। সে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে গুণাম্বিত। ক্লাসের অন্য মেয়েরা এমন করলেও ছোঁয়া এমন কিছুতে মজা পায় না। তার কাছে তার নিজের আত্মসম্মানবোধের যেমন মূল্য আছে, ঠিক ততটাই অন্য একজন মানুষের আত্মসম্মানবোধের মূল্যও আছে। কাউকে ছোটো করার মধ্যে গর্ব করার কিছু নেই, এতে আসলে অন্যকে হেয়কারীর চরিত্রের নীচতা ব্যতীত আর কিছুই পরিলক্ষিত হয় না। একজন বিচক্ষণ, বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি মাত্রেই তা বুঝার কথা। তবে যাদের জন্য জীবনটা একটা ফান তারা এসবের কিছুই বুঝবে না। তারা কেউ পড়ে গিয়ে হাত পা ভেঙ্গে ফেললে সেখানে যেমন হো হো করে হেসে উঠবে, ঠিক তেমনি কোনো মানুষের কষ্ট কিংবা তার চিরতরে পরপারে পাড়ি জমানোটাও এদের কোনো শিক্ষা দিতে পারে না। কারণ তারা সবকিছুতেই শুধু ফান খুঁজে এবং পায়ও। তবে এটা জীবনের অর্থ নয়, উদ্দেশ্যও নয় । জীবনের অর্থ আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত। যার সংজ্ঞার্থ অনেকেই বুঝে না কিংবা বুঝতে চায়ও না।

ছোঁয়া চেয়েছিল অতল যখন চিঠি দিচ্ছিল তখনই না করে দিতে কিন্তু সেটা খুব খারাপ দেখাত। এতে সে অপমান বোধ করত। যেটা ছোঁয়া কোনো অবস্থাতেই চায় না। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল সে নিজে চিঠি লিখে জানিয়ে দেবে অতলকে। এছাড়া আর কোনো পথ অবশ্য খোলা নেই।

তারপর আরো কিছুদূর হেঁটে তার একটা প্রিয় জায়গায় এলো। মন খারাপ হলে সে এখানে এসে বসে থাকে। কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে। তার খুব প্রিয় এই গাছটা। বিশেষ করে বসন্ত এলে তখন। যদি তার হাতে অঢেল সময় থাকত তবে সে এইখানে এসেই বসে থাকত। বসন্তে এই গাছটা সাজে নতুন সাজে। একদম লাল টুকটুকে নববধূর মতন মনে হয় তার কাছে। গাছের শীর্ষে লাল টুকটুকে বর্ণের কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটে থাকে। তখন ছোঁয়ার ইচ্ছে করে সেই ফুলগুলোকে হাত দিয়ে স্পর্শ করতে , ফুলগুলোর ছোঁয়া পেতে। কিন্তু আফসোস! এতটা উচ্চতায় এদের অবস্থান যে তা কোনোভাবেই সম্ভব হয় না।

এখন গ্রীষ্মকাল চলে এসেছে। গাছটাতে ফুল নেই বললেই চলে। কিন্তু তাতে কী! এই গাছটাতে ফুল থাকলেও ছোঁয়া এটাকে পছন্দ করে আবার না থাকলেও পছন্দ করে। পছন্দ জিনিসটা যদি সম্পূর্ণতাহীনতার সাথে সাথে দূরীভূত হয়ে যায় , তবে সেটা পছন্দ নয়, নয় ভালোলাগা বা ভালোবাসা । সেটা শুধুমাত্র মোহ। যা সৌন্দর্যের নিঃশেষেই বিলুপ্ত হয়ে যায় । আর এই মোহ সব সময় প্রলয়ঙ্কারী ও ধ্বংসাত্মক কিছু বয়ে নিয়ে আসে অবেগের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া মানুষগুলোর জীবনে।

হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা কোকিলের কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এল। বসন্তে পাখির কলতানে চারিদিকে মুখরিত হয়ে থাকে। সেই তুলনায় অন্যান্য ঋতুতে তার রেশ কমে যায় অনেক বা বলা যায় থাকেই না।

চারদিকে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তের সেই ছায়াঘেরা শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতি বিরাজ করছে। প্রকৃতিই জানান দিচ্ছে এখন ঘরে ফেরার সময়। আর কোকিলের সেই আচমকা ভেসে আসা কণ্ঠস্বর যেন ছিল প্রকৃতির এক নিজস্ব ঘন্টার ধ্বনি যা সংকেত রুপে দ্রুত গৃহপানে ধাবমান হওয়ার স্পষ্ট আভাস দিল। ছোঁয়া উঠে দাঁড়াল। খুব দেরি হয়ে গেছে । তার মন আনচান করছে। আজ তার উপরে কোন মহা বিপদ অবতীর্ণ হয় কে জানে!

বাসায় এসেই দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেল সে তিন জোড়া চক্ষু অগ্নিঝড়া দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু ভালো করে খেয়াল করতেই সে দেখল ফাহমিদা বেগমের হাতে একটা চিকন বেত। ছোঁয়া মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে গেল। সে ভাবছে আজ সে শেষ। আজ সবকিছুই আবার শেষ হয়ে যাবে। তার কোনো কথায় শুনবে না এই মহিলা। কোনোভাবেই তাকে রেহাই দিবে না। কোনোভাবেই না!

মানুষ সম্ভাব্য ফলাফল জানতে পারা সত্ত্বেও শেষবারের মতো চেষ্টা করেই। এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি । সমুদ্রে ডুবন্ত মানুষটা যেমন বারেবারে হাত পা ছোটাতে থাকে কোনো একটি মাত্র বাঁচার অবলম্বন পাবার আশায় ঠিক তেমনি। হোক সে অবলম্বন কোনো একটি খড়কুটো । তাতে কি! চেষ্টা করেই তারা। আর এই চেষ্টা করাটাই মানব চরিত্রের অন্যতম গুণ।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


ছোঁয়া ত্রস্ত পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে ঘরের ভিতরে। ফাহমিদা বেগমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বলল,’আমি এখনই সব কাজ করে দিচ্ছি। দয়া করে আজ আমাকে মারবেন না। আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কক্ষণো এরকম হবে না।’

ফাহমিদা বেগম যেন ফুঁসে উঠলেন। বললেন, ‘তোর মতো মহারানী পালার আমার আর কোনো সখ নাই। তোকে যে স্কুলে পড়াচ্ছি তার জন্য তো কোনো কৃতজ্ঞতা বোধ নাই। তুই জানিস যে আমার মেয়েরা স্কুল থেকে এসে ক্লান্ত থাকে। আর আজকে তোর জন্য আমার ফুটফুটে মেয়ে দুটো তাদের খাবার ঠিকমতো খেতে পারেনি। কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে তাদের। আর তুই এতক্ষণ পর বাসায় আসলি? তোর এত্তবড় স্পর্ধা !’

ছোঁয়া যেন এবার কেঁদেই দিবে–এমন দেখাচ্ছে তাকে। কিন্তু কিছু মানুষের হৃদয় গলানোর ক্ষমতা চোখের অসহায় অশ্রুধারারও থাকে না! কাঁদো কাঁদো ভাবে ছোঁয়া বলল,’এমন আর কখনো হবে না। আমাকে আজকের মতো মাফ করে দেন।’

হিয়া দুঃখ পাবার ভান করে বলল,’ আম্মু জানো আজ খুব ক্লান্ত লাগছিল স্কুল থেকে আসার পর। কিন্তু ছোঁয়া তো আসেনি। তাই এখনো পর্যন্ত আমি না খেয়ে আছি। তুমি তো জানো আম্মু, না খেয়ে থাকতে আমার কি পরিমাণ কষ্ট হয়।’

চলবে……ইন শা আল্লাহ্

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে