ক্যালেন্ডার! পর্ব: ০৪

0
824

গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ০৪!
লেখক: তানভীর তুহিন!

রাতে মুবিন মিছিলকে ফোন দেবার পর….!
– ” হ্যালো মিছিল! ”
– ” এ্যাই! এ্যাই! কয়টা বাজে এখন? ”
মুবিন ফোনটা কান থেকে নামিয়ে স্ক্রিনে টাইম দেখে নেয়। তারপর বলে,
– ” ১২:০২ বাজে। ”
– ” এত্তো ছ্যাছড়া ক্যান রে তুই? বারোটা বলছি বলে কী বারোটা বাজেই ফোন দিবি তুই? ”
– ” আশ্চর্য! তুমি না বললা তুমি ১২ টা বাজে ফ্রি হও। আমি তো আরো আগেই ফোন দিতাম। শুধু তুমি বারোটা বলে দিসো বলে সেই কখন থেকে ফোন নিয়ে পায়চারি করছিলাম আর ঘড়িতে সময় দেখছিলাম। ”
মিছিল মুবিনের সরল সিকারোক্তি’তে মুচকি হাসে। মুবিন চুপচাপ কানের কাছে ফোন ধরে আছে, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে মিছিলের স্নিগ্ধ কোমল কণ্ঠস্বরের। মিছিল বলে, ” হ্যা বল। ফোন কেনো দিয়েছিস? ”
প্রচন্ড রাগ, ক্ষোভ আর বিরক্তিতে মুবিন দাত খিটে চোখ বন্ধ করে কপাল কুচকে ফেলে। বিরক্তি’র ফলে মুবিনের মুখ থেকে ‘চ্যা’ মতো শব্দ হয়। মুবিন চুপচাপ ফোন কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রচুর মেজাজ গরম হয়েছে তার জাদুকন্যার ওপরে। এটা কেমন কথা? মুবিনের একদমই তুই-তোকারি পছন্দের না। কিন্তু মিছিল তাকে তুই তুই করেই বলছে। মিছিলের মুখ থেকে তুই শব্দটা কেমন যেনো গালির মতো মনে হচ্ছে মুবিনের। মিছিল ফোন কান থেকে নামিয়ে চেক করে নেয় লাইন কেটে গেছে কীনা। কারন ওপাশ থেকে কোন শব্দই আসছে না। না! লাইনতো কাটেনি। তাহলে হারামাজাদা’টা চুপ চাপ ক্যান?
– ” তুই কিজন্য ফোন করছিস ওইটা বলবি? নাকি আমি ফোন রাখবো। ”
খানিক ঝাঁঝালো কন্ঠে মুবিন বলে, ” এই তোমায় বলছি না তুই-তোকারি করবা না। তোমার মুখে তুই শুনলে মনে হয় তুমি আমায় গালি দিচ্ছো! ”
মিছিলের ঝটপট রেডিমেড উত্তর, ” আমি তুই করেই বলবো। পোষাইলে আদাব, নাহয় রাস্তা মাপ। ”
– ” নিজে ড্যাং ড্যাং করে নাম্বার দিলা। আর এখন নিজেই ফোনে যা! তা! ব্যাবহার করছো। তোমার কী মনে হয়…? ”
মুবিনকে থামিয়ে দিয়ে মিছিল বলে, ” তোর কী মনে হয় বাছা? আমি নাম্বার দিয়েছি বলে পটে গেছি? একদমই না! আমি নাম্বার দিয়ে শুধু তোকে বোঝাতে চেয়েছি যে তুই পটানোর সব সুযোগ পেয়েও আমায় পটাতে পারবি না। ”
– ” ধ্যাত! শুধু এক ঘ্যানঘ্যানানি পটবা না, পটবা না। আমি একবারো বলেছি তোমায়, যে পটে যাও? পটতে হবে না তোমায়। তুমি যেভাবে পটা নিয়ে পড়েছো মনে হচ্ছে তুমি চাচ্ছো আমি তোমায় পটায় ফেলি! ”
– ” আসছে রে সিপাহী বিদ্রোহে’র প্রধান সিপাহী। উনি পটালেন আর আমি পটে গেলাম। আমায় তুমি কোনোদিন পটাতে পারবে না! ”
– ” উফফফ! আরেকবার যদি এই ‘পটানো’ ওয়ার্ড ইউজ করছো। আরে মিছিল মনি আমি ভালোবাসি তোমায়। পটাতে কেনো যাবো? যদি পছন্দ করতাম তোমায়, তাহলে পটানোর প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আমি ভালোবাসি তোমায় পটাতে হবে না। তুমি এমনিতেই ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলবা আমায়! ”
মিছিলের সব হম্বিতম্বি গায়েব। চোখগুলো বড়বড় হয়ে গেছে তার। আবার সেই বদমায়েশ অনুভুতি হচ্ছে তার। পুরোটা শরীরে কেমন যেনো সুড়সুড়ি! সুড়সুড়ি লাগছে। তাকে তো কত কত ছেলে প্রপোজ করেছে, কই কখনও তো কোনো ছেলেকে এতো কনফিডেন্ট দেখেনি সে। সবাই নার্ভাস নার্ভাস থাকতো। সে’ও সেই নার্ভাসনেসকে এপ্রিশিয়েট করার জন্য চুপচাপ থেকে মাথা নিচু করে রাখতো। আর যেই কেউ প্রোপোজ করতো মিছিল টুক করে না করে দিতো। কারন তার এই অবধি কোনো ছেলেকেই পছন্দ হয়নি। তবে কলেজে একটা সিনিয়রের ওপর মারাত্মক ক্রাশ ছিলো মিছিলের। মারাত্মক বলে মারাত্মক! মিছিল তো একদম বিয়ে করতে চাইতো ওই সিনিয়রকে। কিন্তু সিনিয়র বেটার প্রেমিকা ছিলো, আর প্রেমিকা নিয়ে শো-অফ মারতো। শো-অফ বলতে একদম রাজকীয় শো-অফ। মিছিলও দেখেও না দেখার ভান করে, ড্যামকেয়ার এটিটিউড এর ভং ধরতো।
– ” প্যানপ্যান হলেও করো। চুপ কেনো? ”
মিছিল একটু কেপে ওঠে। কোথাও একটা গায়েব হয়ে যাওয়া ধরেছিলো সে। মিছিল নিরবতা পালন করছে, কেনো করছে তা সে জানে না। তবে তার ভেতর থেকে কোনো এক বিজ্ঞানি বলছে, ” যত চুপ থাকবি ততই মঙ্গল। যতই কথা বলবি ততই বিপদ! একদম মহাবিপদ। ” সেই বিজ্ঞানি’র কথা মানতেই চুপ আছে মিছিল।
মুবিন আদুরে কন্ঠে বলে, ” শোনো মিছিল মনি! আমার এতো তাড়াহুড়ো নেই। একদমই কোনো তাড়াহুড়ো নেই। তুমি যতদিন ইচ্ছে, ততদিন নিতে পারো। এক যুগ হলে একযুগ। শুধু একযুগ পরে হলেও আমায় ভালোবাসতে হবে। মুখে বলারও প্রয়োজনও নেই আই লাভ ইউ হ্যানত্যান টাইপ কিছু। শুধু একবার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভালোবাসি বলিও আমি তোমার চোখ থেকে পড়ে নেবো! ”
কথাগুলো বলেই একটু চুপ হয়ে যায় মুবিন। তারপর একটু শব্দ করে হেসে বলে, ” এই মিছিল তুমি কী সাহিত্য ভাজা টাজা খাও নাকি? আমি তো সাহিত্যের কিছুই জানতাম না। অথচ তোমাকে কেমন কাব্যিক ধরনে প্রেম নিবেদন করছি! ”
সাহিত্য ভাজা শব্দটা শুনে মিছিল ফিক করে হেসে ফেলে। মিছিলের আবার সেই ল্যাদা বাচ্চা!, ল্যাদা বাচ্চা মার্কা ফিলিংসটা হচ্ছে। ভেতরটা কেমন যেনো অস্থির আর আনচান লাগছে। আচ্ছা মুবিনেরও কী এমন লাগছে? মিছিল মনের মধ্যে একদমই কৌতুহল পুষে রাখতে পারে না। তাই সে মুবিনকে জিজ্ঞেস করে, ” আচ্ছা তোমার ভেতরে এখন কেমন ফিলিংস হচ্ছে? ”
মুবিন বুঝতে পারে মিছিল কী বোঝাতে চাইছে। কিন্তু মুবিন একটু রসিকতা করে বলে, ” কীসের ভেতরের ফিলিংস এর কথা বলছো? শার্টের ভেতরের? নাকি প্যান্টের ভেতরের? ”
মিছিল আহাম্মক বনে যায়। ছেলেটা এতো কঠিন কঠিন কথাগুলো কতো সহজ করে বলে ফেলে। আর এই সহজ কথাটাই বুঝতে পারলো না? আচ্ছা ও কী এই ডাবলমিনিং অসভ্য কথাটা ইচ্ছে করেই বললো? অবচেতন মনে মিছিল নিজের তর্জনী আঙুলের বড় নখটা দাত দিয়ে একটু খুটে ফেললো। নখ খুটে ফেলেছে খেয়াল হতেই আফসোস হলো। ধুর! পুরো নখটাই এখন কেটে ফেলতে হবে। মিছিল কী করবে এখন? ফোনটা কেটে দেবে? নাকি আবার স্পষ্টভাষ্যে জিজ্ঞেস করবে, ” তোমার মনের মধ্যে এখন ঠিক কী চলছে? ” উহু! সে জিজ্ঞেস করবে না। কেনো জিজ্ঞেস করবে? এতো পাকনা পাকনা ডায়লগ দিতে পারে। আর এটা বোঝে না? মিছিল কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দেয়। ফোনটা কেটে দিয়ে, ফোনটাকে নিষ্ঠুর ভাবে খাটের ওপর ছুড়ে মারে। ফোনটাও অসহায়ভাবে খাটে মুখ থুবড়ে পড়ে। মুবিনের মাথায় ঢুকলো না ব্যাপারটা। মিছিল কিছু না বলে ফোন কেটে দিলো কেনো? মিছিলের কী ব্যালেন্স শেষ? ধুর মিছিলের ব্যালেন্স কীভাবে শেষ হবে ফোন তো আমি দিয়েছি! তাহলে আমার ব্যালেন্স শেষ? মুবিন ঝটপট ব্যালেন্স চেক করে। এখনও যথেষ্ট আছে। তাহলে মিছিল ইচ্ছে করেই ফোন কেটে দিলো? রুমে হয়তো কেউ এসেছে, তাই কেটে দিয়েছে।

মিছিল পায়চারি করছে। মুবিনও পায়চারি করছে। মিছিল বারবার খাটের উপর পড়ে থাকা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে হারামাজাদা এখনও ফোন দিচ্ছে না কেনো? ওদিকে মুবিন অপেক্ষা করছে ৩০০ মুহুর্ত পার হবার। সে ফোনে টাইমার’ও সেট করে নিয়েছে। ৩০০ সেকেন্ড মানে ৫ মিনিট শেষ হলেই সে তার জাদুকন্যাকে ফোন লাগাবে। ৫ মিনিট শেষ। মুবিন মিছিলকে ফোন দেয়। ফুল রিং হয়ে কেটে যায়, মিছিল ইচ্ছে করেই ফোন ধরে না। এতো লেট করলি কেনো রে শালা? আমি তো ওয়েট করে ছিলাম নাকি? তাহলে তুই লেট করলি কেনো? এসব বিড়বিড় করে মুবিনকে শাসিয়ে নিচ্ছে মিছিল। মুবিন দুবার ফোন দিয়েছে কিন্তু ফোন ধরছেই না। তাহলে কী মিছিল বাথরুমে গেছে? নাকি রুমের বাইরে গেছে? আচ্ছা লাস্ট একবার ট্রাই করি। এবার রিসিভ করলে করবে। নাহয় আবার পাচ মিনিট পর করবো। মুবিন মিছিলকে ফোন দেয়। মিছিলের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। রিংটোন’টা কয়েক মুহুর্ত বাজার পরেই মিছিল ফোনটা রিসিভ করে। ফোন রিসিভ করেই মুবিনকে ঝারি মারে মিছিল, ” এ্যাই! তুমি এতো বেহায়া কেনো? আমি ফোন কেটে দেবার পরেও এতোবার ফোন দিচ্ছো কেনো? ”
ওপাশ থেকে মুবিন বলে, ” তুমি ইচ্ছে করে ফোন কেটেছিলে? আরে বলে কাটবে তো, যে তুমি ইচ্ছে করে ফোন কেটেছো। তাহলে আমি পাচ মিনিট অপেক্ষা না করেই তোমায় সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিতাম। আচ্ছা বলো কী কারনে ফোন কেটে দিলে? ”
– ” বলবো না। তুমি বলো তুমি এতো বেহায়া কেনো? ”
– ” প্রেমিকরা একটু বেহায়া বেশরম না হলে প্রেমিকা জোটেও না, টেকেও না তাই। ”
মিছিলের কথাই ফুরিয়ে গেছে। কী বলবে সে? মিছিল কিছুই বলছে না। ওদিকে মুবিনও চুপ। সে অপেক্ষা করছে মিছিলের কথা বলার। মিছিল বলে, ” আচ্ছা ঘুমাবো। রাখছি! ”
– ” অন্যদিন হলে আরো কিছুক্ষন আটকে রাখতাম কথা বলার জন্য। কিন্তু আজ প্রথমদিন তো তাই ছেড়ে দিচ্ছি। গুড নাইট! লাভ ইউ মিছিল মনি! ”
মিছিল চুপ করে আছে। সে ও কী গুড নাইট বলবে? গুড নাইট বললে কেমন আস্কারা দেওয়া হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা? সে গুড নাইট কেনো বলতে যাবে? ওই হারামাজাদার নাইট গুড যাক ব্যাড যাক তাতে থোরাই তার ফারাক পড়ে? মিছিল কিছু না বলেই ফোন কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখনই মুবিন বলে, ” এই শোনো আমি তোমায় ফোন রাখার সময় লাভ ইউ বললে তুমি কখনই লাভ ইউ টু বলবে না! ”
মিছিল খানিক অবাক হয়। খানিক না! অনেকখানি অবাক হয়। এ কেমন উদ্ভট চিন্তাধারা? সবাই তো লাভ ইউ টু’ই শুনতে চায়। তাহলে ও কেনো এমন কথা বললো? মিছিল চটজলদি প্রশ্ন করে ফেলে, ” কেনো বলবো না? ”
– ” কারন তুমি লাভ ইউ টু বললে আমি ফোন কাটতেই পারবো না। ” বলেই আধামুহুর্ত সময়ের জন্য থেমে যায় মুবিন। তারপর একটু উৎসুকভাবে মিছিলকে জিজ্ঞেস করে, ” এই তুমি কেন বলবো না জিজ্ঞেস করলে কেনো? তোমার কী লাভ ইউ টু বলতে ইচ্ছে করছিলো? ”
মাত্রই চরম বেয়াক্কেল হয়ে গেলো মিছিল। সে তো কৌতুহল নিবারনে জিজ্ঞেস করছিলো। কিন্তু হারামাজাদা’টা কী অভিযোগ তুলছে এসব? সে কীনা লাভ ইউ টু বলতে যাবে তাও এই বদমায়েশ ছ্যামড়াকে? তাও আবার মাত্র একদিনের মধ্যে প্রেমে পড়ে গিয়ে? মিছিল একটু কড়া শব্দে বলে, ” জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে ঘুমাও। রাখছি! ” বলেই মিছিল ফোন কেটে দিচ্ছিলো। কিন্তু কী যেনো একটা ভেবে মিছিল ফোনটা আবার কানের কাছে নিয়ে বলে, ” গুড নাইট! ” বলেই চোর যেমনি পালায়, মিছিলও তেমনি ফোনটা কেটে দেয়।

চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে