ক্যালেন্ডার! পর্ব: ০৩!

0
964

গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ০৩!
লেখক: তানভীর তুহিন!

মিছিল সিনেপ্লেক্সে ঢুকে বসেছে। মুবিনও গিয়ে ঠিক মিছিলের পাশেই বসেছে। মুবিনকে পাশে বসতে দেখেই মিছিলের পুরো মুখ বিরক্তিতে ভরে গেলো। কপাল,ভ্রু,নাক,চোখ সব মুহুর্তেই কুচকে গেলো। মিছিল মুবিনকে অনেকটা শাসানো মতো করে বললো, ” দেখো মুবিন একটা লিমিট থাকে সবকিছুর। একটা ছেলে হিসেবে একটা মেয়েকে পছন্দ হতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক বা অন্যায় কিছু না কিন্তু মেয়েটা যদি তোমায় প্রত্যাখ্যান করে দেয়। আর তারপরেও যদি তুমি মেয়েটার পিছু নাও, বিরক্ত করো, ঘুরঘুর করো তাহলে সেটা সম্পুর্ন অস্বাভাবিক এবং অন্যায় কাজ! ”
মুবিন নিশ্চুপ শ্রোতার মতো শুনছিলো মিছিলের কথাগুলো। মিছিল কথাগুলো বলে একদম স্বাভাবিক নজরে তাকিয়ে আছে মুবিনের দিকে। পাশ থেকে মিছিলের পিচ্চি কাজিনটাও উকি দিয়ে মুবিনকে দেখছে। পুরো মুখটা মিছিলের পাশ থেকে বের করছে না সে। বোধহয় লজ্বা পাচ্ছে। কিন্তু এই পিচ্চির আবার কোন কারনে এতো লজ্বা পাওয়া? সে ব্যাপারে খানিক সন্দিহান মুবিন। মুবিন পিচ্চিটার উকি দেওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। কারন পিচ্চিটা প্রতি সেকেন্ড পরপরই টুক করে একটু করে উকি দিচ্ছে। মিছিল প্রায় মিনিটখানেক অপেক্ষা করছে মুবিনের মুখ থেকে পজিটিভ কিছু শোনার আশায়। কিন্তু মুবিন ওই পিচ্চির আচরনের রহস্য উদঘাটনে মহাব্যাস্ত। মিছিল কিছু মিনিটের অপেক্ষার ইতি টেনে বলে, ” মুবিন প্লিয। আমার ব্যাপারটা কেমন যেনো উইয়ার্ড আর অকওয়ার্ড লাগছে। সো প্লিজ যাও এখান থেকে, এন্ড ফর গড সেক আমায় ইন ফিউচার ডিস্টার্ব করিও না! ”
মিছিল পুরো কথাটা শেষ করার আগেই মুবিন মিছিলের মুখের সামনে নিজের হাতের পাচটা আঙুল তুলে দিয়ে বলে, ” ধুর তুমি এতো সিরিয়াস কেনো? এতো সিরিয়াসনেস নিয়ে লাইফ ইঞ্জয় করা যায় নাকি? ”
মুবিনের এমন কথার জন্য তো মিছিল অপেক্ষা করেনি। মিছিল অপেক্ষা করছিলো মুবিনের অনুতাপ মিশ্রিত বুলি’র। কিন্তু মুবিন এসব কী বলছে? মিছিলের পুরো মুখে কৌতুহল দৌড়াদৌড়ি করছে। মিছিল কপালটা কুচকে পুরো কপালের চামড়া একদম কপালের মাঝখানে জড়ো করে ফেলেছে। চোখদুটো একদম হাতির চোখের ন্যায় ছোটো করে ফেলেছে। মুবিনও হালকা ভ্রু কুচকে মিছিলের দিকে তাকালো। তারপর বাম চোখটা একটু ছোট করে ঠোটদুটো বাম দিকে বাকিয়ে একটু বাকা হাসলো। তারপর সঙ্গে সঙ্গেই মিছিলের গালদুটো ধরে আলতো করে টেনে দিলো। মিছিলের হাতির চোখের ন্যায় ছোট চোখ দুটো কুল বড়ইয়ের মতো বড় হয়ে গেলো। মিছিল হুংকার দিয়ে মুবিনকে অধিকারের ভাষন শোনাতে যাবে তার আগেই মুবিন আবার মিছিলের মুখের সামনে নিজের হাতের পাচ আঙুল তুলে দেয়। মিছিলের চোখ এবং উৎসুক ভাব’টা স্বাভাবিক হয়। মুবিন একটু বিজ্ঞভঙ্গিতে মিছিলকে জিজ্ঞেস করে, ” আচ্ছা মিছিল মনি তুমি নিশ্চিত তো যে তুমি আমায় প্রত্যাখ্যান করেছো? ”
মিছিল মনি? হারামাজাদা’য় একদম ফ্লার্ট এর আঁতুড়ঘর। মিছিল মুবিনকে মনেমনে কিছু গালাগালি দিয়ে, মুখে বলে ” অবশ্যই আমি তোমায় স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছি। এন্ড লিসেন আমার নাম মিছিল নট দিস রাবিশ মিছিল মনি! ”
মিছিল যে মুবিনকে অপমান করে কথাগুলো বললো সেটা একদমই স্পষ্ট। কিন্তু তাতে মুবিনের কিছুই ফারাক পড়লো না। মুবিন একদম ড্যামকেয়ারভাবে আবার বিজ্ঞভঙ্গিতে বললো, ” দেখো মিছিল মনি তুমি মোটেই আমায় প্রত্যাখ্যান করে দাওনি চিরতরে। শুধু তোমার বর্তমান অনুভুতিটা বলেছো আমায় যে তোমার আমায় পছন্দ না। আর হুট করেই কেউ কারো পছন্দের হয়ে ওঠে নাকি? আমার তোমার প্রেমে পাগল হতে পাক্কা ছয় মাস লেগেছে। তোমার আমার প্রেমে পড়তে অন্ততপক্ষে ছয়দিনতো লাগবে নাকি? ”
মুবিন কথাগুলো বেশ বিজ্ঞভঙ্গিতে’ই বলছিলো। মানে হলো একদম মারাত্মক সিরিয়াস ভঙ্গিতে। কিন্তু মুবিনের কথাগুলো শোনার পরেই মিছিল হাসলো। হাসলো বললে অন্যায় হবে মুবিনকে ব্যাঙ্গ করে হাসলো। মিছিল হাসতে হাসতেই কপট রাগ দেখিয়ে শক্ত গলায় বললো, ” তোমার কী মনে হয় তুমি আমায় ছয় দিনে পটিয়ে ফেলবা? ফিল্ম পেয়েছো এটা…? ”
মিছিল কথা শেষ করার আগেই মুবিন আবার মিছিলের মুখের সামনে নিজের পাচ আঙুল উঠিয়ে দিয়ে বলে, ” শোনো আমার ছোট্র মিছিল মনি প্রত্যেকটা ফিল্ম, প্রত্যেকটা গল্প, প্রত্যেকটা সৃষ্টি, প্রত্যেকটা আবিষ্কার, প্রত্যেকটা উদ্ভাবন কারো না কারো জীবনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। কারো না কারো জীবন থেকেই নেওয়া। তাই এমন ভঙ্গিতে বলার কিছু নেই, আর তুমি মিস ওয়ার্ল্ড টাইপ কেউ না যে তোমায় পটানো যাবে না। ”
মিছিল ভেংচি কাটে। মিস ওয়ার্ল্ড না তাহলে পিছনে পড়েছিস কেনো রে শালা? যা না মিস ওয়ার্ল্ড টাইপ কারো পিছে যা!, হারামাজাদা প্লেবয়। ভার্সিটির একটা মেয়েও তো ছাড়লি না। শুনেছি প্রত্যেকটা মেয়ের সাথে ফ্ল্যার্ট করেছিস। ক্যারেকটারলেস উল্লুক! ইয়ং ম্যাডামদেরও নাকি ছাড় দিস না। আর এখন এসেছিস আমায় প্রেম নিবেদন করতে? তোর প্রেম তোর মানিব্যাগে রাখ। মুবিনের দিকে স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে এক চোখ ছোট এক চোখ একটু বড় করে কপাল কুচকে মনে মনে কথাগুলো মুবিনকে বলছিলো মিছিল। মুবিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছুড়ে মারলো মিছিলকে। মিছিলও কথা বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাব দিলো, ” শোনো তোমার এসব ভং-ছং আমায় শুনিয়ে কোনো লাভ নেই। তোমার এসব কথায় আমি পটবো না। আর আমি যদিও মনের ভুলে বা বুদ্ধির দোষে পটেও যাই তাহলে সেটা তোমায় বলবোই না। তাই তুমি আমায় কোনোদিনই প্রেমিকা হিসেবে পাবে না। এবার তুমি তোমার মতো করে প্রেম নিয়ে লাফাতে থাকো আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার! ”
– ” ব্যাস এই তো আমার সোনামনিটা অর্ধেকটা পটে গেছে। আপাতত আর কিছু লাগবে না! ” বলেই মুবিন শরীর টানা দিলো।
মিছিলের চোখ দুটো কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। সে কিনা অর্ধেকটা পটে গেছে? কই সে তো বিন্দুমাত্র টের পেলো না! তাহলে? তাহলে সে কীভাবে পটে গেলো? নাকি সে এখন এই পটাপটি নিয়ে ভাবছে তাই পটে গেছে? এভাবে ভাবা মানেই কী পটে যাওয়া? আসলেই কী সে অর্ধেক পটে গেছে? এসব লক্ষাধিক এমসিকিউ’র মতো প্রশ্ন মিছিলের মাথার চারপাশে নাগরদোলার মতো ঘুরছে। মিছিলের মুখটা মাঝারি ‘হা’ আকার ধারন করেছে। তার পুরোটা মুখে এক চরম বিস্ময়ের ছাপ। এর চেয়ে বিস্মিত সে ইহজীবনেও হয়নি বোধহয়। মুবিন মিছিলের এই ‘হা’ হয়ে যাওয়া দশা থেকে মিছিলকে বের করার জন্য মিছিলের থুঁতনি ধরে মিছিলের হা করে থাকা মুখটা প্রথমে বন্ধ করে দেয়। তারপর মিছিলের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ” এতো অবাক হলে চলবে মিছিল মনি? আমি তোমায় এতো এতো ভালবাসবো, এতো এতো ভাবে ভালোবাসবো যে তোমার ভালোবাসা নিয়ে সকল বিস্ময় নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে! ”
কথাটা শুনতেই মিছিল মেরুদন্ডে অদ্ভুত এক শিহরন অনুভব করে। ঠিক মেরুদন্ডের শিহরনের মতোই বুকেও শিহরন অনুভব করে মিছিল। তবে মেরুদন্ডের চেয়ে বুকের শিহরনের মাত্রাটা তীব্র সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই মিছিলের। মুহুর্তেই মিছিলের পিলে চমকে উঠলো ভয়ে। সে এই চরিত্রহীনের প্রেমে পড়তে শুরু করলো নাকি? না! না! কিছুতেই এর প্রেমে পড়া যাবে না। তাহলে জীবনের রঙ’ই পড়ে যাবে। প্রচুর পস্তাতে হবে। মুহুর্তেই মিছিল হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মিছিল বলে, ” আমি ফিল্ম দেখবো না। বাসায় যাবো আমি! ”
মুবিন মিছিলের হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে বলে, ” চুপচাপ বসে ফিল্ম দেখো। পিচ্চিটা ফিল্ম দেখতে এসেছে, ফিল্ম না দেখে চলে গেলে মন খারাপ হবে তো ওর! ”
অন্যসময় মুবিন যদি তার হাত ধরতো তাহলে সে নিশ্চই ক্ষেপে গিয়ে মুবিনকে কথা শোনাতো। কিন্তু কী মহাআশ্চর্য ব্যাপার সে এখন কিছুই বলতে পারছে না। মুবিনের এই অনধিকারচর্চাটাও যেনো কেমন অদ্ভুতভাবে অনিচ্ছাকৃতভাবে ভালো লাগছে তার। ভালো না অবশ্য, খুব বেশিই ভালো লাগছে। মুবিন মিছিলকে বলে, ” আচ্ছা যতক্ষন ফিল্ম চলছে ততক্ষন আমি আর তোমায় জ্বালাবো না। শুধু আমার হাতে থাকা পপকর্নের পট থেকে পপকর্ন নিয়ে খেতে হবে! ”
মিছিলের এবার একটু কথা শোনাতে ইচ্ছে হয় মুবিনকে। সে মুখটা মুবিনের কাছাকাছি তেড়ে নিয়ে বলে, ” মগেরমুল্লুক নাকি? আমি কেনো তোমার থেকে পপকর্ন খেতে যাবো? কে তুমি আমার? ”
– ” আপাতত বন্ধুই ভেবে নাও! ”
মিছিল কয়েকদানা লবনের পরিমান অবাক হয়। সে ভেবেছিলো মুবিন হয়তো বলবে, সে তার স্বামি,জামাই,প্রেমিক,সবকিছু,লাইফলাইন,হার্টওয়েভ, এইসেই,হ্যানত্যান কিন্তু না! মুবিন কী স্বাভাবিকভাবেই বলে দিলো ‘বন্ধু’। মিছিল কেমন যেনো পা পিছলে আরেকটু মুবিনের প্রেমে পড়ে গেলো। এই ছেলে জাদুটাদু জানে নাকি? কথাদিয়ে কীভাবে বশ করে নিচ্ছে আমাকে? এর কাছে কোনো পীর-হুজুরের তাবিজ নেই তো? মিছিল মুবিনের গলায় এবং হাতের কব্জিতে চোখ দিলো। না! তাবিজ তো নেই। তাহলে কীভাবে করছে এসব? মিছিল এসব নিয়ে গবেষণারত অবস্থায় থাকাকালীন সময়ে মুবিন বলে, ” চুপ হয়ে গেলে যে? তুমি কী ভেবেছিলে যে আমি প্রেমিক বা জামাই হই ওইটা বলবো? ”
মিছিলের ভেতরটা চমকে উঠলো। এই যা এই হারামাজাদাটা কী মনের কথাও শুনতে পায়? মিছিলের বুকের ধুকপুকানি’র মিছিলটা দ্রুতপায়ে এগোচ্ছে। মিছিলের এখন নিজেকে ক্লাস থ্রি-ফোরের ছোট বাচ্চা মনে হচ্ছে। যে বাচ্চাটা বাসা থেকে ২ টাকা চুরি করে হাতেনাতে ধরা খেয়েছে। ঠিক এমনই অনুভুতি হচ্ছে মিছিলের। মিছিল কিছুই বলছে না। কোথাও যেনো কথাগুলো জমাহয়ে আটকে যাচ্ছে। মুখের কাছে আসতেই পারছে না, তাহলে কী বুক থেকে গলা অবধি ট্র‍্যাফিক জ্যাম লাগলো তার? মিছিলের যে কেমন লাগছে মিছিল তা নিজের কাছেই ব্যাখ্যা করতে পারছে না। কারন এই অদ্ভুত অনুভুতির শিকার সে আগে কখনোই হয়নি। একদমই তাজা আর নতুন অভিজ্ঞতা। মিছিল কিছু বলছে না দেখে মুবিনই শাওনকে বলে, ” ওই পিচ্চিটাকে এনে আমার বাম পাশে বসিয়ে দে তো! ” মিছিল মুবিনের ডান পাশে বসা। মিছিল কিছুই বলছে না। খানিক নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে তো খানিক ফ্যালফ্যালিয়ে মুবিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। শাওন গিয়ে পিচ্চিটাকে বলে, ” চলো ভাইয়া তোমার দুলাভাইয়ের পাশে বসবা! ” পিচ্চিটা ফিক করে মুখ চেপে হেসে ফেলে। শাওনের মুখে কথাটা শুনতেই চমকে ওঠে মিছিল। দুলাভাই? এই হারামজাটা’র বন্ধুগুলাও তো খবিশ সোজা বিয়ে পড়ায় দিলো? পিচ্চিটা গিয়ে মুবিনের পাশে বসে পড়ে। ফিল্ম শুরু হয়ে গেছে। মিছিল একদৃষ্টে সামনে থাকা বড় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে বারবার আড়চোখে দেখছে মুবিনকে। মুবিনকে লুকিয়ে দেখতে গিয়ে মুবিনের কাছে ধরা পড়ছে বারবার। আর ধরা পড়তেই চোখটাও সড়িয়ে নিচ্ছে বারবার। সে মুবিনকে লুকিয়ে দেখছে? কেনো দেখছে? কী করেছে মুবিন তাকে? তাহলে কী কয়েক মিনিটের কথার মাধ্যমেই মুবিন তাকে পটিয়ে ফেললো? হায় হায় সে তো বড় মুখ করে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলো যে ছয়দিনেও মুবিন তাকে পটাতে পারবে না। তাহলে এখন কী হলো? কয়েকমিনিটেই তো পটিয়ে ফেললো? না! না! আমি মোটেই পটি’নি শুধুই ভুলভাল ভাবছি। এসব ভাবতে ভাবতেই ফিল্ম শেষ হয়ে যায়। মুবিন, শাওন, সীমান্ত আর পিচ্চি খুব ভালোভাবেই ফিল্ম ইঞ্জয় করেছে। পিচ্চিটা যদিও ইংরেজি বোঝেনি তবুও তাকে দেখে মনে হয়েছে এখানে বসা সবার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মজা নিয়ে ফিল্মটাকে উপভোগ করেছে এই পিচ্চি। পিচ্চিটার একটা জিনিসে মারাত্মক অবাক হয়েছে মুবিন, শাওন, সীমান্ত। যখনই স্ক্রিনে কোনো কিসিং বা ইন্টিমেট সীন আসতো এই পিচ্চি নিজে নিজেই নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলতো। মুবিন এর কারন জিজ্ঞেস করতেই পিচ্চিটা বলে, ” আমার আম্মু বলেছে আমি তো এখন ছোট। আর ছোট বয়সে বড়দের পাপ্পি দেওয়া দেখতে হয় না। দেখলে নাকি বড় হলে সব দাত পড়ে যায়! ”
পিচ্চির কথা শুনে ওরা তিনজন পুরো দশমিনিট হেসে গড়াগড়ি করছে। কিন্তু ওদের এই গড়াগড়ির দৃশ্য মিছিলের চোখে পড়েনি। কারন মিছিল এক আবছা ঘোরে ছিলো। যে ঘোরে থেকে মিছিল শুধুই ভেবেছে যে, ” আসলেই কী মুবিন তাকে পটিয়ে ফেলেছে? ”

মুবিন মিছিল সহ সবাই শপিংমলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুবিন মিছিলকে জিজ্ঞেস করে, ” কী দিয়ে বাসায় যাবে? ”
– ” স্কুটার দিয়ে! ”
মুবিন একটু গদগদ ভাব নিয়ে মিছিলকে বলে,” এই মিছিল একটা রিকোয়েস্ট রাখবে? প্লিজ! প্লিজ! ”
মিছিল ভ্রু-কুচকে বলে, ” কীসের রিকোয়েস্ট? ”
মুবিন একটু দাত কেলিয়ে শাওনের দিকে তাকায়। তারপর মিছিলকে বলে, ” শাওনের না বহুদিনের শখ স্কুটার চালাবে। আজ তোমার স্কুটারটা একটু ওকে চালাতে দেবে? প্লিজ! তুমি আমার সাথে গাড়িতে চলো না। ও তোমার স্কুটার নিয়ে আমাদের পিছু পিছু আসবে। ”
মুবিনের কথা শুনতেই চমকে যায় শাওন-সীমান্ত। শাওনের আবার কবে বহুদিনের শখ হয়ে দাড়ালো স্কুটার চালানো? এরকম শখতো শাওনের কোনোদিনও ছিলো না। মিছিল সঙ্গে সঙ্গে নিজের মাথাটাকে বাম দিকে ডান দিকে কয়েকবার নাড়িয়ে বলে, ” না! না! আমি পারবো না। ”
মুবিন শাওনের দিকে তাকিয়ে বলে, ” কীরে শাওন চুপ করে আছিস কেনো শালা? বল মিছিলকে, রিকোয়েস্ট কর মিছিলকে। মিছিলকে বল, স্কুটার চালানোটা তোর কতদিনের শখ! ” মুবিন শাওনকে এসব বলতে বলতে চোখ দিয়ে ইশারা করে বোঝালো যাতে শাওন বলেই। সে মিছিলকে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে যেতে চায়। আর শাওন যদি এখন মিছিলকে স্কুটার দিতে রাজি না করায় তাহলে সে শাওনকে ভর্তা করে শাওন ভর্তা খাবে। শাওনও বুঝে যায় ব্যাপারটা। শাওন আকুতির স্বরে মিছিলকে বলে, ” জানো মিছিল আমি লঞ্চ,স্টিমার, রেসিংকার, ঠেলাগাড়ি, রিকশা, সাইকেল সবকিছু চালিয়েছি। একদম সবকিছু এমনকি আমি যুদ্ধবিমানও চালিয়েছি শুধু এই স্কুটার চালানোটাই বাকি। প্লিয বোন না করিও না। আর মুবিন তো বলছে যে তোমায় ওর গাড়ি করে ড্রপ করে দেবে! ”
– ” কীহ? তুমি যুদ্ধবিমান চালিয়েছো? ”
শাওন দাত কেলিয়ে খিটখিট করে হাসে। মুখে হাসি বজায় রেখেই বলে, ” আরে তুমিও না একদম সরল-সিধা। যুদ্ধ বিমান চালিয়েছি মানে হল ভিডিও গেমে চালিয়েছি। প্লেস্টোরে পাওয়া যায় তো, এপল স্টোরেও পাবে। আমি প্লেস্টোর থেকে নামিয়ে খেলেছি মাত্র ৩৬২ এম্বির গেমস। আহ কী চরম গ্রাফিক্স, কী চরম গেমপ্লে কী বলবো! ”
– ” আচ্ছা! আচ্ছা! তুমি স্কুটার চালিয়ে শখ পুরন করে নাও। তবে স্কুটার নিয়ে যদি কোথাও পড়ে গিয়ে স্কুটারে দাগ বা স্ক্র‍্যাচ করিয়েছো তাহলে রিপেয়ার বিল তোমার! ”
– ” একদম। আরে রিপেয়ার কী বলছো? আমি নতুন স্ক্রুটার কিনে দিবো একদম যদি একটু স্ক্র‍্যাচ’ও হয়! ”

মিছিল আর কথা না বাড়িয়ে পিচ্চিটাকে নিয়ে গাড়ির দিকে হাটা ধরে। মুবিন গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। মিছিল পিচ্চিটাকে গাড়ির পিছনের সিটে বসিয়ে দেয়। যেই মিছিল উঠতে যাবে তখনই মুবিন বলে, ” এই মিছিল তুমি পিছনে উঠছো কেনো? তুমি সামনে বসো! ”
মিছিল বিরক্তি নিয়ে বলে, ” কোন দুঃখে? ”
– ” সীমান্ত না সামনে বসতেই পারে না। একদম গলগল করে বমি করে দেয়! ”
মুবিন সীমান্তর দিকে তাকিয়ে বলে, ” কীরে শালা বল। তুই সামনে বসে কেমন প্রেগন্যান্ট মহিলাদের মতো বমি করিস! ”
সীমান্ত তুহিনের সাথে তাল মিলিয়ে বলে, ” হ্যা মিছিল। আমি সামনে বসতে পারি না। একটু কষ্ট করে সামনে বসো! ”
মিছিল সব বুঝতে পারছে যে মুবিন এসব ইচ্ছে করে করছে। মিছিলের ভেতরে কেমন যেনো ভালো লাগা অনুভব করছে মিছিল। ভেতরে একটু অপ্রকাশ্য মুচকি হেসে মিছিল গিয়ে গাড়ির সামনে বসে পড়ে। মুবিন উঠে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করে। একদমই ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে মুবিন। এরকম ধীর গতিতে গাড়ি চালাতে দেখে মিছিল মুবিনকে একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন ছুড়ে মারে, ” আশ্চর্য! এতো আস্তে আস্তে কেনো গাড়ি চালাচ্ছো? ”
মুবিন চমকে গিয়ে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, ” তুমি আমায় ভালো না’ই বাসতে পারো মিছিল। কিন্তু তা বলে মেরে ফেলতে চাচ্ছো আমায়? তুমি জানো না একটি দুর্ঘটনা, সারাজীবনের কান্না! ”
মিছিল মুবিনের দিকে তাকিয়ে নাক ছিটকে, মুখ ভেংচে বলে ” ন্যাকামি যত্তসব! ”
মুবিন মুচকি হাসে। ২৫ মিনিটের রাস্তা ৪০ মিনিট ড্রাইভ করে এসেছে মুবিন। ইচ্ছে করেই এসেছে। কারন সে ড্রাইভ করছিলো আর মিছিলকে দেখছিলো। প্রানভরে দেখে নিচ্ছিলো। এতোদিন তো শুধু কন্ঠ’ই শুনেছে। আজ সুযোগ হয়েছে তার সৌন্দর্য খুটিয়ে দেখার। সে সুযোগ মোটেই হাত ছাড়া করেনি মুবিন।

শাওন মিছিলকে মিছিলের স্কুটার বুঝিয়ে দিয়েছে উইথয়াউট এনি স্ক্র‍্যাচ। পিচ্চিটা বাসার সামনে আসতেই দৌড়ে ভেতরে চলে গেছে। মিছিলও স্কুটার হাটিয়ে নিয়ে ভেতরে যাচ্ছিলো। মুবিন পিছুডাকে। মিছিল ফিরে তাকায়, ভ্রু-কুচকে নিক্ষেপ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। মুবিন হেসে বলে, ” নাম্বারটা দিয়ে যাও না। রাতে একটু প্রেম প্রেম খেলবো! ”
মুবিনের কথা শুনতেই মিছিলের চোখের জিজ্ঞাসাবোধক চিহ্ন উঠে গিয়ে আগুন জ্বলে যায়। মুবিন সে আগুনকে উপেক্ষা করে মায়াজড়ানো কন্ঠে বলে, ” কথাদিচ্ছি বিরক্ত করবো না। ভদ্রভাবে চাচ্ছি দিয়ে দাও। আমি যদি অন্যভাবে নেই তাহলে প্রচুর বিরক্ত করবো! ”
মিছিল স্কুটার স্ট্যান্ড করে মুবিনের সামনে তেড়ে গিয়ে বলে, ” এই ছ্যামড়া কে ভয় পায় রে তোর ডিস্টার্ব করা? আমায় কী আর পাচটা অর্ডিনারি মেয়ের মতো পাইছিস? ”
– ” দেখো মিছিল তুই তোকারি করবা না। শুনতে কেমন যেনো রুড লাগে! ”
– ” হাজার বার করবো। তুই আমার ব্যাচমেট। আমি তোকে তুই বলতেই পারি! ”
মুবিনের রাগ এসেছে খানিক। কিন্তু সে চাইলেও রাগটা মিছিলের ওপর ঝাড়তে পাড়ছে। রাগটা ভেতরে কোথাও একটা আটকে যাচ্ছে। বাইরে আসতেই চাচ্ছে না। মুবিন চুপ করে আছে। মিছিলও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দুদিকেই নিরবতার দেয়াল। মিছিল নিরবতার দেয়াল বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দিয়ে বলে, ” তোর ফোন দে! ”
মুবিন পকেট থেকে ফোন বের করে মিছিলের হাতে দেয়। মিছিল নাম্বার উঠিয়ে ডায়াল করে দেয়। তারপর ফোনটা মুবিনের হাতে দিয়ে বলে, ” আমি ১১ টা অবধি পড়ি। তারপর খেয়েদেয়ে ১২ টার দিকে ফ্রি হই। তার আগে যদি ফোন দেস তাহলে ফোনের মধ্যে ঢুকে তোর দাত ভাঙবো! ” বলেই মিছিল হাটা ধরে। সে বাসায় ঢুকবে, বাসায় ঢোকার যেনো মস্ত তাড়া তার। মুবিন আবার পিছুডেকে বলে ফেসবুক আইডিটা বলে যাও না। মিছিল পিছনে না তাকিয়েই বলে, ” মিছিল মেহরিন! ”

চলবে!
#thetanvirtuhin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে