কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-১৭+১৮

0
256

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৭

ভোরের আলো ফোটার আগেই চোখ মেলল নুপুর। রাতের অর্ধেকের বেশি তার জেগেই কেটেছে। এইতো ঘন্টা খানেক আগেই নিশ্চিন্তে ঘুম নেমেছিলো চোখের পাতায় আবার তা হুট করেই পালিয়ে গেল। কানে আসছে একটা দুটো পাখির ডাক। ফজরের আজান কি হয়ে গেল! পাশ ফিরে ডান দিকে তাকাতেই ঝাপসা আঁধারে চোখে পড়লো অর্নিতার মুখটা। আঁধার কাটছে ধরণীতল ছাড়িয়ে তারই প্রমাণ ওই হলুদাভ মুখটার অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। জীবনে এই প্রথমবার তার বাড়ির বাইরে অল্পচেনা এক বাড়িতে রাত কাটলো। প্রথমবার বলেই ঘুমটা হলো না ঠিকঠাক তবুও চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। মাথার কাছটা হাতড়ে ফোনটা নিয়ে সময় দেখলো ভোর চারটা পঁয়তাল্লিশ। আজান কখন হয় সঠিক সময় জানে না সে। প্রতিদিন তো পাঁচটায় এলার্ম বাজে তখন উঠে নামাজ আদায় করে পড়তে বসে। আজান এর আগেই হয়ে যায় তা জানা আছে৷ এখন আর ঘুম আসবে না খুব করে বুঝতে পারছে সে তাই বিছানা থেকে নামলো। ওয়াশরুমে যাওয়ার তাড়া নেই কিন্তু ঘরটাতে বসতে ইচ্ছে করছে না৷ অর্নির ঘরে লাগোয়া ছোট্ট একটা বারান্দা আছে নুপুর পা বাড়ালো সেদিকেই। ঝাপসা আঁধার কেটে অলস পায়ে বারান্দার দরজা খুলে সেখানে দাঁড়াতেই শীতল বাতাসের আলিঙ্গনে গা শিউরে উঠলো। বাতাসে বৃষ্টির আগমনী বার্তা ছুঁয়ে গেল নুপুরের পাতলা দেহ। ঘরের কৃত্রিম বাতাসটাকে তিরস্কার করতেই যেন এ বাতাসের দমক। নুপুর তাজা হাওয়ায় সতেজ মন নিয়ে আঁধারে নজর বুলালো চারপাশে। ভোরের এ কালোরঙে এক ফোটা চুন সাদার ছোঁয়া লেগে আশপাশের সবটা স্বচ্ছ হয়ে অক্ষিকোটরে ধরা দিচ্ছে। দোতলা বাড়িটার এটা পেছন দিক দেখতেই বোঝা যায়। আগের বার এলেও বারান্দা দর্শনের সুযোগ হয়নি তার। আজ সুযোগ মিলল বলেই হয়ত ঘোর লাগা চোখে দেখছে এদিকটা। খোলা জায়গা অনেকটা তার পরই অনেকগুলো গাছের গুঁড়ি তার পেছনেই আরও নতুন কিছু চারাগাছ। হঠাৎ…. ঘোলাটে আঁধার ছাপিয়ে ভেসে এলো এক ছায়া মানব। এক মুহূর্তের জন্য ছায়া মানবই মনে হলো নুপুরের ওই গোঁফওয়ালা জল্লাদটাকে। কিন্তু এত ভোরে ওই মানুষটা কোথা থেকে এলো! রাতের অর্ধেকটা তো ছাদেই কাটলো এরপরও কি ঘরে থাকেনি? আনমনেই ভাবনা টেনে আরও কিছু ভেবে চুপিসারে পা বাড়ালো নিচে নামার জন্য। এক পলক দেখে নিলো অর্নিতাকে। ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে তারমানে গাঢ় ঘুমেই আছে মেয়েটা। অর্ধপরিচিত জায়গায় এমন সাহস দেখানোটা বোকামি হলো কিনা একটিবারও না ভেবেই নুপুর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধতার চাদরে ঢাকা সেই নিস্তব্ধতার দেয়াল মাড়িয়ে নুপুর বের হলো সদর দরজা খুলে। অর্ণব যেখানে দাঁড়ানো সেখানটাতে যাওয়ার রাস্তা কোনদিকে তা ঠাওর করা গেল না এক দিকে সামনের দিকের ফুল বাগানটা আর অন্যদিকটায় সরু ড্রেন দেখে। মিনিট দুয়েক হতাশ চোখে তাকিয়ে থেকে সে পা বাড়ালো সরু ড্রেনের পাশ ঘেঁষে। এক পা দু পা করে পুরো বিল্ডিংয়ের দেয়াল ঘেঁষে পৌঁছে গেল বাড়ির পেছনে। খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই দেখা গেল ওই তো অর্ণব এখনো আগের জায়গায় বসে আছে। নুপুর এবার আরও কয়েক কদম দ্রুত এগোতেই পায়ের তলায় শুকনো পাতা মড়মড়, খচখচ আওয়াজ তুলে চুরচুর হয়ে গেল। কাল না বৃষ্টি হলো তবুও পাতাগুলো শুকনো! বোকা শ্যামাঙ্গীনি খেয়ালও করলো না পায়ের তলায় প্লাস্টিকে ঢাকা ওই শুকনো পত্রদল এই নিশিসমাপ্তির নীরবতাকে ভেঙেছে আক্রোশে। তবে জানতে পারলো সামনের ওই মানুষটা আকস্মিক এই ছন্দ তোলা রুঢ় আওয়াজে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকেই দেখছে লোকটা। চৌকশ নজর তাকে ঘিরেই গম্ভীরতায় ডুবেছে।

-এখানে কি করছ?

স্বভবসুলভ ভারী স্বরটায় দ্বিগুণ ভার মনে হলো নুপুরের। তৎক্ষনাৎ জবাব এলো না তার ঠোঁটের ডগায়। অর্ণব আবারও একই প্রশ্ন করলো,

-এখানে কি করছ!

-এখানে….

ঠিকঠাক কোন উত্তর মুখে আসছে না নুপুরের। অর্ণব উত্তরের অপেক্ষা করলো না।

-ঘরে যাও।

-রাতে ঘুমাননি?

– ঘুম আসছিলো না।

– মন খারাপ?

ছোট্ট প্রশ্নটায় আহ্লাদের ছোঁয়া ছিল কি! কখনো কারো সাথে অবাধ কথাবার্তায় না জড়ানো অর্ণব আলগোছে বলে দিলো মনটা তার সত্যিই খারাপ। কাল রাতে যা হলো তা কি ভালো হলো! অর্নিতা আত্মকেন্দ্রিক স্বভাবের এ কথা সবারই জানা।বোনটার বয়সটা কম, পড়াশোনার স্বপ্ন তার দীর্ঘ সব জেনেও অর্ণব বাবা-মা’হীনতার কমতি দেখিয়ে যে যা বলল তাই চাপিয়ে দিলো বোনটার ঘাড়ে। ফলশ্রুতিতে কাল রাতের সে অঘটন দেখতে হলো। এটা যে ভীষন অন্যায় হলো তা ভেবেই মনটা বেশি খারাপ অর্ণবের। আঁধার হালকা হচ্ছে সেই সাথে কানে আসছে মুয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠে ফজরধ্বনি। কথার মাঝেই থেমে গেছে অর্ণব। নুপুরও আলতো হাতে গলার ওড়নাটা তুলে দিলো মাথার ওপর। বিড়বিড় করে জবাব দিতে থাকলো আজানের সেই সাথে কেটে গেল পাশাপাশি কিছু মুহূর্ত। আজান শেষ হতেই নুপুর মুখ খুলল এবার।

– আপনার বোধহয় আর মন খারাপ করার দরকার নেই।

অর্ণব ফিরে তাকালো মেয়েটার দিকে। বড্ড চঞ্চল, ফরফরে, চটপটে এই এতটুকু মেয়ে কি করে হতে পারে বোঝে না সে। কই অর্নিতা বা বৃষ্টিকে তো কখনো এত কথা বলতে শোনেনি৷ অবশ্য কলেজে তার এক ক্লাসমেট ছিল এমন বাঁচাল স্বভাবের। মেয়েটা যেচে পড়ে সবসময়ই তার সাথে কথা বলতে আসতো আর এজন্য অর্ণব মেয়েটার ওপর খুব বিরক্তও থাকতো৷ এছাড়া ইউনিভার্সিটি জীবনে তার তেমন কোন মেয়ের সাথে পরিচয় হয়নি। হওয়ার সুযোগই ছিল না কারণ বি.এ পড়াশোনা ছিল তার জন্য শুধুই সার্টিফিকেট সংগ্রহের একটা মাধ্যম৷ ক্লাশে সে হাতে গুণে দশ দিনও ছিল কিনা সন্দেহ৷ সারা বছর দু ঘন্টার কোচিং করেই পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে। কাঁধের ওপর ব্যবসায়ের ভার তাকে সে বয়সেই দায়িত্বশীল পুরুষ বানিয়ে দিয়েছিলো। ঠেকায় পড়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুবাদেই কারো সাথে সখ্যতা নেই, জানা নেই এ ধরাধামে কত রকমের মেয়ে হতে পারে। আজ নুপুরের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল এই মেয়েটা নিশ্চিত পাগলাগারদ ফেরত। কথাটা ভাবতেই তার ঠোঁট ফিচলে হাসির উদ্বেগ প্রকাশ পেলো। নুপুর তখনও বলে চলছে, ‘আমার কথা শুনে আপনার এই মুহূর্তে সকল টেনশন শেষ হয়ে যাবে।’

-তাই!

-সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না আমার কথা? সত্যি বলছি।

-আমার টেনশন কি নিয়ে?

-অর্নিতা খুশি আছে কিনা এটা নিয়ে ভাবছেন আপনি তাই না!

-হু। তা টেনশন না করতে বলার কারণ কি?

– কারণ…… বলে দেব?

-বলো।

— বলবো?

-সমস্যা কি!
রাগত স্বর অর্ণবের।

-আচ্ছা বলছি….

একটু থেমে নুপুর এবার কিছুটা চেঁচিয়েই বলল, অর্নিতা এই বিয়েতে খুশি আছে। রিদওয়ান ভাইয়াকে বর হিসেবে তার খুব পছন্দ।’

হতাশ চোখে অর্ণব তাকালো নুপুরের দিকে। এই কথাটা এভাবে চেঁচিয়ে বলার কি দরকার ছিল! এই কাক ডাকা ভোরে বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে চারপাশ নিস্তব্ধ। এমন অবস্থায় একটু আওয়াজও অনেকটা জোরে শোনায় তাই কথাটা আস্তে বলা উচিত। এতটুকু কমনসেন্স নেই মেয়েটার মাঝে? আধপাগলি বটে! শান্তশিষ্ট অর্নিটার কপালে এমন বান্ধবীই জুটলো! অর্ণব যখন আফসোসের থালা সাজায় নুপুর তখন আরও একবার তাকে ভরকে দিয়ে বলে বসলো, জানেন কাল অর্নিতা বাসর গিফট হিসেবে রিদওয়ান ভাইয়ার কাছ থেকে কি পেয়েছে?

– চুপ…. একদম চুপ। কাকে বলছো হুঁশ নেই তোমার?

আচমকা ধমক ঠিক হজম হলো না নুপুরের। কপাল কুঁচকে, মুখ ফুলিয়ে বলল, কেন কি হয়েছে?

-ছোট বোনের বাসর রাতে কি পেল না পেল সেটা কি তার ভাইকে বলা যায়?

-কেন যাবে না? চমৎকার একটা গিফট বললে সমস্যা কি?

– চুপচাপ ঘরে যাও।

এবারের ধমকটা ভয়ংকর মনে হলো নুপুরের। সে আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না বলে পা বাড়ালো চলে যেতে।

-ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?

ড্রেনের দিকে যেতে দেখেই অর্ণব তাকে ডেকে উঠলো। নুপুর পেছনে না ফিরেই জবাব দিলো, আপনিই না বললেন ঘরে যেতে।

-তাই বলে ড্রেনের পাশ দিয়ে! তুমি ওদিক দিয়েই এসেছিলে?

-হ্যা। তো আর কোথায় রাস্তা আছে?

-বোকার হদ্দ….
অস্ফুটে আওড়ালো অর্ণব তারপরই আবার ডাকলো, আমার সাথে এসো।

বাগানের ভেতর দিয়েই অল্প একটু পথ যা বাড়ির সামনে থেকে পেছনে আসার রাস্তা। অর্ণবের পিছু যেতে যেতে এবার দুঃখ হলো নুপুরের। এত সুন্দর রাস্তা রেখে সে কিনা ড্রেন ঘেঁষে গিয়েছিল! ইশ, যদি পা ফসকে নিচে পড়ে যেত? ইয়াক….. ভাবতেই তো গা গুলিয়ে আসে।

বাগান পেরোতেই অর্ণব তাকে ইশারা করলো ভেতরে যেতে। নিজেও চলে গেল গেইট পেরিয়ে বাড়ির বাইরে। পুরো বাড়ি শুনশান তখনো কেউ ঘুম থেকে জেগে উঠেনি। নুপুর নিঃশব্দে দোতলায় উঠে ঢুকে গেল অর্নিতার ঘরে।

____________

হাতের মুঠোয় টাইটাকে লাগছে গলার ফাঁস, টেবিলের ওপর থাকা নীল রঙের ফাইলটাকে মনে হচ্ছে জজের লেখা শাস্তিনামা। যেখানে লেখা আছে তার জন্য বরাদ্দকৃত শাস্তির কথা। আসলেই তাই! কত বছরের চাওয়া তার আবেগমাখা প্রেম পথ বদলে সরাসরি বৈধ নথি হয়ে জীবনে এলো অথচ ভোর না হতেই তাকে শহর ছাড়তে হচ্ছে৷ এ শহরে তার কাল রাতে যুদ্ধ শেষের উপহারটা রয়ে যাবে আর সে সপ্তাহ জুড়ে পড়ে থাকবে চট্টগ্রামের কোন এক পাহাড়ি খাদে! প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে রিদওয়ান টাইটা রেখে দিলো ব্যাগের ভেতর। এখন ফ্লাইট ধরে প্রথমে যেতে হবে চট্টগ্রাম সুনামধন্য একটি পাঁচ তারকা হোটেলে। সেখানে ঘন্টা দুই রেস্ট নিয়ে মিটিং শুরু করতে হবে খাগড়াছড়ির নতুন প্রজেক্টের। সে ভেবে পায় না কাল পর্যন্ত যে প্রজেক্টকে আব্বু অপশনাল ফেলে রাখলো অর্ধরাতেই তা জরুরি কি করে হতে পারে? রাতভর ঘুম হয়নি তার এরই মাঝে রাত চারটায় আব্বুর কল, বাড়ি যাও এখন এবং ভোর সাতটার আগেই ব্যাগ, ল্যাপটপ আর কাগজপত্র গুছিয়ে রওনা হও চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। ব্যস, রিদওয়ানও তাই করল বিনা প্রশ্নেই। এর পেছনে অবশ্য একটা সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। কাল রাতে হুট করেই মা আর ভাইটার সাপোর্টে সে জীবনের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটা নেওয়ার সময় একটিবার আব্বুর অনুমতি নেয়নি। এমনকি চোখ মেলে একটিবার তাকায়নি সে আম্মুর কথা মেনে। হ্যাঁ এ কথা সত্যি কাল যদি সে আব্বুর দিকে তাকাতো তবে হয়তো অর্নিকে আর নিজের জীবন পৃষ্ঠায় টুকে নেওয়া সম্ভব হতো না। কিন্তু আজকের এই দূরে যাওয়ার শাস্তি অর্নিকে পাওয়ার জন্য একদমই কিছু না৷ আব্বু যদি অর্নিতাকে বিয়ের শাস্তি এরচেয়েও বড় কিছু দিতো সে অনায়েসেই মেনে নিতো এমনটা ভাবতে ভাবতেই তৈরি হয়ে গেল রিদওয়ান৷ ঠিক সাড়ে ছয়টায় রওনা দিলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। সে জানতেই পারলো না এই শাস্তির পেছনেই জমে আছে আরও কোন বড় শাস্তি৷ শুধু সময়ের অপেক্ষা!

_________________

নাস্তার প্লেট হাতে নিয়ে এবার চরম বিরক্ত হলো নুপুর। সেই কখন অর্নিতাকে বলল, চল একসাথে খাই আমি একটু পরই চলে যাব। অর্নিতা বলল, ‘আয় খাই’ এ পর্যন্তই। রুজিনা খালা ঘরেই এনে দিল দুই বান্ধবীর জন্য পরোটা, সবজি, বুটের ডাল অথচ অর্নিতা ফিরেও দেখছে না খাবারে৷ এই মেয়ে নাকি কখনো কাউকে ভালোবাসেনি নুপুর এ কথা আজ এ ক্ষণে একদমই মানতে পারছে না। রাতে হুট করে বিয়ে হলো, বর কি এক উপহার দিল সেই থেকে মেয়েটার মাথাই গেছে! পরাস্ত নিঃশ্বাস ফেলে নুপুর পরোটার প্লেট হাতে বসলো বিছানায় অর্নিতার মুখোমুখি৷ পরোটা একটুখানি ছিঁড়ে তাতে সবজি নিয়ে অর্নিতার মুখের কাছে ধরলো এবার।

-হা কর।

বান্ধবীর আদেশ শুনতেই ঘোর কাটে অর্নির।
-তুই খা আমি পরে খাব।

-হু পরে যে কি খাবি তুই তাতো দেখছিই। কি এক চকচকে একশো টাকা দিলো তাতেই তোর মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে।

– টাকার পরিমাণ দেখছিস কেন! লেখাটা পড়।

-আর লাগবে না বইন মাফ চাই। সেই রাত তিনটা থেকে এখন সকাল আটটা পর্যন্ত কম করে হলেও এক’শবার এক’শ টাকার ভেতরে লুকায়িত চিঠিপত্রের খবর বলছিস। আর না এবার ক্ষ্যামা দে, খাবার খা আর আমারে যাইতে দে।

একদমে সবটা বলে তবেই থামলো নুপুর। তার কথা শুনে অর্নিতার গাল লাল হয়ে উঠলো। লজ্জা পাচ্ছে সে এখন৷ এ কথা তো সত্যি এই টাকা নিয়ে সে কুব জ্বালিয়েছে নুপুরকে তাই বলে এভাবে বলতে হবে নাকি? সে লজ্জা পায় তো!

– এভাবে বলিস কেন তোর বেলায়ও দেখব কিন্তু।

-অবশ্যই দেখবি। কিন্তু আমি বইন বারবার দেখামু না জামাইর দেয়া জিনিস। আচ্ছা অনেক হইছে এবার চল নাশতা কর আমি চলে যাব৷

এবার আর বিলম্ব হয়নি অর্নিতার। সে নুপুরের সাথে নাশতা শেষ করেই ছুটলো ভাইয়ের খোঁজে। অর্ণব বাড়ি নেই তবে রিমন এখনো আছে দেখে স্বস্তি পেলো সে। নুপুরকে একা ছাড়তে মন সায় দেয় না তার। আঙ্কেলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিজেই খালামনিদের গাড়ি পাঠিয়ে এনেছে মেয়েটাকে। ভেবেছিলো যাবার বেলায় ভাইয়া তাকে পৌঁছে দেবে। এখন তো দেখা যাচ্ছে ভাইয়া তার বাড়িতেই নেই। অনেকটা জোর করেই সে নুপুরকে রাজি করালো রিমন ভাইয়ের সাথে যাওয়ার জন্য। রিমন গাড়ি এনেছিলো তার তাই যাওয়ার বেলায়ও গাড়ি বের করলো৷ গেইটের বাইরে গাড়ি নিয়ে সে অপেক্ষা করলো নুপুরের জন্য কিন্তু মেয়েটার তো দেখাই নেই। অফিসের দেরি না হয়ে যায় ভেবেই সে অর্নিতাকে কল করতে ফোন হাতে নেয়। তখনই ঠিক চোখে পড়ে গেইট পেরিয়ে এগিয়ে আসছে নুপুর। রিমন নিজেই এবার ড্রাইভিং সিট থেকে কাত হয়েই পাশের দরজা খুলে দেয়।

– এই পিচ্চি সামনেই বসো।

-আমি পিচ্চি? গাড়ির ভেতর বসতে গিয়েই প্রশ্ন করে নুপুর।

-পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চি পিচ্চি নয়তো কি!

-হা…. ঠিকঠাক কি করে বললেন ভাইয়া। আপনি তো ভীষণ জিনিয়াস!

-ট্যালেণ্ট পিচ্চি বুঝলে!

কথায় কথায় বেশ জমে গেল দুজনের। রিমন মনোযোগে ড্রাইভ করতে করতেই বেশ গল্প হলো। তারা যেতে যেতে পেছনে ফেলে গেল একরাশ কনফিউশান যা একটা সময় নুপুরের জীবনে প্রভাব ফেলবে আশ্চর্যজনকভাবে তা ঘুণাক্ষরেও টের পেল না কেউ। নুপুর যখন গেইটের বাইরে রাস্তার পাশ থেকে রিমনের গাড়িতে বসলো তখন রাস্তার অন্যপাশ থেকে এক জোড়া চোখ দেখলো তাকে। তৎক্ষনাৎই ফোন করলো তার বসকে। রিমনের বর্ণনা দিয়ে আজও সেই লোকটা নুপুরকে অর্নিতা ভেবেই খবর পৌঁছালো ওপাশের ব্যক্তিটিকে। লোকটাও সহাস্যে জানিয়ে দিলো, ‘খালাতো ভাইয়ের সাথে যাচ্ছে! তাহলে বোধহয় খালার বাড়িই ফেরত যাচ্ছে৷ ওর ওপর বাদ দে শুধু অর্ণবের ওপর নজর রাখলেই চলবে তোর।’

চলবে
#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৮

” আমি -রিদওয়ান শেখ আজ থেকে তোর সকল স্বপ্ন পূরণ করার দায়িত্ব নিলাম। তুই – অর্নিতা চৌধুরীশেখ’কে আমার সম্পূর্ণ জীবনের দায়িত্ব দিলাম এই মর্মে এই পত্রে স্বাক্ষর করলাম।”

সত্যিই ছোট্ট করে একটা স্বাক্ষর করেছে রিদওয়ান উপরোক্ত লাইনদুটোর নিচে। এক’শ টাকার নোট যেন তার কাছে সরকারি কোন রেজিস্ট্রার পেপার ছিল সেই রাতে। অর্নিতার হাতে এই নোট গুঁজে দিয়েই চলে গিয়েছিল রিদওয়ান। অর্নিতা অপ্রস্তুত ছিল তবুও যেন একটুখানি প্রস্তুত ছিল রিদওয়ান হয়তো তাকে স্পর্শ করতে চাইবে। খুব না হোক একটু হাতটাই না হয় ছুঁয়ে দেখবে। এমন কিছুই করেনি মানুষটা। কত আরাধ্য জিনিস হাতের কাছে পেয়েও কেমন নিরাসক্ত হওয়ার ভাণ করেই নোটখানা হাতে দিয়ে চলে গেছে। সেই থেকে নিঃশব্দেই যেন কেটে গেছে তিনটা দিন। অর্নিতার মনের ভেতর শিবলীর সাথে বিয়ে নিয়ে যে চাপা ভয়, আতঙ্ক ছিল সবটাই উবে গিয়ে এখন অন্যরকম অপেক্ষা তৈরি হয়েছে। কখনো একটি ফোন কলের অপেক্ষা কখনোবা মানুষটা নিজেই সম্মুখে উপস্থিত হবে সেই অপেক্ষা। ভেতর -বাহিরে অপেক্ষার সাথে যুক্ত হয়েছে লজ্জারুণ শিহরণ। বিয়ে নিয়ে আগে কখনো আবেগের আভাস ছিল না অর্নির। বারংবার মনে হতো বাবা-মা’হীন জীবনে বিয়ে তার জন্য শুধুই একটি ফরমালিটি যার মাধ্যমে তার জীবনের বাকি দিনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নির্দিষ্ট একজনকে হস্তান্তর করা মাত্র। যেই মুহূর্তে সে রিদওয়ানের নামে কবুল পড়লো ঠিক তখন থেকেই যেন বদলে গেল ভাবনারা। সত্যিই বদলেছে তার ভাবনা সেই সাথে বদলেছে জীবনের গতিবিধিও। রিদওয়ান পরের দিন ভোরেই শহর ছাড়লো। অর্নিতা থেকে গেল নিজ বাড়িতে আর চলে গেল তার শ্বশুর বাড়ির প্রত্যেকেই। সেদিন থেকে আবার শুরু হলো নতুন নিয়ম। দাদী শিখিয়ে দিলো খালামনিকে ‘আম্মু আর খালুজানকে আব্বু ডাকবি’। অর্নি অনেক চেষ্টা করে খালামনিকে আম্মু ঠিকই ডাকতে পারলো কিন্তু খালুজানকে বহু কষ্টে বাবা ডাকতে পেরেছে। আব্বু তার মুখে কিছুতেই যেন এলো না আর। তবুও খালুজান খুশি হয়ে তাকে নাশতার টেবিলে হাজার টাকার দুইটা নোট সালামি দিয়েছে। সম্পর্কে এখন সে শেখ বাড়ির বড় বউ বলে রিমন আর বৃষ্টিও হাসি ঠাট্টায় নাশতার সময়টুকু আদায় করে নিয়েছিল। প্রত্যেকের আচরণে বেশ লজ্জা লাগছিল তার। সেই লজ্জার আঁচ তার মুখশ্রীতে প্রভাব ফেলতেই ছোট দাদী তৃপ্তির হাসি হেসেছিলেন। মানুষটা শুরু থেকেই অর্নির পাশে শিবলীকে অপছন্দ করতেন কিন্তু রিদওয়ানকে অর্নিতার জোড় হিসেবে একটুও অপছন্দ হয়নি তাঁর। কিন্তু এই যে, এত সুখ সুখ অনুভবে রিদওয়ান অনুপস্থিত তাতে বিশেষ ভালো ঠেকছে না দাদীর। তিনি গত দু দিনে অর্ণবকে খুব জ্বালিয়েছেন এই নিয়ে। কথায় কথায় বলেছেন অর্নিতা -রিদওয়ানের বড় করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে৷ বাশার শেখ নিজে থেকে এই বিয়ে নিয়ে কিছুই বলেননি সে ব্যাপারটাও দাদীর ভালো ঠেকছে না। যেভাবেই হোক বিয়েটা তো হয়েছে এবং পরিবারের সামনেই হয়েছে। তারপরও কেন রিদওয়ানের বাবা পরবর্তী কোন পরিকল্পনা জানাচ্ছেন না! অর্নিতা আজ কলেজ থেকে ফিরে দাদীর ঘরে এলো প্রথমেই। ঝুড়িভর্তি সুপারি নিয়ে বসেছেন তিনি সেগুলোকে টুকরো করতে। এক দুপুর খুব চেঁচিয়েছেন রুজিনা খালার ওপর সুপারি কেন কাটা হয়নি। এরপর নিজেই দুপুরে খাবার খেয়ে এগুলো নিয়ে বসেছেন।

– কি করো দাদী?

– একি! কাপড় বদলাস নাই ক্যা?

-মাত্রই এলাম তো। একটা কথা বলার ছিল তাই ভাবলাম আগে বলি।

-কি কথা?

-রিদওয়ান ভাই ফোন করেছেন একটু আগে।

লজ্জা লজ্জাভাব অর্নিতার চোখে মুখে। এমন লজ্জা পছন্দের মানুষ ছাড়া অন্যের জন্য পায় না মেয়েরা। বৃদ্ধা নিশ্চিত শিবলীর সাথে বিয়েটা হলে এমন অর্নিকে তাদের দেখা হতো না। মনে মনে তিনি এখন প্রশান্তি অনুভব করছেন, যাক একটা হাত সঠিক জোড়ায় মিলে গেছে এবার নাতিটার কিছু হোক। দাদী সহাস্য উজ্জ্বল মুখে বললেন, ‘ কি কইলো নাত জামাই কবে আসব সে? বিয়া কইরাই তো ফুড়ুৎ হইলো পাখি।’

– আমাকে দেখা করতে বলেছে বিকেলে।

-বুঝলাম না!

-ইয়ে… আসলে দাদী উনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন এ কথা নাকি বাড়িতে কেউ জানে না।

-তাইলে তোরে কই যাইতে কয়?

– উত্তরা….. অর্নির কথা শেষ হয়নি তার আগেই হাতের ফোনটা বাজলো আবার। অর্নি দেখলো রিদওয়ান কল করছে। দাদী ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জামাই ফোন দিছে?’

অর্নিতা মাথা দোলায়, হ্যাঁ জানায়। দাদী ইশারা করলেন কথা বলে নে। অর্নিতা কল ধরলো সালাম দিলো৷ রিদওয়ান প্রথমেই প্রশ্ন করলো, বলেছিস দাদীকে?

-না।

– তোর বলতে হবে না ফোন নিয়ে দাদীর কাছে যা।

-পাশেই আছে।
– দে

অর্নিতা ফোনটা দাদীর দিকে বাড়িয়ে ধরলো।

-কি? দাদী জিজ্ঞেস করলেন?

-তোমার সাথে কথা বলবে।

দাদী হাতের সুপুরি কাটার জাতিটা একপাশে সরিয়ে রাখলেন। ফোন কানে ধরেই বললেন, কি খবর নাতজামাই?

দাদীর গলা শুনে প্রথমেই রিদওয়ান সালাম দিয়ে হাল জানতে চাইলো। এরপর ভণিতা ছাড়াই বলল, ‘দাদী আমি একটু আমার বউকে নিয়ে বাইরে যেতে চাইছিলাম৷ অনুমতি দিবা?’

-তোর বউ তুই নিবি ভাই আমি কি কমু?

– বউ আমার হলেও এখনো তো আমায় দাওনি তাই অনুমতি ছাড়া নেই কি করে! আর বউও আমার তোমরা না বললে এক পাও আসবে না আমার সাথে।

– বুঝছি। তা যাইবা কই আর আসবা কখন?

-ইয়ে… দাদী

– ওরে বাবা নাতজামাই কি লজ্জা পাইতাছোনি?

সত্যিই লজ্জা পাচ্ছে রিদওয়ান। বউকে নিয়ে এক রাতের জন্য কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেওয়া এতোটাই বিব্রত করবে তাকে আগে বুঝতে পারেনি৷ কিন্তু দাদী সহজ করে দিলো তার কথা।

– কি হইলো রাইতে কি থাকবা তোমরা?

-হ্যা দাদী।

-আচ্ছা। রায়না জানে কথাটা?

সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ঠিক এটাই ছিল। তাইতো আগেভাগেই অর্নিকে বলেছিলো কাউকে না জানিয়েই সে যাচ্ছে। এখন কি বলা যায়!

-না মানে আম্মুকে এখনো ফোন করা হয়নি।

-বুঝছি৷ বিয়া করতে তো শরম পায় না ব্যাটামানুষ কিন্তু বউরে কাছে রাখতে যে এত শরম কেমনে পায় বুঝি না। তুমি বাড়ি আসো আমি ততক্ষণে তোমার আম্মার লগে কথা কই অর্নিতাও রেডি হউক।

-থ্যাংক ইউ দাদী এটা আরও বেশি ভালো হয়।

রিদওয়ান ফোন রাখতেই দাদী অর্নিতাকে তাড়া দেন ভালো করে গোসল শেষে তৈরি হতে। নিজেই আবার আদেশ করেন আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করতে। রিদওয়ানের কণ্ঠ শুনে তার যে উচ্ছ্বাস টের পেয়েছিল সে এখন দাদীর কথায় মনে হচ্ছে রিদওয়ানের পর দাদীও খুব উচ্ছ্বসিত তার ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারটায়। সেও আর বিলম্ব না করে দাদীর ইচ্ছে মত গোসল সেরে শাড়ি নিয়ে পড়লো তৈরি হবে বলে।

___________

শেষতক লোনটা ক্যান্সেল হয়ে গেল অর্ণবের। কাগজপত্রের ঝামেলা যেভাবে কাটিয়ে উঠেছিল তাতে করে সে নিশ্চিত ছিল এবার নতুন কোম্পানিটা নির্দ্বিধায় চালু করতে পারবে। যেখানে মাস শেষে অর্ধকোটির হিসেব হতো সেখানে এখন দু কোটির বড় রকমের লেনদেন হবে সে ধরেই নিয়েছিল। লাভ লোকসানের দিকটাও যে তার অনুকূলে থাকবে এবারের ব্যবসা তেমনভাবেই শুরু করতে চাইছিলো। হলো না কিছুই। একটু আগেই তো একে একে তিনটা ইমেইল জমা হলো এই নিয়ে। ম্যানেজার আঙ্কেলই প্রথম দেখেছেন নোটিশ তাইতো অর্ণবকে একটু আগে ছলাকলা বুঝিয়ে অফিসে আসতে বারণ করেছিলেন সকালে। ছেলেটার বহুদিনের স্বপ্ন যে এক মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাবে তা কল্পনাও করেননি। সেই কিশোর বয়স থেকে দেখে আসছেন এই ছেলেটার পরিশ্রম আর আজ তাকে ভেঙে পড়তে দেখা যে উনার জন্যও কষ্টসাধ্য। কেবিনের ভেতর এসির শীতলতা কাজে লাগছে না অর্ণবের। রিভলভিং চেয়ারটায় গা এলিয়ে চোখ বুঁজে লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে নিচ্ছে সে। বারংবার চেষ্টা করছে নিজেকে স্থির রাখতে। উত্তেজনার বশে অসুস্থ হয়ে বিছানায় যাওয়ার একদমই ইচ্ছে নেই এমনকি তার সুযোগটাই নেই। তার কিছু হলে বোনটার কি হবে, দাদীর কি হবে? তবুও দাদীর ভার না চাইতেও বড় দাদার বাড়িতে কেউ না কেউ ঠিক নেবে কিন্তু অর্নিতা! গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো অর্ণব। টেবিলে থাকা পানিভর্তি গ্লাসটা হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ চেয়ে থাকলো সেদিকে। এরপর এক চুমুকে সবটা পানি পান করে ফোন হাতে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। সামনেই পড়লো ম্যানেজার সাহেব তিনি অর্ণবের কাছেই আসছিলেন।

-অর্ণব কোথায় যাও বাবা!

-আপনি ইমেইলগুলো দেখেছেন আঙ্কেল?

– উকিল সাহেবের ফোনটা আমিই ধরেছিলাম কিন্তু তোমাকে বলার মত শক্তি পাচ্ছিলাম না।

অর্ণব খুব স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো ম্যানেজারের দিকে। বুঝতে পারলো ম্যানেজার আঙ্কেল ভুলে গিয়েছেন হয়তো সকল নোটিশ শুধু কাগজে নয় অর্ণবের ইমেইল এড্রেসেও আসবে।

-আমি দেখেছি সবটা। ভয় পাবেন না আমি ঠিক আছি আঙ্কেল। একটু বাইরে যেতে চাই নইলে দমবন্ধ হয়ে আসবে।

-আমি সাথে আসি?

-নাহ।

আর কোন কথা না বলেই বেরিয়ে গেল অর্ণব। বাইক নিয়ে শ্লথ গতিতে এগিয়ে গেল অফিস এরিয়া থেকে অনেক দূর। জায়গাটা সাভারের দিকে একটু গ্রাম্য পরিবেশ। চারপাশে অনেক ফসলি জমি চোখে পড়ছে সেই সাথে কড়া রোদের তেজ। অফিস থেকে বের হয়েছে প্রায় দেড়টা ঘন্টা পার হয়েছে এখানে পৌঁছাতে। তবুও যেন জরুরি ছিল একটু দূরে সরে আসা। এতদিনের পরিশ্রম আর গোছানো স্বপ্ন যখন এক নিমেষেই শেষ হয়ে যেতে দেখলো ঠিক তখনই মনে হলো তার দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের পাতা এবার বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে। নিঃশ্বাসটাও কেমন ভারী লাগছিল। তাইতো হঠাৎ বাইক নিয়ে বেরিয়ে এলো অজানার উদ্দেশ্যে৷ এরই মাঝে দাদী আর বড় খালামনির নম্বর থেকে কল এসেছে বারকয়েক। অর্ণবের মনে হলো তারা ম্যানেজার আঙ্কেলের কাছে কিছু শুনেই টেনশনে কল করছেন। কিন্তু এখন যে তার একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না কারো সাথে কথা বলার কারো কাছে কিছু শোনার! রাস্তা ঘেঁষে ক্ষেতের আইলে বাইক রেখে বসে পড়লো সে। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল ছুঁয়েছে। শ্রাবণের আকাশে দলছুট মেঘেরা ঘুরছে এদিক সেদিক। কোথাও কালো কোথাও সাদা মেঘের দল মন খারাপের পসরা নিয়েই যেন জানান দিচ্ছে ঝরে পড়তে চায়। অর্ণব দৃষ্টিতে অনেকটা সময় চেয়ে দেখলো অন্তরীক্ষের রং পরিবর্তন এরপর খুব হঠাৎই ফোন হাতে কল করলো অর্ধপরিচিত সেই নম্বরটাতে। আজ আর সেটা অর্ধপরিচিত বলা যায় না বোধহয়। এক, দুই, তিন, চার করে কয়েক সেকেন্ডেই কল রিসিভ হলো ওপাশ থেকে অথচ সে কথা না বলেই কেটে দিলো কলটা।

______________

কথা ছিল উত্তরা যাবে চমৎকার এক হোটেলে হানিমুন স্যুইট পর্যন্ত বুক করে রেখেছিল রিদওয়ান। অর্ণবদের বাড়ি এসে অবধি তার পরিকল্পনা সেটাই ছিল। অথচ মত বদলে গেল অর্নিতাকে দেখতেই। রিদওয়ান যখন এসে পৌছুলো অর্নিতার তখন সাজ শেষ হয়ে গেছে। দাদীর ইচ্ছে মত একটা ক্রিম রঙের জমিনে লাল পেড়ে কাতান পরেছিল অর্নি। হাত, কান আর গলায় জোর করেই স্বর্নের চুড়ি, দুল আর চেইন পরিয়ে দিয়েছেন দাদী তাকে৷ মাথার চুল খোঁপা করতে চেয়েও করেনি চশমার কারণে। রুজিনা খালা বলে বসলেন, আম্মাগো চশমার লগে খোঁপা কইরো না তোমারে এমনেই ভালা দেখা যায়। ব্যস, মেঘরাশির মত কেশগুলো রয়ে গেল খোলাই। আখিপল্লবে টান পড়লো লাইনারের ঠোঁটও রঙিন হলো। অর্নিতাকে এক নজর দেখেই দাদী তড়িঘড়ি কাজলের ফোঁটা দিলেন তার কানের পেছনে। সাজতে গিয়ে তার যতটা না লজ্জা লাগছিল তার চেয়েও বেশি পেল দাদীর এই কান্ড দেখে। সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে রিদওয়ানের সামনে এসে দাঁড়াতেই অর্নিতার অসহ্যরকম লজ্জা বাড়লো। আজ থেকে তিনটা দিন আগেও তার এই মানুষটাকে দেখলে এমন লাগতো না। হুট করেই সম্পর্কের আদল পাল্টে কেমন আজব লাগছে সব৷ আসার পর থেকেই দাদীর কথামতো রুজিন খালা একের পর এক আপ্যায়নের অত্যাচার চালিয়েই যাচ্ছিলো রিদওয়ানের ওপর। অথচ সে বসে বসে ভাবছে তার চন্দ্রিমার মুখটা কখন দেখবে! যখন দেখলো তখন মনে হলো না দেখলেই ভালো হতো। হৃৎস্পন্দনের গতির যে বেহালদশা ওই চাঁদপানা মুখে তাকিয়ে এবার বুঝি দুনিয়া ছাড়াটা নিশ্চিত হলো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে