কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-৩৭

0
313

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩৭ (প্রথমাংশ)

চায়ের পাতিলে টবগব করে ফুটছে পানি সেই সাথে ফুটছে মনটাও। এইতো ক’দিন আগেও সে চায়ের জন্য রান্নাঘরে ঢুকলে ছোট মা কত কটুকথাই না শোনাতো! তার গায়ের রঙ কালো আবার চা খেয়ে নাকি পাতিলের তলা হয়ে যাচ্ছে। কোন ছেলে ফিরেও তাকাবে না তার দিকে। আর সে মেয়ে আজ এত বড় এক বাড়ির মালকিন তাও কিনা যে মেয়ে তিনজন ছেলে দ্বারা ধর্ষিত। এত মূল্যবান এই কালো বর্ণের মেয়েটি এ জগতে! আর যে তাকে মূল্যবান করে তুলতে চাইছে সেই মানুষটাই কেমন? মনে পড়ে দিন চারেক আগের রাতের কথা। মৃত্যুশয্যায়ই পড়ে ছিল দাদী তার কথা রাখতেই নুপুর সায় দিলো সে চলে আসবে এ বাড়িতে। পরেরদিন সত্যিই চলো এলো। কেন এলো! ওই ব্যক্তিত্বহীন পুরুষটার একলা জীবনে আজীবনের সঙ্গী হতে। এবার মনে পড়লো ওই পুরুষটার ঘরের প্রথম রাত। হাতের তালুতে একটা হীরের আংটি মেলে ধরে কি বলেছিলো যেন লোকটা?

” আমার শূন্য কুটিরে স্বাগতম আমার জীবনের শ্যামাঙ্গিনীকে। আমার নিঃসঙ্গ জীবনটাতে জড়ানোর জন্য লাখো শুকরিয়া। অসহায় আমার আমিকে বৈধ এক সম্পর্কের একটি সুযোগ দেয়ার জন্য তোমার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। ভালোবেসে প্রত্যেকটা মুহূর্ত তোমাকে আগলে রাখব। ভরসা রেখো আমি কখনো তোমায় একলা করব না আর কোনদিন।”

-সত্যিই!

হুট করেই তিরস্কারের সুরে বলে ওঠে নুপুর। “সত্যিই কৃতজ্ঞ! এত কৃতজ্ঞতা ঠিক সেদিন কোথায় ছিল যেদিন যেচে আমি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করেছিলাম আর আপনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন? সেদিন কোথায় ছিলো এই আগলে রাখা যখন আমায় ফেলে বৃষ্টিকে বিয়ে করতে চলে গেলেন! কোথায় ছিল এই ভালোবাসা যেদিন আমার বাবা ফিরিয়ে দিল বলেই ফিরে এলেন? সেদিন মনে হয়নি যে মেয়েটা বেহায়ার মত আপনাকে ভালোবেসে আপন করার দাবী জানাতো সেই মেয়েটা অন্যের বাগদত্তা কেমন করে হয়ে গেল জেনে নেই সে খবরটা? সেদিন মনে হয়নি আরেকটু ধৈর্য্য রেখে নিজের করে নেয়া হোক মেয়েটিকে? ঠিক তো সেদিন দুলহা সেজে চলে গিয়েছিলেন অন্যকারো আঙিনায়। আজ সেই আঙিনা শূন্য করে আমায় ভালোবাসা বোঝাচ্ছেন? আমাকে কৃতজ্ঞতা দেখাচ্ছেন! অথচ আপনার মিথ্যে ইগোর স্বীকার হয়ে আপনার ভুলের মাশুল দিতে অন্যকারো জীবনে একাকীত্ব নেমে এসেছে টের পান না!”

থেমে গেল নুপুর। দূর্বল, অসুস্থ শরীরে ক্রোধের প্রতাপ অসহনীয় ঠেকছে এবার। চেঁচিয়ে বলা কথাগুলো দরজার ওপারে না পৌঁছুলেও এপারে বিধ্বস্ত করে দিলো অর্ণবকে, হাঁপিয়ে দিলো খোদ নুপুরকেও। তবুও ফুরায়নি এ গঞ্জনা এখনো যে অনেকটা বাকি তাই বোধহয় এবার পিঠের পেছনে বালিশ রেখে হেলান দিলো নুপুর খাটের মাথায়। অর্ণব তখনোও ঠায় দাঁড়িয়ে খাটের পাশে নুপুরের কাছাকাছি। আংটি রাখা হাতের তালুটা ততক্ষণে গুটিয়ে নিয়েছে সে। নুপুর কিছুটা সময় নিয়ে আবারও মুখ খুলল, ” আপনার আপন বোনটিকে আপনি নিজের অহংয়ের খেলায় মেতে শ্বশুরঘর ছাড়া করলেন, রিদওয়ান ভাইকে করলেন পরিবারছাড়া। আমি না হয় মা’হীন সৎমায়ের সংসারে বড় হতে গিয়ে জগতের হাজারটা নিয়ম শিখে বেঁচে আছি অথচ বৃষ্টি আপুর মত নিরেট আহ্লাদে বড় হওয়া মেয়েটার জীবনে দাগ বসিয়ে দিলেন। কেন দিলেন? জেদ হয়েছিল আপনার, নুপুরের বাবা ফিরিয়ে দিয়েছে বলে আপনিও দেখিয়ে দিবেন বিয়ে করা আপনার জন্য চুটকির ব্যাপার। আবার সেই আপনিই বিয়ের আসরে হবু বউকে ফেলে চলে গেলেন ধর্ষিতা মেয়েকে উদ্ধার করতে। সমাজের চোখে আঁচড় কাঁটা মেয়েটাকে রঙিন কাগজে মুড়িয়ে তার দাগ ঢাকতে হাজির হলেন কাজীসমেত৷ বাহ্ কি দয়ার শরীর আপনার। আমায় উদ্ধার করে এই প্রাসাদে এনে মুখোশে ঢেকে দিলেন। এখন কেউ আমায় ধর্ষিতা ভাববে না। বলবে না আমি এ জগতে উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছি ঠিক তেমন করেই সাজিয়ে রাখবেন অধিকার পেয়ে।”

আবারও থেমে গেল নুপুর। কথা শেষ হয়নি অথচ শরীরটা ক্লান্ত হয়ে গেছে। দু চোখের পাতা বুঁজে আসতে চাইছে কিন্তু আরও যে অনেকটা বলার ছিল! নাহ, এবার আর তার সুযোগ নেই কিছু বলার মত। অর্ণব দিলো না বলতে সে স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় বলে দিলো, “কথা শেষ হয়েছে?”

-কেন আর শুনতে চাচ্ছেন না?

-রাত বাড়ছে।

-ওহহো ভুলেই গেছি রাত বাড়ছে আর এটাই তো উত্তম সময় শরীর পাওয়ার! শরীর জাগছে তো আসুন বিছানায় আসুন৷ বাতি নেভাবেন না না থাক আপনার অসুবিধা হলে এভাবেই না হয় শুরু করুন….

-নুপুর! চুপ একদম চুপ। আমার ধৈর্য্যশক্তি অনেক তার মানে এই না সেটা কখনোই ফুরাবে না।
প্রচণ্ড আক্রোশে বেড সাইড টেবিলে থাকা ল্যাম্পটাতে ঘুষি মেরে বসল অর্ণব। নুপুর তাতে দমে গেল না বরং সে আবারও কটাক্ষ করল,

– ফুরিয়ে গেলে কি হবে?

অর্ণব এবার মুখ খুলল না শুধুই ধূর্ত চোখ দুটো মেলে তাকালো নুপুরের দিকে। সেই সময় চোখদুটো কি পরিমাণ হিংস্র ছিল তা জানে না নুপুর। তার শুধু মনে পড়ে সে সময় ওই চোখ দুটো তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটাকে রক্তশূণ্য করে দিয়েছিলো ক্ষণিকের জন্য আর হাত পা কেমন বরফ হয়ে গেল। অর্ণব মিনিট কয়েক নীরব থেকে একটা বক্স আর এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো নুপুরকে।

-চুপচাপ ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আর একটি শব্দও যেন না শুনতে পাই।

কথা শেষ করে অর্ণব ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ভোর রাত অব্দি বাড়িটা শুনশানই ছিল। চুপচাপ শুয়ে থেকে এক সময় চোখ লেগে গেলে সে আর জানে না ঘরের মানুুষটা কোথায় আছে। তার ঘুম ভাঙে ভোর রাতে রুজিনা খালার আহাজারিতে৷ প্রথমে কান্নার আওয়াজটা ভ্রম বলে ভুল হলেও পরক্ষণেই মস্তিষ্ক সজাগ হলো৷ কান্নাটা নিচ থেকে আসছে বুঝতে পেরেই নুপুর হন্তদন্ত হয়ে বিছানা ছাড়লো। চোখ জুড়ে ঘুম, রেশ কাটেনি এখনো। দূর্বল পায়ে ছুটে গেল সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ি থেকে নিচ তলার প্রতিটি কোণায় কোণায় বাতি জ্বলছে। হল ঘরটায় সোফার আশেপাশে পায়চারী করতে করতে অর্ণব কাউকে অনবরত কল করে যাচ্ছে। খুব সম্ভব ওপাশ থেকে কেউ তুলছে না ফোনটা। দাদীর ঘর থেকে কান্নার আওয়াজটা আসছে তা বুঝতে মাত্র সেকেন্ড কয়েক সময় লাগল। এবার একরকম দৌঁড়েই ঢুকলো সে ঘরে। যে মানুষটার ইচ্ছে পূরণে সে এ বাড়িতে পা রেখেছে সে মানুষটা পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপদমস্তক সাদা একটি চাদরে ঢাকা। নুপুর বাকরুদ্ধ, নিঃসাড় হয়ে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ চাদরে মোড়া দেহটার দিকে। কত বড় একটা বাড়ি অথচ এই বাড়িটাতে উপস্থিত মাত্র পাঁচজন যার মধ্যে একজনের শরীরটা পড়ে আছে আত্মাশূন্য। অর্ণব অনেকবার কল করার পর ফোনটা তুলেছে খালুজানের ডাক্তার বন্ধু। খালুজানের সুবাদেই ঘনিষ্ঠতা উনার সাথে। দাদী প্রাণহীন তা মানতে নারাজ অর্ণব ডাক্তার আঙ্কেল দ্রুত তার বাড়িতে আসতে বলায় ডাক্তার সাহেব ভড়কেছেন খুব। সময়টা তখন ফজরের পূর্বমুহূর্ত। আঙ্কেল কিছুটা দোনোমোনা করেও চলে এলেন অর্ণবদের বাড়িতে। দাদীকে এসেই চাদর মোড়া দেখে বুঝলেন মানুষটা আর নেই। অর্ণব মানতে চাইছে না সে কথা। রুজিনা খালা মুখ ঢাকলেও অর্ণব তা সরিয়ে রাখতে চাইছে বারংবার। নুপুর হতবাক হয়ে চেয়ে দেখে গম্ভীর মানুষটাকে ঠিক যেন ছোট বাচ্চা যে কিনা মাকে খুঁজে না পেয়ে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে উঠছে। ফজরের আজান হতেই দারোয়ান খবর দেয় বড় দাদার বাড়িতে এবং তিনি নিজেই খবর দেন রিদওয়ানদের বাড়িতে। ডাক্তার সাহেব নিজেও জানান বাশার শেখকে। মাত্রই দিন কয়েক আগে নিজের মেয়ের হতে হতে না হওয়া বাড়ির কারো সাথেই তিনি হৃদ্যতা দেখাতে প্রস্তুত নন৷ নিজে তাই এদিকে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন না তবে মনুষত্ব্য বোধহয় একটুখানি জেগেছিলো তাই রিমনকে বললেন, এয়ারে চট্টগ্রাম যাও এবং যতদ্রুত সম্ভব অর্নিকে নিয়ে আসো। রিমন নিয়ে আসে অর্নিকে, সংবাদ জানায় রিদওয়ানকেও। সুদূর প্রবাসী ছেলেটা ছটফট করে অর্নিতার মানসিক হাল ভেবে ভেবে। চাইলেও তখন সম্ভব নয় তার পক্ষে ছুটে আসা, সম্ভব নয় অর্নির মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে সান্ত্বনা দেয়া। অর্ণবের প্রতি যা আংশিক ক্ষোভ ছিলো সেটাও এ মুহূর্তে তার দুঃখ ভেবে দূর করে দেয়। অর্নির তো কাছের মানুষ বলতে শুধু দাদী নয় রিদওয়ানের পরিবারই ছিলো কিন্তু অর্ণব! ছেলেটা যে এবার অতল শূন্যতায় ডুবে গেল। দাদীর হাতে মানুষ হওয়া ছেলেটা এতদিনে হলো সত্যিকারের এতিম। রিদওয়ান রিমনকে সারাটাদিন কলের ওপরই রাখলো। আর অর্ণব….. সে খুব একটা কাঁদেনি। শুধু থেমে থেমে দাদীর লাশের পাশে বসে একটি কথাই আওড়ে গেছে, “আমাকে এতিম না করলে চলছিলো না তোমার?”

বাদ আসর জানাজা আর দাফন সম্পন্ন হলে বড় দাদা আর সাখাওয়াত ভাই মিলে কবরস্থান থেকে অর্ণবকে নিয়ে ফিরলো বাড়িতে। সারাদিনে কেউ একটি দানাও দাঁতে কাটেনি তাই সাখাওয়াতের বউ নিজেই কাজের লোকদের মাধ্যমে হালকা খাবারের ব্যবস্থা করলো। নুপুর পুরোটা সময় বসে ছিলো অর্নির পাশে। মেয়েটা কান্নাকাটি করে একেবারে ভেঙে পড়েছে। রায়না বেগম আর বৃষ্টিও খেয়াল রাখছে অর্নিতার। সন্ধ্যের পর মাগরিবের নামাজ শেষে অর্ণব বসেছিলো বসার ঘরের মেঝেতে। তার আশপাশ জুড়েই বসা ছিল বড় দাদার নাতী আর অন্যান্য পুরুষ আত্মীয়রাও। সাখাওয়াত ভাই চলে গেছেন একটু আগেই কিন্তু ভাবীরা ছিল দোতলায়। বড় ভাবী হঠাৎ মনে পড়লো এমন করেই নুপুরকে বললেন, অর্ণব তো মুখে কিচ্ছুটি দেয়নি। তুমি এক কাজ করো ওকে ডেকে ঘরে নিয়ে আসো আমি দুটো রসগোল্লা আর বাখরখানি নিয়ে আসছি।

নুপুর দ্বিধাগ্রস্ত; বসারঘর লোকপূর্ণ সে কি বলে ডাকবে অর্ণবকে! এদিকে ভাবীও চলে গেছেন নিচেই মিষ্টি বাখরখানি আনতে। অসীম জড়তা নিয়েই সে চলে গেল নিচে। ধীরপায়ে গিয়ে থামলো ঠিক অর্ণবের পিঠ ঘেঁষে বড়দাদার কাছাকাছি। কোন দিক না তাকিয়েই সে ডাকলো, একটু উপরে আসবেন ভাবী ডাকছে।

অর্ণব রা করেনি চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। পা বাড়িয়ে সামনে এগোতেই কানে আসে, বাঁচাও আল্লাহ!

নুপুরের ক্ষীণ আওয়াজে বলা কথাটা স্পষ্ট শুনতে পায় অর্ণব। তৎক্ষনাৎ ফিরে তাকায় নুপুরের দৃষ্টি অনুসরণ করে তার সেকেন্ড কয়েক বাদই ধপাস করে পড়ার শব্দ হয়। নুপুর জ্ঞান হারিয়েছে কিন্তু কেন! কি দেখলো সে ওখানটাতে? দরজায় কি দেখেছে সে, মিনার ছিল না সেখানে?

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩৭(শেষাংশ)

নুপুর কেন জ্ঞান হারালো তার সঠিক কারণ উদঘাটন করতে পারছিলো না কেউ। মোটামুটি সহজ ধারণা ছিল, মেয়েটা অতিরিক্ত দূর্বল তাই জ্ঞান হারিয়েছে। শুধুমাত্র অর্ণবের মন মানলো না সে কথা। নুপুর ভয় পেয়ে সেন্স হারিয়েছে এটুকু সে বুঝতে পেরেছে। জ্ঞান ফেরার পরও এ নিয়ে কিছু জানতে চায়নি অর্ণব। দু দিন পরই বাড়িতে লোকের আনাগোনা কমে গেল। সারাদিন অর্ণব বাইরে বাইরেই থাকে বাড়িতে থাকে নুপুর, অর্নি। রুজিনা খালা নিজেও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি বলেই হাত পা গুটিয়ে পড়ে থাকে এক কোণে। জীবনের অর্ধেকটাই তো তিনি ছিলেন দাদীর পাশে এমতাবস্থায় তার মনে কষ্টও বেশি। তবুও জীবন তো থেমে থাকার নয়। আজ দাদী নেই চারদিন হয়ে গেল। কাল ভোরে অর্নি চলে যাবে হলে। তারপর থেকে এই মহল সমান বাড়িটাতে নুপুরকে থাকতে হবে একা। চা ফুটে ছলকে পড়তেই নুপুর বেরিয়ে এলো ভাবনা থেকে। তিনটি কাপে চা ঢেলে সে চলে গেল দোতলায় অর্নির ঘরে। আধশোয়া হয়ে ফোনে কথা বলছে অর্নি। ফোনের ওপাশে রিদওয়ান আছে। খুব সম্ভবত তাকে বোঝাচ্ছে শক্ত হতে। চট্টগ্রামে গেলে একা একা থাকবে পড়াশোনায় মন দিতে হবে নিজেকে সুস্থ থাকতে হবে। নুপুর পাশে বসতে বসতেই অর্নির কথা শেষ হয়েছে। সে এক কাপ চা এগিয়ে দিলো অর্নিকে ততক্ষণে রুজিনা খালাও চলে এসেছেন এ ঘরে। দ্বিতীয় কাপটা খালাকে ধরিয়ে দিয়ে নুপুর নিজের কাপে একটি চুমুক দিলো। অর্নি জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া কোথায়?

-জানি ন….
নুপুরের কথা শেষ হওয়ার আগেই দ্রুতপায়ে অর্ণব ঢুকলো ঘরে।

-তোর কি কিছু গোছানোর আছে?
প্রশ্নটা বোনের উদ্দেশ্যে করেই নুপুরের সামনে থেকে চায়ের কাপ তুলে চুমুক দিলো। রুজিনা খালা খেয়াল করেছেন বিষয়টা তিনি তাই বলতে যাচ্ছিলেন, ওইডা তো বউয়ের কাপ। তা আর বলা হলো না নুপুর হাত ধরে থামতে ইঙ্গিত দিলো। তিনজনের চা পান মুহূর্ত শেষ হওয়ার পর নুপুর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।নিজের জন্য পুনরায় চা বানিয়ে খইয়ে নিলো। নিচ তলায় চা শেষ করে উপরে উঠতেই চোখে পড়লো, অর্নি পরনের জামা বদলে ফেলেছে।

-কোথাও যাচ্ছিস?

-চলে যাচ্ছি। রিমন ভাইয়া চট্টগ্রামের অফিসে বসবে কাল তাই এক্ষুনি যাবে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে সকালে ক্লাস ধরতে হবে।

-ওহ!

নিস্তেজ গলায় ‘ওহ’ বলে নুপুর আবারও নিচে নেমে এলো অর্নির সাথে। বাড়ির গেইটে দাঁড়িয়ে আছে রিমনের গাড়িটা নুপুর সে অব্ধি এলো। অর্নি এবার মুখোমুখি দাঁড়ালো নুপুরের। ভীষণ জরুরি গলায় বলল, “তোকে কিছু কথা বলা দরকার সময়ের অভাবে বলা হয়নি। আমি আজ চট্টগ্রামে চলে যাচ্ছি মাত্র কিছুদিনের জন্য এরপরই বাড়ি ফিরব হয়ত সপ্তাহ খানেকের সময় নিয়ে। আমার কাগজপত্র প্রায় সবই হয়ে গেছে দু দিন আগেই ইমেইল চেক করেছি। পর্তুগাল রিদওয়ানের কাছে যাওয়া সম্ভব নয় এখন সোজা ফিনল্যান্ড যেতে হবে। পড়াশোনা ওখানেই চলবে আর রিদওয়ান চেষ্টা করবে ওখানে মুভ করার। আমি নিঃসঙ্গ ছিলাম না কখনো। মা-বাবার জায়গায় খালা-খালু ছিল। ভাই বোনের জায়গায় বৃষ্টি আপু রিমন ভাইরা ছিলো স্কুল, কলেজে বান্ধবীও ছিলো কিন্তু আমার ভাইয়ের বরাবরই কেউ ছিল না। দাদীই একমাত্র কাছের মানুষ ছিলেন যিনি এখন আর নেই। তোর সাথে খুব একটা অন্যায় করেনি ভাইয়া যা করেছিল আঙ্কেল মানে তোর বাবার কথার দাম দিতেই করেছিল। আমাদের মা-বাবা নিয়ে তিনি কথা তুলেছিলেন, আমাদের বড় হওয়া, অর্থবিত্ত নিশেও অসামাঞ্জ্যসতা দেখিয়ে ভাইয়াকে সরতে বলেছিলেন বলেই পিছু হটেছিল সে। আর রইলো বৃষ্টি আপুকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত সেখানেও তার ভুল ছিলো নগন্য তবুও সে অপরাধী তোদের চোখে।

নুপুর চুপচাপ শুনতে শুনতেই খেয়াল করলো ড্রাইভারের পাশে বসা রিমনও সব কথা শুনছে অথচ সে প্রতিক্রিয়াহীন।

অর্নি তার দৃষ্টি খেয়াল করে বলল, তুই ছাড়া আমরা সবাই এসব ব্যাপারে জানি। নিজের ভাইকে একা ছেড়ে যেতে আমার কেমন লাগছে তা এ দুনিয়ার কাউকে আমি বলতে পারবো না বোঝাতে পারব নস। আমি যা পারব সেটা হলো তোর অজ্ঞাতে হওয়া ঘটনাগুলি তোকে জানিয়ে তোর মনের আঁধার সরানোর চেষ্টা। আমার অনুরোধ তোর কাছে দুনিয়ায় মানুষ কত কিছুতে দয়া দেখায় তুই একটু আমার ভাইকে দয়া দেখাস একটু তাকে আপন করিস আমি আজীবন তোর কাছে ঋণী থাকব।

কথাটুকু বলতে বলতেই গড়িয়ে পড়া অশ্রুটুকু মুছে নিয়েছে অর্নি। অর্ণবকে আসতে দেখে প্রসঙ্গ বদলে অল্প হেসে বলল, যাই আমি ভালো থাকিস তুই… তোরা।

-দাঁড়া অর্নি।

অর্ণব এগিয়ে এলো সামনে। হাতে তার ছোট্ট একটা ব্যাগ সেটা বোনের দিকে বাড়িয়ে ধরলো।

-এটা সাথে নিয়ে যা এখন খোলার দরকার নেই। কাল বিকেলে ফ্রী হয়ে খুলবি তারপর আমাকে কল দিবি।

________

অফিসের কিছু কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিয়ে বসে আছে অর্ণব বসার ঘরে। অর্নি কখন পৌঁছাবে তা না জেনে সে হয়তো বিছানায় যাবে না। এমনিতেও গত কয়েক রাত তার কাটছে দু’এক ঘন্টা ঘুমিয়ে তাও সেটা গেস্টরুমে। নুপুর রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে রুজিনা খালার পাশে৷ তিনি কিছুটা ধোয়া-মোছার কাজ করছেন যেন সকালে উঠেই পরিচ্ছন্ন রান্নাঘরে রাঁধতে পারেন। নুপুর একবার দেখছে রুজিনা খালাকে তো একবার ঘাড় ফিরিয়ে অর্ণবকেও দেখছে। দুজনের কাজের মধ্যে একটা জিনিস খুব মিলে৷ তারা নিঃশব্দে, গুছিয়ে মনোযোগে করে প্রতিটা কাজ। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় রুজিনা খালাই বুঝি জল্লাদমুখোর অভিভাবক। দাদীকেও যথেষ্ট পরিপাটি দেখেছে সে তবে তিনি প্রাণোচ্ছলও ছিলেন৷ অর্নি চুলার কাছে গিয়ে কফি বানানোর প্রস্তুতি নিলো।

-কি করবা এখন?

-কফি বানাব খালা।

-এখন কফি খাইলে ঘুমাইবা কখন?

-আমি খাব না।

রুজিনা এবার বসার ঘরের দিকে তাকালো। অর্ণবের জন্য কফি বানাচ্ছে মেয়েটা! খুশি হলেন রুজিনা খালা যাক, এ বাড়িতে আসার পর এই প্রথম কিছু করছে ছেলেটার জন্য। তিনি কাজ শেষ করে বলে গেলেন, আমি ঘুমাইতে যাইতাছি তুমি ওরে কফি দিয়া ঘুমাইয়া পইড়ো। আর….

থেমে গেলেন রুজিনা খালা।

-আর!
-পারলে টুকটাক কথা কইয়ো অর্ণব বাবার লগে। অনেক কষ্ট অর মনে আগে খালাম্মার কাছে কইতো। এখন তো তুমি ছাড়া আর কেউ নাই।

ইতস্তত করেও মনের কথাটা মুখে বলেই ফেললেন রুজিনা খালা। তিনি দেখেছেন নুপুর একদিনও যেচে কথা বলেনি অর্ণবের সাথে। তাদের মধ্যে কি ছিল বা কিছু হয়েছে কিনা ঠিকঠাক জানেন না তিনি। আন্দাজ করতে পেরেছেন দুটিতে ভাব ভালোবাসা নেই বলে মনে হচ্ছে বলেই এখন এইটুকু বলে গেলেন। নুপুর কফি বানিয়ে নিয়ে গেল অর্ণবের কাছে৷ সোফা, টি টেবিল সবেতেই কাগজপত্রের ছড়াছাড়ি। ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে নুপুরকে একবার দেখে নিলো অর্ণব।

-কিছু বলবে?

নুপুর জবাব না দিয়ে কিছু কাগজ সরিয়ে কফির মগটা রেখে চলে যাচ্ছিলো। তার এই নিঃশব্দে চলে যাওয়া দেখে অর্ণব মগটা উঠিয়ে ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। আওয়াজটা শুনতে পেয়েছেন রুজিনা খালা তবুও বের হননি ঘর থেকে। নুপুর ফিরে এসে টুকরো হওয়া মগটা তুলে নিয়ে আবারও ঢুকলো রান্নাঘরে৷ নতুন করে কফি বানিয়ে আবারও গেল অর্ণবের সামনে।

-রাত জাগবেন তো! কফিটা খেয়ে নিন ভালো লাগবে।

এবার অর্ণব হাত থেকেই নিলো মগটা। চুপচাপ তাতে চুমুক লাগিয়ে কাজে মন দিলো। নুপুর চলে গেল দোতলায়। রাত তখন তিনটা কি সাড়ে তিনটা৷ অর্ণব অন্ধকার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। আন্দাজ করেই উঠে বসলো বিছানায় নুপুরের বিপরীত পাশে। হাতের ফোন আর ওয়ালেটটা বালিশের পাশে রেখেই ঝুঁকে এলো নুপুরের মুখের ওপর। বড্ড হালকা করে চুমু খেলো নুপুরের কপালে। ঘুমন্ত মেয়েটা একটুখানি নড়েচড়ে উঠলো বোধহয় ভেজা চুমুর পরশে। অর্ণব আবারও চুমু খেল এবার নুপুরের ঠোঁটে। মাত্র সেকেন্ড কয়েকের চুমুটাতে গাঢ় ঘুমটাও নিরবে টুটে গেল। নুপুর এবার আর নড়চড় করলো না ভেবেছিলো লোকটা হয়তো আরও কয়েকটা দেবে। তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে অর্ণব শুয়ে পড়লো চুপচাপ। সকালে ঘুমটা ভাঙলো অর্ণবের ফোনের কর্কশ আওয়াজে৷৷ অর্ণব ঘরেই নেই ফোন বেজে চলছে অনবরত। নুপুর চেক করলো কে কল দিচ্ছে। ‘শরাফত’ নামটা দেখে বুঝতে পারলো থানা থেকে কল। মনে ভয় জাগলো আবার কেন কল করছে পুলিশ! কলটা বেজে কেটে গেলেও নুপুর সেটা রিসিভ করলো না।

_________

“রাতে কখন পৌঁছেছিস তোরা?” রিদওয়ান জানতে চাইলো।

– পৌনে তিনটায় এসেছি তোমাদের ওই বাড়িটায়। সকালে রিমন ভাই ভার্সিটিতে দিয়ে গেল। ক্লাস শেষে এখন হলে এসে ঢুকলাম সবে। তুমি কি করছো?

-নাশতা রেডি করছি।

-এখনই!

-আজ ছুটির দিন তাই এক জায়গায় যাব বলে ভোরেই উঠেছি।

-ঘুরতে যাবে?

-না, একজন পরিচিত লোক আজ দেশে চলে যাচ্ছে। তার কাছে কিছু জিনিস দিব তোর আর বৃষ্টির জন্য।

সহজ স্বাভাবিক উত্তর রিদওয়ানের। অর্নি এবার ঝটপট জবাব দিলো, আমার কিছু লাগবে না। কিছু পাঠাতে হবে না এখন।

-বিয়ের পর তোর ন্যাচারাল স্বভাবটা নষ্ট হয়ে গেছে অর্নি। আমি যে অর্নিকে দেখতাম ভালোবাসতাম সেই মেয়েটা চঞ্চলভাবে জবাব দিতে পারতো না। সেই মেয়েটা আস্তে আস্তে রয়েসয়ে কথা বলতো। দশটা কথার জবাব সে এক বাক্যেই শেষ করতো আর তুই বড্ড বেশি কথা বলিস।

-এখন কি তাহলে আর ভালোবাসো না?

-বাসি। কিন্তু আমি আমার আগের অর্নিকে চাই। তোর এমন স্বকীয়তা হারানো আমায় কষ্ট দেয়। কে কবে বলেছিলো কথা কম বললে বর পালাবে সে কথা ধরে তুই এমন বদলে যাচ্ছিস তা কষ্ট দেয় আমাকে। আমি কোথাও পালাব না। তোর জন্যই তো সন্ন্যাস হতে বসেছিলাম সেই তোকে ছেড়ে যাব ভাবিস কেমন করে!

অর্নি আর কথা বাড়ায় না। আসলেই সে অন্যের কথাকে প্রায়োরিটি দিয়ে নিজেকে বদলাতে চেষ্টা করছিল অনেকদিন ধরে। এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছে। অর্নির মৌনতা কাটাতে রিদওয়ান হেসে উঠলো।

-আমি তোকে অন্নেক ভালোবাসি বউ মন খারাপ করতে হবে না। তুই যেমন ছিলি তেমন থাক আমার জন্য নিজেকে বদলানোর দরকার নেই৷ তোর আগে আমি তোকে ভালোবেসেছি তোর সকল স্বভাব জেনেই।

_______

অর্ণবকে থানায় ডাকা হয়েছে আজ। সে ভেবেছিল তৃতীয় আসামীর খোঁজ মিলেছে। থানায় যাওয়ার পর ঘটনা বের হলো অন্যকিছু। গত বছর থেকে ছোট দাদার যে সম্পাত অরিজিনাল দলিলপত্র নিখোঁজ ছিল তা নিয়েই সামনে এলো গোপন রহস্য। ছোট দাদার দলিলপত্রে একমাত্র উত্তরাধিকার হিসেবে আছে অর্ণবের নাম যা নতুন করে লেখা হয়েছে সাখাওয়াত চৌধুরীর নামে। জাল সেই দলিলে মূল বক্তব্য ছিলো, আমি সজ্ঞানে সকল সম্পত্তি সাখাওয়াত চৌধুরীকে দান করছি। দাদার করা উইলের সময়সূচি ছিল বছর পনেরো আগের আর নতুন উইল হয়েছে দিন দশেক আগে। নতুন উইলে অর্ণবের স্বাক্ষরের জায়গাটা ফাঁকা। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে আসল সাপটাই যে বেরিয়ে আসবে তা অর্ণব আগে থেকেই জানতো নুপুরের সাথে হওয়া ঘটনার পর থেকে। নুপুরকে তুলে নেয়ার যে বর্ণনা সে জেনেছে তাতে স্পষ্ট ছিলো তারা নুপুর নয় অর্নিকে তুলে নিতে চেয়েছিল। তাকে এবং নুপুরকে যারা ফলো করতো তারা একজনেরই লোক। পুলিশের সাথে কথা বলে অর্ণব মামলা করে গেছে সাখাওয়াতের নামে।

____

দিন এগুচ্ছে বাড়িতে পরিবর্তন এসেছে দিনের সাথে পাল্লা দিয়েই৷ দাদীর মৃত্যুর চল্লিশ দিন আজ তাই অর্ণব এবারও মসজিদ মাদ্রাসায় মিলাদ রাখলো। অনেকেই বলেছিলো বাড়িতে আয়োজন করো। সে শোনেনি সে কথা। যেখানে আত্মীয় নামের অনাত্মীয়ে ভরপুর জীবনে সেখানে বাড়িতে খাইয়ে দোয়া পাওয়া মুশকিল ব্যাপার। অর্নিও পড়াশোনার পাশাপাশি দেশ ত্যাগের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। এরই মাঝে সে ভিসা সংক্রান্ত কাজে ইন্ডিয়া থেকেও ঘুরে এসেছে। এই প্রথম অর্নি অনেক বড় একটা কাজ করেছিলো একদম একা। এমব্যাসির লোকেরাই সব বুঝিয়ে করিয়ে নিয়েছে তবুও হোটেল থেকে ঘোরাঘুরিটুকু নিজে নিজেই করেছে নির্ভয়ে। রিদওয়ান অবশ্য দূর থেকেই প্রতিমুহূর্তে ডিরেকশন দিয়ে গেছে। অর্নির হাতে আছে আর সপ্তাহ খানেক সময়৷ খালামনি অর্ণবকে মাফ না করলেও অর্নির সাথে স্বাভাবিক হয়ে গেছেন। রিদওয়ান যেদিন দেশ ছাড়ছিলো সেদিন শেষ মুহূর্তে এসে প্রচণ্ড রকম কথার আঘাত দিয়েছিলেন রায়না ছেলেকে। রিদওয়ান আজো জানে না সেদিনের সেই কথাগুলো উচ্চারিত আম্মুর মুখ থেকে হলেও প্রতিটা শব্দ ছিলো আব্বুর বলা। রায়না লুকিয়েছিলেন সেসব কথা কিন্তু অর্নি জেনেছে রিমনের কাছে। অর্নি তাই আশ্বাস দিলো খালামনিকে খুব শিগ্রই রিদওয়ান আবার কথা বলবে তার আম্মুর সাথে। তার সব ভুল ভাঙ্গিয়ে আবারও দেশে নিয়ে আসবে।

একটা সপ্তাহ হাতে আছে বলে অর্নি চলে এসেছে বাড়িতে। নুপুরকে সঙ্গে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করলো। চলে যাবার একদিন আগে অর্নি এলো ভাইয়ের ঘরে।

-ভাইয়া ফ্রী আছো?

-আয়।

অর্ণব বসে ফোন স্ক্রল করছিল তখন। নুপুর ঘরে নেই হয়তো নিচে কিছু করছে। অর্নির হাতে একটা ব্যাগ সেটা অর্নি ভাইয়ের সামনে রেখে বসলো পাশেই।

-ওটা কি?

-আমারও একই প্রশ্ন ভাইয়া, “এটা কি?”

অর্ণব অবাক হয়ে তুলে নেয় ব্যাগটা। ভেতরটা চেক করে বুঝতে পারে অর্নি কেন এতদিন এই ব্যাগটা নিয়ে প্রশ্ন করেনি। কথা ছিলো সেদিন চট্টগ্রাম পৌঁছেই যেন কল করে তাকে ব্যাগটার কথা জানার জন্য। অর্নি কথা বললেও এ প্রসঙ্গে কোন প্রশ্ন করেনি অর্ণবও যেচে বলেনি কিছু।

-বলো এটা কি?

-রেগে যাচ্ছিস নাকি! দ্যাখ এখানে যা ট্রান্সফার হয়েছে সবটা তোর নিজের। আমি চাইছিলাম তোর সিম কানেকশনটাও দিতে যেন সকল প্রকার নোটিফিকেশন ফোনেই পাস কিন্তু তোর নতুন সিমটার রেজিষ্ট্রেশন তোর নামে নেই। আর হ্যাঁ এটা নিয়ে রাগ দেখানোর কিছু নেই আমি পুরো কোম্পানি বেচে যা পেয়েছি তার দশ ভাগের একভাগ এখানে বাকি নয় ভাগ আমার কাছেই। এত হাইপার হওয়ার কিছু নেই। বিদেশ বিভূঁইয়ে তোর এর থেকেও বেশি লাগবে।

-কোম্পানি বেচে দিয়েছো মানে কি ভাইয়া?

-আমি আর ব্যাবসা বানিজ্য করতে চাচ্ছি না।

-কি করবে তাহলে?

কান্নার ডেলা আটকে আছে অর্নির গলায়। সে যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। যে মানুষটা সেই কৈশোর থেকে ব্যবসায় ডুবে গিয়েছিল আজ সে তার সাফল্যকে বিক্রি করে দিয়েছে বলছে! তাও কত স্বাভাবিক স্বরে। অর্ণব বুঝে গেল বোনটি এবার কেঁদে ভাসাবে তাই এগিয়ে এসে বাহু জড়িয়ে ধরলো।একবার দরজায় তাকালো বোধহয় দেখতে চাইলো নুপুর আছে কিনা আশেপাশে তারপর সতর্ক গলায় বলল, “তুই বড্ড দূর্বল রে বোন তাই তোকে আগেই জানাতে চাইনি কিছু।”

ভাইয়ের এমন সাবধানী গলা শুনে মুখ তুলে চাইলো অর্নি।

-এই যে আমরা এই বাড়ি এই ঘরে পড়ে আছি এগুলো সব অভিশপ্ত আমাদেরও জন্য। এগুলো শকুনের নজর লেগে আছে বহু বছর ধরে। আমাদের ছোট দাদা আমার মাথার ছায়া মানুষটা মারা যাওয়ার পর থেকেই ওঁৎ পেতে আছে তারা। জানিস আমার আর তোর ওপরের আঘাতগুলো কার গায়ে লেগেছে?

এ পর্যায়ে অর্ণবের কণ্ঠস্বর ভেজা শোনালো। অর্নিতার প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে অর্ণব আবার বলতে লাগলো, ” আমার পেছনে অনেকদিন ধরে দএকজন লোক লেগেছিলো। সবসময় নজরে রাখতো আমায় ঠিক তেমন করেই আরেকজন ছিলো নুপুরের পেছনে। অবশ্যই সেটা তোকে মনে করে।”

– কি বলছো ভাইয়া!

-হ্যাঁ। পুলিশের কাছে নুপুরের বাবা আরো আগেই জানিয়েছিলেন এ কথা। নুপুর সুস্থ হওয়ার পর তার জবানিতেও সেম ঘটনা জানা গেছে আর কিডন্যাপ হওয়ার দিন মনে আছে তোর ফোনটা ওর কাছে ছিল?

-হ্যাঁ। ওর কাছে ছিল সেজন্য তো পুলিশ আমাকেও জেরা করেছিলো।

-হু, ওই ফলোকারী কোনভাবে তোকে আর ওকে গুলিয়ে ফেলেই একটা বছরের বেশি ওকে ফলো করে গেছে। সুযোগমতো সেদিন ওকে তুলে নিয়ে গেল আর….

থেমে গেছে অর্ণব। এরপর আর একটা শব্দও কণ্ঠধ্বনি পেরোতে পারলো।

-এগুলো কে করিয়েছে ভাইয়া? জানা যায়নি?

-হু। এই যে একটা মাস ধরে নিয়মিত পুলিশের সাথে সাক্ষাৎ করে চলছি তা শুধু ওই মানুষগুলোর জন্যই। সকল ষড়যন্ত্রের মূলহোতা আমদেরই কাছের মানুষ বড় দাদার বড় নাতি।

-সাখাওয়াত ভাই!

প্রচণ্ডরকম অবাক অর্নি এবার কথা বলতেও ভুলে গেল। এগুলো বিশ্বাস করা যায়!

-তিনি সব করিয়েছেন? তাদেরকে পুলিশে দাও ভাইয়া এক্ষুনি।

– যা হওয়ার তা অলরেডি হচ্ছে কিন্তু কি বলতো নুপুরের অপরাধীরা যে কেউ শাস্তি পেলো না ঠিকঠাক।

-সাখাওয়াত ভাই নুপুরকে…..

-উহুম এখানে আরেকটু বাকি। ওটা সাখাওয়াত নয় তার ছেলে ।

-মিনার!
অর্নি আর কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে না। ফুঁপিয়ে উঠলো সে আবারও। নুপুর কত যন্ত্রণা ভোগ করলো শুধু মাত্র তাদের ভালোবাসার মানুষ বলে। আর আপন মানুষগুলোর এই পিশাচরুপ গুলো কেমন করে বেরিয়ে আসছে সামনে।

-অপরাধীরা শাস্তি পাবে। প্রতারণা, জাল দলিলের জন্য সাখাওয়াত চৌধুরী খুব শিগ্রই গরাদের ওপারে থাকবে সেই সাথে তার ছেলেও..

______

অর্নির ফ্লাইট সন্ধ্যা সাতটার। তাকে এয়ারপোর্টে অর্ণব নিয়ে এলেও শেষ মুহূর্তে রায়না বেগম আর বৃষ্টিকে নিয়ে হাজির হলো রিমন। অর্নি ইমিগ্রেশনের জন্য চলে যেতেই রায়না চলে যেতে পা বাড়ায়।

-খালামনি দাঁড়াও।
অর্ণব ডাকতেই থমকে দাঁড়ায় রায়না।

-কথা বলবে না আমার সাথে?

রায়না জবাব দেয় না। অর্ণবই আবার বলে, “একটু কথা বলে যাও খালামনি হয়তো এটাই হবে আমাদের শেষ কথা বলা।”

রায়না ফিরে তাকায় ভাগ্নের দিকে। মমতায় পূর্ণ মায়ের মন কতক্ষণ কঠোর থাকতে পারে! যে সন্তানদের মায়া কাটিয়ে ময়না নতুন জীবনে যেতে পেরেছিলো রায়না সেই সন্তানদুটিকে অপরাধ করলেও ভুলে থাকতে পারবেন না। আকাশপাতাল তফাৎ দু’বোনের মাঝে আর তাই হয়ত, অর্ণব, অর্নি মাকে ভুলে গেলেও খালামনিকে ভুলে থাকতে পারে না৷ বৃষ্টি আর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে চাইলো না এখানটায় তাই মা’কে বলল, আমি গাড়িতে আছি। রিমনও গেল সেদিকে।

-কেন কথা বলতে চাচ্ছিস? কষ্ট দিয়ে মন ভরেনি?

-মাফ করে দাও না। বৃষ্টি দেখবে আমার চেয়েও ভাল কাউকে পাবে।

-তুই ভাল সে কথা কে বলল?

-আচ্ছা আমি খারাপ ও অনেক ভালো কাউকে পাবে তুমি কষ্ট পেয়ো না। আমি একটু জড়িয়ে ধরি তোমায়?

বাচ্চাদের মত শোনালো অর্ণবের এই আবদারটুকু। রায়না নিজেই জড়িয়ে ধরলেন ছেলেটাকে। নিজের সংসারে কত যুদ্ধ, ঝড় বইছে অর্ণব অর্নিকে ঘিরে। তিনি এক মুহূর্তের জন্য সব ভুলে গিয়ে মমতা মিশিয়ে বুকে টেনে নিলেন বোনপোকে। সেই ছোট্ট বেলাকার অর্ণবের মত এই অর্ণব মিশে গেল খালামনির বুকে। সল্প আওয়াজে বলে বসলো, “তোমাকে বড্ড ভালোবাসি খালামনি৷ তুমিই আমার আর অর্নির মা ছিলে তুমিই থাকবে। সবসময় নিজের খেয়াল রেখো তুমি মনে রেখো তুমি ভাল থাকলে আমরাও ভালো থাকব। যতদূরে যাই যতই আড়ালে যাই তোমার দোয়ার মত তুমিও থাকবে আমাদের পাশে। ভালো থেকো।”
_____

অর্নি ফিনল্যান্ড পৌঁছে গেছে আজ দু দিন। সারাদিন কোন কাজ না করে শুয়ে বসেই কাটাচ্ছে অর্ণব এখন। নুপুর জড়তা নিয়েই আজ প্রশ্ন করে বসল, অফিস নেই আপনার?
জবাবে অর্ণব মুচকি হাসলো। নুপুর বোকার মত কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে চলে গেল রান্নাঘরে৷ রুজিনা খালা কাল তাঁর গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। কেন গেলেন নুপুর জানে না। সে বার কয়েক প্রশ্ন করেছিলো অর্ণবকে। সে কেমন হালকাভাবে বলল, খালার বয়স হয়েছে তাই আর কাজ করবেন না। এ জবাবটা নুপুরের একটুও বিশ্বাস হয়নি৷ যে মানুষটার গোটা জীবন কাটলো এ বাড়িতে। যে কিনা সন্তানের চোখে অর্ণবকে দেখতো তাকে একলা করে সে কিনা চলে যাবে! যদি মানুষটার গ্রামে নিজের কোন সংসার থাকতো তবে না হয় মানা যেত। রাতের জন্য ইলিশ ভাজা আর ভাত রান্না করেছে নুপুর সাথে শুকনো মরিচ টালা। বাড়িতে তিনজন মাত্র মানুষ এখন তাও কিনা দারোয়ান চাচা খান নিজ বাড়িতে। এ বাড়িতে একটি মাসের মধ্যেই কত যে পরিবর্তন হয়েছে তা ভাবতে গেলেও ভয় হয় নুপুরের৷ গোটা বাড়িতে দু জন মানুষ বাস করছে আজ সকাল থেকে। বিরাট এই বাড়িটার শুনশান নীরবতা গা ছমছমে ভীষণ অর্ণব অবশ্য সারাক্ষণই আশপাশে থাকছে তবুও কেমন যেন লাগে৷ রাতের খাবার টেবিলে সাজিয়ে অর্ণবকে ডাকলো নুপুর৷ সেও ভদ্র ছেলের মত তৎক্ষনাৎ এসে খাবার খেয়ে উপরে চলে গেল। থালাবাটি পরিষ্কার করে নুপুর যখন উপরে গেল তখন কানে এলো ক্ষীণ এক সুর। চেনা স্বরে এই সুরটা সে আগেও শুনেছিলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে। নিঃশব্দে সে ঘরে ঢুকতেই খেয়াল করলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে অর্ণব গাইছে গানটা। নুপুর এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো অর্ণবের পেছনে। অর্ণব কেমন করে যেন টের পেল শ্যামাঙ্গিনীর উপস্থিতি। পেছন ফিরে এক ঝটকায় হাতটা টেনে নুপুরকে বুকের ওপর ফেলে গেয়ে উঠলো,

তুমি বুকে টেনে নাও না প্রিয় আমাকে

আমি ভালোবাসি….ভালো… বাসি

ভালো…. বাসি তোমাকে

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে