কেয়ারিং হাসবেন্ড পর্ব-০১

0
2375

#কেয়ারিং_হাসবেন্ড
[সূচনা পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

প্রসবের যন্ত্রণায় হাসপাতালের বেডের উপরে কাতরাচ্ছে নেহা। একটু পরেই নেহার সিজার করা হবে। এমন সময় খবর আসলো নেহার হাসবেন্ড হাসপাতালে আশার পথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে মারা গিয়েছে। নেহার কানে তার স্বামীর মৃত্যুর খবর আসতেই নেহা যেনো পাগলের মতো হয়ে গেলো। তার যে একটু পরেই অপারেশন করা হবে সে সেটা ভুলে গিয়ে বেড থেকে নেমে বাহিরে চলে যেতে চাইলে কয়েকজন নার্স এসে নেহাকে আঁটকে দেয়। কিন্তু নেহা কারো কোনো বাধা না মেনেই পেটে হাত দিয়ে হাটা শুরু করে দেয়। তাড়াহুড়ো করে হাটতে গিয়ে নেহার পেটের ব্যাথা বেড়ে যেতে থাকে। আর নেহা সেখানেই ধপাস করে পড়ে যায় ফ্লোরের উপরে। সবাই নেহাকে একা রেখে চলে যায় নেহার হাসবেন্ড এর বাসায়। এদিকে নেহার অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে থাকে। তখন ডাক্তার নেহার বাড়ির লোকজনের খোঁজ করলে কাওকে না পেয়ে নেহার অপারেশন এর কাজ বন্ধ করে দেয়। এদিকে নেহা প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। একটু পরে নেহার শ্বশুর বাড়িতে ফোন দেয় ডাক্তার। নেহার শ্বশুর ফোন রিসিভ করে।

ডাক্তার বলল — রোগীর সাথে কোনো লোকজন কেউ নাই কেন? আপনাদের রোগীর অবস্থা খুব খারাপ ইমিডিয়েট অপারেশন করাতে হবে। না হলে দুজনের একজনকেও বাঁচানো যাবেনা। আর রোগী ফ্লোরের উপরে পড়ে গেছে অবস্থা খুব খারাপ। তাড়াতাড়ি কেউ আসুন। অপারেশন শুরু করতে হবে।

— ডাক্তার আমার ছেলে মারা গিয়েছে সবাই এখানে। আমার ছেলেটা তার সন্তানের মুখ না দেখেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে।

— আমি শুনেছি। আসলে আপনাদের পরিস্থিতি আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু রোগীর বাড়ির লোকজন না থাকলে আমরা অপারেশন শুরু করতে পারছিনা। আবার রোগী পড়ে গিয়ে পেটেও আঘাত পেয়েছে। দেখুন যা করার তাড়াতাড়ি করুন।

ডাক্তারের মুখে এমন কথা শুনে। নেহার শ্বশুর জামাল সাহেব বুঝতে পারছেনা কি করবে। একদিকে ছেলের লাশ। অন্যদিকে ছেলের বউ। সে কোন দিকে যাবে? এসব ভাবতে ভাবতেই জামাল সাহেবের বুকের ব্যাথা শুরু হতে থাকে আর তিনি সেখানেই স্টক করে মারা যায়৷ আর তিনি ধপাস করে ফ্লোরের পড়ে যায়।

মিজান সাহেবের পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে সবাই মিজান সাহেবের কাছে চলে আসে। এসে দেখে মিজান সাহেবও মারা গিয়েছে। এবার চারদিকে কান্নার ডোল পড়ে যায়।

অন্যদিকে নেহার মা হাসপাতালে পৌছে যায়। ডাক্তার এসে বলল — আপনি রোগীর কি হোন?

— আমি ওর মা।

— আচ্ছা শুনুন আপনার মেয়ের অবস্থা খুব খারাপ ইমিডিয়েট অপারেশন শুরু করতে হবে।

— হুম শুরু করুন।

— ঠিক আছে এখানে একটা সিগনেচার করে দিন।

— কিসের সিগনেচার ডাক্তার?

— অপারেশনের সময় যদি রোগীর কিছু হয়ে যায় তারজন্য আমরা দায়ী না। আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করবো। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছে। তাড়াতাড়ি সিগনেচার করে দিন। রোগী ব্যাথায় চটপট করছে।

তারপর নেহার মা সিগনেচার করে দেয়। ডাক্তার অপারেশন করতে শুরু করে। আর নেহার আম্মু বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে।

অন্যদিকে বাপ ছেলে দুইজনের শেষ বিদায়ের আয়োজন করা হলো। এক সাথে দুইটা লাশ। নেহার শ্বাশুড়ি একটু পরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। নেহাকে এখনো জানানো হয়নি তার শ্বশুরের মৃত্যুর খবর। বাবা ছেলের জানাজা শেষ করে দাফন কাজ শেষ করা হলো। দাফনকাজ শেষ করে সবাই বাসায় ফিরে আসলো।

এই দিকে নেহার অপারেশন শেষ করে ডাক্তার বেরিয়ে আসলো। নেহার আম্মু রাহেলা বেগম ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল — ডাক্তার!

— চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনার একটা ফুটফুটে নাতনি হয়েছে। আর বাচ্চা আর মা দুজনেই ভালো আছে।

— আলহামদুলিল্লাহ।

— কিছুক্ষণের মধ্যে রোগীকে কেবিনে শিপ্ট করা হবে তখন দেখা করতে পারবেন।

রাহেলা বেগম ফোন হাতে নিয়ে তার স্বামী জামসেদ আলীর কাছে ফোন দিলো। জামসেদ আলী হাসপাতালে আসতে পারে নাই কারণ তিনি নেহার শ্বশুর বাড়িতে আছে।

রাহেলা বেগম তার স্বামীকে ফোন দিয়ে খুশির খবর টা দিলো। একদিকে খুশি অন্যদিকে দুঃখের আহা কার। জামসেদ আলী নেহার শ্বাশুড়ির কাছেও যেতে পারছেনা। কারণ তিনি সদ্যবিধবা। জামসেদ আলী একটা মহিলাকে দিয়ে খবর টা পাঠালেন। কিন্তু নেহার শ্বাশুড়ি খবর টা পেয়েও খুশি হতে পারলেন না। কি করে খুশী হবেন? যেখানে এক দিনের তার স্বামী সন্তান কে হারালো।

এই দিকে নেহাকে কেবিনে শিপ্ট করা হলো। নেহার পাশে নেহার মেয়েকে রাখলো। নেহা তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে কান্না করে দিলো। একটু পরে নেহার আম্মু কেবিনে আসলো নেহাকে দেখার জন্য।

নেহার আম্মু নেহার পাশে এসে বসলো। এসে দেখে নেহা কান্না করছে।

নেহার আম্মু নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল — মারে কান্না করিস না তোর আর তোর মেয়ের ভাগ্যটাই খারাপ।

— এসব কি করে হলো মা? আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িকে খবর দিয়েছেন?

নেহার মুখে নেহার শ্বশুরের কথা শুনে নেহার আম্মু কান্না করে দিলো।

— কি হয়েছে? কিছু না বলে কান্না করছো কেন?

— মারে কি ভাবে যে বলি।

— কি হয়েছে সেটা বলো আমাকে।

— তোর শ্বশুর ও আর নেই। সেও মারা গেছে।

— মানে কি বলছো এসব? পাগল হয়ে গেলে নাকি?

— সত্যি বলছি মা।

তারপর নেহাকে সব কিছুই বলল। নেহার আম্মুর কথা শুনে নেহা আরো কান্নায় ভেঙে পড়ে।

নেহার আম্মু বলল — মারে এই ভাবে কান্না করিস না। তুই এমনিতেই অসুস্থ। আরো অসুস্থ হয়ে পড়বি। সব ঠিক হয়ে যাবে।

এই ঘটনার পরে ১৫ দিন কেটে গেলো। নেহার মা আর নেহার বাবা সব সময় নেহার পাশে ছিলো। নেহা এখন অনেকটা সুস্থ হয়েছে। নেহাকে নিয়ে চলে গেলো নেহার শ্বশুর বাড়ি। সাথে জামসেদ আলী আর রাহেলা বেগম ও গেলো। নেহার শ্বাশুড়ি নেহার বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে অঝোরে কান্না করতে থাকে।

জামসেদ আলী নেহার শ্বাশুড়িকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল — সব ঠিক হয়ে যাবে। কান্না করবেন না। আমাদের সবাইকেই একদিন এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে।

কিন্তু তিনি কান্না করতেই থাকে। একটু পরে নেহার মেয়েকে নেহার কোলে ফিরিয়ে দিয়ে বলল — দোয়া করি ভালো থেকো তোমরা। বেয়াই সাহেব একটা কথা বলার ছিল।

— হুম বলুন।

— আপনারা বউমাকে আর আমার নাতনিকে নিয়ে চলে যান। আমার বাসায় থাকলে ওরাও না খেতে পেরে মারা যাবে। যেখানে আমি কি খাবো সেটার কোনো ঠিক নাই। আমি চাইনা ওরাও আমার মতো কষ্ট করুক। আপনি ওদের নিয়ে চলে যান বেয়াই সাহেব।

নেহা — মা আপনি একা কি ভাবে থাকবেন?

— আমি থাকতে পারবো মা। তুমি চলে যাও। আর আমার নাতনিটাকে দেখে রেখো।

নেহার শ্বাশুড়ির থেকে বিদায় নিয়ে সবাই নেহার বাপের বাড়িতে চলে গেলো।

তারপর কেটে গেলো এক বছর।

এক বছর পর,,,

জামসেদ আলী নেহাকে বলছে — মা আজকে তোকে একটা ছেলে দেখতে আসবে। আর ছেলেটা তোর মায়ের বান্ধুবীর ভাইয়ের ছেলে। রেডি হয়ে থাকিস।

— বাবা আমার আর কোনো ছেলের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না। কতো ছেলে তো দেখে গেলো সবাই সবার আমাকে পছন্দ হইছে কিন্তু কেউ তো মাইসার দায়িত্ব নিতে চায়না। (মাইসা হলো নেহার মেয়ে)
মাইসার দায়িত্ব নিতে না পারলে আমি কখনো আর বিয়ে করবোনা বাবা।

–মাইসার খেয়াল আমি আর তোর মাও রাখতে পারবো। মাইসার কোনো অযত্ন হবেনা।

— আমি জানি বাবা তোমরা আমার মেয়েকে অনেক ভালোবাস। কিন্তু বাবা আমার মেয়েটা তো মা ছাড়া এতিম হয়ে যাবে। জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছে এখন সে আবার মাকেও হারাবে। আমি সেটা চাইনা। মাইসাকে মেনে নিলেই আমি বিয়েতে রাজি হবো।

— ঠিক আছে। দেখা যাক কি হয়। বিকালে আসবে তারা।

অন্যদিকে নেহার আম্মুর সেই বান্ধুবী তার ভাইয়ের বাসায় চলে গেলো। আমাদের গল্পের হিরো সবুজ। সবুজ বসে আছে সোফায়। সবুজকে দেখতে পেয়ে তার ফুফু তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল — বিকালে রেডি হয়ে থাকিস।

— কেন?

— তোকে নিয়ে মেয়ে দেখতে যাবো আজকে বিকেলে।

— রাজকে বিয়ে করাবে নাকি?

— না তোর জন্য। আর কতোদিন এই ভাবে থাকবি তুই?

— ফুফি তুমি তো সবি জানো আমার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই। তাও কেন তোমরা বার বার এমন করো?

— বাবা আমরা চাই তুই এবার সংসার কর। এই ভাবে আর কতো দিন চলবে? মাকে তো অনেক দিন আগেই হারালি এখন তোর বাবার যদি কিছু হয়ে যায় তখন তুই তো আরো একা হয়ে যাবি।

চলবে??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে