কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-০১

0
1951

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব: ০১
লিখা: জাহান আরা

বিয়ের ৭ দিনের মাথায় আমি বিধবা হলাম।৪ বছর ধরে ভালোবেসে যাকে বিয়ে করেছি সেই ভালোবাসার মানুষ কে হারিয়ে ফেললাম চোখের পলকে। আমার চোখের সামনেই কুপিয়ে হত্যা করা হলো আমার ভালোবাসার মানুষকে।
একঘর মানুষ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম কিভাবে জীবন্ত একটা মানুষকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে।

মা বাবা ভাই বোন স্ত্রী সবার সামনেই খুন হলো আমার স্বামী।
নিজের রক্তাক্ত স্বামীকে দেখতে দেখতে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ি।
দুই হাতের মেহেদী রঙ এখনো ফ্যাকাশে হয় নি,নাকে দেওয়া ডায়মন্ডের নাকফুলটি ঝিকঝিক করে তার সৌন্দর্য প্রকাশ করছে সেই মুহূর্তেই নিজের বৈধব্যকে প্রকাশ করার জন্য খুলে ফেললাম নাকের নাকফুল।
দুই হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি ছিলো,তার মধ্যে চিকন দু’খানা সোনার বালা।
খুলে ফেললাম সেই বালা,চুড়ি।

বিয়েতে পরার জন্য অনেকগুলো রঙিন শাড়ির মধ্যে একটি সিঁদুর লাল রঙের শাড়ি ছিলো আমার স্বামী অভ্রর প্রিয় শাড়ি।
ভাগ্যক্রমে সেদিন সেই লাল শাড়ি পরনে ছিলো,সেই শাড়ি খুলে পরতে হলো একটা সাদা শাড়ি।

এই জগৎ আমার মিথ্যা মনে হয়।সব মিথ্যে অভ্র ছাড়া। আমার অভ্র তো আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসতো,কেনো এভাবে আমার অভ্রকে মেরে ফেললো?
যে স্বপ্ন দেখে স্বামীর সংসারে এসেছি সেই স্বপ্ন আজন্মের জন্য স্বপ্নই রয়ে গেলো। মাঝখান থেকে ফাঁকি দিয়ে অভ্র চলে গেলো।
অভ্রর মৃত্যুর পর আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়ি।২ বার সুইসাইড করতে গিয়েও ব্যর্থ হই।
প্রথম বার হাসপাতালে নিয়ে যায় ঘুমের ঔষধ খাওয়ার পর,দ্বিতীয় বার গলায় ফাঁস দিতে গেলে দরজা ভেঙে শ্বশুর বাড়ির লোকজন উদ্ধার করে আমাকে।

আমার শাশুড়ী আমার এই অবস্থা দেখে আরো বেশি ভেঙে পড়েন।বাবার বাড়ি থেকে বাবা মা ভাইয়া আপুরা এসে অনেক চেষ্টা করলো আমাকে বাবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু প্রাণ সয় না আমার এই বাড়ি ছাড়তে।
যদিও জানতাম এখানে আমার কিছু নেই।
প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর শুধু কান্না করে আল্লাহ কে জিজ্ঞেস করতাম,কি এমন অপরাধ ছিলো আল্লাহ,কেনো এভাবে অভ্রকে মেরে ফেললো ওরা?
কেনো আমার হাতের মেহেদীর রঙ উঠার আগেই বিধবা হয়ে গেলাম?
কেনো?
কি দিবে আমার এই প্রশ্নের উত্তর?
আমার বুক ফাঁটা কান্না শুনে বাসার সবাই কাঁদতো।আশেপাশের সবাই আসতো আমাকে সান্ত্বনা দিতে।
কিন্তু কিভাবে আমি শান্ত হবো?
আমি তো জানি আমি কাকে হারিয়েছি?
আমাকে কেনো খুন করলো না,আগে আমাকে মেরে ফেলতো তারপর আমার অভ্রকে মারতো।কিভাবে আমি বাঁচবো?
কাকে নিয়ে বাঁচবো আমি?

অভ্রর মৃত্যুর পর পুলিশ এলো।সবাইকে আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো।
পুলিশ এসে আমার জবানবন্দি নিলো।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম আমি পুলিশ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো,কাউকে আমি চিনতে পেরেছি কি-না! এই ঘটনার সাথে কোনোভাবে আমি জড়িত কি-না। এমন ও তো হতে পারে আমি পরকীয়া করছি,অভ্র বাঁধা দেয়ায় মানুষ ধরিয়ে ওকে খুন করাই,এবং সবাইকে বিভ্রান্ত করার জন্য ডাকাতির নাটক সাজাই।

কি নিষ্ঠুরভাবে তারা কথাগুলো বলে গেলো।তাদের বল প্রতিটি কথা ছুরির মতো ভিতরে গিয়ে আমার কলিজা ফালাফালা করে দিলো।

১ মাস ধরে পুলিশের আসা যাওয়া,জিজ্ঞাবাদের পর ওরা জানালো,তদন্ত চলছে,আসামীদের ধরতে পারলে জানানো হবে আমাদের।
আমি জানতাম কিছুই হবে না আর।আস্তে আস্তে ওরাও ভুলে যাবে অভ্র হত্যার কথা।তাদের দোষ দিয়েও লাভ নেই,প্রতিদিন হাজারটা মামলার ভিড়ে একটা অভ্র হত্যার কথা মনে না থাকাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু আমার কাছে তো অভ্র একজনই,সে আমার ভালোবাসা। সবাই ভুলে যেতে পারে কিন্তু আমি কিভাবে ভুলবো। এ যে একটা গভীর ক্ষত,কিছুতেই সারবে না।

২ মাস পর বাবার বাড়িতে এলাম।একপ্রকার জোর করেই ভাইয়ারা তুলে নিয়ে আসলো।বাবার বাড়ি আসার পর কষ্ট আরো বেশি হতে লাগলো আমার।সারাদিন আশেপাশের মহিলারা আসে,সবাই বারবার জিজ্ঞেস করে কিভাবে কি হয়েছিলো।
সবার কাছে একটা গল্পমাত্র,আমার কাছে তো জীবনের একটা কালো অধ্যায়।
যার ব্যথা সে-ই বুঝে,বাকীরা তো গল্প খোঁজে!

আমার কাটা গায়ে লবনের ছিঁটার মতো লাগতো যখন সবাই আমাকে দেখে আহ,উহ,আহারে মেয়েটার কপাল পোড়া,অভাগী,পোড়াকপালি বলে আফসোস করতো।

বড়ভাবী বিষয়টা খেয়াল করে সবার আগে,৭ দিনের মাথায় ভাবী বাড়িতে বিশেষ করে আমার কাছে মহিলাদের আসা বন্ধ করে দেয় দক্ষ হাতে।
যেই এসে বলতো,”কাজলের সাথে একটু দেখা করতে এসেছি,আহারে মেয়েটাকে একটু দেখতে এসেছি” তাকেই ভাবী মুখের উপর বলে দিতো,”দেখা করে কি করবেন?
ওর জামাইকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন আপনারা?
তাহলে দেখা করার দরকার নাই,ও মেন্টালি সিক এখন।”
ভাবীর এরকম চাঁচাছোলা জবাবের জন্য আশেপাশের সব মহিলার কাছে ভাবী বেয়াদব বউ বলে পরিচিত হয়ে গেলো দুই দিনের মাথায়।
তাতে ভাবী একটুও কষ্ট পায় নি।রিলেশনের সময় সবার আগে অভ্রর কথা আমি ভাবীকে জানিয়েছি,ভাবী আস্তে আস্তে সবাইকে ম্যানেজ করে দিয়েছে বাসায়।
যখনই আমি কান্না করতাম ভাবী,আপুরা ছুটে আসতো আমাকে সান্ত্বনা দিতে। সারাক্ষণই কেউ না কেউ সাথে থাকতো আমার।

কিন্তু কিছুতেই আমি মনকে শান্ত করতে পারতাম না।
কান্না যেনো গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে থাকতো। বুকের উপর যেনো একটা দশ মণ ওজনের পাথর বসে আছে সবসময়। ইচ্ছে করতো বুক কেটে ভিতর থেকে সব জ্বালা যন্ত্রণা বের করে দিই।
১০ দিন বাবার বাড়িতে থাকার পর ভিতরের জ্বালাপোড়া আরো বেড়ে গেলো। শাশুড়ী আম্মাকে কল দিয়ে বললাম,”মা’গো,তোমার কাজ করে দেয়ার জন্যও তো একটা দাসীবাঁদী দরকার হয়,আমাকে না হয় তোমার দাসী হিসেবে রেখে দাও মা,খাওয়া পরা ছাড়া কিছু দিতে হবে না,তবুও আমাকে নিয়ে যাও তোমার বাড়ি,ওখানে আমার জামাইয়ের সব স্মৃতি মা।ছোট একটা জীবন আমার কেটে যাবে মা ওর স্মৃতিচারণ করে,আমাকে তাড়িয়ে দিও না মা,ঠাঁই দাও একটু।”

শাশুড়ী আম্মা কান্নার জন্য কথা বলতে পারলেন না।কোনোমতে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললেন,”তুই চলে আয় মা,আমার দরজা তোর জন্য আজীবন খোলা থাকবে।”

সেদিন রাতেই বাবা মা ভাইয়া আপু সবার কথা উপেক্ষা করে চলে এলাম বাবার বাড়ি থেকে। ভাবী আপুরা অনেক চেষ্টা করলো আমাকে নিবৃত্ত করতে। কিন্তু পারে নি কেউ।
রাত সাড়ে আটটায় আমি শ্বশুর বাড়ি চলে এলাম।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম,মৃত্যু ছাড়া আর এই বাড়ি ছেড়ে যাবো না।
এখন আমার একমাত্র কাজ হচ্ছে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করা ওদের।

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে