কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে পর্ব-০৫

0
2240

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৫.
পায়ে হেঁটে পদ্মদিঘি দেখতে বেরিয়েছে নৈঋতা-রৌদ্রুপ। নৈঋতা বলেছিল রৌদ্রুপের হাঁটতে কষ্ট হলে ভ্যানগাড়ি নিতে পারে। রৌদ্রুপ তাতে রাজি হয়নি। নৈঋতার সাথে গল্প করতে-করতে পথ চলার লোভটা সে সামলাতে পারেনি। নৈঋতারও বেশ ভালো লাগছে রৌদ্রুপের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে। রৌদ্রুপের শহুরে জীবনের গল্প সে খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে। গল্পে-গল্পে কখন সে এই মানুষটার সাথে পরিচিত জনের মতোই আলাপ জমিয়েছে বুঝতেই পারেনি। রৌদ্রুপের মতো সে-ও নিজের গল্প বলে চলেছে। রৌদ্রুপও নৈঋতার গ্রাম্য জীবনের গল্প শুনে মুগ্ধ হচ্ছে। গল্প করতে-করতে প্রায় পনেরো মিনিটের পথ পেরিয়ে তারা পদ্মদিঘী পৌঁছল। ইয়া বড়ো দিঘি, বড়োসড়ো এক মাঠের সমান। টলমলে হালকা সবুজ বর্ণের পানি। তার মাঝে শত-শত রূপসী পদ্ম মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তারা যেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে শহুরে নতুন অতিথিকে স্বাগত জানাচ্ছে। রৌদ্রুপের মুগ্ধতার শেষ নেই। একদিকে এই পদ্মদিঘির বর্ণনাতীত সৌন্দর্য, আরেকদিকে সাক্ষাৎ পদ্মাবতীর। রৌদ্রুপ এসেই দিঘির পাড় থেকে হাত বাড়িয়ে একটা পদ্ম তুলল। নৈঋতা ততক্ষণে পাড়ে বেঁধে রাখা ডিঙি নৌকায় উঠে বসে তাকে ডাকতে শুরু করেছে। রৌদ্রুপ এগিয়ে গেল। এক লাফে নৌকায় উঠে বসল। নৈঋতা বৈঠা হাতে নিল। নৌকার বাঁধন খুলে বৈঠা চালাতে শুরু করল। নৌকার দুপাশে দুজন। নৈঋতা উৎফুল্ল মনে নৌকা বাইছে, আর রৌদ্রুপ মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছে পদ্মদিঘীর পদ্মাবতীকে। এই গ্রামটা কি তাকে এমন মায়াবী বিস্ময়ের জালে আটকাবে বলে টেনে এনেছে? দুদিন আগেও তো সুন্দরী মেয়েরা সামনে দাঁড়ালে তাদের প্রতি এমন অদ্ভুত অনুভূতি জন্মাত না। অথচ এই গ্রামে পা রাখতেই অজানা এক অনুভূতি এসে মায়াজালের মতো তার চারদিকে বেষ্টনী তৈরি করে দিলো। এই বেষ্টনী থেকে বেরোনোর কোনো উপায় তার জানা নেই। বরং সে টের পাচ্ছে এ বেষ্টনী ক্রমশ শক্ত থেকে শক্ত হচ্ছে। হুট করে জন্মানো এই অনুভূতির নাম খুঁজতে গিয়ে রৌদ্রুপ নিজেই বারংবার আরও অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। নৌকার অপর প্রান্তে বৈঠা হাতে হাস্যোজ্জ্বল মুখের তরুণীর মাঝে তেমন বিশেষ কিছু তো নেই, শুধু শরীরের সাদা রংটা ছাড়া। রৌদ্রুপের সাথে তুলনায়ও কেবল তার আকর্ষণীয় রূপটাই উঠে আসবে। গভীরভাবে ভাবতে গিয়ে রৌদ্রুপ নিজের মনের কাছেই প্রশ্ন রেখেছে, এ অনুভূতির নাম কী দেওয়া যায়? কেবল ওই আকর্ষণীয় রূপে ভরা যৌবনে আকৃষ্ট হলে তার নাম সে ‘ভালোবাসা’ দিতে চায় না। তবু রৌদ্রুপ খুব করে চাইছে নিজের অনুভূতিকে সঠিকভাবে জানার। গত দুদিনেই মায়াবী মেয়েটা তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। রৌদ্রুপ গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মোহাচ্ছন্নের মতো উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল নৌকার অপর প্রান্তে। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে নৈঋতার বৈঠা ধরা হাত স্থির হলো। এতক্ষণের হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রশ্নের ছাপ পড়ল। রৌদ্রুপ গিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লে তার মুখে একটু অপ্রস্তুতির ছাপ ফুটে উঠল। রৌদ্রুপ বিনা বাক্যে হাতের পদ্ম ফুলটা গুঁজে দিলো নৈঋতার কানের পাশে। নৈঋতা লজ্জায় লাল হলো। দৃষ্টি নামিয়ে নিতেই রৌদ্রুপ নিচু স্বরে বলল,
“পদ্ম ছাড়া পদ্মাবতীকে অসম্পূর্ণ লাগছে। এবার ঠিক আছে। পূর্ণ পদ্মাবতী।”
নৈঋতা বিস্ময় নিয়ে চোখ তুলে তাকাল। আবার আরেক নাম! মেঘবতী, পদ্মাবতী। এসব নাম কেন দেয় লোকটা? এসব নতুন-নতুন নামে ডাকলে যে তার হৃদপিন্ডে তুমুল ঝড় বয়ে যায়, তা কি লোকটা জানে? নৈঋতার লাজুক চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা সম্ভবপর হলো না। দৃষ্টি ফিরিয়ে রৌদ্রুপ পুনরায় নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। নৈঋতা পুনরায় ধীর গতিতে বৈঠা চালালো। তার ঠোঁটের কোণের লাজুক হাসিটুকু রৌদ্রুপের মুখেও হাসি ফোটাল। নৌকা বাইতে-বাইতে নৈঋতা মুঠো ভর্তি পদ্ম তুলে নৌকার পাটাতনে রাখল। অনেকটা সময় নিয়ে পদ্মদিঘী চক্কর দিয়ে নৈঋতা ডাঙায় নৌকা ভিড়াল। নৌকা থেকে নেমেই রৌদ্রুপ হাসিমুখে বলল,
“ভ্রমণটা অসাধারণ ছিল। থ্যাংকস অ্যা লট।”
নৈঋতা হাসল। পরক্ষণেই কাঁচুমাচু মুখে অনুরোধের সুরে বলল,
“বাম দিগের রাস্তা দিয়া যাইবেন?”
“তুমি তো বললে বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে যেতে বেশি সময় লাগে। তো শর্টকাট রেখে বড়ো রাস্তা দিয়ে যেতে চাইছো কেন?” ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করল রৌদ্রুপ।
“অহনও অনেক সময় আছে। চলেন না,” আবারো অনুরোধ নৈঋতার।
রৌদ্রুপ বুঝল নৈঋতার বড়ো রাস্তা ধরে যেতে চাওয়ার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। তাই বেশি প্রশ্ন না করে রাজি হয়ে গেল। নৈঋতার চোখে-মুখে দারুণ উচ্ছাস। সে দ্রুত পা চালালো বাঁ দিকের রাস্তায়। রৌদ্রুপও তার সাথে পা মিলালো। একনাগাড়ে অর্ধেকটা পথ হাঁটার পর নৈঋতা হঠাৎ পা থামাল। রৌদ্রুপ প্রশ্ন করল,
“থামলে কেন? পা ব্যথা করছে?”
নৈঋতা দ্রুত ডানে-বায়ে মাথা দুলিয়ে রাস্তার ডান দিকে চোখের ইশারায় দেখাল। সেদিকে তাকিয়ে রৌদ্রুপ কপাল কুঁচকে ফেলল। রাস্তার ডান পাশে ছোটোখাটো একটা খোলা মাঠ। ছোটো থেকে তরুণী বয়সী একদল মেয়েরা সেখানে খেলছে। খেলছে কী? ছুটাছুটি করেই তো কূল পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখে রৌদ্রুপ নৈঋতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“কী?”
নৈঋতা ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে মিষ্টি হেসে বলল,
“একটু দাঁড়াইবেন? আমি ততক্ষণ খেইলা আহি।”
রৌদ্রুপ বোকা-বোকা চোখে বার তিনেক পলক ফেলে বলল,
“খেলবে মানে?”
“হুঁ, বেশিক্ষণ খেলমু না। যাই?”
রৌদ্রুপ ভাবেওনি নৈঋতার মাথায় এসব চলছিল। তবে তার এতে আগ্রহ জাগল। অগত্যা সম্মতি জানাল। অনুমতি পেয়ে নৈঋতা ছুট লাগাল মাঠের ডান দিকে। রৌদ্রুপ তাকে আটকানোর সুযোগটুকুও পেল না। নৈঋতা যাওয়ামাত্র মাঠের মেয়েগুলো তাকে ঘিরে ধরল। নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ শলা পরামর্শ করে আবার খেলা শুরু করল। এবার রৌদ্রুপ ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। কারণ নৈঋতা সত্যি-সত্যিই খেলতে নেমেছে। কোমরে ওড়না গুঁজে ছুট লাগিয়েছে। মুখে তার উপচে পড়া উৎফুল্ল হাসি। রৌদ্রুপের বিস্ময় ভরা চোখে মুগ্ধতা এসে ভর করল। অতি লজ্জাবতীর মধ্যে যে এমন চঞ্চলতা লুকিয়ে আছে, এ তার জানা ছিল না। নৈঋতার প্রাণখোলা হাসিটা যেন সোজা এসে রৌদ্রুপের হৃদপিন্ডে আঘা’ত হানল। সে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখপানে। টানা পনেরো মিনিট রৌদ্রুপ এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে নৈঋতার চঞ্চল রূপ দেখল। তারপর হাতের ঘড়ি দেখে চিন্তা করল, এখনও বাড়ি না ফিরলে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। রৌদ্রুপ রাস্তা থেকে নেমে এগিয়ে গেল। মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকল,
“নৈঋ? নৈঋ?”
দুবারেই নৈঋতা খেলা থামিয়ে ফিরে তাকাল। তার সাথে সব মেয়েরাই সেদিকে তাকাল। রৌদ্রুপ হাতের ইশারায় নৈঋতাকে ডেকে বলল,
“চলে এসো। দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
সব মেয়েরা অবাক চোখে একবার রৌদ্রুপকে, তো কয়েকবার নৈঋতাকে দেখছে। অপরিচিত লোকের প্রতি তাদের যত কৌতুহল। মেয়েগুলোর দৃষ্টি দেখে রৌদ্রুপ চোখ দুটো সরু করল। ওদিকে কুসুমিতা চোখ দুটো ছানাবড়া করে বলেই ফেলল,
“ওই রিতা। এইডা কে?”
নৈঋতা হেসে বলল,
“ওই যে কইছিলাম না শহর থিকা আমগো বাইত মেহমান আইব? ওই মেহমান।”
“আরেব্বাস! এ তো ঝাক্কাস মেহমান। কী সুরত রে! দেহিস রিতা, প্রেমে পইড়া যাইস না আবার। আমার তো মন চাইতাছে বেডারে ধইরা-বাইন্ধা বিয়া কইরা ফালাই।”
নৈঋতা কপাল কুঁচকে কুসুমিতার মাথায় জোরে এক থাপ্প’ড় মা’রল। তিক্ত মুখে বলল,
“স্বভাব পালটা লুচু মাইয়া। আমারে তোর মতোন মনে করস?”
কুসুমিতা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“অ্যাহ্! বেডারে লইয়া গ্রামে ঘুইরা বেড়াইতাছ, আবার বড়ো-বড়ো কতা কও?”
“উনি নিজেই ঘুরতে চাইছে। মায় কইছে দেইখা আমি নিয়া আইছি। উলটা-পালটা কতা কইস না। আমি গেলাম।”
নৈঋতা সামনের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে দোলা বলে উঠল,
“তিন দিন পর আইজ খেলতে আইলি। আবার কয়দিন পর আইবি?”
ওদের খ’প্পরে পড়ার ভয়ে নৈঋতা ফিরে না তাকিয়েই হাঁটতে-হাঁটতে উত্তর দিলো,
“জানি না। মেহমান আইছে দেইখা মায় বাইত থিকা বাইর হইতে দেয় না। সুযোগ পাইলে আমু নে।”
রৌদ্রুপ মাঠের পাশ থেকে আবার রাস্তায় উঠে দাঁড়িয়ে আছে। নৈঋতা কোমর থেকে ওড়না খুলে মাথায় পরতে-পরতে এগিয়ে গেল। সে আসতেই রৌদ্রুপ ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“কী চঞ্চলা? তুমি তো দেখছি মোটামুটি চঞ্চল আছো। আমি ভেবেছিলাম তুমি খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে। এখন তো দেখছি আমার দুটো দিনের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিলে।”
নৈঋতা লাজুক মুখে মিষ্টি করে হেসে বলল,
“মায়েরে কইবেন না তো?”
“কেন? ভয় পাও?”
নৈঋতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। সামনের দিকে পা বাড়িয়ে রৌদ্রুপ প্রশ্ন করল,
“সবসময় এখানে খেলো না কি?”
নৈঋতা রৌদ্রুপের সাথে পা মিলিয়ে উত্তর দিলো,
“মাঝে-মাঝে খেলি। মায় আইতে দিতে চায় না। লুকায়া আহি। আপনে আওয়ার পর তো বাইত থিকাই বাইর হইতে দেয় না।”
“তাহলে তো আমি এসে তোমায় বিরক্তিতে ফেললাম।”
“না, না। বিরক্ত হই নাই তো।”
“আচ্ছা, তো আন্টিকে ভয় পেলে আসো কেন খেলতে?”
নৈঋতা মিনমিনে কন্ঠে বলল,
“খেলার অভ্যাস ছাড়তে পারিনাই। বড়ো হইছি দেইখা মা রাগারাগী করে। কিন্তু আমার খেলতে ভালা লাগে। কী করমু? মা বোঝেই না এই মাঠে পুরুষ মানুষের চলাচল কম। এমনেও এহন আগের মতো অত বেশি যাই না। সুযোগ পাইলে যাই।”
রৌদ্রুপ মৃদু ভঙ্গিতে মাথা দোলাল। তারপর মজা করে বলল,
“এখন যদি গিয়ে আমি আন্টিকে বলে দিই?”
নৈঋতার মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। অসহায় মুখে বলল,
“কইবেন?”
“যদি বলি?”
নৈঋতাকে একটু চিন্তিত দেখাল। পরক্ষণেই আবার কী ভেবে বলে উঠল,
“আপনে ভয় দেখানোর লাইগা কইতাছেন।”
“সত্যিও তো বলতে পারি।”
“মিছা কতা।”
নৈঋতার দৃঢ় কন্ঠ শুনে রৌদ্রুপ আপন মনে হাসল। টুকটাক গল্প করতে-করতে সন্ধ্যার আগেই দুজন বাড়ি পৌঁছাল। সবেমাত্র নৈঋতা নিজের ঘরের দিকে দু’পা বাড়িয়েছে, তখনই পিছুডাক,
“শোনো মেয়ে।”
নৈঋতা দাঁড়াল। বুকটা ধক করে উঠল। এখনই যে কোনো এক পা’ষাণ বাক্য তার হৃদপিন্ডে হাতুড়িপেটা করবে, তা সে বেশ বুঝতে পারল। তার ধারণাকে সত্যি করে রৌদ্রুপ কোমল কন্ঠে বলল,
“চঞ্চলতাও তোমার সাথে মানানসই। লজ্জা দিয়ে তা লুকিয়ে রেখো না চঞ্চলা। লাজুকতায় তুমি যতটা সুন্দর, উচ্ছলতায়ও তাই।”
কথাটা বলতে দেরী হলেও, নৈঋতার ছুটে পালাতে দেরী হয়নি। সেদিক তাকিয়ে রৌদ্রুপ হাসিমুখে বুল ফুলিয়ে দম নিল।

হাতে একটা আধ পুরোনো শাড়ি নিয়ে বসে আছে নৈঋতা। মুখ ভার করে সে মাথা নিচু করে আছে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে আফিয়া বেগম ষষ্ঠবারের মতো বিদ্রুপ করে বললেন,
“ভালা মানুষগিরি দেহাস, হ্যাঁ? সারাজীবন এই সংসারে ভুইগা আইছি আমি। তোর অবস্থাও এমনই হইব দেইখা রাহিস। আরে, বেডা মাইনষের মন আর কিছুতে না গললেও, মাইয়া মাইনষের রূপে ঠিকই গলে। আর এ তো শহরের বেডা।”
নৈঋতা গম্ভীর গলায় বলল,
“সব মানুষ এক হয় না মা। ওনারে দেইখা তা আমি বুঝছি। কায়েস ভাইরা আমারে দেখলে কী খারাপ নজরে চায়। কী বিশ্রী কতা কয়! কিন্তু ওই শহরের মেহমানের চোখে ওমন খারাপ কিছু নাই। হেয় আমার শইলের না, সৌন্দর্যের প্রশংসা করে।”
“এল্লেগ্গাই তো কইতাছি হাত করতে। একবার হাত করার চেষ্টা কর, হেরপর আজীবন সুখে কা’টাইতে পারবি। তাড়াতাড়ি আয়, কাপড়ডা পরাইয়া দেই।”
আফিয়া বেগম নৈঋতার হাত ধরে টেনে দাঁড় করালেন। নৈঋতার হাত থেকে শাড়িটা কেড়ে নিয়ে একটা পুরোনো ব্লাউজ আর পেটিকোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বললেন,
“এগুলা পর তাড়াতাড়ি।”
“মা, আমার কতাডা একটু হুনো”, অসহায় মুখে অনুরোধ করল নৈঋতা।
আফিয়া বেগমের মন তাতে পালটাল না। বরং চোখ গরম করে বলে উঠলেন,
“কতা পরে কইস। এইগুলা পর আগে।”
মায়ের ধমকিতে নৈঋতা চুপসানো মুখে ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে নিল। আফিয়া বেগম বেশ যত্ন সহকারে মেয়েকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। সুন্দর করে চুল আঁচড়ে চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে দিলেন। মুখে পাউডার দিয়ে দিলেন। নৈঋতা শুধু থম মে’রে বসে রইল। মেয়েকে সাধারণভাবে সাজানো শেষ করে আফিয়া বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন একটা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। চায়ের কাপটা নৈঋতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“যা এইবার।”
“এইডা ঠিক হইতাছে না মা। আমার শরম লাগে,” কাঁদো-কাঁদো মুখ করে বলল নৈঋতা।
আফিয়া বেগম পুনরায় ধমকে উঠে আরেক দফা কটুক্তি ছুঁড়ে দিলেন। মাকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে নৈঋতা লজ্জা, সংকোচ, বিষণ্ণ মন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রৌদ্রুপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখছিল আর কিছু একটা ভাবছিল। দরজায় টোকা পড়ায় তার ভাবনায় ছেদ পড়ল। নিজের দৃষ্টি অনড় রেখে উঁচু গলায় বলল,
“দরজা খোলা আছে।”
তবু সে ফিরে তাকাল না। মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তাগুলো জটলা পাকিয়ে বসেছে। নৈঋতা একরাশ অস্বস্তি নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। অদূরে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল কিছু মুহূর্ত। আশা করছিল রৌদ্রুপ কখন ফিরে তাকাবে। তার যে ভীষণ লজ্জা লাগছে। চিন্তিত রৌদ্রুপ ফিরে তাকায়নি। শেষমেষ নৈঋতা ইতস্তত করে নিচু স্বরে বলল,
“আপনের চা।”
এসময় যে নৈঋতাই এসেছে তা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল রৌদ্রুপ। সে-ও এটাই চাইছিল নৈঋতা নিজেই তাকে ডাকুক। নৈঋতার কথায় এবার ফিরে তাকাল। মুহুর্তেই তার দু চোখে যেন অদ্ভুত আলোর রাজ্য ভেসে উঠল। দৃষ্টি আটকে গেল সামনের শাড়ি পরিহিতা অতিশয় সুন্দর রমণীর ওপর। আধ পুরোনো নীল শাড়িতে রৌদ্রুপের দৃষ্টিতে নৈঋতাকে নীলাম্বরের মতো লাগছে। দুচোখে বিস্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে সে ভাষাহীন তাকিয়ে রইল নৈঋতার দিকে। হঠাৎ এ রূপ কেন মেয়েটার? এই মেয়ে কি তার চোখের তৃষ্ণা বাড়ানোর পায়তারা করছে? নৈঋতা মাথা তুলে তাকাতেই একদফা দৃষ্টি বিনিময় হলো ওই বিপজ্জনক চোখ জোড়ার সাথে। সঙ্গে-সঙ্গে সে মিইয়ে পড়ল। অস্বস্তি আরও বেশি চেপে ধরল। পুনরায় মাথা নিচু করে দুহাতে শক্ত করে চায়ের কাপ চেপে ধরল। মনে-মনে নিজেকে হাজারটা গালি দিলো। কেন সে মাকে বুঝাতে পারল না? কেন ভয় নিয়ে থাকল? এবার যদি রৌদ্রুপ তাকে নির্লজ্জ ভাবে? সে তো বিশ্বাস করে রৌদ্রুপ বাজে মনোভাবের ছেলে নয়। মুগ্ধতার রেশ ধরে রৌদ্রুপ উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল‌ নৈঋতার দিকে। তাকে এগোতে দেখেই নৈঋতার হঠাৎ গলা শুকিয়ে এল। হৃদস্পন্দন দ্বিগুণ হারে বেড়ে গেল। ভয়ে না, লজ্জায়। রৌদ্রুপ নৈঋতার সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল চায়ের কাপের জন্য। নৈঋতা কাঁপা হাতে চায়ের কাপটা তার হাতে দিলো। নৈঋতার কম্পন দেখে রৌদ্রুপ মৃদু হাসল। তবু সামনে থেকে সরে গেল না। মুখোমুখি দাঁড়িয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
“লজ্জাবতী, হঠাৎ শাড়ি কেন?”
নৈঋতা আমতা-আমতা করে নিচু স্বরে বলল,
“মায় পরায়া দিছে।”
“তো এমন উস-খুস করছ কেন? শাড়িতে সুন্দর লাগছে তোমাকে।”
নৈঋতাকে সহজ করার উদ্দেশ্যে হলেও সত্যিটাই বলল রৌদ্রুপ। অথচ এতে নৈঋতার আড়ষ্টতার সাথে-সাথে হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়ে চলল। রৌদ্রুপ মুচকি হাসি মুখে ঝুলিয়ে সরে গিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল। নৈঋতার দিকে দৃষ্টি রেখেই চায়ের কাপে একের পর এক চুমুক দিয়ে চলল। নৈঋতা একবারও মাথা তুলে তাকাল না। তার চঞ্চল দৃষ্টি মাটিতেই বিচরণ করছে। রৌদ্রুপ খেয়াল করল শাড়ি সামলাতে মেয়েটাকে রীতিমতো নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে। হয়তো অভ্যাস নেই। তারপর আবার শাড়িতে পিন করা হয়নি। ফলস্বরূপ বাঁ কাঁধে রাখা আঁচলটা বারবার খসে পড়তে চাইছে। নৈঋতা বিরক্তি নিয়ে বারবার জড়োসড়ো ভঙ্গিতে আঁচল টেনে ঠিক করছে। হাত উঠিয়ে আঁচল ঠিক করার চেষ্টা করতে গিয়ে যে একবার তার ফরসা উদরের কিছু অংশ দৃশ্যমান হয়ে গেল, সে খেয়াল মেয়েটার নেই। সে তো‌ আঁচল সামলাতেই ব্যস্ত। রৌদ্রুপ ফাঁকা একটা শুকনো ঢোক গিলে দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। মিনিট খানেক চুপ মে’রে বসে থেকে নৈঋতার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করল,
“এর আগে কখনও শাড়ি পারনি?”
“না।”
“যাতে অভ্যস্ত নও তা পরলে কেন?”
নৈঋতা হকচকিয়ে গেল। আমতা-আমতা করে বলল,
“মায় পরাইছে দেইখা পরছি।”
রৌদ্রুপ একটু ইতস্তত করে শুধাল,
“সেফটিপিন নেই?”
নৈঋতা এবার একটু বেশিই চমকাল। মায়ের এমন কাজে লজ্জায় তার নিজেরই মাটি ফাঁক করে ঢুকে পড়তে ইচ্ছা করছে। সেফটিপিন তো ছিল দুইটা। মা সেগুলো ব্যবহারই করল না। বলল এসব শাড়ি সেফটিপিন ছাড়াই সামলানো যায়। আনাড়ি নৈঋতা নিজের আনাড়িপনাকেই দোষ দিলো। কিন্তু রৌদ্রুপকে এসব বলতে না পেরে চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে রইল। তার উত্তরের আশায় থেকে রৌদ্রুপ বুঝল বোকা মেয়েটার মনের হাল। নিঃশব্দে শ্বাস ছেড়ে সে নরম গলায় বলল,
“নৈঋ, কিছু মনে কোরো না। তোমার ভালোর জন্য একটা কথা বলি। তুমি এখনও ছোটো একটা মেয়ে। যে পোশাক সামলাতে পারো না, তা পরে বাইরের কারো সামনে যেয়ো না। পোশাকে তোমার সৌন্দর্য যতই বাড়ুক। তোমার বেসামাল অবস্থা দেখে কিন্তু সবাই চোখ ফিরিয়ে নিবে না। বরং চোখ দিয়ে ভস্ম করতে চাইবে। এত সহজে সবাইকে বিশ্বাসও কোরো না। তোমার মতো মেয়ের জন্য এটা খুবই ভ’য়ং’কর।”
নৈঋতা ডানহাতে বাঁ কাঁধের আঁচল চেপে ধরে অবাক চোখে রৌদ্রুপের মুখের দিকে তাকাল। লোকটা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। হঠাৎ করেই এই স্বল্প পরিচিত মানুষটার প্রতি তার প্রবল শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠল। এত বছরে সে বহুবার বহু ছেলেদের লোভাতুর দৃষ্টির শি’কার হয়েছে। এই লোকটাও তো ওদের মতোই একজন পুরুষ। অথচ মনুষ্যত্বে বিস্তর ফারাক। নৈঋতার হঠাৎ চোখ গেল টেবিলে রাখা শূন্য জগের ওপর। এগিয়ে গিয়ে জগটা হাতে নিয়ে সে চুপচাপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। রৌদ্রুপ সেদিকে ফিরেও তাকাল না। চায়ের কাপ নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সে চা শেষ করতে-করতে নৈঋতা আবার ফিরে এল। রৌদ্রুপ পেছন ফিরে তাকিয়ে নৈঋতার পরনে এবার থ্রি-পিস দেখে মুচকি হেসে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াল। আশ্চর্যজনকভাবে কিছুক্ষণ আগের নৈঋতার সাথে এই মূহুর্তের নৈঋতার মুখোভাবে অনেক পার্থক্য। কিছুক্ষণ আগের এত-এত লজ্জা, সংকোচ, জড়তা এখন আর নেই। পানি ভর্তি জগটা টেবিলে রেখে নৈঋতা পেছন থেকে উঁকি মে-রে দেখল রৌদ্রুপের চা খাওয়া শেষ। এগিয়ে গিয়ে রৌদ্রুপের কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কাপটা নিয়া যাই, দ্যান।”
রৌদ্রুপ নৈঋতার হাতে কাপটা ফিরিয়ে দিলো। বাইরে প্রচণ্ড জোরে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ হলো। নৈঋতা চমকে উঠে জানালার পাশে ছুটে গেল। রৌদ্রুপের পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে উঁকি মে’রে দেখল হঠাৎ করে বেশ জোরেশোরেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নৈঋতার মুখের অভিপ্রায় লক্ষ্য করে রৌদ্রুপ প্রশ্ন করল,
“বৃষ্টি পছন্দ করো না?”
নৈঋতা গোমড়া মুখে ডানে-বায়ে মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলো,
“না।”
“কেন? বৃষ্টি তো ভালো লাগার জিনিস। আচ্ছা বলো তো, তোমার কাছে বৃষ্টি মানে কী?”
“বিষণ্ণতা, কষ্ট, আহাজারি,” মলিন মুখে উত্তর দিলো নৈঋতা।
রৌদ্রুপ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
“তা কেন?”
“আমগো মতোন গরিবের লাইগা বৃষ্টি কহনও সুখ নিয়া আহে না। সব ফসল ভাসাইয়া নিয়া দুঃখের সাগরে ডুবাইয়া দিয়া যায়। তিনবেলা খাওন জোগাইতেও কত হাঁ-হুতাশ করা লাগে, তা আমরা বুঝি।”
রৌদ্রুপের মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। এভাবে তো সে ভাবেনি। সচ্ছল পরিবারের ছেলে সে। অভাব-অনটন অনুভব করার সুযোগই আসেনি কখনো। নৈঋতা প্রশ্ন করে বসল,
“আপনের কাছে বৃষ্টি মানে কী?”
“প্রশান্তি।”
নৈঋতা রৌদ্রুপের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাইলে তো অহন আপনের মন অনেক ভালা থাকার কতা। আমার কতায় খারাপ হইয়া গেল।”
রৌদ্রুপ মৃদু হেসে ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নৈঋতা পুনরায় জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি আবদ্ধ করল। উদাস কন্ঠে বলল,
“একই বৃষ্টি। অথচ কারো হাসির কারণ, করো দুঃখের।”
“জীবন তো এমনই, বিচিত্র।”
“তয় আমার কিন্তু মেঘলা আকাশ ভাল্লাগে,” রৌদ্রুপের দিকে তাকিয়ে বলল নৈঋতা।
“বৃষ্টি ভালো লাগে না, মেঘলা আকাশ ভালো লাগে?”
নৈঋতা মাথা ঝাঁকিয়ে প্রশস্ত হেসে বলল,
“হ। আকাশে মেঘ করলে পরিবেশটা একেবারে শান্ত, গুমোট থাহে। ওইসময় আকাশ দেখতেও ভালা লাগে।”
রৌদ্রুপ মৃদু শব্দ তুলে হেসে বলল,
“আচ্ছা‌‌ বুঝলাম। মাছ ভালো লাগে না, মাছের ঝোল ভালো লাগে।”
নৈঋতা মুখটা ছোটো করে বলল,
“অ্যাঁ!”
“হ্যাঁ,” হাসতে-হাসতে বলল রৌদ্রুপ।
“আপনে মজা নিতাছেন?” গাল ফুলিয়ে প্রশ্ন করল নৈঋতা।
রৌদ্রুপ ঠোঁট টিপে হেসে দুপাশে মাথা দুলিয়ে বলল,
“মোটেও না।”
“এই তো হাসতাছেন।”
“তো কী করব? কাঁদব?”
হঠাৎ বাইরের দিকে তাকিয়ে নৈঋতা বলে উঠল,
“বৃষ্টি কমছে একটু। যাইগা, নইলে পরে আবার আরও জোরে নামব।”
রৌদ্রুপের দিকে না তাকিয়েই নৈঋতা দ্রুত দরজার দিকে হাঁটা দিলো। দুপা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রৌদ্রুপ পিছু ডাকল,
“শোনো মেয়ে।”
নৈঋতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাল। পরের বাক্যটা শোনার অপেক্ষায় রৌদ্রুপের দিকে তাকিয়ে রইল। সবসময় এভাবে পিছু ডাকাটা বোধ হয় লোকটার অভ্যাস। এটাকে ভালো অভ্যাস, না খারাপ অভ্যাস বলে, নৈঋতার জানা নেই। নৈঋতার প্রশ্নভরা চোখে চোখ রেখে রৌদ্রুপ কোমল কন্ঠে বলল,
“আজ যেভাবে শাড়ি পরেছ, সঠিক একজন মানুষ না পাওয়া অবধি এভাবে শাড়ি পোরো না। যখন পাবে, তখন থেকে তোমার সেফটিপিনবিহীন আঁচল সামলানোর দায়িত্বটা তার। বাকি সব লোভাতুর দৃষ্টি তখন চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাবে না। ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করো মেঘবতী।”
নৈঋতা লজ্জায় নেতিয়ে পড়ে হরিণ শাবকের মতো ছুটে পালাল।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে