কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
3670

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২০.
বারান্দায় রৌদ্রুপ একটা দোলনা কিনে এনে বসিয়েছে। নৈঋতার আরামের জন্যই এই ব্যবস্থা। সামান্যতম সাজগোজের পর নৈঋতাকে নিয়ে সেখানে গিয়ে বসেছে রৌদ্রুপ। নৈঋতা পা তুলে আরাম করে বসেছে। রৌদ্রুপের বুকে তার শরীরের ভর। অতি যত্নে রৌদ্রুপ তার দেহটাকে বুকে আগলে রেখেছে। এক হাতের আঙুল বুলিয়ে চলেছে তার চুলের ফাঁকে। নৈঋতা বিড়বিড় করে কথা বলেই চলেছে। রৌদ্রুপ কান পেতে খুব মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনছে, মাঝে-মাঝে উত্তর দিচ্ছে, হাসছে। বারান্দার বাতি নিভিয়ে রেখেছে রৌদ্রুপ। পূর্ণ চাঁদের আলো এসে পড়েছে বারান্দার একপাশে, দোলনার ওপরে। সেই আলোতে স্ত্রীর মুখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে রৌদ্রুপ। এই মেয়েটা সবসময় তার চোখে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। কিন্তু এই মুহূর্তে যেন তার রূপ আরও একগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই তো তার অনবরত বকবকানিতেও রৌদ্রুপের বিরক্তির লেশমাত্র নেই। সময় কত দ্রুত চলে যায়। সবসময় মনে হয় এই তো সেদিন এক ভারী বর্ষণে দুজনের সাক্ষাৎ ঘটেছিল। চোখে চোখ পড়েছিল, মনের আদান-প্রদান হয়েছিল। আর তারপর কত বাঁধা পেরিয়ে তারা একে অপরকে আঁকড়ে ধরেছিল। মানসপটে প্রত্যেকটা স্মৃতি জীবন্ত। অথচ পেরিয়ে গেছে আড়াই বছরেরও বেশি। নৈঋতা আফসোসের সুরে বলল,
“সুখের সময়গুলা এত দ্রুত কা’টে ক্যান কন তো? এই তো কদিন আগে হুট কইরা আমগো দেখা হইলো, প্রেম হইলো। অথচ হিসাব কষলে হইয়া যায় তিন বছরের কাছাকাছি!”
রৌদ্রুপ বলল,
“হবে না? এখন তো আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা থেকে বাবা-মা হতে চলেছি।”
“আমি চাই না আপনের লগে আমার সুখের দিনগুলা এত দ্রুত কা’ইটা যাক। আমার কোনো দৈবশক্তি থাকলে, আমি এই সময়গুলা এইহানেই থামায়া রাখতাম। আপনের লগে আমার এমন হাজারো দিন কা’টানের লোভ। এইভাবে আঁকড়ায়া ধইরা আজীবন ভালোবাসার লোভ। ইশ্! কী লোভী আমি!”
“আমার লোভী মেঘবতীর মতো তো আমিও ভীষণ লোভী হয়ে গেছি। তবে আমাদের এ লোভ আজন্ম থাকুক। ওই আকাশের মতো সুবিশাল হোক আমাদের সম্পর্কের স্থায়ীত্ব।”
“বেশ তো। আপনের সেই আকাশে আমি চাঁদ না, সূর্য হমু।”
“চাঁদ না কেন?”
“চাঁদ তো রোজ থাহে না। আইজ ওঠে, কাইল ডোবে। যহন ডুইবা যায়, তহন আবার পৃথিবীতে দিয়ে যায় অমবস্যা। আমি আপনের জীবনে অমবস্যা দিতে চাই না। আমি চাই সূর্যের মতোন রোজ আপনের জীবনে উঁকি দিতে।”
“সূর্য-ও তো সকালে উঠে সন্ধ্যায় ডুবে যায়।”
“যাক না। আমি আপনের মাঝেই ডুইবা যামু, তবে একেবারে হারামু না। আবার নিয়মমাফিক রোজ সকালে জাইগা উঠমু।”
রৌদ্রুপ নৈঋতার গালে উষ্ণ চুমু খেয়ে বলল,
“আমার ছোট্ট মেঘবতী বড়ো হয়ে গেছে। কত কথা শিখেছে!”
নৈঋতা উৎসুক হয়ে শুধাল,
“আপনের মতো?”
রৌদ্রুপ মুচকি হেসে বলল,
“তুমি সবসময় আমার মতোই কেন হতে চাও? তুমি হবে তোমার মতো। এটাই তো সুন্দর।”
“না, আমি আপনের মতোই হমু।”
নৈঋতার অনড় কথায় রৌদ্রুপ হেসে ফেলল। নৈঋতাকে আলতো করে জড়িয়ে রাখা হাতের বাঁধন সামান্য একটু শক্ত করে বলল,
“ঠিক আছে মহারানি। আপনি আমার মতোই হোন। আমার বাবুটা আপনার মতো হলেই হবে।”
“উঁহু, বাবুও আপনের মতোই হইব। আমার মতো হইলে সারাক্ষণ আপনের আদর পাইতে চাইব। তহন আমার দিকে কে তাকাইব?”
“তা বলে কি আমি বাবুকে আদর করব না?”
“না কহন কইলাম? অবশ্যই করবেন। কিন্তু বাবুর আম্মুর আদরে কমতি যেন না হয়।”
নৈঋতার ফোলা পেটে হাত বুলিয়ে রৌদ্রুপ বলল,
“তাহলে বাবুর আদরে কমতি হবে না?”
“উঁহু, আমি পুষায়া দিমু।”
“তা আমার হিং’সুটে বাবুর আম্মু, আমার কথা কি কেউ ভাবছে না? আমি বাবুর আম্মুকে আদর করব, সে বাবুকে আদর করবে, আর মাঝ থেকে বাবুর আব্বু ঠকবাজি খাবে?”
“বাবুর আব্বুরে বাবু আদর করব।”
“আর বাবুর আম্মু?”
“উমম… এইটা ভাইবা দেখতে হইব,” ঠোঁট টিপে হেসে বলল নৈঋতা।
রৌদ্রুপ নিজের বুক থেকে দুহাতে তার মুখটা টেনে তুলে বলল,
“ওকে, ভাবো।”
“এহন না তো, পরে।”
“না, এখনই বলতে হবে।”
নৈঋতা রুমের দিকে কান পেতে বলল,
“কে যেন ডাকতাছে।”
রৌদ্রুপ তার মুখটা নিজের দিকে স্থির রেখে বলল,
“আগে আমার উত্তর চাই।”
“সত্যিই কেউ ডাকতাছে। আপনে কান পাইতা হুনেন।”
রৌদ্রুপ চুপ করে কান সজাগ করল। সত্যিই কেউ দরজায় টোকা দিয়ে ডাকছে। নৈঋতাকে বসতে বলে রৌদ্রুপ গেল দরজা খুলতে। নিদ্রা এসেছে। তার হাতের ট্রেতে দুইটা পায়েসের বাটি। রৌদ্রুপের হাতে ট্রে ধরিয়ে দিয়ে সে বলল,
“ঠান্ডা না হতে বউকে খাওয়াও।”
“পায়েস কে করল?”
“মা করেছে। তোমার বউ তো কখনো বলেই না কখন কী খেতে ইচ্ছে করে। মিষ্টি খেতে পছন্দ করে বলে মা পায়েস করে দিয়েছে।”
রৌদ্রুপ উঠে আসার পর নৈঋতাও বসে থাকেনি। তার পেছন-পেছন রুমে চলে এসেছে। সে এগিয়ে এসে বলল,
“মা এখন কষ্ট করে এসব কেন করতে গেল?”
নিদ্রা বলল,
“খাওয়ার জন্য করেছে। তুমি তো মুখ ফুটে কিছুই বলবে না। তাই মা নিজেই করেছে, এখন চুপচাপ খেয়ে নাও। আর তোমাকে এই সময় শাড়ি পরিয়ে বসিয়ে রেখেছে এই বেয়া’দব, না?”
রৌদ্রুপ ভ্রুকুটি করে বলল,
“কেন? ভালো লাগছে না?”
“ওকে তো ভালো লাগছেই। কিন্তু তোমাদের মাথামোটা কর্মকাণ্ড একদমই ভালো লাগছে না।”
“কোন কর্মকাণ্ড?”
“এই যে, মেয়েটাকে দিন-রাত ঘরে আ’টকে রাখছ। একটা মানুষ কত ঘরে বসে থাকতে পারে? এখন যে বউকে সাজিয়ে গুছিয়ে বসিয়ে রেখেছ, কেন? একটু বাইরে নিয়ে যেতে পারো না? তাহলে তো ওর শরীরের সাথে মনটাও ভালো লাগবে। আমি যখন ওর মতো ছিলাম, তোমার ভাইকে কখনো দেখেছ আমাকে এভাবে ঘরে বসিয়ে রাখতে? সবসময় ঘরে আটকে থাকলে শরীর, মন আরও বেশি খারাপ হয়। এটা কি বুঝিয়ে বলতে হবে? মেয়েটাকে নিয়ে কী যে শুরু করলে তোমরা!”
রৌদ্রুপ মিইয়ে পড়া স্বরে বলল,
“ওই দু’র্ঘট’নার পর থেকে ভয় হয় ভাবি।”
নিদ্রা চ-সূচক শব্দ তুলে বলল,
“রৌদ্রুপ, দু’র্ঘ’টনা মানুষের জীবনে বলে-কয়ে আসে না। তাই বলে কি সেই ভয়ে কেউ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? তোমার ভাইয়াকেই দেখো। সে কি বসে আছে? আমি বলি তুমি ওকে নিয়ে মাঝে-মাঝে একটু বাইরে যাও। বেশি দূরে না যাও, আশপাশ থেকে ঘুরে এসো। আরও সাবধান হও ওর প্রতি। তবু তো বাইরের আলো-বাতাস গায়ে লাগবে।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখছি।”
“নৈঋতা, পায়েসটা সম্পূর্ণ শেষ করবে। মা কিন্তু কষ্ট করে বানিয়েছে। আমি যাই।”
বলেই নিদ্রা চলে গেল। রৌদ্রুপ হাতের ট্রে নিয়ে টেবিলে রাখতেই নৈঋতা একটা বাটি হাতে তুলে নিয়ে খেতে বসে পড়ল। এক চামচ মুখে নিয়ে হাসিমুখে বলল,
“পায়েসটা দারুণ বানাইছে তো মা। কিন্তু এতটা আমি খাইতে পারমু না। আপনে আমার বাটি থিকাই খান। আমারটা শেষ কইরা পারলে আবার নিজেরটা খাইবেন।”
রৌদ্রুপ তখন নিদ্রার বলে যাওয়া কথা চিন্তা করছে। সে নৈঋতার পাশে বসে হাত ধরে শুধাল,
“তোমার বাসায় বসে থাকতে খারাপ লাগে নৈঋ?”
নৈঋতা হেসে বলল,
“মাঝে-মাঝে একটু খারাপ লাগে। আপনে তো সারাদিন অফিসে থাকেন।”
“কই? তুমি তো কখনো বলনি তোমার খারাপ লাগে?”
“কইলে কী হইত? আপনে কি অফিস ফালায়া রাইখা আইতে পারতেন?”
“বলে দেখতে পারতে।”
নৈঋতা এবারেও হাসল। প্রত্যুত্তর না করে এক চামচ পায়েস রৌদ্রুপের মুখে পুরে দিলো। রৌদ্রুপ অসহায়ের মতো আরও কিছুক্ষণ ভেবে বলে উঠল,
“বাইরে যাবে নৈঋ?”
নৈঋতা আনন্দিত গলায় বলল,
“এহন নিয়া যাইবেন?”
রৌদ্রুপ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল। নৈঋতা তখনই পায়েসের বাটি রেখে বলল,
“যামু, চলেন। আইজকা কিন্তু চটপটি খাওয়াইতে হইব।”
রৌদ্রুপ মুচকি হেসে নৈঋতাকে আবার বসিয়ে দিলো। পায়েসের বাটিটা পুনরায় হাতে তুলে দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, আগে এটা শেষ করো।”

সেদিনও বাইরে ছিমছাম বৃষ্টি ছিল। নৈঋতা গুটিসুটি মে’রে ঘুমিয়ে ছিল রৌদ্রুপের বুক জুড়ে। আনুমানিক ভোর তিনটার দিকে হঠাৎ তার প্রসব বেদনা আরম্ভ হয়। হুট করে ঘুম ভেঙে এমন কিছু দেখে প্রথমে রৌদ্রুপ ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। আ’ত’ঙ্কে নৈঋতাকে আঁকড়ে ধরে চেঁচিয়ে বাড়ির সবাইকে ডেকে তোলে। সে ভোরেই নৈঋতাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্ধকার কে’টে সূর্যের আলোয় ধরণি আলোকিত হয়, তবু নৈঋতার ছটফটানি কমে না। রৌদ্রুপ চেয়েছিল নরমাল ডেলিভারি হোক। কিন্তু নৈঋতার অবস্থা তেমন সন্তোষজনক নয়। নরমাল ডেলিভারির আশায় থাকলে ভ’য়ানক কিছু হয়ে যেতেও পারে। ডক্টর বলেছে সিজারিয়ান ডেলিভারি ছাড়া গতি নেই। এ কথা শুনে রৌদ্রুপ চমকে ওঠে। নৈঋতা বরাবরই সিজারিয়ান ডেলিভারি ভয় পায়। অথচ মেয়েটার কপালে কি না এটাই লেখা ছিল! মনের শ’ঙ্কাকে গুরুত্ব দেওয়ার সময়ও নেই। নৈঋতার অবস্থা দেখে ইতোমধ্যে তার বুকের ভেতর ভূমিক’ম্প শুরু হয়েছে। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার আগে নৈঋতার হাতটা শক্ত করে ধরে সে ভরসা জোগায়। ভীতু মেয়েটা কাতরাতে-কাতরাতে বলে,
“ভয় পাবেন না। সুসময়ের জন্য এটুকু কষ্ট করতে হয়। অপেক্ষা করুন। আমি ফিরে আসব আপনার কাছে।”
অথচ মেয়েটার নিজের মুখেই ভয়। রৌদ্রুপ তাকে ভরসা জোগায়, অথচ সে নিজের কথায় নিজেই ভরসা খুঁজে পায় না। পায় কেবল ভয়। কী ব্যথা সেই ভয়ে! ডেলিভারির আগের করণীয় সম্পন্ন করার সময় কাগজে সাইন করতে গিয়ে রৌদ্রুপের হাত কাঁপে। চোখের পাতা ভিজে ওঠে। একটা সাইনও তার জন্য এত কঠিন হতে পারে, তা বোধ হয় সে ইতঃপূর্বে ভাবেনি। অথচ অফিসে বসে রোজ কত সাইন সে চোখের পলকে করে ফেলে। নৈঋতার ডেলিভারি চলাকালে বাইরে প্রতিটি মানুষ ছটফট করছিল। তার বাবা-মাকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারাও রওয়ানা হয়েছেন। তারা পৌঁছানোর আগেই হয়তো ডেলিভারি সম্পন্ন হয়ে যাবে। রৌদ্রুপের ইচ্ছে করছিল নৈঋতার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। তাকে কাছে পেলে মেয়েটা ভরসা পেত। সব ভয়কে জয় করত নির্দ্বিধায়। কিন্তু উপায় নেই। এ নিয়মটাই যে নেই আমাদের দেশে। কেন নেই এটা ভেবেও রৌদ্রুপের আফসোস হয়। বুক ভরা কষ্ট নিয়ে সে অনবরত দোআ জপতে থাকে। একটু পরপর সবাই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। ওসব তার কানেও ঢুকছে না। তার কানে বাজছে কেবল বন্ধ দরজার ভেতরে নৈঋতার ছটফটানি। মেয়েটা না ফিরতে যে সে নিজেও শান্ত হতে পারবে না। টানা দেড় ঘন্টা সবাইকে আ’ত’ঙ্কে রেখে নৈঋতার ডেলিভারি সম্পন্ন হলো। তোয়ালে মোড়ানো ছোট্ট একটা দেহ আগে তুলে দেওয়া হলো রৌদ্রুপের কোলেই। রৌদ্রুপ অবাক হয়ে সেই ছোট্ট মুখটায় তাকিয়ে রইল। এই ফুটফুটে শান্ত বাচ্চাটা নৈঋতার অংশ। নৈঋতাকে দেখলে যেমন প্রশান্তি আসে, তেমনি প্রশান্তি এই বাচ্চাটার মুখে। এতগুলো দিন ধরে এই ছোট্ট মানুষটির জন্য তাদের কতশত অপেক্ষা ছিল! কত স্বপ্ন ছিল! ছিল ভয় আর কৌতূহল। আচ্ছা? নৈঋতা যখন বাচ্চাটাকে কোলে নিবে, তখন তার মুখের অভিব্যক্তি কেমন হবে? এই ছোট্ট প্রাণটার জন্য মেয়েটা কতই না কষ্ট করেছে। বাচ্চাটাকে ছুঁয়ে রৌদ্রুপের ভয় কমলেও বুকের ভেতরের ছটফটানি কমেনি। তা অনুভব করতেই সে নৈঋতাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। কিন্তু ডক্টর জানিয়েছে এখনই নৈঋতার সাথে দেখা করা যাবে না। কেবিনে শিফট করা অবধি অপেক্ষা করতে হবে। রৌদ্রুপ অপেক্ষা করল। মেয়েটা তার কাছে ফিরে আসবে এ-ই অনেক। সেই মুহূর্তের জন্য সে আজন্ম অপেক্ষা করতে রাজি।

তারপর কে’টে গেছে ঊনিশটি বছর। এই লম্বা সময়ে অনেক কিছুই ঘটেছে, পরিবর্তন হয়েছে। শাহানা খানম গত হয়েছেন দুবছর আগেই। নসিব বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। সে এখন স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকে। মাঝে-মাঝে গ্রামেও যায় বাবা-মায়ের কাছে। সে এখনো কাজ করে তিহানের সাথেই। তুলির সদ্য বিয়ে হয়েছে। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে পড়ার পর থেকে নিদ্রার আর বিশ্রাম নেওয়ার জো নেই। বয়সও বাড়ছে। চকচকে মুখে বয়স বৃদ্ধির ছাপ পড়েছে। তবু নিজের সংসারটা গুছিয়ে রাখা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তার ওপর এ পরিবারের মানুষ একেকজন বিচিত্র। দিন-রাত কত যে চেঁচাতে হয় তাকে! তুলিটার বিয়ের আগে এমনটা বেশি হত। সে ছিল বাড়িতে সবচেয়ে অগোছালো সদস্য। সে চলে যাওয়ার পর থেকে নিদ্রার চেঁচামেচিও কমে গেছে। আজ তুলি তার স্বামীকে নিয়ে বাড়ি আসবে। তার পৌঁছাতে হয়তো রাত হবে। নিদ্রার রান্নাবান্নার ধুম পড়ে রয়েছে সারাদিন ধরে। বেছে-বেছে তুলির পছন্দের খাবার তৈরি করছে সে। এরমধ্যে যখন পিঠা বানাতে গিয়ে দেখল চিনি শেষ হয়ে গেছে, তখন ভীষণ বিরক্ত হলো। রৌদ্রুপকে ডেকে বলল চিনি কিনে আনতে। সঙ্গে-সঙ্গে রৌদ্রুপ শার্ট গায়ে চাপিয়ে নিচে নেমে এল। ড্রয়িংরুম পার হতে গিয়ে ডাইনিংয়ে চোখ পড়তেই তার পা থামল। মিষ্টি মেয়েটা আজও তার বাকি পড়া খাবার দিব্যি খাচ্ছে। পা ঘুরিয়ে রৌদ্রুপ এগিয়ে গিয়ে তার পেছনে দাঁড়াল। মাথায় এক হাত রেখে বলল,
“আজও আমার খাবার খাওয়া হচ্ছে?”
সে মিষ্টি হেসে বলল,
“রাখো কেন তুমি? রোজ-রোজ খাবার নষ্ট করা ভালো বুঝি?”
“আমার তো অভ্যাস।”
“আমারো অভ্যাস।”
রৌদ্রুপ মুচকি হেসে বলল,
“আমি বাইরে যাচ্ছি।”
“আচ্ছা, তাড়াতাড়ি ফিরবে।”
রৌদ্রুপ চলে যেতেই সে দ্রুত খাওয়ার পর্ব সেরে রুমে ছুট লাগাল। আলমারি খুলে বের করল উনিশ বছর আগের পুরোনো শাড়ি। এখনও একদম নতুন দেখতে। যতটা সম্ভব তাড়াহুড়ো করেই সে শাড়ি পরল। শাড়ি পরা খুব বেশি গোছানো না হলেও, একেবারে খারাপও হয়নি। তারপর সামান্য সাজগোজ করল। ইতোমধ্যে কলিংবেলের আওয়াজ তার কানে এসেছে। এরপর তার তাড়াহুড়ো বাড়ল। শাড়ির কুচি মুঠোয় ধরে সাবধানে নিচে নেমে এল। নিদ্রার সামনে পড়তেই নিদ্রা সূক্ষ্ম চোখে পরখ করে মুচকি হাসল। থুতনি ধরে বলল,
“মিষ্টি লাগছে। বরটা মাথা ঘুরে না পড়লেই হলো।”
লাজুক হেসে সে পাশের রুমে ঢুকে পড়ল। গিটারের শিক্ষক বসে গিটার নাড়াচাড়া করছেন। সে আসতেই চোখ তুলে মৃদু হাসল। ইশারায় পাশে বসার নির্দেশ দিয়ে বলল,
“দ্রুত শুরু করো। আমার তাড়া আছে।”
সে ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
“আসতে না আসতেই এত তাড়া কিসের?”
“কাজ আছে। বসে-বসে সুন্দরী বালিকা দেখলে তো আর উপার্জন হবে না।”
“সুন্দরী বালিকার দিকে আপনি ভালো করে তাকিয়েছেন? আবার বলছেন দেখলে উপার্জন হবে না! যান আপনি আপনার কাজে। এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট করতে হবে না।”
গাল ফুলিয়ে উঠে যাওয়া ধরতেই তাইরান গম্ভীর গলায় ডাকল,
“তিয়ানা। আমার কিন্তু সত্যিই কাজ আছে। তাড়াতাড়ি শুরু করো।”
তিয়ানা ধপ করে আবার পূর্বের জায়গায় বসে পড়ল। থমথমে মুখে গিটারটা কোলে টেনে নিল। গিটারে ঝংকার তোলার সাথে-সাথে গিটারের সঙ্গে তার হাতের চুড়িও বাড়ি খেল। মুহুর্তেই সে গিটার থামিয়ে হাতের চুড়ি খুলে ছুড়ে ফেলে দিলো। এরপরও সে থামল না। গলার হার খুলেও একইভাবে ছুড়ে ফেলল। তারপর আবার চুলের বিনুনি খোলা ধরতেই তাইরান খপ করে তার হাত দুটো মুঠোবন্দী করল। শান্ত স্বরে শুধাল,
“কী হচ্ছে এসব?”
তিয়ানা উত্তর না দিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। তার ফোলানো মুখের দিকে তাকিয়ে তাইরান হেসে ফেলল। হাত ছেড়ে দিয়ে তার মুখটা দুহাতের মাঝে নিয়ে বলল,
“এই মেয়ে, মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে আবার? এত সুন্দর করে সাজগোজ করে এখন নষ্ট করার কী হলো? যার জন্য এই সাজ, তার মন্তব্য চাই না?”
তিয়ানা তেতে উঠে বলল,
“চাই না আমার কারোর মন্তব্য। আমি কারোর জন্য সাজিওনি। ইচ্ছে করেছে সেজেছি, এখন ইচ্ছে চলে গেছে তাই নষ্ট করেছি।”
“আচ্ছা, খুবই ভালো করেছ। এমনিতেও আমার দেখা হয়ে গেছে। এখন আর সাজ রাখার দরকার নেই। যদি অন্য কারোর মাথা খারাপ হয়, তাহলে তো আমার মাথায় বাঁশ পড়বে।”
“চাপাবাজি করতে হবে না। কে কত দেখেছে তা আমি ভালো করেই জানি। আমাকে দেখার দরকার নেই। দেখার জন্য চারপাশে কত মেয়ে আছে।”
তিয়ানা গাল থেকে হাত সরাতে চাইলে তাইরান তার মুখটা আরও শক্ত করে ধরল। নরম গলায় বলল,
“তিয়া, আমার সত্যিই কাজ আছে। বাবা আজ তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে।”
“তো এসেই উপার্জনের কথা বললেন কেন? আমি আপনার উপার্জনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছি?”
“আমি তো দুষ্টুমি করে বলেছি।”
“বলবেন কেন? আমি এত কষ্ট করে সেজেছি, আপনি আগে ভালো করে আমাকে দেখবেন, মন্তব্য করবেন। তা না, আপনি এসেই তাড়া দেখালেন।”
তাইরান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“হায়রে আমার পা’গলি রাগিনী! আচ্ছা, আমার ভুল হয়েছে। এবারের মতো কি ক্ষমা পাওয়া যাবে?”
তিয়ানা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“ভেবে দেখব।”
তাইরান তার ফোলা গাল টিপে দিয়ে বলল,
“তাহলে এবার শুরু করো। প্রাকটিস করতে-করতে ভাবো। এরপর আবার আমি চলে যাওয়ার পর যেন আবার গাল ফুলিয়ে থেকো না।”
তিয়ানা মুখ বাঁকাল। তাইরান তার হাত টেনে ভালোভাবে গিটার ধরিয়ে দিলো। তিয়ানা মুখ ফুলিয়ে রেখেই তাইরানের নির্দেশ পালন করল।
রৌদ্রুপ বাড়িতে ঢুকতেই গিটারের টুংটাং শব্দ শুনতে পেল। নিদ্রার হাতে চিনির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে শুধাল,
“তাইরান‌ এসেছে?”
“হ্যাঁ।”
রৌদ্রুপ রুমের দিকে এগিয়ে গেল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখল তিয়ানার পরনে তারই পছন্দের কেনা সেই শাড়ি। খুব মানিয়েছে মেয়েটাকে। সে গিটারে আঙুল চালাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার মুখ প্যাঁচার মতো করে রেখেছে। পাশে বসে তাইরান ঠোঁট টিপে হাসছে আর তাকে নির্দেশনা দিচ্ছে। তিয়ানা নির্দেশনা পালন করলেও তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। রৌদ্রুপ মৃদু হাসল। মেয়েটা হয়েছে তার মায়ের মতোই। মুখের গড়ন পেয়েছে নৈঋতার। তবে তার স্বভাব অনেকটা রৌদ্রুপের মতোই। মায়ের চেহারা বাদে গুণ কেবল সে একটাই পেয়েছে। কথায়-কথায় অভিমান করা। তবে নৈঋতার অভিমান ভাঙা সহজ ছিল, মেয়ে তার বিপরীত। একবার গাল ফুলালে তাকে বাগে আনা দায়। এই অভিমানিনীর দায় মাথা পেতে নিয়েছে তাইরান ছেলেটা। পুরো নাম তাইরান তায়েফ। সদ্য পড়াশোনার ইতি টেনেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছেলেটা গান-বাজনায় বেশ পটু। তবে সে এটা পেশা হিসেবে বেছে নেয়নি। তিয়ানার মাথায় গিটার শেখার জেদ চেপেছে তাইরানের থেকেই। তাইরান নিদ্রার ভাতিজা। সেই সুবাদেই ছোটোবেলা থেকে তাদের পরিচয়। ছোটোবেলায় খুব একটা মেলামেশা না থাকলেও বড়ো হওয়ার সাথে-সাথে তিয়ানা তাইরানের চোখে ধরা পড়ে। এই ছেলেটাকে প্রথমদিকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে তিয়ানার মনে হয় ছেলেটা আসলেই চমৎকার। বলা চলে এরপর থেকেই শুরু হয় তাদের সাদামাটা প্রেম কাহিনী। তবে সম্পর্কের শুরু থেকেই নিজেদের পরিবার থেকে তা গোপন করেনি দুজনের কেউই। যার কারণে উভয় পরিবারেরই এতে সমর্থন ছিল। ইদানিং তাদের বিয়ের ব্যাপারেও কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তারা। রৌদ্রুপ অবশ্য বিয়ের বিষয়ে এখনো মুখ খোলেনি। মেয়ের বাবা যখন হয়েছে, অন্য পরিবারের হাতে তুলে দিতেই হবে; তা সে বোঝে। কিন্তু কষ্টটা যে একাকীত্বের ভয়ে। উনিশটা বছর ধরে নৈঋতার দিয়ে যাওয়া সম্বল তার তিয়ানা। তিয়ানার জন্মের এক ঘন্টার মাথায় যেদিন নৈঋতা তাকে চিরতরে বিদায় জানায়, সে দিনটি ছিল রৌদ্রুপের জীবনের সবচেয়ে ভ’য়ঙ্ক’র কালো দিন। খবরটা পাওয়ার পর সে টানা দুই ঘন্টা জ্ঞানহীন পড়ে ছিল। কীভাবে কীভাবে তার প্রাণভোমরার ক’বরে সে দুমুঠো মাটি দিয়েছিল, তা-ও ছিল তার কাছে অস্পষ্ট। নৈঋতার মৃ’ত্যুর এক সপ্তাহ পরও রৌদ্রুপ এই নি’র্ম’ম সত্যিটা মেনে নিতে পারছিল না। অবস্থা এমন ছিল যে, তাকে নিয়েই সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কেউ-কেউ তো ধারণা করে নিয়েছিল এই ছেলে বউয়ের শোকে পা’গল বনে গেছে। তার সুস্থতার একমাত্র কারণ ছিল তখন তিয়ানা। তিয়ানাকে বুকে পেলেই সে শান্ত থাকত। এরপর ধীরে-ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে তার জীবন-যাপনের একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তিয়ানা। মেয়েকে বুকে আগলেই সে এতটা বছর পার করে এসেছে। তবু বুকের ভেতরের ক্ষ’তটা যে আজও সেই উনিশ বছর আগের দিনটির মতোই রয়ে গেছে। সেই প্রেমিক পুরুষ রৌদ্রুপ সাহরীফ আজ শান্তশিষ্ট এক দায়িত্ববান পিতা হলেও, স্ত্রীর ভালোবাসার জন্য ভেতরের ছটফটানি কেবল সে-ই টের পায়। যে মেয়ে ছিল তার দিনের শুরু, রাতের শেষ। কে জানত এই মেয়েটাকে ছাড়াই সে এতগুলো বছর কা’টিয়ে দিতে পারবে? বাস্তবতা তাকে বাধ্য করেছে বেঁচে থাকতে। ফ্রেমে বাঁধানো নিজের সাথে নৈঋতার হাসিমাখা ছবিটার দিকে রৌদ্রুপ দিন-রাত তৃষ্ণার্তের মতো চেয়ে থাকে। মনে হয়, ইশ্! আর একবার যদি তাকে বুকে জাপটে ধরা যেত। হাহাকারে পুড়ে চশমার ফাঁকে রৌদ্রুপ চোখ মোছে। অসহায়ের মতো আওড়ায়,
“নৈঋ, মেঘবতী নাম দিয়েছিলাম বলেই কি এভাবে ফাঁকি দিলে? মেঘের মতো এসে, মেঘের মতোই হারিয়ে গেলে? তুমি না বলেছিলে তুমি আমার জীবনের স্থায়ী সূর্য হবে? তার কী হলো? সেই তো অস্থায়ী মেঘের মতোই হারিয়ে গেলে। বিশ্বাস করো, এমনটা হবে জানলে আমি কোনোদিনই তোমায় মেঘবতী নাম দিতাম না, সূর্য নামটাই দিতাম। তুমি আমায় অমবস্যা দিতে চাওনি। অথচ আজকাল রোজ আমি অমবস্যার আঁধার হাতড়ে তোমায় খুঁজে বেড়াই। তবু তোমায় পাই না। সারাটাক্ষণ আমি তোমায় বড্ড মিস করি নৈঋ। খুব ইচ্ছে করে তোমার কাছে যেতে। কিন্তু তুমি যে আমায় বিশাল এক দায়িত্ব দিয়ে গেছ। তোমার মেয়েকে আমি সবটা ভালোবাসা দিয়েই বড়ো করেছি। তুমি তো এটাই চেয়েছিলে। আচ্ছা, আমাকে ছাড়া আমার পা’গলি বউটা কেমন আছে? একটা সময় আমাদের একজন ছাড়া আরেকজনের চলত না। অথচ উনিশটা বছর আমরা একে অপরকে ছাড়াই কা’টিয়ে দিলাম। কী আশ্চর্য জীবন! জানো নৈঋ? এই টানাহেঁচড়ার জীবনটা আমার আর সহ্য হয় না। তোমায় আরেকটা বার ভালোবাসতে বড়ো ইচ্ছে করে। ওপারে আমি তোমায় পাব তো নৈঋ?”
নিচ থেকে তখন তাইরান আর তিয়ানার সমস্বরে গান ভেসে আসছে,

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে?
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে?
তোমারে দেখিতে দেয় না।

আহ্! রৌদ্রুপের মতো প্রেমিকদের এই স্বার্থপর পৃথিবীর বুকে ফেলে যাওয়া নৈঋতারা যদি শুনতে পেত তাদের হাহাকার! আকাশের মতো হৃদয়টায় প্রেম নামক অস্থায়ী মেঘেরা হানা দেয় বুঝি একটা প্রেমিককে এভাবে লন্ডভন্ড করে রেখে যাওয়ার জন্যই? অথচ এই সুন্দর মেঘেদের আগমনে তাদের বোঝার সাধ্য থাকে না এদের স্থায়ীত্ব ক্ষণকালের। চিরকালের জন্য তাদের ভালোবাসা নামক ব্যা’ধিতে আ’ক্রা’ন্ত করে এরা বাষ্পের মতোই আলগোছে বিলীন হয়ে যায়।

~সমাপ্ত~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে