কান্তা মনি পর্ব-১৩

0
893

#কান্তা_মনি
#পর্ব_১৩
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

ছোট একখানা চৌকি পেতে বসে আছে কান্তা মনি। তার বরাবরই মেঝেতে বসে আছে এক পয়তাল্লিশ কি ছেচল্লিশ বছর একজন মহিলা। উসকোখুশকো চুলগুলো যেন কত বছর কাঁকুইয়ের ছোঁয়া পায়না। গায়ে ময়লাযুক্ত বহু তালিযুক্ত কাপড়। স্বচ্ছল চোখ জোড়ায় মায়া স্পষ্ট। কিন্তু মানুষটার মুখ দেখে যেন বোঝাই যায়না মাথায় গন্ডগোল আছে।

-কেমন আছেন আপনি চাচীজান? (কান্তা মনি)
মহিলাটি ফ্যালফ্যাল করে কান্তা মনির দিকে তাকিয়ে আছে।
-চাচীজান? (কান্তা মনি)
-কেডা তুই? এইখানে কেন আসছিস? আমারে মারবি তুই তাইনা? (মুঞ্জিলা)
-না না আমি কেন আপনাকে মারব? আমি নিয়াজ মানে আপনার জা বেগম নূর জাহানের পুত্রের বেগম। আমাকে দেখে ভয় পাবেন না। তাকান আমার দিকে চাচীজান। (ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠল কান্তা মনি)
– না না তুই মিথ্যা বলতেছিস। আমি জানি তুই আমারে মারবি। ওরা যেভাবে আমাকে মারত তুইও সেইভাবে আমাকে মারবি। চলে যা বলতেছি। চলে যা। চলে যা। (উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে)
মুঞ্জিলাকে তেড়ে আসতে দেখেই কান্তা মনি আতকে ওঠে। দ্বারের খিল নিয়ে কান্তা মনিকে আঘাত করতে নিতেই মুঞ্জিলার বড় ভাইয়ের বেগম রশিদা কান্তা মনির হাত টেনে নিয়ে কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এসে কক্ষের দ্বার বন্ধ করে দেন। কক্ষের ভেতর থেকে আসা ভাঙ্গা-চূড়ার আওয়াজে ক্ষানিক বাদে বাদে কেঁপে উঠতে থাকে কান্তা মনি।

-আচ্ছা আপনি বলতে পারবেন কে বা কারা চাচীজানকে মারতো যে সে এভাবে আতংকিত হয়ে থাকে? (কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠে কান্তা মনি)
কান্তা মনির এহেন প্রশ্নে চোখ-মুখ চুপসে যায় রশিদার।

-কি হলো বলুন? (কান্তা মনি)
-মুঞ্জিলার স্বামী মানে জমিদারের ভাই সুলতান মির্জা। সুলতান মির্জা আমার এই বোনটারে রাত-দিন শুধু অত্যাচার করত। মারতে মাততে সারা শরীরে কালশীটে দাগ বসিয়ে ফেলেছিল।সে দাগ এখনো যায়নি। এমনকি ওই আহসান ও তাই ওর গায়ে হাত তুলতো। গর্ভের সন্তান তাই নিজের মাইয়ের গায়ের হাত তুলতো। মাথায় গন্ডগোল কি সাধে হয়েছে? এত অত্যাচার সহ্য কে সহ্য করতে পারে? ঘুমের মানুষকে টেনে তুলে মারধর করত। গরম লোহা দিয়ে হাত-পা পুড়িয়ে দিত। কখনো মুখ দিয়ে টু শব্দটি করত না। স্বামী ভক্ত ছিল খুব। যখন মারত কেউ টের ও পেতোনা। দিনের পর দিন এত অত্যাচারে সুস্থ মানুষটা পাগল হয়ে গেছে। সবাইকে বলা হয় যে জ্বীনের আচড় পড়েছিল নাকি মুঞ্জিলার ওপর,তাই পাগল হয়ে গেছে। শেষে আর ওই জমিদার বাড়িতে মুঞ্জিলার ঠাই হলো না। নিজের মেয়েটাও তাই মায়ের কোনো খোজ নেয় না। মেঝ ছেলেটা মাঝে মাঝে এসে খোজ নিয়ে যেত। আজ দশটা বছর আমি আর মুঞ্জিলার বড় ভাইজান দুজনে ওর দেখাশোনা করি। জমিদারের বেগম নূর জাহান মানুষটা ভালো। প্রায়ই এসে মুঞ্জিলার সাথে দেখা করে যায়। ভালো-মন্দ রান্না করলে এসে খাইয়ে দিয়ে যায়। (রশিদা)

এমন নিষ্ঠুরতার বর্ণনা কান্তা মনির কর্ণগোচর হতেই চোখ ছলছল করে ওঠে তার।
-কেন এত অত্যাচার হতো তার সাথে? (কান্তা মনি)
-মা আমার দ্বারা আর কিছু বলা সম্ভব না। তোমাকে দেখে আমার বেশ ভরসা যোগ্য মনে হলো তাই বললাম। তুমি বেশ সাহসী তুমি নিজেই এর উত্তর খুজে নিতে পারবে আমি জানি। কিন্তু মা তুমি সাবধান থেকো। কিছু মানুষ আছে খুব জঘন্য তারা। আমি তাদের নাম উচ্চারণ করতে চাই। কেউ যদি জানে যে তোমাকে আমি কিছু বলেছি তো আমাকে আর মুঞ্জিলার ভাইজানকে একদম জানে মেরে ফেলবে। (রশিদা)
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায় কান্তা মনির।
-আচ্ছা আমি কিছুই আর জিজ্ঞাসা করব না আপনার কাছে। (কান্তা মনি)
-একটা কথা। গ্রামে যে প্রজাদের ঘরে ঘরে লুটপাট হয়েছে কয়েকদিন তাতে কার কার হাত রয়েছে জানো? (রশিদা)
-হ্যা আমি জানি। (কান্তা মনি)
-শেষ দিন লুটপাট করে ভেগে যাওয়ার সময় আমার স্বামী মানে তোমার মুঞ্জিলা চাচীর ভাইজানের সামনে পড়ে যায় ওরা। উনি ওদের চিনে যাওয়ার পর উনার গলায় তরোয়াল ঠেকিয়ে হুমকি দেয়, সে যদি এই কথা কাউকে বলে দেয় তো তাকে মেরে ফেলবে। ওরা মানুষ না মা। ওদের মনে বিন্দু মাত্র মায়া-দয়া নেই। তুমি সাবধানে থেকো। (রশিদা)
-আমি সব জানি মামিজান। আমি উনাকে (নিয়াজ মির্জা) বলার সুযোগ খুজে পাচ্ছিনা। উনাকে খুব দ্রুত এসব জানাতে হবে। (কান্তা মনি)

-বেগম সাহেবা? এখন বের হতে হবে নাহলে দেরি হয়ে যাবে ফিরতে। (দাসী তানিয়া)
ফেরার কথা মনে পড়তেই কান্তা মনির বুকের ভেতর ধুকপুক করে ওঠে।
-মামিজান? চাচীজানের কাপড়গুলো পালটে দিয়ে মাথার চুলগুলো কাঁকুই দিয়ে আছড়িয়ে দিন। (কান্তা মনি)
-কি বলব মা বল কাছে গেলে কেমন চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেয়। কখনো কখনো মারাত্মকভাবে আঘাত করে বসে। (রশিদা)
-আচ্ছা আমি চেষ্টা করে দেখছি। আপনি চাচীজানের কাপড়-চোপড় নিয়ে আসুন। (কান্তা মনি)

গ্রামের আকা-আকা মেঠোপথ ধরে এগিয়ে চলেছে কান্তা মনি। হিমশীতল বায়ুতে বারংবার কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। গায়ের মোটা শালটিকে আর একটু জাপটে ধরে সামনে এগিয়ে চলল দাসীকে নিয়ে।

সরদার বাড়ির পাশ ঘেষে যেতে নিতেই চোখ আটকে যায় কান্তা মনির। দাসীকে ইশারা করে নিয়ে একটা গাছের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সরদার বাড়ির সিংহদ্বারের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। শাহ সুলতান মির্জা কালো মোটা শাল দিয়ে আপদমস্তক ঢেকে চুপিসাড়ে সরদার বাড়ির সিংহদ্বার হতে বের হয়েই দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করে। কান্তা মনির মাথায় নানারকম প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করে। শাহ সুলতান মির্জা হঠাত এই সরদার বাড়িতে? তাও এত ভোরে?

-আচ্ছা ফুফুজান মুঞ্জিলা চাচীজানকে এই বাড়িতে নিয়ে আসলে কেমন হয়? আমিই না হয় দেখাশোনা করব তার। (কান্তা মনি)
কান্তা মনির মাথায় তেল দিয়ে দিতে দিতে হঠাত কান্তা মনির মুখে এমন কথা শুনে খুশখুশ করে কাশতে শুরু করেন মেহেরুন্নেছা।
-মুঞ্জিলা ভাবিজানের তো মাথায় গন্ডগোল কান্তা মনি। তুমি তো তাকে এখানে এনে সামলাতে পারবেনা। তাকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল শুধুমাত্র তাকে কেউ সামতে পারত না বলে। (মেহেরুন্নেছা)
-আমি না আজ গিয়েছিলাম ভোরে চাচীজানের সাথে দেখা করতে। মানুষটাকে না অনেক কোমল কোমল মনে হয়। আমার খুব মায়া হয় তার জন্য। (কান্তা মনি)
ভ্রু কুচকে আসে মেহেরুন্নেছার।
-কারো অনুমতি নিয়েছিলে? একা একা ওখানে গিয়েছো নিয়াজের কানে গেলে কিন্তু অনেক ক্ষেপে যাবে কান্তা মনি। (মেহেরুন্নেছা)
একটা শুকনো ঢোক গেলে কান্তা মনি।
-আপনি কিছু বলবেন না উনাকে। দোহায় লাগে ফুফুমনি। (মনতির সুরে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-আচ্ছা বলব না। কিন্তু হ্যা আর কখনো ওখানে কেন কোথাও কাউকে না জানিয়ে যেয়োনা ঠিক আছে? (মেহেরুন্নেছা)
-আচ্ছা ফুফুমনি।
কান্তা মনি কিছু একটা বলতে গিয়ে মাঝে পথে থেমে যায় হেতিজার ডাকে।

পালঙ্কের ওপর বসে কিছু কাগজ-পত্র নেড়ে চেড়ে দেখছে নিয়াজ শাহ। পানপাত্রটা পাশের চৌপায়ার ওপর রেখে নিয়াজের পাশে বসে পড়ে কান্তা মনি।

-এই যে শুনছেন? (কান্তা মনি)
-হুম। (কাগজ-পত্রের দিকেই চোখ স্থির রেখে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
-একটা কথা বলার ছিল আপনাকে। (কান্তা মনি)
কাগজ-পত্রগুলো একপাশে রেখে কান্তা মনির আরও পাশ ঘেষে বসে কান্তা মনির মুখ পানে তাকায় নিয়াজ মির্জা।
-হুম বলুন আমার বেগম? (নিয়াজ মির্জা)

-আসলে…
কথার মাঝখানেই দ্বারে ঠকঠক আওয়াজ হতেই কান্তা মনি উঠে দাঁড়ায়।
-কে? (গম্ভির কন্ঠে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
-সাব, নওশাদ সাব আসছেন। (রক্ষী)
দ্বার খুলে দিতেই নওশাদ হুড়মুড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করে হন্তদন্ত হয়ে বলে ওঠে,
-ভাইজান মামাজান হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাড়াতাড়ি আসো।
জমিদারের অসুস্থতার কথা শুনে বুকের মাঝে হঠাত ছ্যাত করে ওঠে কান্তা মনি। তার আব্বাজানের মৃত্যুতে সে যে শোক বয়ে বেড়াচ্ছে এই আরেক আব্বাজানের কিছু হলেও তো সে নিজেকে সামলাতে পারবেনা।
-কবিরাজকে খবর পাঠিয়েছিস? (হন্তদন্ত কন্ঠে)
-হ্যা ভাইজান খবর পাঠানো হয়েছে। তাড়াতাড়ি আসো। (নওশাদ)

হঠাত জমিদারের অসুস্থ হয়ে পড়ায় জমিদার বাড়িতে দুশ্চিন্তার ছায়া নেমে এসেছে। বাচা-মরার দ্বারপ্রান্তে এসে জমিদার সকলকে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন খুব শিঘ্রয়ই নিয়াজকে জমিদাররের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া তারও বেশ বয়স হয়েছে।

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জার শরীরের অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। জমিদার বাড়িতে যে খুশির বন্যা বয়ে চলেছে। আজ শাহ নিয়াজ মির্জার হাতে জমিদারির দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। জমিদার বাড়িতে অতিথিতে গিজগিজ করছে। বাইরে প্রজা সাধারণের জন্য বিশাল ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হেতিজাকে আজ দেখতে এসেছে শাহতাজ ও তার পরিবার। এ যেন আজকের দিনে আর এক আনন্দের নতুন মাত্রা যোগ করে দিয়েছে।

সকাল হতেই নিয়াজ পুরো গ্রামে সবার মাঝে মিষ্টি বিলিয়েছে নিজ হাতে। কান্তা মনি তার প্রাণ প্রিয় স্বামীর চোখে এমন আনন্দ দেখে যেন নিজেও আনন্দে ফেটে পড়ছে। তার মধ্যে যে ধীরে ধীরে আরও একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে। আজ জমিদার বাড়িতে যেন একে একে খুশিরা এসে হানা দিচ্ছে।

রান্নাবান্না কতদূর হয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য সেদিকে যেতেই একটা কক্ষের সামনে এসে চলার গতি থেমে যায় নূর জাহানের। দ্বারের পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকে নূর জাহান। বিস্ফোরিত নয়ন স্থির হয়ে আছে । কক্ষের ভেতর থেকে আসা কথোপকথনের ধ্বনি কানে এসে বাজতেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নূর জাহানের।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে